সাহিত্য পাঠের মূল্য



(সংকেত: সূচনা; সাহিত্য কি; সাহিত্যের উদ্দেশ্য; মানব জীবনে সাহিত্য; সাহিত্য ও সমাজ; সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য; সাহিত্যের বিস্তৃতি; সাহিত্য পাঠের মূল্য; মুক্ত হৃদয়ে সাহিত্যের জয়গান; সাহিত্যের সূর্যসন্তানেরা; উপসংহার।)
সূচনা: ভাষার জন্ম হয়েছে নিজের ভাব অন্যের কাছে তুলে ধরার জন্য। আর ভাষাকে মহিমান্বিত করেছে সাহিত্যের স্বপ্নীল ছোঁয়া। সাধারণ একটি কথাই সাহিত্যিকের স্পর্শে হয়ে উঠে অনন্য। তুচ্ছ একটি কথা সাহিত্যিকের মুখে এসে নতুন জীবন লাভ করে। সাহিত্য ভাষাকে উপমা, অলংকার, আর শব্দের ব্যঞ্জনায় করে তোলে শ্রুতিমধুর। সাহিত্য পাঠে মনের যে বিশালতার সৃষ্টি হয় তা আকাশের বিশালতাকেও হার মানায়।
সাহিত্য কি?: ‘সহিত’ শব্দ হতে সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি। যার ধাতুগত অর্থ হচ্ছে মিলন। এ মিলন শুধু ভাবের সাথে ভাষার নয়। এ মিলন মানুষের সাথে মানুষের, অতীতের সাথে বর্তমানের,দূরের সাথে নিকটের। সেতুবন্ধনের প্রগাঢ় মাধ্যম সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কোনোরকম জটিলতা ছাড়াই আমরা সাহিত্যকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি এভাবে- মানুষের হৃদয়ের আবেগ ও চেতনাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করাই সাহিত্য। হৃদয় মনের অনুভূতির ভাষাগত রূপায়নকেই সাহিত্য বলা যায়। সাহিত্যকে আরো তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে শ্রীশচন্দ্র দাসের ভাষায় বলতে হয়- ‘নিজের কথা, পরের কথা, বাহ্য জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয় তার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।’
সাহিত্যের উদ্দেশ্য: সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী তার ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া কারো মনোরঞ্জন করা নয়।’ মানবাত্মা সাহিত্যের ভেতর দিয়েই নিজেকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করে। সাহিত্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো। এই জাগরণ মানব মনকে করে তোলে সুশোভিত। মানুষ মাত্রই সুন্দরের পূজারী। এই সুন্দর মানুষের মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। আর জগতে সাহিত্যই হলো একমাত্র শুদ্ধতম জিনিস যা মনের গভীরতম স্থানে প্রবেশ করে। ভালো কোনো কবিতা কিংবা গল্প আমরা সহজেই ভুলে যাই না। বরং তা স্থান, কাল, পাত্র ভেদে মনের মানসপটে ভেসে উঠে। আর সাহিত্য এইখানেই তার উদ্দেশ্যে শতভাগ সফল। সাহিত্যের শুদ্ধ চর্চা মানুষের মনকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
মানবজীবনে সাহিত্য: আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছু ব্যবহার করি যাতে রয়েছে শিল্পের অবদান। চমৎকার সব বাহারি পোশাক, নান্দনিক ডিজাইন, নজরকাড়া নকশা এর সবই শিল্পের উন্নত সংস্করণ। সময়ের আবর্তে তা বাজারে আসে এবং মানুষের ব্যবহার্য হয়ে যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই, আমাদের সুন্দর বাচন ভঙ্গি, চমৎকার শব্দচয়ন, ভাষার অলংকার এর সবই সাহিত্যের অবদান। পণ্যের প্রচারে, বিজ্ঞাপনে সৃজনশীল সাহিত্যের প্রকাশ ও ব্যবহার। সাহিত্য হলো আমাদের চোখের মতো যা ক্ষুদ্র অথচ চারপাশের সব কিছুকে বিশালাকারে দেখতে পায়। সাহিত্যকর্ম সে গল্প, কবিতা, উপন্যাস যাই হোক না কেনো তা মানুষের অন্তরের অনুভূতিকে প্রকাশ করে। সমাজের মূল্যবোধ, সমসাময়িক সকল চিন্তার সৃজনশীল প্রকাশের মাধ্যম হলো সাহিত্য।
সাহিত্য ও সমাজ: কবি-সাহিত্যিকরা কল্পনা নির্ভর হলেও বাস্তবের বাইরে নন। তাই তাদের সৃষ্ট সাহিত্যকে এককথায় সমাজের দর্পণ বলা যায়। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় তৎকালীন সমাজের রূপ আমাদের সামনে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল কিংবা সুকান্তের লেখায় ফুঁটে উঠেছে সমাজ চিত্র, সাম্যের গান। মানবজীবনের জয়গান শুধু সাহিত্যিকের বীণাতেই ঝংকৃত হয়েছে বারবার। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও অজস্র কবিতা-গান-অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গান-
                                               “কারার ঐ লৌহ কপাট
                                                                ভেঙ্গে ফেলে কররে লোপাট।”
এসব গান আজো অজস্র বিপ্লবের ডাক শোনায়। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের কথা বলে। সুতরাং সাহিত্যকে সমাজের বাইরে কল্পনা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সাহিত্য আর সমাজ একই সুঁতোয় গাঁথা।
সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য: যখন বিশ্বমানের সঙ্গে নিত্যনতুন সম্বন্ধ পাতানো কবি মনের উদ্দেশ্য তখন সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ জ্ঞানার্জন নয়। বস্তুনিষ্ঠ শিক্ষা যেমন ফলপ্রসু হয় না তেমনি উদ্দেশ্যহীন সাহিত্য পাঠের কোনো মূল্য নেই। সাহিত্য পাঠের যে পবিত্র উদ্দেশ্য তা অনেক সময়ই সফল হয় না। কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে মেলানোর চেষ্টা। কারণ সাহিত্য কখনোই স্কুল শিক্ষকের ভার নেয়নি। কাজেই সাহিত্য পাঠের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানকে আনন্দ দেয়া। সেই আনন্দদানের ভেতর দিয়ে যদি কোনো জ্ঞানার্জন হয় তবেই তা সার্থকতা লাভ করে। কারণ একমাত্র সাহিত্যেই মানবাত্মা খেলা করে এবং তার আনন্দ উপভোগ করে।
সাহিত্যের বিস্তৃতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “যে দেশে সাহিত্যের অভাব সে দেশের লোক পরস্পর সজীব বন্ধনে আবদ্ধ নহে, তাহারা বিচ্ছিন্ন।” সাহিত্য হলো এমন বন্ধন যা অতীতকে বর্তমানের সাথে দারুণভাবে এক করে দিয়েছে। সাহিত্যের সূত্র ধরেই মানুষ তার শিকড়ের টানে ছুটে যায়। মুজতবা আলী যেমন জগতের সকল ভ্রমণ রহস্যকে জীবন্ত করে দেন তেমনি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসংসারকে নাড়া দিয়ে যান। নজরুল গেয়ে যান বিদ্রোহের গান। শরৎ, বঙ্কিম দেখিয়েছেন সমাজ বদলের স্বপ্ন। সাহিত্যের বিস্তৃতি শুধু কবিতার ছন্দে আর গল্পের লাইনে আবদ্ধ নয়। সাহিত্য দেশ, কাল, সীমানার গন্ডি পেরিয়ে গেছে বহু আগে। কারণ সাহিত্যিকের কর্ম শুধু বইয়ের ভেতর আবদ্ধ থাকে না। মানুষের কল্পনা আর চিন্তার প্রকাশ ঘটে এর ভেতর দিয়েই। আকাশের যেমন সীমানা নেই তেমনি সাহিত্যও বিস্তৃত মানব সভ্যতার দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
সাহিত্য পাঠের মূল্য: সাহিত্য পাঠ আমাদেরকে অতীতের সাথে যেমন আবদ্ধ করে তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখায়। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে সমকালীন সমাজের চিত্র যেভাবে ফুটে ওঠে তা আর কিছুতে এতটা দৃশ্যমান হয় না। তাই বলা হয়ে থাকে কোনো দেশকে ভালোভাবে জানতে হলে তার সাহিত্যকে জানো । সাহিত্য মানুষের মননকে যতটা বিকশিত করে ততটা বিকাশ লাভ আর কিছুতে হয় না। সাহিত্য মানবাত্মাকে তৃপ্তি দানের পাশাপাশি নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। সাহিত্যের স্নিগ্ধ জলে ম্লান করা পরিশীলিত মন কখনোই জগতের অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। সাহিত্য চর্চা মানব মনকে জাগতিক ব্যস্ততা থেকে মুক্তি দান করে। মুক্ত আত্মাই কেবল শুদ্ধ চিন্তার মাধ্যমে সভ্যতার বাতিঘরে অতন্দ্র প্রহরী হতে পারে। সুতরাং সাহিত্য পাঠের মূল্য জগতের যেকোনো কিছুর বিচারে শ্রেষ্ঠ।
মুক্ত হৃদয়ে সাহিত্যের জয়গান: দুই চরণ কবিতা মানুষের মনকে যতটা নাড়া দিতে পারে এত ক্ষুদ্র পরিসরে মনকে নাড়া দিতে আর কিছুই পারে না। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় মানব মনের সকল আকুতি। সাহিত্য না থাকলে মানুষের মন আর যন্ত্রের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যেত। শুধু সাহিত্যিকের তুলিতে মানুষের হৃদয়ের চিত্রাংকন সম্ভব। কেননা সাহিত্য ব্যতিত মনকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আর কিছুতে নিহিত নেই। যে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারে না, সাহিত্যের সুনীল আকাশ সে দেখে না। মুক্ত হৃদয়ে প্রতিনিয়ত যে গান বেজে চলেছে তা সাহিত্যেরই জয়গান।
সাহিত্যের সূর্য সন্তানেরা: বাংলা সাহিত্যের আকাশ উজ্জ্বল করা নক্ষত্রদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, শরৎ, ইংরেজি সাহিত্যের শেক্স পিয়ার, ইয়টস, মিলটন অন্যতম। শুধু এরাই নয়, সাহিত্যের আকাশকে ঝলমলে করে রেখেছেন আরো অজস্র নক্ষত্র। সাহিত্যের এই সব সূর্য সন্তানরা যুগে যুগে আমাদের সভ্যতাকে আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখিয়েছেন। মূলত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে সাহিত্যিকরা। ভাষা মানুষের মুখ থেকে সাহিত্যিকের হাত ধরে মুক্ত, স্বাধীন ও স্পষ্ট হয়ে উঠে।
উপসংহার: ফুল যেমন বাগানকে সুশোভিত করে, সাহিত্য তেমনি ভাষাকে অলংকৃত করে। সাহিত্য না থাকলে পৃথিবীতে এত গান, সুর, গল্প, কবিতা জন্মাত না। নীরস পৃথিবীকে সরস রাখতে সাহিত্য তাই অনুক্ষণ জেগে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। অন্তরকে জাগ্রত রাখতে, মনকে আন্দোলিত করতে, চিত্তকে আকর্ষিত করতে সাহিত্য পাঠের কোনো বিকল্প নেই।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]