বাংলা সংস্কৃতিতে একুশের চেতনা



(সংকেত: ভূমিকা; সংস্কৃতি; বাংলা সংস্কৃতি; মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস; সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারবোধে একুশ; বাংলা সংস্কৃতিতে একুশের চেতনা; বাংলা সাহিত্যে একুশের প্রভাব; সঙ্গীতে একুশের প্রভাব; একুশ উদযাপন; উপসংহার।)
ভূমিকা: মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে একাত্ম হয়ে আছে যে চেতনা, তার নাম মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মহৎ স্বীকৃতির প্রতীক এই দিনটি। পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াইয়ের এমন ইতিহাস আর দ্বিতীয়টি নেই। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ অমর ভাষা শহিদ আজও আমাদের চেতনার স্মারক। তাঁদের ত্যাগে ভাস্বর একুশ বাংলা সংস্কৃতির নতুন চেতনা সঞ্চারকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ। বাংলা সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে একুশের চেতনা এক অপরিমেয় শক্তি, প্রাণের দীপ্ত জাগরণ।
সংস্কৃতি: সংস্কৃতি মানুষের জীবনাচরণেরই অপর নাম। মানুষের সমস্ত আঁচার-আচরণের সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। মোতাহার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাঁচা।’ ম্যাথু আর্নল্ডের ভাষায়, ‘সংস্কৃতি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বের সর্বোত্তম জিনিসগুলোর সঙ্গে এবং সে সঙ্গে মানুষের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গেও।’ কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান বলেছেন, ‘সংস্কৃতি জীবনকে মোকাবিলার চেতনা।’ মানুষের বিশ্বাস, জ্ঞান, ভাষা, রুচি, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, পোশাক, পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধ, নিয়ম, নীতি, সংস্কার প্রভৃতি সংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা সংস্কৃতি: বাংলা ও বাঙালি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। বাংলা সংস্কৃতির রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। ধর্মীয় রীতিনীতি, উৎসব, লোকসাহিত্য, সঙ্গীত, ঋতু উৎসব, খেলাধুলা, সামাজিক প্রথা, প্রভৃতি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। তবে বিভিন্ন সময়ে সংস্কৃতির পালাবদল, রূপান্তর বা পরিবর্ধন সাধিত হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, দেশীয় খাবার, পোশাক, উৎসব, সম্প্রীতি প্রভৃতি ছাড়া বাংলা সংস্কৃতির কথা ভাবাই যায় না। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, নৌকা বাইচ, বৈশাখী মেলা, যাত্রাগান, রথযাত্রা, ঈদ-উসব প্রভৃতি আমাদের বাংলা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম শোষণ। ধীরে ধীরে পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলার জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ জমতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন-‘Urdu and only urdu shall be the state language of Pakistan.’ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথা বললে ছাত্রদের মধ্য থেকে , ‘No, No, It can’t be.’ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনও একই রকম ঘোষণা দেন। এতে সারাদেশে ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ৪ ফেব্রুারি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পালিত হয় ‘ধর্মঘট’। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ঢাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। রাজপথে মিলিত হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢেউ। এই মিছিলে সরকার গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরো অনেকেই শহিদ হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে যাওয়া এই ইতিহাস পৃথিবীর মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারবোধে একুশ: একটি দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে সে দেশের ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যুগ যুগান্তর ধরে বহমান থাকে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার যে লড়াই তা সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রামও বটে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আর শোকের দিন নয়, এটি অমর ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার এবং শোক-কে শক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে নব অধিকার চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার দিন। কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ স্মরণ করিয়ে দেয় সেই অগ্নিঝরা রাজপথের জ্বলন্ত প্রাণের মিছিলকে। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে উপ্ত ছিল, এদেশের মানুষের সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আকাক্সক্ষা। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে অধিকারবোধ জেগে ওঠে। বাংলা সংস্কৃতি রক্ষায় একুশের চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক উত্তরণের পথে গড়ে ওঠা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের এই জাগরণ পরবর্তীতে বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনাকে দিয়েছে অমেয় শক্তি। যার প্রকাশিত নাম ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
