(সংকেত: ভূমিকা, কৃষি এক অলাভজনক খাতে পরিণত, লাভজনক না হওয়ার কারণ, বিএডিসি’র ভূমিকা, কৃষির বিরাষ্ট্রীয়করণ ও উদারীকরণ, কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি-স্যাপ, সমাধান)
ভূমিকা
ঐতিহাসিক ভাবেই বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৬% মানুষ বাস করে গ্রামাঞ্চলে। আবার গ্রামাঞ্চলের ৯০% মানুষ জীবিকার জন্য সরাসরি কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সর্বাধিক কর্মসংস্থানের খাতটি হচ্ছে কৃষি। বিগত ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৫১.৬৯%-ই হয়েছে কৃষিতে এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান হচ্ছে ২১.৭৭%। সবচেয়ে বড় কথা দেশের মানুষের অন্ন যোগাতে এই খাতটিই প্রধান ভূমিকা রাখে।
কৃষি এক অলাভজনক খাতে পরিণত
আমাদের কৃষি আজ দারুণ সংকটে নিমজ্জিত, কিন্তু এটি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা হয় সবচেয়ে কম। সার ও ডিজেল সংকটে কৃষকের আন্দোলনের সময় এবং সম্প্রতি খাদ্য ঘাটতির সময় ব্যতীত আমরা সাধারণত কৃষি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চাই নি কখনোই। অথচ আমাদের অর্থনীতির প্রাণ এই কৃষি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কৃষকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যে উৎপাদন করে, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস শেষ পর্যন্ত তার উৎপাদন খরচই ঘরে তুলতে পারে না। ফলে অব্যাহত ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কৃষক ঋণের জালে আটকে পড়ে এবং অবশেষে তার শেষ অবলম্বন এক টুকরো আবাদী জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এভাবে কৃষক সর্বস্বান্ত ও বেকার হয়ে পড়ে। বাঁচার তাগিদে প্রথমে ক্ষেতমজুরদের তালিকায় নিজের নাম লিখে এবং পরে গ্রামে কাজ না পেয়ে কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি জমায়। ছেড়ে যায় নিজের চিরচেনা গ্রামটি। এই হচ্ছে বাংলার কৃষকের যুগ-যুগান্তরের শোক গাঁথা ।
লাভজনক না হওয়ার কারণ
প্রথমত, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় উপকরণ খরচের হার বেড়েছে।
দ্বিতীয়ত, উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার হার উপকারণের দাম বাড়ার হারের চেয়ে কম হয়েছে।
তৃতীয়ত, উপকরণ ব্যয় বাড়ার হার অত্যন্ত উচ্চ ও দ্রুত হয়েছে বাজারবিরোধী তৎপরতায় (যেমন মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, কালোবাজারি ও মজুতাদারি)।
চতুর্থত, কৃষি উদারীকরণের কারণে বাজার এমনভাবে নিয়ন্ত্রণহীন করা হয়েছে যে বাজার থেকে উৎপাদকরা কম ও ব্যবসায়ীরা অধিক লাভ পেয়েছে। যেহেতু বাজারে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেহেতু ব্যবসায়ীরা কৃষক তথা উৎপাদকের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে পণ্য কিনে নেয়। আর ব্যবসায়ীদেরই বাজারে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে যা উৎপাদকের নেই। কৃষিখাতটি এহেন অলাভজনক হওয়ার এই কারণগুলো আরো গভীরে ঢুকতে চাইলে কয়েকটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। যেমন :
বিএডিসি’র ভূমিকা
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কার্যত এককভাবেই কৃষি উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ যেমন সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচ-যন্ত্রপাতি আমাদানি, সংগ্রহ ও বিতরণ-বিপণনের কাজগুলো করত। একটা সময়ে ভর্তুকি দিয়ে বিএডিসির মাধ্যমেই এককভাবে সার বিতরণ করা হত। এই ভর্তুকির ব্যবস্থার ফলে ক্ষুদ্র ও গরিব কৃষকদের জন্য কম দামে সার কেনার সুযোগ ছিল। এছাড়াও বিএডিসির তত্ত্বাবধানে সমবায়ভিত্তিক মালিকানা ব্যবস্থায় কৃষকদের পানি সেচের সুবিধা দেয়া হত। এই ব্যবস্থায় সেচ কার্যক্রমের ব্যয় কম পড়ত বলে দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা সহজইে সুযোগটি নিতে পারত। অন্যদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচের পানি সরবরাহ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশনের কাজ দেখভাল করত। ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেটি এড়াতে বা মোকাবেলায় টিসিবির মাধ্যমে সরকার হস্তক্ষেপ করত বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারত। এ দেশে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) নামের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি খুবই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারত।
কৃষির বিরাষ্ট্রীয়করণ ও উদারীকরণ
