সাধু ও চলতি ভাষা
সাধু ও চলতি ভাষার মধ্যে যে দ্ব›দ্ব ও জটিলতা তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ
শতকের শুরুতে তার গ্রহণযোগ্য মীমাংসা আমরা লাভ করেছি। সাধু ও চলতি ভাষারীতির প্রধান পার্থক্য নির্ভর করে সর্বনাম
ও ক্রিয়াপদের ওপর। সাধুরীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়ার পূর্ণ ও দীর্ঘরূপ ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে চলতি বাংলায় সর্বনাম ও
ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত বা হ্রস্বরূপ ব্যবহৃত হয়। নিচে ওই সাধু ও চলতি রীতিতে এদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী পার্থক্য ঘটে তা
এ কথা সত্য যে সাধু ও চলতি রীতির সম্পর্ক যত সহজ ও সমান্তরাল মনে করা হয়, তা তেমন সহজ ও সমান্তরাল নয়।
বাংলা বাক্যে অনেক ক্ষেত্রেই যেহেতু ক্রিয়া উহ্য বা অনুক্ত থাকে তাই বিচ্ছিন্নভাবে একটি বাক্য দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায়
না ঐ বাক্যটি সাধু না চলতি রীতির। নিচের বাক্যগুলো লক্ষ করুন :
ক. সায়মার এখন বাড়ি ফেরা উচিত।
খ. দূরের পথ, যত দ্রæত ফেরা যায় ততই ভাল।
গ. সায়মার বাড়ি ঢাকার এক প্রান্তে।
ওপরের তিনটি বাক্যকে তাদের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে বলা প্রায় অসম্ভব যে বাক্যগুলো সাধু নাকি
চলতি বাংলার অন্তর্গত। এর প্রধান কারণ বাক্যে যদি সমাপিকা ক্রিয়া উহ্য থাকে অর্থাৎ অনুক্ত থাকে তবে সাধু চলতির
পার্থক্য নিরূপণ করা প্রায় অসম্ভব।
আবার কোনো কোনো বাক্যে ক্রিয়ার অনুক্ত না হলেও তার সাধু চলতির গোত্র নিরূপণ দুরূহ। যেমন নিত্য বর্তমান বা
বর্তমান অনুজ্ঞায় কিছু কিছু ক্রিয়ার রূপ একবচন ও বহুবচনে এবং সাধু ও চলতি অভিন্ন। উদাহরণগুলো লক্ষ করুন :
আমি/আমরা শুই
তুমি/তোমরা শোও
সে/তারা শোয়
কিন্তু নিত্য বর্তমান ও বর্তমান অনুজ্ঞা ছাড়া অন্যকালের ক্রিয়ারূপে সাধু ও চলতির পার্থক্য স্পষ্ট। যেমন−
সাধু রূপ চলতি রূপ
আমি/আমরা শুইলাম আমি/আমরা শুলাম
তুমি/তোমরা শুইলে তুমি/তোমরা শুলে
সে/তারা শুইল সে/তারা শুল .... ইত্যাদি।
সাধু ও চলতি ভাষার পার্থক্য নিয়ে প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধু ভাষা’ ও ‘সাধুভাষা বনাম
চলতি ভাষা’ প্রবন্ধ দুটিতে নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। আমরা এখন সাধু ও চলতি ভাষার পার্থক্য সম্পর্কে প্রমথ
চৌধুরীর মতামতের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করছি। তাঁর মতে, ‘লেখার ভাষা শুধু মুখের ভাষার প্রতিনিধি মাত্র’। তাই মুখের
ভাষার সঙ্গে লেখার ভাষার কোনো পার্থক্য থাকা অনুচিত। একমাত্র সেই ভাষা অবলম্বন করেই আমরা সাহিত্যকে সজীব,
করে তুলতে পারব। তবে লিখিত ও কথিত ভাষার মধ্যে যে সামান্য পার্থক্য সব সময়ই লক্ষ করা যায় ‘সে পার্থক্য ভাষাগত
নয়, স্টাইলগত’। সংস্কৃতের অনুসরণে উনিশ শতকে যে ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল প্রমথ চৌধুরী তাকে বলেছেন, ‘কবিরাজ
বিনিন্দিত মন্দগতি’। ফলে সাধুভাষার গড়নটি হয়ে ওঠে ‘চলৎশক্তি রহিত’। ‘ভাষার এই আড়ষ্ট ভাবটাই সাধুতার একটা
লক্ষণ বলে পরিচিত। তাই বাংলা সাহিত্যে সাধারণ লেখকদের গদ্য গদাই লশ্করি ভাবে চলে, এবং কুলেখকদের হাতের
লেখা একটা জড় পদার্থের স্ত‚পমাত্র হয়ে থাকে। এই জড়তার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, লেখাতেও
মৌখিক ভাষার সহজ ভঙ্গিটি রক্ষা করা।’ প্রমথ চৌধুরী মৌখিক ভাষার সহজ ভঙ্গিটিকেই চলতি বাংলার আদর্শ হিসেবে
নির্ধারণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন নদীয়া-শান্তিপুর এবং ভাগীরথীর উভয় তীরের ডায়ালেক্ট বা
উপভাষাকে। তিনি পূর্ববাংলার কিংবা কলকাতার উচ্চারণকে প্রমিত বলে গ্রহণ করেননি। তাঁর মতে, ‘ঢাকাই কথা এবং
খাস-কলকাত্তাই কথা, অর্থাৎ সুতানুটির গ্রাম্যভাষা, দুয়েরই উচ্চারণ অনেকটা বিকৃত। ....পূর্ববঙ্গের লোকের মুখে স্বরবর্ণ
