সমাস ও সমাসের সাহায্যে শব্দ গঠন
বাংলা ভাষায় সমাস মূলত একধরনের যৌগিকীকরণ। অর্থাৎ, এর সাহায্যে একাধিক শব্দ মিলিত হয়ে যৌগিক শব্দ তৈরি
হয়। বলা চলে যে, বাগর্থগত সম্বন্ধ আছে এমন একাধিক শব্দের এক শব্দে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াই হলো সমাস। এর
সাহায্যে ভাষাকে সংহত ও সংক্ষেপিত করা সম্ভব হয়। ভাষার ব্যবহারিক মাধুর্য বৃদ্ধি পায়। সমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু
পরিভাষা হলো ব্যাসবাক্য, সমস্তপদ, সমস্যমান পদ, পূর্বপদ এবং পরপদ। নিচে এগুলোর পরিচয় তুলে ধরা হলো।
ব্যাসবাক্য: সমাসবদ্ধ শব্দের বিস্তারিত রূপই হলো ব্যাসবাক্য। একে বিগ্রহবাক্যও বলা হয়। ব্যাসবাক্যেই মূলত সমাস
নির্ণয়ের সূত্রসমূহ নির্দেশিত থাকে।
সমস্ত পদ: ব্যাসবাক্যের সাহায্যে যৌগিকীকরণের মাধ্যমে যে সংহত নতুন শব্দ তৈরি হয়, তাকে বলা হয় সমস্ত পদ।
সমস্যমান পদ: যে উপাদানগুলোর আশ্রয়ে সমস্ত পদ গঠিত হয় তাদের সমস্যমান পদ বলে। এই সমস্যমান পদগুলোই
সমাস প্রক্রিয়া সম্পাদন করে।
পূর্বপদ : সমস্ত পদের প্রথম পদকে পূর্বপদ বলে।
পরপদ: সমস্ত পদের শেষ অংশকে পরপদ বলা হয়। একে উত্তরপদ বলেও অভিহিত করা হয়।
নিচের একটি উদাহরণ এই পরিভাষাসমূহের পরিচয় তুলে ধরতে সক্ষম। ‘বিদ্যালয়’ একটি সমাসবদ্ধ শব্দ। অর্থাৎ, এই
সমাসের সমস্তপদটি হলো ‘বিদ্যালয়’; আর এর ব্যাসবাক্য হলো : ‘বিদ্যার আলয়’। এখানে সমস্যমান পদগুলো হলো :
বিদ্যা, আলয় এবং ষষ্ঠী বিভক্তি ‘র’। এই সমাসের পূর্বপদ হলো বিদ্যা এবং পরপদ হলো আলয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে,
সমাস হলো শব্দগঠনের প্রক্রিয়া। আর তাই একই শব্দ কখনও কখনও একাধিক প্রক্রিয়ায় সমাসনিষ্পন্ন হতে পারে। এ
কারণে ব্যাসবাক্য অনুসারেই সমাস নির্ণয়ের প্রয়োজন হয়। বাংলা ভাষায় প্রধাণত ছয় প্রকারের সমাস রয়েছে। এগুলো
হলো : দ্ব›দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, দ্বিগু ও অব্যয়ীভাব। এছাড়া কিছু অপ্রধান সমাসও রয়েছে। যেমন : প্রাদি, নিত্য,
সুপসুপা প্রভৃতি। পূর্বপদ কিংবা পরপদের প্রাধান্যের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত সমাস নির্ণয় করা হয়ে থাকে। নিচে এর
একটি তালিকা প্রদান করা যেতে পারে :
পূর্বপদের প্রাধান্য পরপদের প্রাধান্য সমাসের নাম
আছে আছে দ্ব›দ্ব (সমান প্রাধান্য)
নেই আছে কর্মধারয়, তৎপুরুষ, দ্বিগু
আছে নেই অব্যয়ীভাব
নেই নেই বহুব্রীহি (ভিন্ন কোনোকিছুর প্রাধান্য)
নিচে বিভিন্ন প্রকার সমাসের বর্ণনা ও উদাহরণ উপস্থাপিত হলো।
দ্ব›দ্ব সমাস : এতে পূর্বপদ ও পরপদের সমান প্রাধান্য থাকে। ব্যাসবাক্যে সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার ঘটে থাকে। যেমনমা ও বাপ = মা-বাপ। এখানে পূর্বপদ ‘মা’ ও পরপদ ‘বাপ’। ব্যাসবাক্যে ‘মা’ ও ‘বাপ’ দুইজনকেই সমান প্রাধান্য দেয়া
হয়েছে, এবং দুজনকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, পূর্বপদ ও পরপদ, উভয়েরই অর্থের প্রাধান্য রক্ষিত হয়েছে।
ঐঝঈ-২৮৫১ ব্যাকরণ-৭৪
কর্মধারয় সমাস: কর্মধারয় সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। মূলত, এই সমাসে বিশেষণ বা বিশেষণ ভাবাপন্ন পদ
পূর্বপদ ও বিশেষ্য বা বিশেষ্য ভাবাপন্ন পদ পরপদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর ব্যাসবাক্যটিতে ওই বিশেষ্য বা বিশেষ্য
ভাবাপন্ন পদটি সম্পর্কে কিছু বলা হয়। অর্থাৎ পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। যেমন- নীল যে আকাশ = নীলাকাশ। এখানে,
পূর্বপদ ‘নীল’ বিশেষণ ও পরপদ ‘আকাশ’ বিশেষ্য। ব্যাসবাক্যে ‘আকাশ’ সম্পর্কে বলা হয়েছে আকাশ ‘নীল’ রঙের।
অর্থাৎ, ‘আকাশ’ বা পরপদের অর্থই এখানে প্রধান। কর্মধারয় সমাসের কয়েকটি বিশেষ নিয়ম নিচে উল্লেখিত হলো:
দুইটি বিশেষণ একই বিশেষ্য বোঝালে সেটি কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন, যে চালাক সেই চতুর = চালাক-চতুর।
এখানে পরবর্তী বিশেষ্যটি অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে এটি দ্ব›দ্ব সমাস হবে না।
দুইটি বিশেষ্য একই ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝালে সেটিও কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন: যিনি জজ তিনি সাহেব =