১৯৭১-৭২ অর্থবছরে যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় কৃষি খাতে সরকারের মূলধনী ব্যয় ছিল ৩১% সেখানে তা কমতে কমতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৩% এরও নিচে নেমে এসেছে। তেমনি ভাবে ১৯৯১ সালে যেখানে কৃষিখাতে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ১০%, সেখানে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে তা কমে ১.২% এ নেমে আসে। এর অর্থ হল, কৃষিখাতে সরকারের ভর্তুকি প্রদান মারাত্মকভাবে কমেছে। কেন? কারণ, কৃষির বিরাষ্ট্রীকরণ ও তথাকথিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ কৃষি উপকরণ সরবরাহ খাতে উদারীকরণ তথা বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। এটি করা হয় কৃষিতে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং বহির্বাণিজ্য উদারীকরণ নামে আমাদনি পর্যায়ের শুল্ক হ্রাস করার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর চাপে ক্রমান্বয়ে কৃষিখাতে ভর্তুকি হ্রাস ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সেবা সুবিধা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে উদারীকরণ ঘটে। বিশ্বব্যাংক ১৯৭৯ সালে খাদ্যনীতির ওপর প্রথম একটি প্রতিবেদনেই বিশ্বব্যাংক উৎপাদন বাড়ানো ও খাদ্যশস্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের ওপর জোর দিয়ে কৃষি উদারীকরণের পরামর্শ দেয়।
কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি-স্যাপ
আশির দশকের গোড়ার দিকে স্যাপ এর আওতায় বাংলাদেশের কৃষিখাতে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা নববইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চলে। এই কর্মসূচির আওতায় বাস্তবায়িত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হচ্ছে:
১. কৃষিখাতে বিশেষ করে সারে ভর্তুকি হ্রাস প্রত্যাহার, সার সরবরাহ-ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ।
২. আশির দশকের শেষ নাগাদ বেসরকারি ভাবে সেচ যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
৩. ১৯৯৫ সালে বেসরকারি খাতে চালসহ খাদ্যশস্য আমাদানীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
৪. কৃষিখাতে বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে সার আমাদানি, বিক্রয় ও বিতরণ এবং সেচ কার্যক্রম ও বীজ বিতরণের দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে সংকোচন।
৫. আশির দশকেই সরকারিভাবে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন। পল্লি অঞ্চলে রেশন বন্ধ করে খাদ্য নিরাপত্তার নতুন কর্মসূচি কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও ভিজিএফ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হয়।
১৯৯২ সালে জাতীয় বীজনীতি প্রবর্তন করে তাতে বীজ উৎপাদন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে পাঁচটি শস্য এককভাবে সরকারের হাতেই রেখে দেয়া হয়।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, কৃষিখাতের আয় ও লাভ কমে যাওয়ার বিষয়টি একাধারে জটিল ও বহুমুখী। তবে পুরোটাই বাংলাদেশের সরকারি তথা রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষত গত দেড় দশকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক কৌশলে ক্রমান্বয়ে কৃষি বিষয়ক সবরকম সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা তুলে দেয়ার কাজ করা হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-যোগানের মিথষ্কিয়ায় পণ্যসামগ্রীর দাম নির্ধারিত হয়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না’, এসব তত্ত্বকথা বলে বিশ্বব্যাংকের কথিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন (টিসিবি)সহ প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলায়, প্রয়োজনের সময় সরকারের পক্ষে কার্যকরভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সমাধান
সমাধান একটাই। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ এর কবল থেকে বেরিয়ে স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে তোলা, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা, রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় ও বাজেটেকৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা প্রধান। ফলে অতীত সরকারসমূহের ভূমিকা পর্যালোচনা করে, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা-সর্বাত্মক কৃষি আন্দোলনের মধ্যে সরকারকে বাধ্য করা এবং প্রয়োজনে কৃষি-বিরোধী সরকারসমূহকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে জনগণের প্রকৃত সরকার গঠন করা। দুনিয়াজুড়ে কৃষকদের আন্দোলন জোরদার হচ্ছে, কৃষকদের মধ্যে দাবিদাওয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ আন্দোলন বিশ্বব্যাংক আইএমএফ-ডব্লওটিও এর তাঁবেদার সরকারকে উচ্ছেদের আন্দোলনেও রূপান্তরিত হচ্ছে। কেননা, এটাই একমাত্র সমাধান।
আমাদের গ্যাস, বন্দর, কয়লা এসব নিয়েও দাতাগোষ্ঠীদের বিভিন্ন চক্রান্ত সফল হয় নি বা গণতান্ত্রিক সরকারসমূহ বাস্তবায়ন করতে পারে নি, সেগুলো নিয়ে আন্দোলনের ফলেই।
সুতরাং পুরোটাই নির্ভর করছে, আমাদের জনগণ কতখানি সচেতন ও কিভাবে ক্রিয়া করছে তার উপর।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