ছড়িয়ে যায়, কলকাতার লোকের মুখে স্বরবর্ণ জড়িয়ে যায়।’ এসব কারণেই নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলের ডায়ালেক্টকেই তিনি
প্রমিত মনে করেছিলেন এবং বর্তমানে প্রচলতি চলতি ভাষা প্রমথ চৌধুরীর আদর্শ অনুসরণ করেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
এই দুটি রীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেনÑ ‘সাধু ভাষা মাজা ঘষা,
সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা। চলতি আটপৌরে সাজ, নিজের চরকায় কাটা সুতো
দিয়ে বোনা।’ ভাষার মৌখিক রূপের আবার দুটো রীতি। যথা:
১. আঞ্চলিক রীতি ও
২. প্রমিত রীতি।
বাংলা ভাষার এই রীতিভেদকে নিচের ছকে দেখানো হলোÑ
১. কথ্য ভাষা: ‘কথ্য’ কথাটি এসেছে ‘কথা’ থেকে। অর্থাৎ, যে ভাষায় আমরা সব সময় কথা বলি, তাকে বলা হয় কথ্য
ভাষা। যেমন:
১. এক জনের দুই হুত আছিল।
২. এক মানষের দুই পোয়া আছিল।
ক. আঞ্চলিক উপভাষা : উপভাষা হলো ব্যাপক ভাষা অঞ্চলে ব্যবহৃত ভাষার বিচিত্র রূপ। বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলা ভাষার
বিভিন্ন রূপকে আঞ্চলিক উপভাষা বলে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাঙালা ব্যাকরণ” গ্রন্থের আলোকেঢাকা : একন মানশের দুইডা পোলা আছিলো।
বগুড়া : য়্যাক ঝনের দুই ব্যাটা আছিল।
রংপুর : একজন ম্যানশের দুইক্না ব্যাটা আছিল্।
ময়মনসিংহ: য়্যাক জনের দুই পুৎ আছিল্।
খ. প্রমিত কথ্য ভাষারীতি : কথ্য ভাষারীতি মার্জিত হয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য যে রূপ লাভ করেছে, সেই শিক্ষিত
লোকের ভাষাকেই প্রমিত কথ্য ভাষারীতি বলা হয়।
২. লেখ্য ভাষা : “লেখ্য” কথাটি মূলত ‘লেখা’ থেকে এসেছে। যে ভাষায় আমরা বক্তব্য লিখি বা সাহিত্য রচনা করি,
তাকে লেখ্য ভাষা বলা হয়।
ক. সাধু ভাষারীতি : যে ভাষারীতিতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি এবং ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়,
তাকে সাধু ভাষারীতি বলা হয়। যেমন: করিয়াছি, তাহারা, তাহাদের ইত্যাদি।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সাধারণ গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।”
খ. চলিত ভাষারীতি : যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষারীতি বলে।
যেমন; করেচি, তারা, তাদের ইত্যাদি।
ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চলতি ভাষারীতি নিয়ে বলেছেনÑ “দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র
ও শিক্ষিত সমাজের ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা রূপে গৃহীত
হয়েছে। একে চলতি ভাষা বলা হয়।”
সাধুরীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১. সাধু রীতি ব্যাকরণ নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে।
২. সাধু রীতি তৎসম শব্দবহুল ও গুরুগম্ভীর।
৩. সাধু রীতিতে ক্রিয়ার পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: পড়িতেছি, লেখিতেছি ইত্যাদি।
৪. সাধু রীতিতে সর্বনামের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: তাহারা, উহারা ইত্যাদি।
৫. সাধু রীতিতে অব্যয়ের তৎসম রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: তথাপি, যদ্যপি ইত্যাদি।
৬. সাধু রীতির রূপ সুনির্দিষ্ট।
৭. এই রীতিতে সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার বেশি। যেমন: রসনেন্দ্রিয়, মহাবুদ্ধিসম্পন্ন ইত্যাদি।
বাংলা ভাষারীতি
কথ্য লেখ্য
আঞ্চলিক উপভাষা প্রমিত কথ্য
ভাষারীতি
সাধু চলতি
৮. সাধু রীতি প্রাচীন বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।
৯. সাধু রীতি নাটক, বক্তৃতা, সংলাপের উপযোগী নয়।
১০. সাধু রীতি শুধু লেখার উপযোগী।
চলতি রীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১. চলতি রীতি ব্যাকরণের সুনির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে না।