বাংলা সংস্কৃতিতে একুশের চেতনা: কোনো জাতির সম্যক পরিচয় ফুটে ওঠে তার সংস্কৃতির মধ্যে। সংস্কৃতি গড়ে ওঠে দীর্ঘদিনের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অগ্রযাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়ার ভিন্নতাও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপ অঞ্চলের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি এখানকার মানুষের জীবনবোধ, জীবনাচরণ, আবেগ-অনুভূতির মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত সংস্কৃতিকে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। সাহিত্যে, শিল্পে, পোশাকে, বিনোদনে ছিল অনুকরণ প্রিয়তা। কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনই সেই আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে এবং নিজস্ব সংস্কৃতির উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদেরকে করে তোলে বদ্ধ পরিকর। এই সংগ্রামের গড়ে উঠেছিল ‘ছায়ানট’, ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’র মতো সমাজ সংগঠনসমূহ।
বাংলা সাহিত্যে একুশের প্রভাব: বাংলা সাহিত্যে একুশের চেতনার বাস্তব প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এদেশের সচেতন লেখক ও শিল্পীগণ তাঁদের নিখুঁত তুলির আঁচড়ে একুশের চেতনাকে তুলে ধরেছেন উপন্যাস, নাটক, গল্প, কবিতাসহ সাহিত্যের প্রায় প্রত্যেকটি শাখায়। একুশের উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জহির রায়হানের ‘আরেক ফাগুন’, শওকত ওসমানের ‘আর্তনাদ’, সেলিনা হোসেনের ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ প্রভৃতি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম অভিনীত একুশের নাটক ‘কবর’ রচনা করেছিলেন শহিদ মুনীর চৌধুরী। কবি মাহবুব-উল আলম চৌধুরী রচনা করেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর কবিতায় মাতৃভাষা রক্ষার আকুতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
                                   ‘মাগো, ওরা বলে
                                              সবার কথা কেড়ে নেবে।
                                    বলো মা, তাই কি হয়?’
কবি সিকান্দার আবু জাফর জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছিলেন-
                                             ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই
                                      আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’
সঙ্গীতে একুশের প্রভাব: একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অনেক শিল্পী গান রচনা করেছেন। অসংখ্য বাংলা গানে একুশের চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়। সেসব গান বিখ্যাত সব শিল্পীদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে এখনও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর অমর রচনা-
                                     ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
                                                                                  আমি কি ভুলিতে পারি।’
সাহিত্য, সঙ্গীত ছাড়াও চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে একুশের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। জহির রায়হান নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন ও দেশপ্রেমের অপূর্ব চিত্র। পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রমুখের চিত্রকর্মে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও একুশের তাৎপর্য ধরা পড়েছে।
একুশে উদযাপন: প্রতি বছর প্রভাত ফেরীর মাধ্যমে শুরু হয় একুশ উদযাপন। এই দিনে নগ্ন পায়ে শহিদ মিনারে শহিদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। একুশের গান, কবিতায় চারদিক ধ্বনিত হয় মাতৃভাষার মাহাত্ম্য। বাংলা একাডেমিতে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে আয়োজিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা হয় একুশে পদক। বিশ্বের দরবারে বাঙালি, বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির গোরবগাঁথা পৌঁছে যায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে। অমর হয়ে থাকবে তাই একুশের চেতনা।
উপসংহার: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একুশের চেতনা ধারণ করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। একুশের চেতনা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের সংস্কৃতিকে উন্নতভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একুশের চেতনা অপরিহার্য। কেননা, সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে তা ভিন্নরূপে আমাদেরকে নির্মাণ করবে, সংস্কৃতিকে নবআঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করবে।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]