জজসাহেব।
কার্যপরপম্পরা বোঝাতে দুটি কৃদন্ত বিশেষণ বা ক্রিয়াবাচক বিশেষণ পদেও কর্মধারয় সমাস হয়। যেমন: আগে ধোয়া
পরে মোছা = ধোয়ামোছা। এখানে ‘মোছা’ কাজটি অধিকতর গুরুত্বপ্রাপ্ত।
পূর্বপদে নারীবাচক বিশেষণ থাকলে তা পুরুষবাচক হয়ে যাবে। যেমন : সুন্দরী যে লতা = সুন্দরলতা
বিশেষণবাচক মহান বা মহৎ শব্দ পূর্বপদ হলে মহা হয়। যেমন: মহৎ যে জ্ঞান = মহাজ্ঞান
পূর্বপদে ‘কু’ বিশেষণ থাকলে এবং পরপদের প্রথমে স্বরধ্বনি থাকলে ‘কু’, ‘কৎ’ হয়। যেমন : কু যে অর্থ = কদর্থ।
পরপদে ‘রাজা’ থাকলে ‘রাজ’ হয়। যেমন: মহান যে রাজা = মহারাজ।
বিশেষণ ও বিশেষ্য পদে কর্মধারয় সমাস হলে কখনো কখনো বিশেষ্য আগে এসে বিশেষণ পরে চলে যায়। যেমন:
সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ।
কর্মধারয় সমাসকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদগুলো
লোপ পায়। যেমন : ‘স্মৃতি রক্ষার্থে সৌধ = স্মৃতিসৌধ’। এখানে ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তী পদ ‘রক্ষার্থে’ লোপ পেয়েছে।
উপমান এবং উপমিত কর্মধারয় সমাস নির্ধারণ করা হয় উপমান, উপমেয় ও সাধারণ ধর্মের তুলনামূলক বিশেষত্বের ওপর।
উল্লেখ্য যে, যাকে তুলনা করা হয়, তাকে বলা হয় উপমেয়; আর যার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে বলে উপমান। অপরদিকে,
উপমেয় এবং উপমানের যে গুণের ওপর ভিত্তি করে এই তুলনার কাজটি সম্পাদিত হয় তাকে বলা হয় সাধারণ ধর্ম। যেমন,
তুষারধবল শব্দটির ব্যাসবাক্য হলো তুষারের ন্যয় ধবল। এখানে ‘তুষার’ হলো উপমান এবং যার সঙ্গে তুষারের তুলনা করা
হয়েছে তা হলো উপমেয়। আর উপমান এবং উপমেয়র মধ্যে সাদৃশ্য তৈরি করেছে ‘ধবল’ বিশেষণ, যা এই সমাসের
সাধারণ ধর্ম। এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, উপমান কর্মধারয় সমাসে সাধারণ ধর্মবাচক পদের সঙ্গে উপমান পদের সমাস
হয়। অর্থাৎ, এই সমাসে সাধারণ ধর্মবাচক পদের উল্লেখ থাকবে। অপরদিকে, উপমিত কর্মধারয় সমাসে উপমেয় ও
উপমান পদের মধ্যে সমাস হয়। এতে সাধারণ ধর্মের উল্লেখ থাকে না। যেমন: ‘পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ’।
এখানে উপমেয় ‘পুরুষ’কে উপমান ‘সিংহ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু সিংহের কোন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পুরুষের সাদৃশ্য
রয়েছে তা-র উল্লেখ থাকে না। অপরদিকে, রূপক কর্মধারয় সমাসে উপমান ও উপমেয় পদের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয়
এবং ব্যাসবাক্যে ‘রূপ’ শব্দটি থাকে। যেমন: ‘ভব রূপ নদী = ভবনদী’। এখানে ‘ভব’ উপমেয় ও ‘নদী’ উপমান।
কিন্তু এখানে সাদৃশ্য নয়, অভেদ কল্পনাকে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, এখানে ভব তথা পৃথিবীকেই নদীর সঙ্গে একীভ‚ত
রূপে বিবেচনা করা হয়েছে।
তৎপুরুষ সমাস : পূর্বপদের শেষের বিভক্তি লোপ পায় এই সমাসে এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়। পূর্বপদের যে বিভক্তি
লোপ পায়, সেই বিভক্তি অনুযায়ী তৎপুরুষ সমাসের নামকরণ করা হয়। পূর্বপদে কোনো বিভক্তি লোপ না পেলে তাকে
অলুক তৎপুরুষ সমাস বলা হয়। তবে, সাধারণত তৎপুরুষ সমাসে বিভক্তি লোপ পায়। যেমন, দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত।
এখানে পূর্বপদ ‘দুঃখ’-এর সঙ্গে থাকা দ্বিতীয়া বিভক্তি ‘কে’ লোপ পেয়েছে। আবার পরপদ ‘প্রাপ্ত’-এর অর্থই বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বপদে বিভক্তি লোপ এবং পরপদের অর্থের প্রাধান্য তৎপুরুষ সমাসের বৈশিষ্ট্য।
বহুব্রীহি সমাস: পূর্বপদ বা পরপদের পরিবর্তে এই সমাসে ভিন্ন অনুল্লিখিত কোনো কিছুকে এই সমাসে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
যেমন : ‘গায়ে হলুদ’ একটি বহুব্রীহি সমাস। এর ব্যাসবাক্য হলো : ‘গায়ে হলুদ দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে’। লক্ষণীয় যে,
এতে কারও শরীরে হলুদ মাখানোকে বোঝানো হয়নি বরং এর বাইরে বিবাহের একটি অনুষ্ঠানকে বোঝানো হয়েছে। বিভিন্ন
ধরনের বহুব্রীহি সমাস হয়ে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে : সমানাধিকরণ বহুব্রীহি, ব্যধিকরণ বহুব্রীহি, ব্যাতিহার বহুব্রীহি