২. চলতি রীতিতে তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের ব্যবহার বেশি।
৩. চলতি রীতিতে ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: পড়ছি, লিখছি ইত্যাদি।
৪. চলতি রীতিতে সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: ওরা, তারা ইত্যাদি।
৫. চলতি রীতিতে অব্যয়ের তদ্ভব রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: তবু, যদিও ইত্যাদি।
৬. চলতি রীতি পরিবর্তনশীল।
৭. চলতি রীতিতে সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম।
৮. চলতি রীতি আধুনিক বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।
৯. চলতি রীতি বক্তৃতা, নাটক ও সংলাপের উপযোগী।
১০. চলতি ভাষা কথ্য ও লেখ্য উভয়ই।
গুরুচÐালী দোষ
একই গদ্য রচনায় সাধু ও চলতি উভয় রীতি অসংগতরূপে মিশ্রিত হলে বা লঘুগুরু শব্দের মিশ্রণে ভাষা শ্রæতিকটু হলে,
তাকে গুরুচÐালী দোষ বলে।
বাংলা কবিতায় সাধু ও চলতি ক্রিয়া, সর্বনাম প্রভৃতি পদের মিশ্রণ প্রচলতি আছে। উভয় ভাষারীতির মিশ্রণ দূষণীয় বলে
গণ্য হয় না। কিন্তু বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে সাধু বা চলতি রীতির যেকোনো একটিকে পুরোপুরি অনুসরণ করতে হয়। লক্ষ
রাখতে হয়, যেন উভয় রীতির মিশ্রণ না ঘটে।
যেমনÑ চলতি ভাষার আধারে একটি সুন্দর বাক্য: “গাড়ি চলতে লাগল, বেলি ঘুমোতে লাগল, বন-পাহাড়-পর্বত-ঝরনা-
মেঘ এবং বিস্তর খাঁদা নাক এবং বাঁকা চোখ দেখা দিতে লাগল।” যদি এ বাক্যে সাধু ও চলতি ক্রিয়া ও শব্দের এরকম
অসংগত মিশ্রণ ঘটে, “গাড়ি চলতে লাগিল, বেলি ঘুমাইতে লাগল, বন-পাহাড়-পর্বত-ঝরনা-মেঘ এবং বহু খাঁদা নাসিকা
এবং বক্র চোখ দেখা দান করিতে লাগল”, তাহলে বাক্যটির ভাষা গুরুচÐালী দোষে দুষ্ট হবে।
সাধু ও চলতি ভাষারীতির মধ্যকার পার্থক্য:
সাধু ভাষারীতি চলতি ভাষারীতি
১. সাধু ভাষারীতি প্রাচীন ও পুরনো বৈশিষ্ট্যের অনুসারী। ১. চলতি ভাষারীতি আধুনিক ও নতুন বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।
২. সাধু ভাষার রীতি ব্যাকরণের নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ২. চলতি ভাষারীতি ব্যাকরণের সকল নিয়ম দ্বারা সমান
নিয়ন্ত্রিত নয়।
৩. সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয় সাধু
ভাষারীতিতে। যেমন- তাহারা, করিয়া প্রভৃতি।
৩. চলতি ভাষারীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ
ব্যবহৃত হয় না। যেমন: তারা, করে প্রভৃতি।
৪. সাধু ভাষারীতিতে তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। ৪. চলতি ভাষায় তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দের প্রয়োগ
বেশি।
৫. সাধু ভাষারীতি নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। ৫. চলতি ভাষারীতি পরিবর্তনশীল।
৬. সাধু ভাষারীতি সংলাপ, বক্তৃতা ও নাটকের উপযোগী
নয়।
৬. চলতি ভাষারীতি বক্তৃতা, নাটক ও সংলাপের জন্য
উপযোগী।
৭. সাধু ভাষারীতিতে অভিশ্রæতি ও অপিনিহিতির ব্যবহার
নেই।
৭. চলতি ভাষারীতিতে অপিনিহিতি ও অভিশ্রæতির ব্যবহার
রয়েছে।
৮. সাধু ভাষারীতিতে অব্যয় পদের তৎসম রূপ ব্যবহৃত
হয়। যেমন: তথাপি, বরঞ্চ ইত্যাদি।
৮. চলতি ভাষারীতিতে অব্যয় পদের তদ্ভব রূপ ব্যবহৃত
হয়। যেমন: যদি, তবু, বরং ইত্যাদি।
৯. সাধু ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য নেই। ৯. চলতি ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার ও প্রাধান্য
রয়েছে। যেমন: টুকটুক, ভনভন, হনহন ইত্যাদি।
১০. সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন:
হইতে, নিকট, দিয়া ইত্যাদি।
১০. চলতি ভাষারীতিতে অনুসর্গের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহৃত হয়
না। যেমন: হতে, কাছে, দিয়ে ইত্যাদি।
সাধুরীতিকে চলতি রীতিতে রূপান্তর :
নিয়মের যথাযথ প্রয়োগ করে সাধুরীতিকে চলতি রীতিতে রূপান্তর করা যায়Ñ
১. সর্বনাম পদে ‘ই’ ধ্বনি থাকলে উক্ত ‘ই’ ধ্বনি লোপ পায়। যেমন: তোমাদিগের > তোমাদের।
