মাানুষ যখন কথা বলে তখন আসলে সে অনেকগুলো ধ্বনি উচ্চারণ করে। বাংলা
প্রতিশব্দ হচ্ছে ধ্বনি। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ রাখতে হলে তার প্রধান উপায় কথা বলা, আওয়াজ
করা। যে কোনো ভাষার উচ্চারিত যে কোনো আওয়াজকে সাধারণত ধ্বনি বলা হয়। অর্থ প্রকাশ করে এমন
ধ্বনিগুলোই মানুষের বিভিন্ন ভাষার বাগ্ধ্বনি। মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বা কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত আওয়াজকেই ধ্বনি বলা হয়।
বর্ণ
ধ্বনি মুখে উচ্চারিত হয় আর বর্ণ তারই লিখিত প্রতীক। ধ্বনিকে লিখে বোঝাতে যে চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাকে বর্ণ
বলে। যেমন Ñ ‘অ’ ধ্বনির প্রতীক হলো অÑবর্ণ, ‘আ’ ধ্বনির প্রতীক আÑবর্ণ।
ধ্বনির প্রকার ভেদ
ধ্বনি দু-প্রকার Ñ স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি।
স্বরধ্বনি : যেসব ধ্বনি উচ্চারণে মুখবিবরে, জিহŸায় বা ঠোঁটে কোনো প্রকার শ্রæতিগ্রাহ্য বাধা সৃষ্টি হয় না সেগুলোকে
স্বরধ্বনি বলা হয়। অর্থাৎ জিহŸা বা ঠোঁটের সঙ্গে কোনোরূপ স্পর্শ ছাড়া ঘোষবৎ বা গম্ভীর হয়ে উচ্চারিত হয় এই স্বরধ্বনি।
ব্যঞ্জনধ্বনি : যেসব ধ্বনি স্বরধ্বনি নয় সেগুলোকে সাধারণভাবে ব্যঞ্জনধ্বনি বলা যেতে পারে। ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে
মুখবিবরে বা ঠোঁটে জিহŸার সাহায্যে বাধার সৃষ্টি হয়।
ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়া
প্রতিদিন মানুষ যখন কথা বলে তখন আসলে সে কতকগুলো ধ্বনি উচ্চারণ করে। অর্থবোধক ধ্বনিসমষ্টি হলো ভাষা।
ভাষারও পরিবর্তন ঘটে থাকে। ভাষার পরিবর্তন বলতে ধ্বনির পরিবর্তনকে বোঝায়। ভাষার ধ্বনিগুলো নানাভাবে প্রভাবিত
হয়ে থাকে। একটি ধ্বনির প্রভাবে আরেকটি ধ্বনি পরিবর্তিত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দুই ধ্বনির মাঝামাঝি আরেকটি
নতুন ধ্বনি এসে যায়। প্রত্যেকের উচ্চারণ অবিকল একই রকম হয় না এবং একই ব্যক্তি সবসময় একইভাবে উচ্চারণ করে
না। আমরা অনেক শব্দের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের উচ্চারণ করে থাকি। বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের মূলে শরীরী কারণ থাকতে
পারে, থাকতে পারে সামাজিক কারণ। শ্রান্ত-ক্লান্ত থাকলে কিংবা স্বরযন্ত্রের কারণেও অনেক সময় উচ্চারণ অন্য রকম হয়।
পরিবেশগত কারণে মানুষের উচ্চারণভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ফলে শিষ্ট ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার পার্থক্য
তৈরি হয়ে থাকে। বাংলা একটি চলমান জীবন্তভাষা, ধ্বনিপরিবর্তনের কারণে এই ভাষারও পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই
ভাষার ধ্বনিপরিবর্তনের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যাক :
১) স্বরাগম
শব্দের প্রথমে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য ওই ব্যঞ্জনের আগে ই, উ বা আ স্বর যোগ করাকে স্বরাগম
বলা হয়।
যেমন:
ইস্কুল [ ই+স্কুল], স্টিশন [ ই+ স্টেশন]
ইস্তিরি [ ই+স্তিরি], ইস্টিমার [ ই+স্টিমার]
২) স্বরসঙ্গতি
