ব্যাকরণ বলতে কী বোঝেন? বাংলা ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বাংলা ব্যাকরণের মুখ্য আলোচ্য বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ কর

ব্যাকরণ : সাধারণ পরিচয়
ভাষা মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের অন্যতম উপায়। ভাষার সাহায্যে যোগাযোগ স্থাপন করার ক্ষেত্রে কথকের যেমন প্রয়োজন হয় তেমনি প্রয়োজন হয় শ্রোতার । এক্ষেত্রে কথককে যেমন বোঝাতে হবে তাঁর
কী বক্তব্য, একইভাবে শ্রোতাকেও বুঝতে হবে কথক কী বলছেন। কেননা, এর সূত্র ধরেই উত্তর-প্রত্যুত্তরের ধারাবাহিকতা
চলবে এবং এক ধরনের যোগাযোগ তথা সংজ্ঞাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ভাষার ব্যবহারের কথা বিবেচনায় রেখে বলা যায়
যে, বিভিন্নভাবে যোগাযোগ প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন হতে পারে। তবে, সকল ক্ষেত্রেই ভাষার কিছু সাধারণ নিয়ম ভাষীদের জানা
থাকতে হবে এবং সে-সব নিয়ম কথক এবং শ্রোতা দুজনকেই মেনে চলতে হবে। প্রতিটি মানব ভাষাতেই কমবেশি এরকম
নিয়ম রয়েছে। এই নিয়মের সমষ্টিই হলো ব্যাকরণ। মুখের ভাষা কিংবা লেখার ভাষা যা-ই হোক না কেন ব্যাকরণ
মেনেই তা ব্যবহার করতে হয়। আর এর ব্যতিক্রম ঘটলে ভাষা বোধগম্যতা হারায়। তাই ভাষার যে কাজ তা ঠিকমতো
করতে গেলে ব্যাকরণ সম্পর্কিত জ্ঞান আয়ত্ত করা ও তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
শিশু যখন ভাষা আয়ত্ত করতে শুরু করে তখনই সে পরোক্ষভাবে ব্যাকরণিক বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। যেমন:
একজন বাঙালি শিশু, যে সবেমাত্র দুই শব্দের বাক্য বলতে শিখছে, সে হয়ত বলল, “আমি খাবে”। সঙ্গে সঙ্গে যে তাকে
দেখাশোনা করছে সে বুঝিয়ে দেবে, বাক্যটি ‘আমি খাব’ হবে। অর্থাৎ, শিশুটি পরোক্ষভাবে বাংলা ব্যাকরণের ব্যক্তিবাচক
ক্রিয়া প্রয়োগ সম্পর্কে কিছুটা শিখে নিল। এভাবে, শিশুর ভাষা আয়ত্তীকরণ (ধপয়ঁরংরঃরড়হ) প্রক্রিয়াতে ব্যাকরণ বিশেষ
গুরুত্ব পায়। তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাকরণ শেখার কাজটি শুরু হয় শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সূত্র ধরে। আর এই ব্যাকরণ
যতটা না মুখের ভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার চেয়ে অনেক বেশি লেখার ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্তমান গ্রন্থেও লেখার ভাষার
ব্যাকরণ নিয়েই আলোকপাত করা হবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভাষায় কৃত্রিমতার হার যত বাড়ে তার ব্যবহারে
ব্যাকরণগত অসংগতি ও ত্রæটির হারও তত বাড়ে। একজন ভাষী যখন তার মায়ের ভাষা (যা প্রায়শই নির্দিষ্ট একটি ভাষার
অপ্রমিত কোনো নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপ) ব্যবহার করে তখন সে সবচেয়ে সাবলীলভাবে ব্যাকরণ অনুসরণ করে থাকে। ওই
ব্যক্তি যখন প্রমিত ভাষায় (যা তার নিজস্ব আঞ্চলিক রূপ থেকে ভিন্ন ও তথাকথিত পরিশীলিত মান রূপ) কথা বলে তখন
তার বেশ কিছু নতুন ব্যাকরণিক সূত্র শিখে নিয়ে সেগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে হয়। আর যখন সে লেখ্যভাষা ব্যবহার করে
তখন তাকে আরও বেশি ব্যাকরণিক নিয়ম শিখতে হয়।
ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থ: ব্যাকরণ হলো ভাষা ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত বিধির সমষ্টি যা ভাষার ধ্বনি ব্যবস্থা, শব্দ তথা রূপের
গঠন, বাক্যিক বিন্যাস এবং বাগর্থকে বর্ণনা করে। ব্যাকরণকে অনুশাসনমূলক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার রীতি দীর্ঘদিন
ধরে প্রচলিত থাকলেও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাকরণ মূলত বর্ণনামূলক। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট ভাষার ক্ষেত্রে
প্রযোজ্য কোনো বিধি কেন প্রাসঙ্গিক তার বর্ণনামূলক ব্যাখ্যা প্রদান করাই ওই ভাষার ব্যাকরণের লক্ষ্য। সুতরাং, বাংলা