২. ক্রিয়ায় ‘ই’ ধ্বনি থাকলে উক্ত ‘ই’ ধ্বনি লোপ পায়। যেমন: যাইব >যাব, খাইব >খাব, হইবে >হবে ইত্যাদি।
৩. ক্রিয়াপদে ‘উ’ ধ্বনি থাকলে তা চলতি রীতিতে লোপ পায়। যেমন: হউক> হোক, যাউক> যাক, থাকুক> থাক
ইত্যাদি।
৪. পদাশ্রিত ‘ই’ ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ‘আ’ ধ্বনি ‘এ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যেমন: বিয়া> বিয়ে, দিলাম >দিলেম,
বিলাত> বিলেত ইত্যাদি।
৫. পদাশ্রিত পূর্ববর্তী ‘উ’ বা ‘ঊ’ ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ‘আ’ ধ্বনি ‘ও’ বা ‘উ’ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন:
কুলা >কুলো, পূজা >পুজো ইত্যাদি।
৬. পদের শেষে ‘অ’, ‘আ’ বা ‘এ’ থাকলে পূর্ববর্তী ‘উ’ ধ্বনি ‘ও’ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন: বুনা >বোনা,
শুনা >শোনা ইত্যাদি।
৭. পদের শেষে অ, আ, এ থাকলে পূর্ববর্তী ‘ই’ ধ্বনি ‘এ’ ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন: ভিজা >ভেজা, লিখ >লেখ
ইত্যাদি।
৮. বিশেষণঘটিত পরিবর্তন হয়। যেমন: গ্রাম্য >গেঁয়ো।
চলতি রীতি হতে সাধু রীতিতে রূপান্তর :
নি¤েœাক্ত নিয়মাবলির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে চলতি রীতি হতে সাধু রীতিতে রূপান্তর করা যায়:
১. তদ্ভব শব্দকে তৎসম শব্দে রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যবহার করা হয়। যেমন: রক্ষা >পরিত্রাণ, মাথা >মস্তক ইত্যাদি।
২. ক্রিয়াকে দীর্ঘরূপে ব্যবহার করা হয়। যেমন: করছি >করিতেছি।
৩. সর্বনামের দীর্ঘরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন: তার >তাহার, তাদের >তাহাদের ইত্যাদি।
৪. সন্ধি বা সমাসবদ্ধ শব্দের ব্যবহার করা হয়। যেমন: তুষারের ন্যায় শুভ্র >তুষারশুভ্র ইত্যাদি।
৫. বিশেষণ শব্দের পরিবর্তন করা হয়। যেমন: খুব >অতি, লাখ >লক্ষ ইত্যাদি।
৬. ধ্বন্যাত্মক কিছু শব্দের পরিবর্তন হয়। যেমন: মরমর >মর্মর ইত্যাদি।
৭. অভিশ্রæতিঘটিত পরিবর্তন হয়। যেমন: ছুটো > ছুটিয়া, মেছো >মেছুয়া মাড়–য়া ইত্যাদি।
৮. স্বরসংগতিঘটিত পরিবর্তন হয়। যেমন: ভিক্ষে >ভিক্ষা, ফিতে >ফিতা ইত্যাদি।
সাধু ও চলতি রীতির রূপভেদ
সাধুভাষায় গুরুগম্ভীর ভাবপ্রকাশে ও কমগতির উচ্চারণে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়াপদের পূর্ণ রূপ ব্যবহৃত হয়।
পক্ষান্তরে চলতিরীতিতে তা শ্রæতিমধুর, সহজ-সরল, সাবলীল ও সংক্ষিপ্ত রূপ হয়।
সাধুভাষার যৌগিক ক্রিয়ার পরিবর্তে চলতি ভাষার যৌগিক ক্রিয়া সংক্ষিপ্ত ও সরল হয়ে থাকে এবং বুঝতে সহজ হয়।
যেমনÑ ‘গাহিতে গাহিতে গমন করিতেছে’ না বলে ‘গাইতে গাইতে যাচ্ছে’ বললে বাক্যটি সহজ-সরল, বোধগম্য ও
শ্রæতিমধুর হয়।
লক্ষণীয়: ক্রিয়াপদে সাধুভাষায় হ থাকলে প্রায় কেবল চলতি ভাষায় হ লোপ পায়। যেমনÑ
দ্রষ্টব্য: কিছু অব্যয় সাধু ও চলতি দুটি রীতিতেই ব্যবহৃত হয়। আবার কিছু অব্যয় কেবল চলতিরীতিতেই ব্যবহৃত হয়ে
থাকে। যেমন Ñ তো, তা, তাহলে, তাইতো, তাই বলে, বলে, নইলে, নয়তো, হলে, পরে, মতো ইত্যাদি।
বিশেষ্যের রূপভেদ:
১। সাধুভাষায় বিশেষ্য পদের তৎসম বা সংস্কৃত রূপ সাধারণত ব্যবহৃত হয়। চলতি ভাষায় বিশেষ করে তৎসম শব্দের
তদ্ভব রূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বহুবচনের রূপভেদ : সাধুভাষায় বিশেষ্য পদের বিভিন্ন ধরনের বহুবচন দেখা যায়। যেমনÑ উদ্যানসমূহ, পর্বতমালা,
পুস্তকাদি, বৃক্ষরাজি, লোকসকল, ভ্রাতৃগণ, সাংবাদিকমহল ইত্যাদি।
কিন্তু চলতি ভাষায় বহুবচনের রূপ সীমিত। চলতি ভাষায় বহুবচনের ক্ষেত্রে প্রধানত রা/এরা, গুলি/গুলো ইত্যাদি প্রত্যয়
ব্যবহৃত হয়। বহুবচনের কতকগুলো রূপ কেবল সাধুভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। যেমন- নিকর (নক্ষত্রনিকর), নিচয়
(তারকানিচয়) সমুচ্চয় (দ্রব্যসমুচ্চয়), গ্রাম (গুণগ্রাম), দাম (পুষ্পদাম)।
