বাংলা রচনা/ বাংলাদেশের পোশাক শিল্প /অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের ভূমিকা



(সংকেত: ভূমিকা, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের গুরুত্ব, উৎপাদিত পোশাক সামগ্রী, পোশাক শিল্পের ক্রেতা, তৈরি পোশাক শিল্পের সমস্যা, পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানের উপায়, উপসংহার।)
ভূমিকা
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে যে কয়টি শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে তার মধ্যে সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে পোশাক শিল্প অন্যতম। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ভূমিকা করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অন্যতম প্রধান উৎস। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পোশাক শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। অতীতে পাটকে বলা হতো ‘স্বর্ণসূত্র’। এখন পাটের স্থান দখল করেছে এই পোশাক শিল্প। তাই এই শিল্পকে বাংলাদেশের সোনালি শিল্প বলা চলে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের গুরুত্ব
এক সময়ে বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানি ছিল ভুবন বিখ্যাত। কিন্তু উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ফলে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে তার এই শিল্প মর্যাদা হারায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বস্ত্র ক্ষেত্রে তার হারানো গৌরব ফিরে পায়। বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প এক নতুন সম্ভাবনাময় সংযোজন। ১৯৭৭-৭৮ সালে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তিগত চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত সামান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ শিল্পযাত্রা শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২২০০ গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছে। এ সমস্ত কারখানায় প্রায় ১০ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট লাখ। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে। বেকার সমস্যা সমাধান বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।
উৎপাদিত পোশাক সামগ্রী
পোশাক শিল্পের উৎপাদিত পোশাকের মধ্যে শার্ট, পাজামা, জিন্সপ্যান্ট, জ্যাকেট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, স্যুয়েটার, পুলওভার, ল্যাবরেটরি কোর্ট, খেলাধুলার পোশাক, শীতকালীন নানা ধরনের গরম কাপড়ের তৈরি পোশাক, নাইট ড্রেস, মেয়েদের ব্লাউজ প্রভৃতি বিশ্ববাজারে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।
পোশাক শিল্পের ক্রেতা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম প্রধান ক্রেতা দেশ আমেরিকা। আমেরিকায় তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ানের পর বাংলাদেশের স্থান। বর্তমানে কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ, মধ্যপ্রাচ্য, ইসিভুক্ত দেশসমূহসহ পাশ্চাত্যের অনেকগুলো দেশে আমাদের পোশাক শিল্পের বাজার গড়ে উঠেছে।
তৈরি পোশাক শিল্পের সমস্যা
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বেশ কিছু সমস্যা এ শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। সমস্যাগুলো হলো :
নিম্নমানের উপকরণ: পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমাদের বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। অনেক সময় বিদেশি সরবরাহকারীদের অসততার কারণে তারা নিম্নমানের উপকরণসমূহ সরবরাহ করে থাকে। এ সকল নিম্নমানের কাঁচামালে তৈরি পোশাক রপ্তানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সুনাম ও নির্ভরযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়।
কোটা আরোপ: বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অন্যতম সমস্যা হল বিদেশি আমদানিকারক দেশের কোটা আরোপ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেশি রপ্তানি হয় আমেরিকায়। ১৯৮৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাকের ওপর কোটা আরোপ করেছে। সেখানে রপ্তানিযোগ্য ৮৪ টি ক্যাটাগরির মধ্যে ২৮ টিতে কোটা আরোপ করায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি হয়।
স্বল্প আইটেমের পোশাক রপ্তানি: বিশ্ববাজারে প্রায় শতাধিকসংখ্যক তৈরি পোশাকের চাহিদা রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ১৫-১৮ টি আইটেমের পোশাক রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে চীন, হংকং, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ ৬০ থেকে ৭০ আইটেমের পোশাক রপ্তানি করে। ফলে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ সুদৃঢ় স্থান লাভে ব্যর্থ হচ্ছে।
ঋণের অভাব: যেকোনো শিল্পের প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য মূলধনের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের দ্রুত প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ প্রাপ্তির অসুবিধা রয়েছে। ফলে পোশাক শিল্পের ব্যাপক বিকাশ সম্ভব হচ্ছে না।
দক্ষ শ্রমিকের অভাব
