পৃথিবীর সকল ভাষাতেই গদ্যের আবির্ভাব ঘটেছে পদ্যের অনেক পরে; পদ্যেই রচিত হয়েছে প্রাচীনতম
সাহিত্য। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আনুমানিক হিসাব করে বলা যায় যে, বাংলা কবিতার
বয়স যদি হয় দেড় হাজার বছর তবে বাংলা গদ্যের বয়স মাত্র শ’দুয়েক বছর। সমগ্র মধ্যযুগের (১২০১-
১৮০০ পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্যে গদ্যের যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তা পরিমাণে খুবই সামান্য; তাও সীমাবদ্ধ ছিল দলিল-
দস্তাবেজ ও চিঠিপত্র রচনার মধ্যে। সেদিক থেকে বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে গদ্যের সূত্রপাত আধুনিক যুগে (১৮০১-
বর্তমান কাল অবধি)। এদেশে ইংরেজদের আগমনের পর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (প্রতিষ্ঠা ১৮০০ সাল)-কে
কেন্দ্র করে বাংলা গদ্য চর্চা বেগবান হয়। উল্লেখিত হয়েছে যে, এর আগে বাংলা গদ্যের ব্যবহার ছিল স্বল্প এবং সীমিত
পরিসরে। এ থেকে মনে করার কোনো কারণ নেই, প্রাচীন বা মধ্যযুগের লোকেরা কথাবার্তা বলত পদ্যে; ছন্দ মিলিয়ে
মিলিয়ে। আসলে কথাবার্তার ক্ষেত্রে কোনোদিনই কেউ কবিতা ব্যবহার করত না, বলত গদ্যেই, এখনও যেমন আমরা
বলি। কিন্তু তারপরও সাহিত্য রচনার জন্য দীর্ঘকাল ব্যবহৃত হয়েছে কবিতা বা কবিতার ভঙ্গি।
সাধারণ কথাবার্তা যখন মানুষেরা বলে তখন ভাষা ব্যাকরণের আঁটো-সাঁটো বন্ধনের অনেক বাইরে থাকে অর্থাৎ ব্যাকরণ
তখন কড়াকড়িভাবে আরোপ করা হয় না, ভাষীরা আরোপ করেন না− ভাব প্রকাশ করাই সেখানে মুখ্য। কিন্তু লৈখিক রূপ
বা লেখ্য রূপ অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট বা সুনিয়ন্ত্রিত। বাংলা ভাষার মৌখিক রূপের যেমন চলতি ও আঞ্চলিক এই দুই ভাগ
রয়েছে তেমনি। লৈখিক রূপ বা লেখ্যরূপেরও আদর্শ চলতি রীতি এবং সাধুরীতি
দুটো ভাগ বিদ্যমান। বাংলা গদ্যের উল্লিখিত বৈচিত্র্য নিচের চিত্রের সাহায্যে দেখানো যায় :
বাংলা ভাষা
লৈখিক মৌখিক
সাধুরীতি
(সর্বজন স্বীকৃত লেখ্যরূপ)
চলতি রীতি
(সর্বজন স্বীকৃত আদর্শ চলতি রূপ)
আঞ্চলিক কথ্যরূপ বা উপভাষা
নোয়াখালি চট্টগ্রাম সিলেট রংপুর ... ইত্যাদি
সাধুরীতি
যতদূর জানা যায় ‘সাধুভাষা’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি ১৮১৫ সালে ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ নামে
একটি রচনায় প্রথম ওই শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু সাধুভাষা বলতে তিনি বিশেষ কোন্ ধরনের ভাষারীতিকে
বুঝিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে এ-টুকু বোঝা যায় যাঁরা ‘সংস্কৃতে ব্যুৎপন্ন’ তাঁদের ভাষাকে বোঝাতে তিনি ব্যবহার
করেছিলেন সাধুভাষা শব্দটি। অর্থাৎ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যাঁদের ভাষা ছিল ‘সংস্কৃতমূলক’ ও ‘সংস্কৃতানুসারী’
তাঁদের ভাষাকেই রামমোহন চিহ্নিত করেছিলেন সাধুভাষা বলে। সাধুভাষার বিপরীতে এখন যে ‘চলতি’ বা ‘চলতি’ রীতির
কথা আমরা বলছি, রামমোহনের বেশ পরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা ভাষা’ নামে একটি প্রবন্ধে সে বিষয়ের প্রথম উল্লেখ
পাওয়া যায়। ওই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “কিছুকাল পূর্বে দুইটি পৃথক ভাষা বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল। একটির নাম সাধু ভাষা;
অপরটির নাম অপরভাষা। একটি লিখিবার ভাষা, দ্বিতীয়টি কহিবার ভাষা। ... সাধুভাষায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ সকল