কারক-বিভক্তির রূপভেদ : সাধুভাষায় ব্যবহৃত কিছু কিছু কারক-বিভক্তি চলতি ভাষায় ভিন্নতর রূপ গ্রহণ করে। যেমনসাধু চলতি সাধু চলতি সাধু চলতি
দিগকে দের দিগে দের দিগের দের
বিশেষণের রূপভেদ: সাধুভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাবে স্ত্রীবাচক শব্দে এবং স্ত্রীবাচক ভিন্ন অন্য শব্দেও স্ত্রীবাচক
বিশেষণের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
১. সাধু রীতিতে নারীবাচক শব্দে নারীবাচক বিশেষণ:
অনাথা, বিধবা
ছলনাময়ী, প্রেমময়ী, মমতাময়ী, নারী
নবমালিকা, কুসুমকোমলা শকুন্তলা
রূপযৌবনসম্পন্না, নিষ্কলঙ্কচন্দ্রাননা, মহামাননীয়া রাজকুমারী
ধর্মশীলা, ন¤্রস্বভাবা নারী
রণরঙ্গি, খড়গধারিণী, রুদ্ররূপিণী চÐী
২. সাধু রীতিতে নারীবাচক নয় এমন শব্দেও নারীবাচক বিশেষণ:
ওজস্বিনী ভাষা
জ্যোৎ¯œাপুলকিতা রজনী
তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধা তটিনী
মোহিনী মূর্তি
শস্যশালিনী ভূমি
সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবী
সুজলা সুফলা শস্যা শ্যামলা মাতৃভূমি
লক্ষণীয় : কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ প্রীতিমূলক অর্থে পুরুষবাচক শব্দে নারীবাচক বিশেষণ এবং নারীবাচক শব্দে
পুরুষবাচক বিশেষণের প্রয়োগ দেয়া যায়।
প্রিয় নার্গিস, ভালো থেকো। [নারীবাচক শব্দে পুরুষবাচক বিশেষণ ]
বেশ ল²ী ছেলে। [পুরুষবাচক শব্দে নারীবাচক বিশেষণ ]
বাক্যে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধু ও চলিতের রূপভেদ : সাধু ও চলতি রীতির বাক্যে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য
লক্ষ করা যায়। এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো কেবল সাধুভাষাতেই ব্যবহৃত হয়; অন্যদিকে কিছু শব্দ কেবল চলতি
ভাষাতেই প্রত্যাশিত।
তৎসম-অতৎসম শব্দের প্রয়োগ
সাধু রীতিতে তৎসম শব্দের অধিক ব্যবহার দেখা যায়। পক্ষান্তরে, চলতি রীতিতে ওই সব তৎসম শব্দের পরিবর্তে সমার্থক
অতৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি) শব্দের অধিক ব্যবহার হয়ে থাকে।
<
সমাসবদ্ধ শব্দ প্রয়োগে পার্থক্য
সাধুভাষায় দীর্ঘ সমাসবদ্ধ শব্দের প্রয়োগ বেশি। এ ধরনের প্রয়োগ ভাষাকে ওজস্বী করে। চলতি ভাষায় সমাসবদ্ধ শব্দ
যতটা সম্ভব পরিহার করা হয়। ভাষা পরিবর্তনের সময়ে তাই সাধুভাষার সমাসবদ্ধ পদকে চলতি ভাষায় ভেঙে সহজ করে
সন্ধিঘটিত শব্দের প্রয়োগে পার্থক্য
সাধু রীতিতে সন্ধিঘটিত শব্দের ব্যবহার বেশি। বিষয়ের কারণে অপরিহার্য না হলে চলতি ভাষায় আড়ম্বরমুখী সন্ধিজাত শব্দ
যতটা সম্ভব পরিহার করা হয়। প্রয়োজনে সন্ধিজাত শব্দ ভেঙে সহজ করে লেখা হয় কিংবা তদ্ভব রূপ দেওয়া হয়।
শব্দদ্বিত্বের প্রয়োগে পার্থক্য
সাধু রীতিতে শব্দদ্বিত্ব প্রয়োগের রীতি নেই। তা চলতি রীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যেমনÑ আইঢাই, আধাআধি, কাছাকাছি,
ফ্যালফ্যাল, উসখুস, ফিসফাস, হাইফাই ইত্যাদি চলতি ভাষার নিজস্ব সম্পদ।
ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগে পার্থক্য
ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার সাধু রীতিতে নেই বললেই চলে। এ ধরনের শব্দ চলতি রীতিতেই প্রচুর ব্যবহৃত হয়। যেমনÑ
ক্যাঁটকেটে (রং), কুচকুচে (কালো), খাঁ খাঁ (রোদ), ঝমঝম (বৃষ্টি), ঝিরঝির (বাতাস), টুকটুকে (লাল), গনগনে (আগুন),
শোঁ-শোঁ (হাওয়া), ফুরফুরে (মেজাজ), ধবধবে (সাদা) ইত্যাদি।
বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের প্রয়োগে পার্থক্য
বাগধারা প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি চলতি ভাষার নিজস্ব সম্পদ। সাধুভাষায় এদের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এদের প্রয়োগ
অনেক সময় সাধুভাষাকে কৃত্রিম করে তোলে। যেমন- ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ ইত্যাদি
চলতি ভাষারই সম্পদ।
অলংকার প্রয়োগে পার্থক্য
প্রাচীন রীতির সমাসবদ্ধ উপমা প্রয়োগ সাধুভাষার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। প্রদত্ত উদাহরণগুলোর মতো আলংকারিক শব্দপ্রয়োগ