প্রভৃতি।
দ্বিগু সমাস: এই সমাসেও পরপদের অর্থই প্রধান। এতে বিশেষণ পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের সমাস হয়। তবে এখানে
বিশেষণ পদটি সর্বদাই সংখ্যাবাচক হয়। যেমন : ‘পঞ্চবটী’। এর ব্যাসবাক্য হলো : ‘পঞ্চ বটের সমাহার’। এ ধরনের
কাঠামোতেই অর্থাৎ পূর্বপদে সংখ্যাবাচক শব্দ এবং পরপদে ‘সমাহার’ শব্দবন্ধ রক্ষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সমাসের
ব্যাসবাক্য গঠিত হয়। একই সঙ্গে এই সমাসে পরপদের অর্থ প্রধান হিসেবে দেখা দেয়।
অব্যয়ীভাব সমাস : পূর্বপদে অব্যয় বাচক শব্দ এবং তার অর্থই প্রাধান্য পায় এই সমাসে। যেমন, ‘মরণ পর্যন্ত = আমরণ’।
এখানে পূর্বপদ হিসেবে পর্যন্ত অর্থে ‘আ’ উপসর্গ ব্যবহৃত হয়েছে। আর পরপদ ‘মরণ’। কিন্তু এখানে সমস্ত পদটিকে নতুন
অর্থ দিয়েছে ‘আ’ উপসর্গটি। অর্থাৎ, এখানে ‘আ’ উপসর্গ বা অব্যয় বা পূর্বপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এটি
অব্যয়ীভাব সমাস।
প্রাদি সমাস : প্র, প্রতি, অনু, পরি, ইত্যাদি অব্যয় বা উপসর্গের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্য বা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের
সমাস হয়। যেমন : প্র (প্রকৃষ্ট) যে বচন = প্রবচন। এখানে ‘বচন’ সমস্যমান পদটি একটি বিশেষ্য, যার মূল বচ্ ধাতু।
‘প্র’ অব্যয়ের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় সাধিত বিশেষ্য ‘বচন’-এর সমাস হয়ে সমস্ত পদ ‘প্রবচন’ শব্দটি তৈরি হয়েছে।
নিত্য সমাস : এই সমাসের সমস্তপদই ব্যাসবাক্যের কাজ করে। অর্থাৎ, এরা নিত্য সমাসবদ্ধ থাকে। যেমন : অন্যগ্রাম =
গ্রামান্তর। এখানে ‘অন্য গ্রাম’ আর ‘গ্রামান্তর’, এই বাক্যাংশ ও শব্দটি উভয়েই প্রায় অভিন্ন। অর্থাৎ, সমস্তপদ এবং
ব্যাসবাক্য প্রায় অভিন্ন। কেবল ‘অন্য’ শব্দের বদলে ‘অন্তর’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তাই এটি নিত্য সমাস।
দ্বিরুক্তি ও পরিভাষিক শব্দ
দ্বিরুক্তি
বাংলা ভাষায় কখনও কখনও একই শব্দের একাধিকবার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে অর্থের সংকোচন, প্রসারণ, পরিবর্তন ঘটে
থাকে। এগুলোকে সাধারণভাবে ‘দ্বিরুক্তি’ (অর্থাৎ দুইবার উক্ত হয়েছে এমন) নামে আখ্যা দেওয়া হয়। বাংলা ভাষায়
অনেক শব্দ কিংবা বাক্যে ব্যবহৃত পদ, এমনকি অনুকার ধ্বনিও একাধিকবার ব্যবহৃত হয়ে বিশেষ বাগর্থ তাৎপর্য সৃষ্টি
করতে সক্ষম। যেমন- ‘তুমি মাঝে মাঝে বেড়াতে এসো।’ বাক্যটি যে বক্তব্য প্রকাশ করছে, যদি একবার ‘মাঝে’ ব্যবহৃত
হতো তাহলে তা প্রকাশিত হতো না। দ্বিরুক্তি তিন প্রকারের : শব্দের দ্বিরুক্তি, পদের দ্বিরুক্তি ও অনুকার দ্বিরুক্তি।
শব্দের দ্বিরুক্তি: একই শব্দ অভিন্নভাবে পরপর দুইবার ব্যবহৃত হয়ে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠন করতে পারে। যেমন- ভাল ভাল বই,
ফোঁটা ফোঁটা জল, বড় বড় বাড়ি, ইত্যাদি। ধ্বনিগত সাদৃশ্য ও সম্পর্ক আছে এমন শব্দ জোড় তৈরি করে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠিত
হতে পারে। যেমন : কাপড়-চোপড়, লালন-পালন, খোঁজ-খবর প্রভৃতি। কখনও কখনও একই শব্দ অভিন্নভাবে দুইবার
ব্যবহৃত না হয়ে এদের কোনো একটি সামান্য ধ্বনিগত পরিবর্তন সহযোগে উচ্চারিত হয়। যেমন : মিট-মাট, ফিট-ফাট,
বকা-ঝকা, তোড়-জোড়, গল্প-সল্প, রকম-সকম প্রভৃতি। এছাড়া সমার্থক শব্দযোগে দ্বিরুক্তি হতে পারে। যেমন : ধন-
দৌলত, বলা-কওয়া, টাকা-পয়সা। আবার বিপরীতার্থক শব্দযোগেও দ্বিরুক্তি ঘটতে পারে। যেমন- লেন-দেন, দেনা-পাওনা,
ধনী-গরিব, আসা-যাওয়া প্রভৃতি।
পদের দ্বিরুক্তি : বাক্যস্থিত বিভিন্ন পদ কখনও কখনও দুইবার ব্যবহৃত হয়ে অর্থের পরিবর্ধন ঘটিয়ে থাকে। পদের দ্বিরুক্তির
বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এতে বিভক্তি চিহ্ন থাকে এবং ওই বিভক্তি চিহ্নেরও দ্বিরুক্তি ঘটে। এক্ষেত্রে, একই পদ অভিন্নভাবে
পরপর দুইবার ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন : ঘরে ঘরে লেখাপড়া হচ্ছে। দেশে দেশে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। মনে মনে
আমিও এ কথাই ভাবছিলাম প্রভৃতি। দুটি পদ সম্পূর্ণ এক না থেকে কখনও দ্বিতীয় পদে সামান্য পরিবর্তন ঘটেও ব্যবহৃত