ভাষার ব্যাকরণের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো : এই ভাষার ধ্বনিব্যবস্থা কীরূপ তা বর্ণনা করা, বাংলা ভাষার রূপতাত্তি¡ক
বৈশিষ্ট্যসমূহ শনাক্ত করা, বাংলা বাক্য বিন্যাসের কৌশল ও প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা এবং সর্বোপরি ধ্বনি রূপ ও বাক্যের বাগর্থ-
সংগতি নির্ধারণ করা।
সুতরাং বলা চলে যে, ব্যাকরণের মূল কাজ হলো ভাষার সংগঠন বিশ্লেষণ। ব্যাকরণ শব্দটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করলেও এই
উদ্দেশ্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা, ‘ব্যাকরণ’ শব্দটির মূল অর্থ হলো ‘বিশেষভাবে বিশ্লেষণ’। শব্দটির গঠন হলো : বিআ+কৃ+অন। ব্যাকরণ অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে যে বিষয়সমূহ আয়ত্ত করা যায় তা হলো :
ক) ভাষার ধ্বনি, রূপ, বাক্য এবং বাগর্থের গঠন-প্রকৃতি সম্পর্কে শেখা;
খ) উল্লিখিত সকল উপাদানের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারা;
গ) ভাষার প্রমিত ব্যবহারের সামর্থ্য অর্জন করা।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-বংশের অন্তর্গত ইন্দো-ইরানীয় শাখাভুক্ত নব্য-ভারতীয় আর্য ভাষা। প্রাচীন বৈদিক
ভাষা তথা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে ভাষার যে প্রাকৃত স্তর সৃষ্টি হয়েছিল তা কালক্রমে
অপভ্রংশ স্তর অতিক্রম করে বিভিন্ন নব্য-ভারতীয় আর্য ভাষার জন্ম দেয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে
গৌড়ী অপভ্রংশ হয়ে বঙ্গ-কামরূপীর মধ্য দিয়ে বাংলা এসেছে। আর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাংলা এসেছে
মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ হয়ে। এভাবে জন্ম নেওয়া বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ; যা ছিল মূলত
সহজিয়া বৌদ্ধমতের জীবনধারা এবং ধর্মসাধনার নির্দেশনা সংবলিত গ্রন্থ। অনার্য ও অব্রাহ্মণ্য এই মতাদর্শ যখন চর্যাপদে
সংকলিত হচ্ছিল, সেই খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে (মতান্তরে খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতকে) সংস্কৃত এবং প্রাকৃত ভাষার ব্যাপক প্রভাব
ছিল। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন বৈদিক ভাষার পরিবর্তন ঠেকানোর জন্যই এক সময় এর সংস্কারকৃত রূপ হিসেবে সংস্কৃত ভাষা
সৃষ্টি হয়েছিল যার ব্যবহার ছিল অত্যন্ত সংরক্ষিত। ফলে, জ্ঞানচর্চায় এর ব্যাপক প্রভাব থাকলেও এর থেকে কোনো
ভাষার সৃষ্টি হওয়ারও আর সুযোগ ছিল না। অপরদিকে, সময়ের ব্যবধানে মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত বৈদিক ভাষার
অসংস্কারকৃত রূপ থেকে সৃষ্ট প্রাকৃত ভাষাসমূহ নানাভাবে পাল্টে গেলেও বিভিন্ন নব্য-ভারতীয় আর্য ভাষা সৃষ্টির কাল পর্যন্ত
লেখ্যভাষা হিসেবে প্রাকৃতের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু চর্যাকারগণ সেসব ভাষার পরিবর্তে তখনকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক
বিবেচনায় অনেক বেশি অপরিশীলিত বাংলা ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই কাল থেকেই বাংলা ভাষা এমন নিজস্ব
বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হতে শুরু করে যে, সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ বিভিন্ন সময় প্রবেশ করলেও এ ভাষার ধ্বনি পরিবর্তন,
শব্দের গঠন, বাক্য বিন্যাস-সহ আরও বিভিন্ন ব্যাকরণিক বিষয় সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম প্রায়শই না মেনে ব্যাপক স্বাধীনতা
গ্রহণ করে। অথচ, মধ্যযুগের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের সূচনাপর্বে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্য
লেখকদের সূত্র ধরে এবং সেই থেকে শুরু করে মোটাদাগে এখন পর্যন্ত বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে রচিত প্রায় সকল গ্রন্থেই
সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাঁচে বাংলা ব্যাকরণকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে, এমন অনেক নিয়ম বাংলা ব্যাকরণে
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যেগুলো সংস্কৃত ভাষায় প্রাসঙ্গিক থাকলেও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছিল না। তাছাড়া, আধুনিক
কালে মানব ভাষার ব্যাকরণকে ব্যাখ্যা করে থাকে একটি বিশেষ জ্ঞানশাখা যার নাম ভাষাবিজ্ঞান)। কিন্তু বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হয়েছেন এমন প্রায় সকলেই প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণকে
ভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বিত করতে সক্ষম হননি। তবে, এর ব্যতিক্রম ঘটেছে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ্-র ক্ষেত্রে। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে শিক্ষালাভ করায় তাঁরা তাঁদের রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানকে
প্রথাগত বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে আংশিকভাবে সমন্বিত করার প্রয়াস পান। এসব গ্রন্থের আলোকে বলা যায় যে, বাংলা
ব্যাকরণের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হলো : বাংলা ধ্বনিতত্ত¡, বাংলা রূপতত্ত¡, বাংলা বাক্যতত্ত¡ ও বাংলা বাগর্থতত্ত¡। ব্যাকরণনির্দেশিত বিভিন্ন বিধি ও সূত্র ভাষায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা-ও পরোক্ষভাবে ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়। এ কারণে
ভাষার প্রয়োগরীতি এবং নির্মিতি অধ্যয়নও ব্যাকরণ আয়ত্তীকরণের অংশ। নিচে বাংলা ব্যাকরণের মুখ্য আলোচ্য বিষয়সমূহ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
বাংলা ধ্বনিতত্ত¡ : এর মূল কাজ হলো বাংলা ভাষার ধ্বনি ব্যবস্থার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করা। বাংলা স্বরধ্বনি
উচ্চারণের মাপকাঠিসমূহ, ব্যঞ্জনধ্বনিসমূহের উচ্চারণস্থান ও উচ্চারণরীতি, অর্ধস্বর, যৌগিকস্বর, অক্ষর ও অক্ষরায়ণ,
ধ্বনি-পরিবর্তনসূত্র প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করাই বাংলা ধ্বনিতত্তে¡র লক্ষ্য।
বাংলা রূপতত্ত¡ : বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের উৎপত্তি, শব্দের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রূপমূলের গঠন ও বিন্যাস এবং শব্দের
বিবিধ প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করাই বাংলা রূপতত্তে¡র মূল কাজ। বাংলা ভাষায় যেসব শব্দ রয়েছে তাদের উৎস ও ব্যুৎপত্তি
নির্দেশ করা, এসব শব্দের অন্তর্গত রূপমূল বা রূপমূলসমূহ কীভাবে বিন্যস্ত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা এবং বাংলা শব্দের
প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে বাংলা রূপতত্তে¡র আলোচনার পরিধি নির্দেশিত হয়।
বাংলা বাক্যতত্ত¡ : বাংলা বাক্যের গঠনবৈশিষ্ট্য, পদক্রম, বাক্যাংশ ও পদের গঠন, কারক-বিভক্তির প্রয়োগ-সহ বিভিন্ন বিষয়ে
আলোকপাত করে এ ভাষার বাক্যতত্ত¡। একই সঙ্গে ক্রিয়ার কাল, ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের কর্তা ও কর্মের সম্বন্ধ, উক্তি ও উক্তি
পরিবর্তন এবং বাচ্য বিষয়েও আলোকপাত করে বাক্যতত্ত¡।
বাংলা বাগর্থতত্ত¡ : বাংলা ধ্বনির অর্থদ্যোতকতা এবং বাংলা শব্দ ও বাক্যের অর্থবাচকতা নিয়ে আলোচনা করে বাংলা
বাগর্থতত্ত¡। এরই অংশ হিসেবে অভিন্ন অর্থের বিভিন্ন শব্দ এবং একই শব্দের বিভিন্ন প্রকার অর্থ নিয়েও আলোকপাত করে বাগর্থতত্ত¡।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১. ব্যাকরণ বলতে কী বোঝেন? বাংলা ব্যাকরণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখুন।
২. বাংলা ব্যাকরণের মুখ্য আলোচ্য বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ করুন।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]