চলতি ভাষায় দেখা যায় না। ঋণজাল, যাতনাযন্ত্রে পেষণ, লোভানলে আহুতি, লোভরিপু, শোকসিন্ধু, বিষাদ-বারিপ্রবাহ,
নবনীরদ-নন্দিত। বাংলা ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে অভিশ্রæতি, স্বরসংগতি, অপিনিহিতি ইত্যাদি নিয়ম প্রচলতি আছে। এসব
উচ্চারণ রীতি সাধু ও চলতিরীতির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। তা কখনো বা এগুলোর মধ্যবর্তী স্বরধ্বনির যোগ ঘটায়,
আবার কখনো তা ই-কার যোগে ভাষারীতির মধ্যে রূপভেদ সৃষ্টি করে। এগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
শব্দের মাঝখানে ই-কারের লোপ
সাধু রীতি : যাহা, তাহা, ইহা, তাহাকে, যাহাকে, কাহাকে, কাহারও, ইহাদের, ইহারা, যাহারা, তাহারা ইত্যাদি।
চলতি রীতি: যা, তা, এ, তাকে, যাকে, কাকে, কারো, এদের, এরা, যারা, তারা ইত্যাদি।
সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে
সাধু রীতি : কহিল, গাহিল, চাহিল ইত্যাদি।
চলতি রীতি : কইল, গাইল, চাইল ইত্যাদি।
অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে
সাধু রীতি : সহিতে, কহিতে, রহিতে ইত্যাদি।
চলতি রীতি : সইতে, কইতে, রইতে ইত্যাদি।
শব্দের মধ্যবর্তী স্থলে ই-কার লোপের আরও দৃষ্টান্ত
ক্রিয়াভেদের মধ্যবর্তী স্থলে ই বা উ ধ্বনি লোপের উদাহরণ:
সাধু রীতি : যাউক, খাউক, লউক, খাওয়াইবি, নাওয়াইব, জানাইব ইত্যাদি।
চলতি রীতি : যাক, খাক, নিক, খাওয়াব, নাওয়াব, জানাব ইত্যাদি।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধু রীতির শব্দের আগে বা পরের স্বরধ্বনি পদের মধ্যবর্তী স্থলের স্বরধ্বনির পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়।
ব্যাকরণের ভাষায় একে বলে স্বরসংগতি। যেমন Ñ
ক. শব্দের কোনো অক্ষরে অ, আ বা এ থাকলে এর পূর্ববর্তী ধ্বনি- এ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। এ পরিবর্তন সাধু ও চলতি
ভাষারীতিকে প্রভাবিত করে। যেমনÑ সাধুভাষায় লেখা হয়Ñ লিখ, শিখ, লিখা, লিখালিখি, শিখাশিখি, শিয়াল ইত্যাদি।
খ. পরবর্তী অক্ষরে অ, আ বা এ থাকলে পূর্ববর্তী ‘উ’ ধ্বনি ‘ও’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণ: যেমনÑ সাধুভাষায়Ñ
শুন, শুনা, শুনে, বুঝে, বুঝানো, গুছানো, উঠ, উঠানো, বুঝা ইত্যাদি।
গ. পূর্ববর্তী ‘ই’ ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী অক্ষরের ‘আ’ ধ্বনির এ ধ্বনিতে পরিবর্তনের উদাহরণ:
সাধু ভাষারীতিতে : মিছা, ফিতা, মিঠা, গিয়ে, দিয়ে ইত্যাদি।
চলতি ভাষারীতিতে : মিছে, ফিতে, মিঠে, গিয়ে, দিয়ে ইত্যাদি।
ঘ. আগে উ, ঊ থাকলে শেষে আ-হয়ে যাওয়ার উদাহরণ:
সাধু ভাষারীতিতে : রূপা, ধূলা, কুলা, মূলা, চুলা ইত্যাদি।
চলতি ভাষারীতিতে : রুপো, ধুলো, কুলো, মুলো, চুলো ইত্যাদি।
স্বরসংগতি, অপিনিহিতি ও অভিশ্রæতির প্রভাবে সাধুভাষায় শব্দ পরিবর্তিত হয়ে চলতি রূপ লাভ করার আরও কিছু নমুনা
প্রদত্ত হলো :
উল্লেখ্য যে, উভয়ের নিয়মকানুন ও পরিবর্তনের দৃষ্টান্তগুলো স্মরণ রাখলে সাধুরীতি থেকে চলতিরীতিতে ও চলতিরীতি
থেকে সাধুরীতিতে রূপান্তর অনেক সহজ হয়ে যাবে।
সাধুরীতি থেকে চলতিরীতিতে পরিবর্তন
১. সাধুরীতি : ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পÐিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা
করিয়া, বিদ্রƒপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম; কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি,
যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পÐিতমশায়দের মুখে বিদ্রƒপ আবার যেন অমনি করিয়াই প্রকাশ
পায়। - অপরিচিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
চলতিরীতি : ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা নিয়ে পÐিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সঙ্গে তুলনা