হতে পারে, যদিও সেক্ষেত্রে বিভক্তি চিহ্ন অবশ্যই অপরিবর্তিত থাকবে। যেমন : আমরা হাতে-নাতে চোরটাকে ধরেছি।
এছাড়া, ধ্বনিগত সাদৃশ্যপূর্ণ শব্দ কিংবা সমার্থক বা বিপরীতার্থক শব্দে একই বিভক্তি যুক্ত হয়ে এবং পরপর ব্যবহৃত হয়ে
পদের দ্বিরুক্তি ঘটতে পারে। যেমন : আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। দেশে বিদেশে বইটি লিখেছেন সৈয়দ মুজতবা
আলী, আর পথে-প্রবাসে লিখেছেন মুহম্মদ এনামুল হক। পদগত দ্বিরুক্তির কিছু উদাহরণ নি¤œরূপ :
আধিক্য বোঝাতে : রাশি রাশি ধন, ধামা ধামা ধান, ভাল ভাল আম, ছোট ছোট ডাল।
সামান্য বোঝাতে : আমার জ্বর জ্বর লাগছে, কবি কবি ভাব, উড়ু উড়ু ভাব।
পরস্পরতা বা ধারাবাহিকতা বোঝাতে : তুমি দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছ।
ক্রিয়া বিশেষণ : ধীরে ধীরে যায়, ফিরে ফিরে চায়।
অনুরূপ কিছু বোঝাতে : তার সঙ্গী সাথি কেউ নেই।
আগ্রহ বোঝাতে : ও দাদা দাদা বলে ডাকছে।
তীব্রতা বোঝাতে : গরম গরম জিলাপি। নরম নরম হাত।
সর্বনামের বহুবচন বোঝাতে : সে সে লোক কোথায় গেল? কে কে এল? কেউ কেউ বলে।
ক্রিয়ার বিশেষণাত্মক ব্যবহার : রোগীর তো যায় যায় অবস্থা। তোমার নেই নেই ভাব আর গেল না।
স্বল্পকাল স্থায়ী বোঝাতে : দেখতে দেখতে আকাশ কালো হয়ে এল।
ক্রিয়া বিশেষণ : দেখে দেখে যাও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলে কীভাবে?
পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে : ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছি।
অনুকার দ্বিরুক্তি : কখনও কখনও আপাত অর্থপূর্ণ নয় কিন্তু কোনো বিশেষ কিছুর বৈশিষ্ট্য কিংবা আচরণকে ধ্বনিগত
সাদৃশ্যে প্রকাশ করে− এমন অব্যয় শব্দও পরপর ব্যবহৃত হয়ে দ্বিরুক্তি সৃষ্টি করতে পারে। এরূপ অনুকার অব্যয়ের
সাহায্যে সৃষ্ট কিছু দ্বিরুক্তির উদাহরণ নি¤œরূপ :
ভাবের গভীরতা বোঝাতে : সবাই হায় হায় করতে লাগল। ছি ছি, তুমি এত খারাপ!
পৌনঃপুনিকতা বোঝাতে : বার বার সে কামান গর্জে উঠল।
অনুভূতি বা ভাব বোঝাতে : ভয়ে গা ছম ছম করছে। ফোঁড়াটা টন টন করছে।
বিশেষণ বোঝাতে : পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
ধ্বনিব্যঞ্জনা : ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর।
আরও কিছু অনুকার দ্বিরুক্তির উদাহরণ নিচে সন্নিবেশিত হলো :
বজ্রের ধ্বনি : কড় কড়
তুমুল বৃষ্টির শব্দ : ঝম ঝম
¯্রােতের ধ্বনি : কল কল
বাতাসের শব্দ : শন শন
নূপুরের আওয়াজ : রুম ঝুম
সিংহের গর্জন : গর গর
ঘোড়ার ডাক : চিঁহি চিঁহি
কোকিলের ডাক : কুহু কুহু
চুড়ির শব্দ : টুং টাং
পারিভাষিক শব্দ
জ্ঞানচর্চার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জ্ঞানশাখাভিত্তিক যোগাযোগের প্রয়োজনে এবং বাংলা ভাষায় সেই সংশ্লিষ্ট কোনো
যথোপযুক্ত শব্দ না থাকায় কখনও কখনও নতুন শব্দ তৈরি করে নিতে হয়। অন্য ভাষার শব্দের বাগর্থ, প্রয়োগ ও গঠনগত
সাদৃশ্যে সৃষ্ট এ সকল শব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলা হয়। এর কিছু উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো :
পারিভাষিক শব্দ মূল বিদেশি শব্দ পারিভাষিক শব্দ মূল বিদেশি শব্দ
অ¤øজান Oxygen সচিব Secretary
উদ্যান Hydrogen স্নাতক Graduate
নথি File স্নাতকোত্তর Post Graduate
প্রশিক্ষণ Training সমাপ্তি Final
ব্যবস্থাপক Manager সাময়িকী Periodical
বেতার Radio সমীকরণEquation
মহাব্যবস্থাপক General Manager Curriculum পাঠক্রম
পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টি করার চেয়ে তার প্রচলন নিশ্চিত করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কখনও কখনও দেখা যায় যে,
অন্য ভাষা থেকে আগত শব্দের পরিভাষা তৈরির পরও ওই শব্দটিই কৃতঋণ হিসেবে বেশি প্রচলিত হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে
শেষ পর্যন্ত পরিভাষাটিই ক্রমশ অপরিচিত হয়ে যায়। ওপরের উদাহরণে ঙীুমবহ-এর বাংলা পরিভাষা অ¤øজান করা হলেও
বর্তমানে অক্সিজেন হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত। আবার কম্পিউটার, ল্যাপটপ প্রভৃতি শব্দের তো বাংলা পরিভাষা তৈরির
