গ্রন্থাগার



(সংকেত: সূচনা; গ্রন্থাগার কি; গ্রন্থাগারের ইতিহাস; গ্রন্থাগারের ধরণ; গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য; গ্রন্থাগারের সুবিধা; বিখ্যাত গ্রন্থাগার সমূহ; গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা; উপসংহার।)
সূচনা: শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানব সভ্যতার সকল জ্ঞান জমা হয়ে আছে গ্রন্থের ভেতর। অন্তহীন জ্ঞানের আঁধার হলো গ্রন্থ, আর গ্রন্থের আবাসস্থল গ্রন্থাগার। মানুষের হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত সব ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে একেকটি গ্রন্থাগারের ছোট ছোট তাঁকে। গ্রন্থাগার হলো কালের খেয়াঘাট, যেখান থেকে মানুষ সময়ের পাতায় ভ্রমণ করে। প্রাচীন শিলালিপি থেকে আধুনিক লিপির গ্রন্থিক স্থান হলো গ্রন্থাগার। একটি গ্রন্থাগার মানব জীবনকে পাল্টে দেয়। গ্রন্থ কিবা গ্রন্থাগার আত্মার খোরাক যোগায়। গ্রন্থাগার হলো শ্রেষ্ঠ আত্মীয় যার সাথে সবসময় ভালো সম্পর্ক থাকে। আর জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনন্য।
গ্রন্থাগার কি: গ্রন্থাগার বা প্রকৃত অর্থে পাঠাগার হলো বই, পুস্তিকা ও অন্যান্য তথ্য সামগ্রির একটি সংগ্রহশালা যেখানে পাঠক গ্রন্থপাঠ, গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান করতে পারেন। বাংলা গ্রন্থাগার শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে ‘গ্রন্থ+আগার’ পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রন্থাগার হলো গ্রন্থ সজ্জিত পাঠ করার আগার বা স্থান। গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের এমন এক সমুদ্র সেখানে বিচরণ করে প্রতিটি মানুষ উন্নত মননের অধিকারী হতে পারে। আর তাই গ্রন্থাগারকে তুলনা করা হয় শব্দহীন মহাসমুদ্রের সাথে। এটি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে সেতুবন্ধনের এক নীরব সাক্ষী।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস: আজকের পৃথিবীকে জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে যে গ্রন্থাগার তা প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। সভ্যতার ক্রমশ অগ্রসর হওয়ার পথে মানুষ তার সৃষ্টিশৈলিকে সংরক্ষণ করা শুরু করল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, ইরাকের বাগদাদ, দামেস্ক, প্রাচীন গ্রিস ও রোমে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়া উপমহাদেশের তক্ষশীলা ও নালন্দায় সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। আব্বাসীয় ও উমাইয়া শাসনামলে ‘দারুল হকিমা’ নামক গ্রন্থাগার ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে। সমকালীন মিশরের ‘বাইতুল হিকমা’ও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেছে। যুগে যুগে গ্রন্থাগারগুলো গড়ে উঠেছিল রাজদরবার ও ধর্মীয় উপাসনালয়কে ঘিরে।
গ্রন্থাগারের ধরণ: আধুনিক সভ্যতায় গ্রন্থাগারের ধরণ বদলে গেছে। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের ধারণা থেকে মানুষ এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছে। পারিবারিক গন্ডি থেকে গ্রন্থাগার এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ধরণ অনুযায়ী গ্রন্থাগারকে নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
ক) গণগ্রন্থাগার: সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত গ্রন্থাগারকে গণগ্রন্থাগার বলা হয়। যা পাবলিক লাইব্রেরি নামে পরিচিত।
খ) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার: সাধারণত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চমানসম্পন্ন গ্রন্থাগার থাকে। যেখানে বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংরক্ষিত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার এরকম সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার।
গ) গবেষণা গ্রন্থাগার: বিশেষ কোনো বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনে যে গ্রন্থাগার খোলা হয় তাই হলো গবেষণা গ্রন্থাগার। ঢাকায় বিজ্ঞান বিষয়ক এমন গ্রন্থাগার হলো ‘ম্যান্সডক লাইব্রেরি’।
ঘ) বিশেষ গ্রন্থাগার: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যে গ্রন্থাগার পরিচালনা করে তাকে বিশেষ গ্রন্থাগার বলে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এরকম গ্রন্থাগার রয়েছে।
ঙ) ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার: বিভিন্ন দেশে গাড়িতে বহনযোগ্য গ্রন্থাগার রয়েছে, যা পাঠকের কাছে গ্রন্থ পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশে ‘বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’ এমন একটি গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছে। ভেনিজুয়েলার ‘মমবয়’ বিশ্ববিদ্যালয় খচ্চরে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার বানিয়ে পাহাড়ি জনপদে বই সরবরাহ করে থাকে।
গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য: গ্রন্থাগার হলো সময়ের পাতা থেকে পাতায় ভ্রমণের একমাত্র সেতু। গ্রন্থাগারের জ্ঞান নদীর মতো দেশ, কাল, সীমানার গন্ডি পেরিয়ে যায়। প্রবাহিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে। গ্রন্থাগার তাই অজস্র মানুষের শব্দহীন মিলনের মুক্তমঞ্চ। জ্ঞানী যেখানে পায় জ্ঞানের অমিয় সুধা, ভাবুক খুঁজে পায় ভাবের টলমলে দীঘি, চিন্তাবিদ পায় চিন্তার বহুমুখী খোরাক। গ্রন্থাগারে রয়েছে সহস্র বছর ধরে জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর। হৃদয় ও মনের এমন রঙিন পাঠশালা আর কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধে বলেছেন-‘লাইব্রেরীর মধ্যে আমরা অজস্র পথের চৌমাথার উপর দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতল স্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ধাবমান হও কোথাও বাধা পাইবে না।’ মানুষ গ্রন্থাগারের ভিতর খুঁজে পায় তার সকল জিজ্ঞাসার উত্তর। অনন্তকাল ধরে গ্রন্থাগার মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীরবে-নিভৃতে।
গ্রন্থাগারের সুবিধা: সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার জ্ঞানের নীরব সমুদ্র। তৃষিত পাঠকের জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করাই গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্য। গ্রন্থাগার হলো কালান্তরের সকল গ্রন্থের মহাসম্মেলন। যেখানে এক হয়ে গেছে অতীত আর বর্তমান। সন্ধানী হৃদয় গ্রন্থাগারে অতীত-বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের সেতু রচনা করে। একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, একটি জাতির উন্নতির সোপান। গ্রন্থাগার নারী, পুরুষ, বয়সের কোনো বাঁধা রাখেনি। যে কেউ চাইলে এখানে এসে জ্ঞানের অতল সমুদ্রে অবগাহন করতে পারে। গ্রন্থাগারের সারি সারি তাকে জমে আছে সহস্রাব্দের কথামালা। গ্রন্থাগারের শব্দহীন কারাগারে বন্দী প্রতিটি মানুষই সভ্যতার আলোকবর্তিকা বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
বিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহ: সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ ধন-সম্পদের পাশাপাশি গ্রন্থ সংগ্রহের মতো মহৎ কাজ করে আসছে। মানুষের এই মহৎ উদ্যোগের কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে উন্নতসব গ্রন্থাগার। বিখ্যাত গ্রন্থাগারসমূহের মধ্যে প্রথমেই আসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে’র নাম। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত এই লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ বইয়ের এক বিশাল সমাহার। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামও পৃথিবীর বিখ্যাত লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বডলিন লাইব্রেরি’তে রয়েছে ১ কোটিরও বেশি গ্রন্থ। এছাড়া পৃথিবীর প্রাচীনতম লাইব্রেরির মধ্যে রয়েছে ‘ভ্যাটিকান লাইব্রেরি’। এ ছাড়াও ফ্রান্সের বিবলিওথিক লাইব্রেরি, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি ও কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিও পৃথিবীর প্রাচীন লাইব্রেরির মধ্যে অন্যতম। যা এক সময় পৃথিবীর সপ্তাচার্যের মধ্যেও ছিল।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা: বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাবার দরকার, তেমনি জীবনকে গতিময় করার জন্য দরকার জ্ঞান। জ্ঞানের আঁধার হলো গ্রন্থ আর গ্রন্থের আবাসস্থল হলো গ্রন্থাগার। প্রতিটা সমাজে যেমন উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল দরকার তেমনি গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। গ্রন্থাগার মানুষের বয়স, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী গ্রন্থ সরবরাহ করে থাকে। আর তাই সচেতন মানুষ মাত্রই গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। পৃথিবীর যতো মহান মনীষী আছেন তাদের সবাই জীবনের একটা বড় সময় গ্রন্থাগারে কাটিয়েছেন। সাহিত্য-শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস সংস্কৃতিসহ সব ধরণের জ্ঞানের আঁধার হতে পারে একটি গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদন্ড। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় চেতনার জাগরণ হয় না। আর তাই গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৃথিবীর বহুদেশ পাঠকের চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে তুলেছে অগণিত গ্রন্থাগার। শিক্ষার আলো বঞ্চিত কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষার বাতিঘর বলা হয় গ্রন্থাগারকে। গ্রন্থাগার ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তার নাগরিককে পরিপূর্ণ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা তাই প্রতিটি সমাজে অনিবার্য।
উপসংহার: জীবনে পরিপূর্ণতার জন্য জ্ঞানের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করতে রয়েছে গ্রন্থাগার। একটি সমাজের রূপরেখা বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। মনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে গ্রন্থাগারের অবদান অনস্বীকার্য। তাই শহরের পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামে গ্রন্থাগার গড়ে তোলা প্রয়োজন।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]