করে, বিদ্রƒপ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এতে তখন বড় লজ্জা পেতাম; কিন্তু বয়স হয়ে এ কথা ভেবেছি, যদি
জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে স্বরূপ এবং পÐিতশায়দের মুখে বিদ্রƒপ আবার যেন অমন করেই প্রকাশ পায়।
২. সাধুরীতি : এক্ষণে স্বস্থানে গমন কর, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিও, উভয়ে ভাগ
করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইও না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীর হও, তবে পুনর্বার আসিও, এক
সরিষাভোর আফিং দিব।
চলতিরীতি : এখন নিজের জায়গায় যাও, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দেবে বলেছে, জলযোগের সময় এসো, উভয়ে ভাগ
করে খাব। আজ আর কারও হাঁড়ি খেয়ো না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীর হও, তবে আবার এসো, এক সরিষাভোর
(সরিষা দানার পরিমাণ) আফিং দেব।
৩. সাধুরীতি : তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়
মধ্যাহ্নের মার্তÐপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল
যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।
চলতিরীতি : তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তারই যার শক্তি অপরিমেয়, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়
দুপুরের সূর্যের মতো, বিপুল যার আশা, ক্লান্তিহীন যার উৎসাহ, বিরাট যার ঔদার্য, অফুরন্ত যার প্রাণ, অটল যার সাধনা,
মৃত্যু যার মুঠিতলে।
৪. সাধুরীতি : বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ
করিতেছি। তেমন করিয়া কোন মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। আনন্দের সহিত পড়িতে
পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষ্যে বৃদ্ধি পাইতে থাকে, গ্রহণশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজ ও স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পায়।
চলতিরীতি : বাল্যকাল হতে আমাদের শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই। শুধু যা কিছু নিতান্ত প্রয়োজন তাই কণ্ঠস্থ করছি।
তেমন করে কোনো মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। আনন্দের সঙ্গে পড়তে পড়তে পড়বার
শক্তি অলক্ষ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকে, গ্রহণশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজ ও স্বভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পায়।
চলতিরীতি থেকে সাধুরীতিতে পরিবর্তন
১. চলতিরীতি : নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শুনায়। অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে।
তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই।
সাধুরীতি : নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদিগকে সার্থকতার গান গাহিয়া শুনায়। অনুভূতির কান দিয়া সেই গান শুনিতে
হইবে। তাহা হইলে বুঝিতে পারা যাইবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাহাই।
২. চলতিরীতি : বিকেলের দিকে বেড়াতে যাবার পথে দেখতে গেলাম বুড়িকে। বুড়ি শুয়ে আছে একটা মাদুরের ওপর,
মাথায় মলিন বালিশ। আমি গিয়ে কাছে দাঁড়াতেই বুড়ি চোখ মেলে আমার দিকে চাইল।
সাধুরীতি : বিকালের দিকে বেড়াইতে যাইবার পথে দেখিতে গেলাম বুড়িকে। বুড়ি শুইয়া আছে একটা মাদুরের উপর,
মাথায় মিলন বালিশ। আমি গিয়া নিকটে দাঁড়াইতেই বুড়ি চোখ মেলিয়া আমার দিকে চাহিল।
৩. চলতিরীতি : তাও বুঝতুম, যদি বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা না থাকত, আমার বেদনাটা সেইখানে। বাঙালি যদি হটেনটট হত
তবে কোন দুঃখ ছিল না। এরকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতের কোথাও দেখিনি। জ্ঞানতৃষ্ণা তার প্রবল, কিন্তু বই
কেনার বেলা সে অবলা। আবার কোনো কোনো বেশরম বলে, “বাঙালির-পয়সার অভাব।” বটে? কোথায় দাঁড়িয়ে
বলছে লোকটা এ-কথা?