এই শিল্পের অন্যতম সমস্যা হল দক্ষ জনশক্তির অভাব। বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক শিল্পে যেসব শ্রমিক কাজ করে তার বেশির ভাগই নিরক্ষর এবং অদক্ষ মহিলা। দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বাংলাদেশে উন্নতমানের পোশাক তৈরি হয় না।
রপ্তানি কাজে অহেতুক বিলম্ব
আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকগণ বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রাপ্তিতে বিলম্ব, শুল্ক জাটিলতা, পরিবহন ঝামেলা প্রভৃতি কারণে অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পোশাক ডেলিভারি দিতে পারে না। ফলে আমদানিকারকরা অর্ডার বাতিল করে দেয়। সেজন্য পোশাক শিল্প লোকসানের সম্মুখীন হয় এবং রপ্তানি কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ে।
এছাড়া আরো অনেক সমস্যার কারণে আমাদের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। যেমন : দেশীয় বস্ত্র শিল্পের অনুন্নতির জন্য পোশাক শিল্পে ব্যবহারযোগ্য উন্নত মানের কাপড় তৈরি হয় না। তৈরি পোশাকের মান অনেক সময় বিদেশি ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী নির্ধারণ করা যায় না। ফলে রপ্তানির ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয় না অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে শ্রমিকরা কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং উৎপাদন হ্রাস পেয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া দেশে প্রচুর বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকায় পোশাক শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও অনেক সময় পোশাক শিল্পের উৎপাদনকে ব্যাহত করে।
পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানের উপায়
এ শিল্পের উদ্ভূত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে আগামী বছরগুলোতে এ শিল্প থেকে কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-
তৈরি পোশাকের আইটেম বৃদ্ধি: বর্তমানের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পোশাকের বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের আইটেম বাড়াতে হবে।
তৈরি পোশাকের মান উন্নয়ন: বর্তমান বিশ্বে পোশাকের বাজারে নিত্য নতুন ফ্যাশানের উদ্ভব ঘটছে। ফলে পোশাক আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদাও পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই আমদানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মান উন্নত করতে হবে। তাহলে বিশ্ব বাজারে আমাদের পোশাক শিল্পের অবস্থান আরো সুসংহত হবে।
প্রযুক্তির উন্নয়ন: তৈরি পোশাকের মান উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের  জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঋণের ব্যবস্থা: পোশাক শিল্পের যথাযথ উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত মূলধনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে এ শিল্পের জন্য একটি স্বতন্ত্র ঋণ কাঠামো কার্যকর করতে হবে।
বস্ত্র শিল্পের উন্নয়ন: বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল যেমন: সুতা, বোতাম, রং, মেশিনের যন্ত্রাংশ দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করতে হবে। তাহলে এ শিল্পের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং কম দামে পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ: পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পোশাকের গুণগত মান ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি: আমাদের পোশাক শিল্পে যতটা মূল্য সংযোজন হয় তার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি শ্রমিকের শ্রম থেকে আসে। অথচ এই মূল্য সংযোজনের মাত্র ২৫ ভাগ শ্রমিককে দেওয়া হয়। তাই এই শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ালে তাদের কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং উৎপাদন বাড়বে।
এছাড়া পোশাক শিল্পের উন্নতির জন্য আরো কিছু সময় উপযোগী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দিন দিন এ শিল্পের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। যেমন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত সুবিধা প্রদান করতে হবে। প্রতিযোগী দেশের সাথে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। পোশাক শিল্পের এজেন্টদের দৌরাত্ম্য হ্রাস করতে হবে। পোশাক শিল্পের উন্নয়নের জন্য খুলনা, রাজশাহী এলাকায় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা গড়ে তুলতে হবে। তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য দেশে বিদেশে রপ্তানি মেলার আয়োজন করতে হবে। পোশাক শিল্পের জন্য রপ্তানি ব্যুরো গঠন করতে হবে।
উপসংহার
বর্তমান বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পের প্রসারের পথে বিরাজমান যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ শিল্পের উত্তরণে এগিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট সকলের অন্যতম দায়িত্ব। আর এ লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই এখানে ১০০% সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এ শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে Garment Valleyতে পরিণত হবে। এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]