কোনো উদ্যোগই গৃহীত হয়নি। সেলুলার ফোন বা মোবাইল ফোনের বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘মুঠোফোন’ সৃষ্টির চেষ্টা
গৃহীত হলেও তা যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহৃত হয় না। তাই বলা যায় যে, পারিভাষিক শব্দ তৈরিতে ভাষীদের আগ্রহ এবং
তাগিদ উভয়েরই বিশেষ ভ‚মিকা রয়েছে।
শব্দ প্রকরণ
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শ্রেণির শব্দ ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে প্রচলিত ব্যাকরণে পদ হিসেবে নির্দেশ করা হলেও মনে রাখা
প্রয়োজন যে, কোনো একটি শব্দ তখনই পদ হয়ে উঠতে পারে যদি তা বাক্যে ব্যবহৃত হয় এবং এই সূত্রে বিভক্তি যুক্ত হয়।
বাক্যে যখন শব্দ ব্যবহৃত হয়, তখন শব্দগুলোর মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য প্রতিটি শব্দের সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত শব্দাংশ যুক্ত
হয় যা বিভক্তি নামে পরিচিত। যেহেতু শূন্য বিভক্তি যোগের সুযোগ বিদ্যমান সেহেতু বলা যেতে পারে যে, বাক্যের সকল
শব্দই বিভক্তিযুক্ত। কিন্তু শব্দ যখন বাক্যের কাঠামোর বাইরে স্বাধীনভাবে থাকে তখন তাকে পদ বলে অভিহিত করার
কোনো সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, ‘শিশুটি হাসে’ বাক্যে ‘শিশুটি’ বিশেষ্য পদ কিন্তু বাক্যের কাঠামোর
বাইরে ‘শিশু’ কেবল বিশেষ্য শব্দ। কখনও কখনও শব্দ ও পদের গঠন অভিন্ন হতে পারে; যেমন : ‘ভালো’ একটি বিশেষণ
শব্দ, আবার ‘সমাজে ভালো মানুষের একান্ত প্রয়োজন’ বাক্যে ‘ভালো’ বিশেষণ পদ। এরা দেখতে অভিন্ন হলেও এদের
ব্যাকরণিক অবস্থান এক নয়। এ কারণে শব্দ প্রকরণের অংশ হিসেবেই বিভিন্ন শ্রেণির শব্দ সম্পর্কে আলোচনা করা
প্রয়োজন। এই সূত্রে বলা চলে যে, বাংলা ভাষায় পাঁচ শ্রেণির শব্দ রয়েছে। এগুলো হলো : বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম
অব্যয় ও ক্রিয়া।
বিশেষ্য : কোনো কিছুর নামকেই বিশেষ্য বলে। কোনো ব্যক্তি, বস্তু, প্রাণী, সমষ্টি, স্থান, কাল, ভাব, কর্ম, গুণ প্রভৃতির নাম
প্রকাশক শব্দই হলো বিশেষ্য। বিশেষ্য ছয় প্রকার। নিচে বিভিন্ন ধরনের বিশেষ্যের উদাহরণ দেওয়া হলো :
নামবাচক বিশেষ্য
(ক) ব্যাক্তির নাম : নজরুল, ওমর, আনিস, মাইকেল
(খ) ভৌগোলিক স্থানের নাম : ঢাকা, দিল্লি, লন্ডন, মক্কা
(গ) ভৌগোলিক নাম (নদী, পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদির নাম) : মেঘনা, হিমালয়, আরব সাগর
(ঘ) গ্রন্থের নাম : গীতাঞ্জলি, অগ্নিবীণা, দেশে বিদেশে, বিশ্বনবী
জাতিবাচক বিশেষ্য
(এক জাতীয় প্রাণী বা পদার্থের নাম) মানুষ, গরু, গাছ, পাখি, পর্বত, নদী, ইংরেজ
বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য
বই, খাতা, কলম, থালা, বাটি, মাটি, চাল, চিনি, লবণ, পানি
সমষ্টিবাচক বিশেষ্য (ব্যক্তি বা প্রাণীর সমষ্টি)
সভা, জনতা, পঞ্চায়েত, মাহফিল, ঝাঁক, বহর, দল
ভাববাচক বিশেষ্য
(ক্রিয়ার ভাব বা কাজের ভাব বা কাজের নাম বোঝায়) গমন, শয়ন, দর্শন, ভোজন. দেখা, শোনা, যাওয়া, শোয়া
গুণবাচক বিশেষ্য
মধুরতা, তারল্য, তিক্ততা, তারুণ্য, সৌরভ, স্বাস্থ্য, যৌবন, সুখ, দুঃখ
বিশেষণ :বিভিন্ন প্রকার শব্দের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ প্রভৃতি প্রকাশ করে বিশেষণ। বিশেষণের মূল কাজ হলো
বিশেষিত করা। বিশেষণ প্রধানত দুই প্রকার : নাম বিশেষণ ও ভাব বিশেষণ। নাম বিশেষণ কোনো বিশেষ্য বা সর্বনাম
শব্দকে এবং বাক্য-অন্তর্গত পদকে বিশেষিত করে; পক্ষান্তরে, ভাব বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনাম শব্দ ছাড়া অন্য যে কোনো
শব্দকে এবং বাক্য-অন্তর্গত পদকে বিশেষিত করে। নিচে বিভিন্ন ধরনের বিশেষণের উদাহরণ তুলে ধরা হলো :
বিশেষ্যের বিশেষণ : নীল আকাশ আর সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে একটি ছোট্ট পাখি উড়ে যাচ্ছে।
সর্বনামের বিশেষণ : সে রূপবান ও গুণবান।
ক্রিয়া বিশেষণ : ধীরে ধীরে বায়ু বয়। পরে একবার এসো।
বিশেষণের বিশেষণ (কোনো বিশেষণ যদি অন্য একটি বিশেষণকেও বিশেষিত করে, তাকে বিশেষণের বিশেষণ বলে।) :
ও অতি ভালো ছেলে। গাঢ়/টকটকে লাল গোলাপ।
নাম বিশেষণের বিশেষণ : সামান্য একটু দুধ দাও। এ ব্যাপারে সে অতিশয় দুঃখিত।
ক্রিয়া বিশেষণের বিশেষণ : রকেটি অতি দ্রæত চলে।