শব্দের ভিতরে বিদ্যমান স্বরধ্বনিগুলো যখন পরস্পরের প্রভাবে সমরূপ ধারণ করে কিংবা পরস্পর মিল বা সংগতি লাভ
করতে চায় তখন তাকে স্বরসঙ্গতি বলা হয়।
যেমন:
বিলাতি > বিলিতি, দেশি > দিশি
কুড়াল > কুড়–ল, মিছা >মিছে
সুবিধা >সুবিধে, পূজা > পুজো, তখনি >তখুনি, এখনি > এখুনি
চিরনি >চিরুনি, ধূলা > ধুলো, শুনা >শোনা, হিসাব >হিসেব, ভিক্ষা >ভিক্ষে
৩) স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ
কঠিন শব্দে কোমলতা আনার জন্য এবং উচ্চারণকে সহজ করার জন্য সংযুক্ত ব্যঞ্জনকে ভেঙে তার মধ্যে স্বরধ্বনি অ, ই, এ,
ও, উ ইত্যাদি যোগ করাকে স্বরভক্তি বা বিপ্রকর্ষ বলে। যেমনÑ
অ স্বরধ্বনি যোগে : যতœ > যতন
একইভাবে রতœ > রতন, বর্ষ > বরষ, জন্ম > জনম, কর্ম > করম, পূর্ব > পুরব, স্বপ্ন > স্বপন, ত্রাস >তরাস, প্রাণ >
পরান, মর্দ >মরদ, ভক্তি >ভকতি,
ই স্বরধ্বনি যোগে: প্রীতি >পিরিতি,
শ্রী >ছিরি, ফিল্ম > ফিলিম; বর্ষা >বরিষা ¤øান >সিনান, চিত্র > চিত্তির
এ স্বরধ্বনি যোগে : গ্রাম >গেরাম
এইভাবে ট্রাম > টেরাম, গøাস >গেলাস, শ্রাদ্ধ > ছেরাদ্দ, সির্ফ >সেরেফ
উ স্বরধ্বনি যোগে : মুক্তা >মুকুতা
এইভাবে রাজপুত্র > রাজপুত্তুর, শূদ্র >শুদ্দুর, মুল্ক > মুলুক, শুক্রবার > শুক্কুরবার, > বুলু, ফ্লুট > ফুলুট, সূর্য >সুরুজ
ও স্বরধ্বনি যোগে : শ্লোক > শোলোক
একইভাবে মুর্গ >মোরগ
৪) ধ্বনি বিপর্যয়
উচ্চারণের সময় শব্দস্থিত বা শব্দের মধ্যবর্তী ধ্বনির স্থান পরিবর্তন ঘটলে তাকে ধ্বনি বিপর্যয় বলা হয়।
যেমন : রিক্শা >রিশ্কা, বাক্স >বাস্ক, পিশাচ > পিচাশ, লাফ >ফাল, মুকুট > মুটুক, হ্রদ >হদ>দহ
৫) অপিনিহিতি
শব্দের মধ্যে ‘ই’ বা ‘উ’ থাকলে সেই ‘ই’ বা ‘উ কে আগেই উচ্চারণ করে ফেলার রীতিকে অপিনিহিতি বলা হয়। যেমন
বসিয়া > বইসা
একইভাবে
করিয়া > কইর্যা কালই > কাইল
আজি >আইজ রাতি > রাইত
রাখিয়া > রাইখ্যা করিয়া > কইর্যা
বাদিয়া > বাইদ্যা করিয়াছি > কইর্যাছি
ঐঝঈ-২৮৫১ ব্যাকরণ-২৬
হাসিয়া > হাইস্যা ধরিয়া >ধইর্যা
গাঁতি > গাঁইতি কাঁচি > কাঁইচি
জলুয়া > জউলা সাধু >সাউধ
মাছুয়া >মাউছুয়া গাছুয়া > গাউছা
৬) অভিশ্রæতি
অপিনিহিতির ‘ই’ বা ‘উ’ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সঙ্গে মিলিত হয়ে যখন তার রূপ পরিবর্তন করে দেয় তাকে অভিশ্রæতি বলে।
যেমনÑ
করিয়া > কইরা > করে
হাসিয়া > হাইস্যা >হেসে
মারিয়া > মাইর্যা > মেরে
জলুয়া > জউলুআ > জইলুআ > জলো > জোলো
আজি > আইজ > আজ
রাতি > রাইত > রাত
ধরিয়া > ধইর্যা > ধরে
অভিশ্রæতি অপিনিহিতির নির্ভরশীল, অপিনিহিতি ছাড়া অভিশ্রæতি হয় না। বাংলা চলিত ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য হলো
অভিশ্রæতি।
৭) সমীভবন বা সমীকরণ
শব্দের মধ্যে ভিন্ন দুটি ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য যখন ধ্বনি দুটি একই ধ্বনিতে পরিণত হয় তাকে
সমীভবন বা সমীকরণ বলা হয়। যেমনÑ
পদ্ম > পদ্দ ধর্ম্ম > ধম্ম
জন্ম > জম্ম গল্প > গপ্প
কর্তা > কত্তা তর্ক >তক্ক
মূর্খ > মুখ্খু কাঁদ্না > কান্না
৮) বিষমীভবন
শব্দের মধ্যে দুটি একজাতীয় ব্যঞ্জনধ্বনির একটির পরিবর্তন ঘটলে তাকে বিষমীভবন বলে। সমীভবনের ঠিক বিপরীত