বাঙ্গালা ক্রিয়াপদের আদিম রূপের সঙ্গে সংযুক্ত হইত। যে শব্দ অভাঙ্গা সংস্কৃত নহে, সাধুভাষায় প্রবেশ করিবার তাহার
কোন অধিকার ছিল না।” বঙ্কিমচন্দ্র ওই প্রবন্ধে তৎকালীন সাধুভাষাকে আক্রমণ করে বলেছিলেন ‘সংস্কৃতপ্রিয়তা এবং
সংস্কৃতানুকারিতা’র কারণেই বাংলা সাহিত্য ‘অত্যন্ত নীরস, শ্রীহীন, দুর্বল হয়ে উঠেছে’। তাই তাঁর পরামর্শ, ‘অকারণে ঘর
শব্দের পরিবর্তে গৃহ, অকারণে মাথার পরিবর্তে মস্তক, অকারণে পাতার পরিবর্তে পত্র এবং তামার পরিবর্তে তাম্র ব্যবহার
উচিত নহে।’ সাধুভাষা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওই সব মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, উনিশ শতকের তৃতীয় দশক
পর্যন্ত সাধুভাষার যে সুনির্ধারিত রূপ গড়ে উঠেছিল তাতে তদ্ভব, অর্ধতৎসম প্রভৃতি শব্দের তুলনায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ
ছিল বেশি। তবে বিদ্যাসাগর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে সাধুভাষা ক্রমে সংস্কৃতের গÐি
বা সংস্কৃত ভাষারীতির অপ্রয়োজনীয় বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে ভাষায় তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন তাকে আজ আমরা নিঃসন্দেহে সাধুভাষা বলে
চিহ্নিত করি। কিন্তু তিনি তাঁর শেষ দিককার উপন্যাসগুলোয়, আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) এবং
‘সীতারাম’ (১৮৮৬)-এ যে সাধুভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা ক্রিয়ার আদিম রূপ ছাড়া অনেকখানিই বর্তমানের চলতি
বাংলার পূর্বসুরি হবার যোগ্য।
তবে সাধুরীতি বাংলাভাষীদের মুখের ভাষার অনেক কাছাকাছি চলে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধু গদ্যরীতির মাধ্যমে।
তিনি ১৯১৪ সালের আগে চলতি ভাষা ব্যবহার করেননি একথা তথ্য হিসেবে সত্য হলেও চলতি বাংলা বা কথ্য বাংলার
অনেক কাছাকাছি এসে গিয়েছিল তাঁর গদ্যভঙ্গি। ক্রিয়া ও সর্বনামের আদিম রূপ হয়ত রবীন্দ্রনাথের ১৯১৪ সালের
আগেকার গদ্যে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি অনেক বেশি চলতি বাংলার নিকটবর্তী। ওপরের আলোচনা থেকে
বোঝা যায, উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের রীতি প্রতিষ্ঠার সময় বাংলা সাহিত্যিক গদ্য অবলম্বন করেছিল সংস্কৃত ভাষার
আদর্শ অর্থাৎ সংস্কৃত রীতির শব্দ চয়ন, সমাস-বাহুল্য, কথ্য ভাষার পদ বর্জন রীতি। ওই শতাব্দীর পÐিতেরাই এ ধরনের
ভাষা রীতির নাম দিয়েছিলেন সাধুভাষা। এখানে বলে রাখা দরকার যে সাধু রীতি কখনোই মানুষের অনানুষ্ঠানিক কথাবর্তার
ভাষা ছিল না, এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল মুখ্যত সাহিত্য রচনার মধ্যেই।
চলতি ভাষা রীতি
চলতি বাংলা গদ্যরীতির প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে যাঁর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন তিনি শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়। বয়সের
দিক দিয়ে তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক। বাংলা সাধু গদ্যরীতির আঁটোসাঁটো বন্ধন থেকে ভাষাকে
সহজ স্বাভাবিক করে তোলার বাসনায় তিনি ‘ক্যালকাটা রিভিউ’তে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধে তিনি প্রস্তাব করেন
যেÑ ১. বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ রাখার প্রয়োজন নেই; ২. বহুবচনে- গণ প্রত্যয় বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাভাবিক নয়; ৩.