অব্যয়ের বিশেষণ (অব্যয়ের অর্থকে বিশেষিত করে) : ধিক তারে, শত ধিক নির্লজ্জ যে জন।
বাক্যের বিশেষণ (সম্পূর্ণ বাক্যকে বিশেষিত করে) : দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ আবার নানা সমস্যাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বাস্তবিকই আজ আমাদের কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন।
বিশেষণের অতিশায়ন (ফবমৎবব): দুই বা ততোধিক বিশেষ্য বা সর্বনামের মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের অতিশায়ন
ঘটে। বিভিন্নভাবে এই অতিশায়নরে বিষয়টি সম্পাদিত হয়। নিচে তা নির্দেশ করা হলো :
দুয়ের মধ্যে অতিশায়ন বোঝাতে দুইটি বিশেষ্য বা সর্বনামের মধ্যে হতে, থেকে, চেয়ে, অপেক্ষা, ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম বিশেষ্যটির সঙ্গে ষষ্ঠী বিভক্তি (র, এর) যুক্ত হয়। যেমন : গরুর থেকে ঘোড়ার দাম বেশি; বাঘের
চেয়ে সিংহ বলবান, প্রভৃতি। তবে, কখনও কখনও প্রথম বিশেষ্যের শেষের ষষ্ঠী বিভক্তিই হতে, থেকে, চেয়ে-র কাজ
করে। যেমন : এ মাটি সোনার বাড়া (সোনার চেয়েও বাড়া)। দুয়ের মধ্যে অতিশায়নে জোর প্রদানের জন্য মূল বিশেষণের
পূর্বে ‘অনেক’, ‘অধিক’, ‘বেশি’, ‘অল্প’, ‘কম’, ‘অধিকতর’প্রভৃতি শব্দ যোগ করতে হয়। যেমন : পদ্মফুল গোলাপের চেয়ে
বেশি সুন্দর; ঘিয়ের চেয়ে দুধ বেশি উপকারী প্রভৃতি।
বহুর মধ্যে অতিশায়নে বিশেষণের পূর্বে সবচাইতে, সর্বাপেক্ষা, সবথেকে, সবচেয়ে,সর্বাধিক, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়।
যেমন:
তোমাদের মধ্যে করিম সবচেয়ে বুদ্ধিমান; পশুর মধ্যে সিংহ সর্বাপেক্ষা বলবান, প্রভৃতি।
সংস্কৃত থেকে আগত বিশেষণের অতিশায়নের ক্ষেত্রে দুয়ের মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘তর’ এবং বহুর মধ্যে
তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘তম’ যোগ হয়। যেমন : গুরু- গুরুতর- গুরুতম; দীর্ঘ- দীর্ঘতর- দীর্ঘতম প্রভৃতি।
কখনও আবার দুয়ের মধ্যে তুলনা বোঝালে বিশেষণের শেষে ‘ঈয়স’ প্রত্যয় যুক্ত হয় এবং বহুর মধ্যে তুলনা বোঝালে
বিশেষণের শেষে ‘ইষ্ঠ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। যেমন : লঘু- লঘীয়ান- লঘিষ্ঠ; অল্প- কনীয়ান- কনিষ্ঠ; বৃদ্ধ- জ্যায়ান- জ্যেষ্ঠ;
শ্রেয়- শ্রেয়ান- শ্রেষ্ঠ। উল্লেখ্য যে, দুয়ের তুলনায় এই নিয়মের ব্যবহার বাংলায় হয় না।
সর্বনাম : বিশেষ্য শব্দের পরিবর্তে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়, তাই হলো সর্বনাম। বিভিন্ন ধরনের সর্বনাম রয়েছে। এগুলো হলো :
ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক : আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, তাহারা, তিনি, তাঁরা, এ, এরা, ও, ওরা
আত্মবাচক : স্বয়ং, নিজ, খোদ, আপনি
সামীপ্যবাচক : এ, এই, এরা, ইহারা, ইনি
দূরত্ববাচক : ঐ, ঐসব, সব
সাকল্যবাচক : সব, সকল, সমুদয়, তাবৎ
প্রশ্নবাচক : কে, কি, কী, কোন, কাহার, কার, কীসে
অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক : কোন, কেহ, কেউ, কিছু
ব্যতিহারিক : আপনা আপনি, নিজে নিজে, আপসে, পরস্পর
সংযোগজ্ঞাপক : যে, যিনি, যাঁরা, যাহারা
অন্যাদিবাচক : অন্য, অপর, পর
ঐঝঈ-২৮৫১ ব্যাকরণ-৭৯
সাপেক্ষবাচক : যত-তত, যেই-সেই, যেমন-তেমন
অব্যয় : কোনো প্রকার ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ায় এসব শব্দের কোনো পরিবর্তন ঘটে না বলে এদের অব্যয় বলা হয়। বাক্যে
ব্যবহৃত হলেও, অব্যয় পদের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এরা বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে কখনো বাক্যকে আরও শ্রæতিমধুর করে;
কখনো-বা একাধিক পদ বা বাক্যাংশ বা বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ধরনের অব্যয় রয়েছে। এগুলো হলো :
সমুচ্চয়ী অব্যয় : যে অব্যয় পদ একাধিক পদের বা বাক্যাংশের বা বাক্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয়
বলে। এই সম্পর্ক সংযোজন, বিয়োজন বা সংকোচন যে কোনটিই হতে পারে। একে সম্বন্ধবাচক অব্যয়ও বলে।
সংযোজক অব্যয় : ও, আর, তাই, অধিকন্তু, সুতরাং, ইত্যাদি। উচ্চপদ ও সামাজিক মর্যাদা সকলেই চায়। (উচ্চপদ,