বিষয় বিষমীভবন। যেমন: শরীর > শরীল, লাল > নাল, লাঙ্গল > নাঙ্গল
৯) ধ্বনিবিলোপ
উচ্চারণের সময় দুটি একজাতীয় ধ্বনির একটির লোপ হলে তাকে ধ্বনিবিলোপ বা বর্ণবিচ্যুতি বলে।
যেমন : বড়দাদা > বড়দা, ছোটদিদি > ছোড়দি, বউদিদি > বউদি, ঠাকুরদাদা > ঠাকুরদা, ছোটদাদা > ছোট্দা
১০) ধ্বনিদ্বিত্ব
কোনো শব্দের ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়ার জন্য সেই শব্দের কোনো ধ্বনি দু-বার উচ্চারণ করা হলে তাকে ধ্বনিদ্বিত্ব
বলে।
যেমন : ছোট >ছোট্ট, বড় >বড্ড, সকাল >সক্কাল, পাকা > পাক্কা
১১) ধ্বনিবিকৃতি
শব্দের মধ্যকার কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপ ধারণ করলে তাকে বলা হয় ধ্বনিবিকৃতি। যেমন:
ধাইমা> দাইমা, ধোবা > ধোপা
১২ ) স্বরলোপ
উচ্চারণের সুবিধার জন্য শব্দের স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত স্বরধ্বনির লোপ পাওয়াকে স্বরলোপ বলা হয়।
যেমন: উধার > ধার (উ স্বরধ্বনির লোপ), বড় দাদা > বড়দা (ড়Ñএর সঙ্গে যুক্ত অ স্বরধ্বনির লোপ)
১৩ ) অন্তর্হতি
শব্দের মধ্যস্থ কোনো স্বরহীন বা স্বরযুক্ত ব্যঞ্জনের লোপ ঘটলে তাকে অন্তর্হতি বলা হয়। যেমন:
পূর্ব > পুব র্( এর বিলোপ); ফাল্গুন > ফাগুন ( ল্ এর বিলোপ)
একইভাবে নারিকেল > নারকেল, ফলাহার > ফলার, নাতিনী >নাত্নি, অতসী > তিসি, অতিথি > অতিথ্
১৪) ‘য়’Ñশ্রæতি ও ‘ব’Ñশ্রæতি
শব্দের মধ্যে পাশাপাশি দুটি স্বরধ্বনি থাকলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য সেই দুটি স্বরের মধ্যে ‘য়’ ধ্বনি অথবা অন্তস্থ বধ্বনি অর্থাৎ ‘ওয়’, ‘ও’ ধ্বনির আগমন ঘটে, এদের য়Ñশ্রæতি ও অন্তস্থ বÑশ্রæতি বলা হয়।
য় Ñশ্রæতি
যেমন: বউএর > বউয়ের, দুইএর > দুইয়ের
বÑ শ্রæতি [অন্তস্থ ‘ব’ এর উচ্চারণ ‘ওয়া’ দ্বারা নির্দেশ করা সম্ভব।]
খা+ আ> খাওয়া [খা+ও+আ]
যা+ আ > [যা+ও+আ]
তেমনভাবে
খোআ > খোওয়া, নাহা > নাআ> নাওয়া
১৫) হÑকার লোপ
কথ্য বাংলায় ‘হ’ এরও লোপ হয়।
যেমন : কহে > কয়; চাহ > চাও; আলাহিদা > আলাদা ফলাহার > ফলার
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
এখানে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। পাঠটি ভালো করে পড়ে আপনি প্রশ্নগুলোর উত্তর নিজে লিখুন।
১। ধ্বনি কাকে বলে ? ধ্বনির প্রকারভেদ উল্লেখ করুন ? কী কী কারণে সাধারণত ধ্বনির পরিবর্তন হয় ?
২। স্বরাগম ও স্বরসঙ্গতি কাকে বলে ? চারটি করে উদাহরণ দিন।
৩। স্বরভক্তি কাকে বলে ? স্বরভক্তির পাঁচটি উদাহরণ দিন।
৪। অপিনিহিতি বলতে কী বোঝায় ? অপিনিহিতির সঙ্গে অভিশ্রæতির সম্পর্ক নির্ণয় করুন এবং অপিনিহিতি থেকে
অভিশ্রæতি হওয়ার পাঁচটি উদাহরণ দিন।
৫। উদাহরণসহ সংজ্ঞার্থ লিখুন :
বর্ণবিচ্যুতি, সমীভবন, বর্ণদ্বিত্ব, স্বরলোপ, বিষমীভবন, বর্ণবিকৃতি
৬। নিম্নলিখিত ধ্বনি পরিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর নাম লিখুন :
ক) বিলাতি > বিলিতি
খ) যতœ > যতন
গ) বাক্স >বাস্ক
ঘ) বসিয়া > বইসা
ঙ) করিয়া > কইরা > করে
চ) পদ্ম > পদ্দ
ছ) শরীর > শরীল
জ) বড়দাদা > বড়দা
ঝ) ধাইমা> দাইমা
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