বাংলায় অযথা সন্ধির ভার বাক্যের পক্ষে ক্ষতিকর; ৪. অবিকৃত সংস্কৃত (অর্থাৎ তৎসম) শব্দের তুলনায় রূপান্তরিত (অর্থাৎ
তদ্ভব) এবং দেশজ শব্দের ব্যবহারই বাংলায় স্বাভাবিক। শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এসব প্রস্তাবে, তাঁর কালের তুলনায়,
অনেক বেশি আধুনিক চিন্তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। কিন্তু বর্তমানে প্রচলতি চলতি বাংলার সঙ্গে সাধু বাংলার প্রধান যে
পার্থক্য অর্থাৎ সর্বনাম ও ক্রিয়া, সে-সম্পর্কে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো প্রস্তাব নেই। তারপরও বলা যায়,
শ্যামাচরণের ওই প্রস্তাবসমূহ চলতি বাংলা প্রবর্তনে বা ভাষাকে, সরল ও সাবলীল করে তোলার ক্ষেত্রে বেগবান করেছিল।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর লেখায় তৎকালীন কলকাতার সাধারণ মানুষের মুখের
ভাষাকে সাহিত্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্যারীচাঁদের ওই ভাষাভঙ্গি অন্যদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে বিকাশ লাভ
করেনি; এমনকি প্যারীচাঁদ মিত্র নিজেও ওই ভাষাভঙ্গি পরিত্যাগ করেছিলেন। হয়ত এর অন্যতম কারণ, সমকালের মানুষের
সাহিত্য রুচির সঙ্গে ‘আলালের ঘরের দুলাল’- এর ভাষার খুব বেশি ঐক্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ফলে ‘আলালী ভাষা’র
অকাল মৃত্যু ঘটে।
বর্তমানে যাকে আমরা চলতি বাংলা ভাষা বলে চিনি তার প্রবর্তনের ও প্রয়োগের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে
প্রমথ চৌধুরীর নিজস্ব পদক্ষেপের জন্য। ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্র’ নামে একটি উঁচুমানের পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন
তিনি। ওই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই চলতি বাংলার প্রায়োগিক প্রকাশ ঘটতে থাকে। প্রমথ চৌধুরীর এ প্রচেষ্টা খুব সহজসাধ্য
ছিল না। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘কথার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমার ইচ্ছে বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়।’ তার
কারণ স্বাধীন হয়ে, স্বাধীনভাবে নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাতেও সুখ আছে। সংস্কৃতের মৃতদেহ স্কন্ধে নিয়ে বা
সংস্কৃতের ‘অঞ্চল ধরে বেড়ানো’তে বাংলা ভাষার কোনো কল্যাণ নেই। তারপর তিনি প্রশ্ন করেছেন, কাকে বলে বাংলা
ভাষা? উত্তর দিচ্ছেন এভাবে, ‘যে ভাষা আমরা সকলে জানি শুনি বুঝি, যে ভাষায় ভাবনা চিন্তা সুখ-দুঃখ বিনা আয়াসে বিনা
ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি, এবং সম্ভবত আরো বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব, সেই ভাষাই বাংলা ভাষা। তাই
চলতি বাংলার প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মতামত হচ্ছে, আসল কথাটা কি এই নয় যে, লিখিত ভাষায় আর মুখের ভাষায় মূলে
কোনো প্রভেদ নেই। ভাষা দুয়েরই মূল এক, শুধু প্রকাশের উপায় ভিন্ন। একদিকে স্বরের সাহায্যে অপরদিকে অক্ষরের
সাহায্যে। বাণীর বসতি রসনায়। শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে
পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা
নয়। ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে
শুধু কালি পড়ে।’ চলতি বাংলা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর এই মানসিকতা ও সবুজপত্রকে কেন্দ্র করে তাঁর কুশলতায় আধুনিক
বাংলায় চলতি গদ্যরীতি বিকশিত হবার সুযোগ পেয়েছে। তা ছাড়া প্রমথ চৌধুরীর প্রতি সব সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল
অকুণ্ঠ সমর্থন। ফলে প্রমথ চৌধুরীর প্রচেষ্টা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা গদ্যে চলতি রীতি
আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাভাবিক কারণে পিছিয়ে পড়েছে সাধুরীতি এবং সম্প্রতি তা প্রায় বর্জিত হবারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১. সাধু ও চলতি ভাষা কাকে বলে?
২. সাধু ও চলতি ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