সামাজিক মর্যাদা- দুটোই চায়); তিনি সৎ, তাই সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। (তাই অব্যয়টি ‘তিনি সৎ’ ও ‘সকলেই তাকে
শ্রদ্ধা করে’ বাক্য দুটির মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছে।
বিয়োজক অব্যয় : কিংবা, বা, অথবা, নতুবা, না হয়, নয়তো, ইত্যাদি। আবুল কিংবা আব্দুল এই কাজ করেছে। (আবুল,
আব্দুল- এদের একজন করেছে, আরেকজন করেনি। সম্পর্কটি বিয়োগাত্মক, একজন করলে অন্যজন করেনি।) মন্ত্রের
সাধন কিংবা শরীর পাতন। (‘মন্ত্রের সাধন’ আর ‘শরীর পাতন’ বাক্যাংশ দুটির একটি সত্য হবে, অন্যটি মিথ্যা হবে।)
সংকোচক অব্যয় : কিন্তু, বরং, তথাপি, যদ্যপি, ইত্যাদি। তিনি শিক্ষিত, কিন্তু অসৎ। (এখানে ‘শিক্ষিত’ ও ‘অসৎ’ দুটোই
সত্য, কিন্তু শব্দগুলোর মধ্যে সংযোগ ঘটেনি। কারণ, বৈশিষ্ট্য দুটো একরকম নয়, বরং বিপরীতধর্মী। ফলে তিনি অসৎবলে
তিনি শিক্ষিত বাক্যাংশটির ভাবের সংকোচ ঘটেছে।)
অনন্বয়ী অব্যয় : এগুলো নানা ভাব বা অনুভূতি প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এরা বাক্যের অন্য কোনো পদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক
না রেখে স্বাধীনভাবে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন :
উচ্ছ¡াস প্রকাশে : মরি মরি! কী সুন্দর সকাল!
স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি প্রকাশে : হ্যা, আমি যাব। না, তুমি যাবে না।
সম্মতি প্রকাশে : আমি আজ নিশ্চয়ই যাব।
অনুমোদন প্রকাশে : এতো করে যখন বললে, বেশ তো আমি আসবো।
সমর্থন প্রকাশে : আপনি তো ঠিকই বলছেন।
যন্ত্রণা প্রকাশে : উঃ! বড্ড লেগেছে।
ঘৃণা বা বিরক্তি প্রকাশে : ছি ছি, তুমি এতো খারাপ!
সম্বোধন প্রকাশে : ওগো, তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে।
সম্ভাবনা প্রকাশে : সংশয়ে সংকল্প সদা টলে/ পাছে লোকে কিছু বলে।
বাক্যালংকার হিসেবে : কত না হারানো স্মৃতি জাগে আজ মনে।
অনুসর্গ অব্যয় : বাক্যে ব্যবহৃত বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের কারকবাচকতা প্রকাশ করার কাজ করে অনুসর্গ অব্যয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ওকে দিয়ে এ কাজ হবে না। (এখানে ‘দিয়ে’ তৃতীয়া বিভক্তির মতো কাজ করেছে, এবং
‘ওকে’ যে কর্ম কারক, তা নির্দেশ করেছে। এই ‘দিয়ে’ হলো অনুসর্গ অব্যয়)।
ক্রিয়া:
ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ক্রিয়া। এটি কোনো কাজ করা বোঝায়। বাংলা ভাষায় ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে পুরুষ
ও কাল অনুযায়ী ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে বাক্যে ক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটায়। ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি বাক্যে
অপরিহার্য। বিভিন্নভাবে ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ সম্ভব। নিচে এগুলো আলোচিত হলো :
সমাপিকা-অসমাপিকা ক্রিয়া : সমাপিকা ক্রিয়া বাক্যের বক্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটায়। একটি বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া
থাকতেই হয়। অপরদিকে, অসমাপিকা ক্রিয়া বাক্যে বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটায় না। প্রসঙ্গত দুটি উদাহরণ লক্ষণীয় : ছেলেরা
খেলছে। মেয়েরা খেলে বাড়িতে ফিরল। প্রথম বাক্যে ‘খেলছে’ এবং দ্বিতীয় বাক্যে ‘ফিরল’ সমাপিকা ক্রিয়া। অপরদিকে,
দ্বিতীয় বাক্যে ‘খেলে’ ক্রিয়াটি ভাবের বা বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটাচ্ছে না বলে তা অসমাপিকা ক্রিয়া। একটি বাক্যে যতোগুলো
প্রয়োজন অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করা যায়। সাধারণত অসমাপিকা ক্রিয়ার শেষে ইয়া, ইলে, ইতে, এ, লে, তে
বিভক্তিগুলো যুক্ত থাকে।
ঐঝঈ-২৮৫১ ব্যাকরণ-৮০
সকর্মক-অকর্মক-দ্বিকর্মক ক্রিয়া : বাক্যে ব্যবহৃত কর্মপদের ওপর নির্ভর করে ক্রিয়াকে অকর্মক, সকর্মক ও দ্বিকর্মক− এই তিন
ভাগে ভাগ করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাক্যে যে সকল পদকে আশ্রয় করে ক্রিয়া তার কাজ সম্পাদন বা সংঘটন করে,
তাকে বা তাদের কর্মপদ বলে।