সাধুরীতি : তাহাও বুঝিতাম, যদি বাঙালির জ্ঞানতৃষ্ণা না থাকিত, আমার বেদনাটা সেইখানে। বাঙালি যদি হটেনটট
হইত তাহা হইলে কোন দুঃখ ছিল না। এই রকম অদ্ভুত সংমিশ্রণ আমি ভূ-ভারতের কোন জায়গায় দেখি নাই।
জ্ঞানতৃষ্ণা তাহার প্রবল, কিন্তু বই কিনার বেলায় সে অবলা। আবার কোন কোন বেশরম বলে, “বাঙালির পয়সার
অভাব” বটে? কোন জায়গায় দাঁড়াইয়া বলিতেছে মানুষটা এই কথা?
৪. চলতিরীতি : সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া, কারও মেেনারঞ্জন করা নয়। এ দুয়ের ভিতর যে আকাশ
পাতাল প্রভেদ আছে, সেইটি ভুলে গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করে পরের জন্য খেলনা তৈরি করতে বসে।
সমাজের মনোরঞ্জন করতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ে, তার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নয়।
সাধুরীতি : সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কাহারও মনোরঞ্জন করা নয়। এই দুইয়ের ভিতর যে আকাশপাতাল প্রভেদ রহিয়াছে সেইটি ভুলিয়া গেলেই লেখকেরা নিজে খেলা না করিয়া অপরের জন্য খেলনা তৈয়ার করিতে
বসে। সমাজের মনোরঞ্জন করিতে গেলে সাহিত্য যে স্বধর্মচ্যুত হইয়া পড়ে তাহার প্রমাণ বাংলাদেশে আজ দুর্লভ নহে।৩
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১. সাধুরীতি ও চলতিরীতির বৈশিষ্ট্য লিখুন।
২. সাধুরীতি ও চলতিরীতির পার্থক্য লিখুন।
৩. সাধুরীতি থেকে চলতিরীতিতে রূপান্তর করুন।
ক. মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর মূঢ়তা এবং ততোধিক একগুঁয়েমির কথা বলিয়া দিলেন। বাবা হৈমকে ডাকিয়া
বলিলেন, “আইবড় মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটিয়া বেড়াইতে হইবে?
আমাদের এখানে এসব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি।”
খ. স্বচ্ছন্দে ভিতরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরের দরজা খোলা, বেশ উজ্¦ল একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর ঠিক সুমুখেই তক্তপোষের
উপর পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে। তাহার কঙ্কালসার দেহের প্রতি চাহিলেই বুঝা যায়, বাস্তবিক
যমরাজ চেষ্টার ত্রæটি কিছু করেন নাই।
গ. সাধুরীতি : দিন কাটিয়া যায়। জীবন অতিবাহিত হয়। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়, পদ্মার ভাঙন-ধরা তীরে মাটি ধসিতে
থাকে, পদ্মার বুকে জল ভেদ করিয়া জাগিয়া উঠে চর, অর্ধ শতাব্দীর বিস্তীর্ণ চর পদ্মার জলে আবার বিলীন হইয়া যায়।
জেলেপাড়ার ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দন কোনদিন বন্ধ হয় না। ক্ষুধা-তৃষ্ণার দেবতা, হাসি-কান্নার দেবতা, অন্ধকার
আত্মার দেবতা, ইহাদের পূজা কোনদিন সাঙ্গ হয় না।
৪. চলতিরীতি থেকে সাধুরীতিতে রূপান্তর করুন।
ক. কাক-ডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতাম আমরা। তপু উঠত সবার আগে। ও জাগাতো আমাদের দুজনকে। ওঠো,
ভোর হয়ে গেছে দেখছ না? অমন মোষের মতো ঘুমোচ্ছ কেন, ওঠো। গায়ের ওপর থেকে লেপটা টেনে ফেলে দিয়ে
জোর করে আামদের ঘুম ভাঙাতো তপু। মাথার কাছের জানালা খুলে দিয়ে বলতো, দেখো বাইরে কেমন মিষ্টি রোদ
উঠেছে। আর ঘুমিয়ো না, ওঠো।
খ. চলতিরীতি : কাব্যরস নামক অমৃতে যে আমাদের অরুচি জন্মেছে, তার জন্য দায়ী এ যুগের স্কুল এবং তার মাষ্টার।
কাব্য পড়বার ও বোঝবার জিনিস, কিন্তু স্কুল মাস্টারের কাজ হচ্ছে বই পড়ানো ও বোঝানো। লেখক এবং পাঠকের
মধ্যে এখন স্কুল মাস্টার দÐায়মান। এই মধ্যস্থদের কৃপায় আমাদের সঙ্গে কবির মনের মিলন দূরে থাক, চার চক্ষুর
মিলনও ঘটে না।
গ. চলতিরীতি : আস্তে চুপি চুপি তারা কথা কয়, আহ্লাদির ঘুম না ভাঙে। অতি সপ্তর্পণে তারা বিছানা ছেড়ে ওঠে।
আহ্লাদির বাপের আমলের গোরটা নেই, গামলাটা আছে। ঘড়া থেকে জল ঢেলে মোটা কাঁথা আর পুরনো ছেঁড়া একটা
কম্বল চুবিয়ে রাখে, চালায় আগুন ধরে উঠতে উঠতে গোড়ায় চাপা দিয়ে নেভানো যাতে সহজ হয়।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