ক্রিয়াপদকে ‘কী/ কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, সেটিই কর্মপদ। যেমন- মেয়েটি তার বন্ধুকে কলমটি
দিল। এই বাক্যে ‘কে’, ‘কী’ এবং ‘কাকে’ এই তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য যে, ‘কে’ প্রশ্ন দিয়ে বাক্যের
কর্তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সাধারণত বাক্যে কর্তা উহ্য বা প্রত্যক্ষ হিসেবে থাকে। এর বাইরে এই বাক্যে ‘কী’ এবং
‘কাকে’-র উত্তর মেলে; অর্থাৎ এই বাক্যে দুটি কর্ম রয়েছে। তাই একে বলা হয় দ্বিকর্মক ক্রিয়া। আবার, ‘মেয়েটি ছবি
আঁকে’ বাক্যে একটি কর্ম রয়েছে। তাই এটি সকর্মক ক্রিয়ার বাক্যের উদাহরণ। অপরদিকে, বাক্যে যদি কেবল কর্তা ও
ক্রিয়া থাকে কিন্তু কোনো কর্ম না থাকে তবে সেই ক্রিয়াকে অকর্মক ক্রিয়া বলা হয়। যেমন : মেয়েটি হাসে।
প্রযোজক ক্রিয়া: এই ক্রিয়া একজনের প্রযোজনায় আরেকজনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। প্রযোজক ক্রিয়ার দুজন কর্তা
থাকে। এরমধ্যে একজন কর্তা কাজটি আরেকজন কর্তাকে দিয়ে করান। প্রযোজক ক্রিয়ার দুইজন কর্তার মধ্যে যিনি কাজটি
করান, তাকে বলে প্রযোজক কর্তা। আর যিনি কাজটি করেন, তাকে বলে প্রযোজ্য কর্তা। যেমন- শিক্ষক ছাত্রদের ব্যাকরণ
শেখাচ্ছেন। এখানে ‘ব্যাকরণ শেখার’ কাজটি করছে ‘ছাত্রেরা’, কিন্তু শেখাচ্ছেন ‘শিক্ষক’। অর্থাৎ, ‘শিক্ষক’ কাজটি
প্রযোজনা করছেন। তাই ‘শিক্ষক’ এখানে প্রযোজক কর্তা। আর ‘ব্যাকরণ শেখার’ কাজটি আসলে ‘ছাত্ররা’ করছে, তাই
‘ছাত্রেরা’ এখানে প্রযোজ্য কর্তা।
নামধাতুর ক্রিয়া : বিশেষ্য, বিশেষণ ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে সব ধাতু গঠিত হয়, তাদেরকে
নামধাতু বলে। নামধাতুর সঙ্গে ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে নামধাতুর ক্রিয়ার গঠিত হয়। যেমন : বিশেষ্য বেত+আ = বেতা,
ক্রিয়া = বেতানো, বেতাচ্ছেন; বিশেষণ = বাঁকা+আ = বাঁকা, ক্রিয়াপদ = বাঁকানো, বাঁকাচ্ছেন প্রভৃতি।
যৌগিক ক্রিয়া: একটি সমাপিকা ক্রিয়া ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া পাশাপাশি বসে যদি কোনো বিশেষ বা স¤প্রসারিত অর্থ
প্রকাশ করে, তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। সাধারণত যৌগিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে, একাধিক ক্রিয়া যুক্ত হয়ে তাদের সাধারণ অর্থ
প্রকাশ না করে কোনো বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। কয়েকটি উদাহরণ দ্রষ্টব্য :
ঘটনাটা শুনে রাখ। (শোনার বদলে তাগিদ দেয়া অর্থ বুঝিয়েছে)
তিনি বলতে লাগলেন। (ক্রিয়ার ঘটমানতা বোঝাচ্ছে)
ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ল। (শোওয়ার পাশাপাশি কার্যসমাপ্তিও বোঝাচ্ছে)
সাইরেন বেজে উঠল। (আকস্মিকতা বোঝাতে)
শিক্ষায় মন সংস্কারমুক্ত হয়ে থাকে। (অভ্যস্ততা অর্থে)
এখন যেতে পার। (যাওয়ার অনুমোদন অর্থে)
মিশ্র ক্রিয়া : বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে কর, হ্, দে, পা, যা, কাট্, গা, ছাড়্, র্ধ র্মা প্রভৃতি ধাতু যোগ
হয়ে মিশ্র ক্রিয়া গঠিত হয়। উদাহরণ : মানা র্ক, ভাত দে ইত্যাদি।
ব্যাকরণিক উপাদান
পুরুষ
উত্তম পুরুষ : বাক্যের বক্তার ভ‚মিকা যে পালন করে তাকেই উত্তম পুরুষ হিসেবে নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বাক্য
উচ্চারণ করছে, সেই উত্তম পুরুষ। উত্তম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো : আমি, আমরা, আমাকে, আমাদের, ইত্যাদি।
মধ্যম পুরুষ : যাকে উদ্দেশ করে বক্তা বাক্য উচ্চারণ করে তাকে মধ্যম পুরুষ বলে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষভাবে উদ্দিষ্ট শ্রোতাই
মধ্যম পুরুষ। মধ্যম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- তুমি, তোমরা, তোমাকে, তোমাদের, তোমাদিগকে, আপনি, আপনার,
আপনাদের ইত্যাদি।
নামপুরুষ : বাক্যে অনুপস্থিত যেসব ব্যক্তি, বস্তু বা প্রাণীর উল্লেখ বক্তা করেন, তাদের নামপুরুষ বলে। অর্থাৎ, বক্তার সামনে
নেই এমন যা কিছুর কথা বক্তা বাক্যে বলেন, সবগুলোই নামপুরুষ। নাম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- সে, তারা, তাহারা,
তাদের, তাহাকে, তিনি, তাঁকে, তাঁরা, তাঁদের, ইত্যাদি।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