পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সম্ভাবনা



(সংকেত: ভূমিকা; পদ্মাসেতুর অবস্থান; একনজরে পদ্মাসেতু; পদ্মাসেতুর উদ্দেশ্য; পদ্মাসেতুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট; অর্থায়ন; অবকাঠামো; পদ্মাসেতু ও দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভাবনা; যোগাযোগ ব্যবস্থা; দারিদ্র্য দূরীকরণ; শিল্পায়ন; বাণিজ্য বৃদ্ধি; জিডিপি বৃদ্ধি; বাজার সৃষ্টি; যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি; জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক; উপসংহার।)
ভূমিকা: নদী মাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র নদী পথ জালের মতো ছড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় আবহমান বাংলায় ২৩০ টিরও অধিক ছোট বড় নদী রয়েছে। পদ্মা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী যার দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কিলোমিটার। আর এই পদ্মা নদীতেই খুব শীঘ্রই নির্মিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গের স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সেতুটি নির্মিত হলে এটি হবে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সেতু। পদ্মা সেতুর দ্বারা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে।
পদ্মাসেতুর অবস্থান: ভারতের হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে পদ্মা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি কুষ্টিয়া জেলার উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলতদিয়া নামক স্থানে যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ জেলা এবং শরীয়তপুর জেলার মাঝে পদ্মা সেতুর অবস্থান মাওয়া ও জাজিরা পয়েন্টে। রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর দূরত্ব হবে ৩০ কিলোমিটার।
একনজরে পদ্মাসেতু: দেশের প্রথম দ্বিতল সেতু (উপরে সড়ক ও নিচে রেল)। বাংলাদেশে একক বা যৌথভাবে (সড়ক ও রেল) দীর্ঘতম সেতু। দক্ষিণএশিয়ারও দীর্ঘতম সেতু। দৈর্ঘ্য হবে ৬.১৫ কিলোমিটার। অবস্থান হবে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট (মুন্সিগঞ্জ-শরীয়তপুর)। প্রস্থ হবে ১৮.১০ মিটার। নির্মাণ ব্যয় ২৯০ কোটি ডলার, উভয় প্রান্তে সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ১২ কি.মি., নদী শাসন-১৪ কি. মি., ভূমিকম্প সহনশীলমাত্রা রিখটার স্কেল ৯, সেতুর আয়ুষ্কাল হবে ১০০ বছর, লেন ৪টি, পাইল সংখ্যা ২৬০টি, কাঠামো-দ্বিতল, নির্মাণ দ্রব্য ইস্পাত সড়ক ভায়াডাক্ট-৩.১৪৮ কি. মি. রেল ভায়াডাক্ট ০.৫৩২ কি. মি.। ভূমি অধিগ্রহণ হবে ১,১২৪.৭৭ হেক্টর।
পদ্মাসেতুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হচ্ছে পদ্মা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি এটি। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে সেতু নির্মাণের স্থান ও প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে (BCL/RPT/NEDO) দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে খসড়া প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে দু’টি স্থানের কথা বলা হয় মাওয়া ও গোয়ালন্দ। মাওয়াকেই বেশি উপযুক্ত বলে প্রথম পদ্মাসেতু মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মাসেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরে নানা জটিলতায় কাজটি থমকে যায়। এরপর জাইকা ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালিয়ে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টকে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে। পরে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থায়নে সম্মত হলে ২০০৭ সালে একনেকে পদ্মাসেতু প্রকল্পটি পাস করা হয়।
পদ্মাসেতুর অর্থায়ন: পদ্মাসেতু প্রকল্পটি তিন বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল মেগাপ্রকল্প। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট একনেকের বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে পদ্মাসেতু প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল। পরবর্তীতে নির্মাণ ব্যয় সংশোধন করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা ধরা হয়। এতে অর্থায়নের জন্য ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৪টি দাতা গোষ্ঠীর সাথে এগুলো হলো-
দাতা  চুক্তি স্বাক্ষর পরিমাণ (মার্কিন ডলারে)
WB ২৮ এপ্রিল ২০১১  ১২০ কোটি
ADB ৬ জুন ২০১১ ৬২ কোটি
JICA ১৮ মে ২০১১    ৪০ কোটি
IDB ২৪ মে ২০১১  ১৪ কোটি
মোট ২৩৬ কোটি (মা.ড)
অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। উল্লেখ্য, এই দাতাগোষ্ঠীগুলো পদ্মাসেতু প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে ২০১৩ সালে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমানে চীনা কোম্পানি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে পদ্মা সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
পদ্মাসেতুর অবকাঠামো: পদ্মাসেতুটি হবে দ্বিতল এর উপরে থাকবে সড়ক, নিচে থাকবে রেল। মূল সেতুটি হবে ৪ লেনের। টোল তোলার জন্য দুটি টোল প্লাজা থাকবে। উভয় পাশে ১২ কি. মি. দীর্ঘ সংযোগ সড়ক হবে। সেতুটির আয়ষ্কাল হবে ১০০ বছর। ইস্পাত দ্বারা নির্মিত সেতুটির পাইল হবে ২৬৮টি। এর ওপর দিয়ে গ্যাস লাইন, বিদ্যুৎ লাইন যাবে।
পদ্মাসেতু ও দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভাবনা: বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের ৪৭.৩০ শতাংশ লোক কৃষির সাথে সরাসরি জড়িত। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক হারে কৃষিকার্য সংঘটিত হলেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা এসব দ্রব্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্যই গড়ে উঠেনি শিল্প কল-কারখানা। পদ্মাসেতু নির্মিত হলে এ অঞ্চলে শিল্পায়নসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা: দেশের জনগোষ্ঠীর এক বৃহত্তর অংশের বসবাস দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর যাওয়া আসার জন্য মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হিমশিম খায়। এতে দীর্ঘ যানজট, যাত্রী দুর্ভোগ, ব্যবসা বাণিজ্যের চরম ক্ষতিসাধন হয়। পদ্মাসেতু নির্মিত হলে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থার অপার দ্বার খুলে যাবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ: পদ্মাসেতু পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখবে। এই প্রজেক্টে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। ফলে প্রতিবছর ০.৮৪ শতাংশ দারিদ্র্য নিরসন হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
শিল্পায়ন: শিল্পায়নের পূর্বশর্ত হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামো। পদ্মাসেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ বঙ্গে শিল্পায়নের ব্যাপক গতি বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই দেশীয় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান পদ্মার ওপারে শিল্প স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাণিজ্য বৃদ্ধি: দেশের ২টি প্রধান সমুদ্র বন্দর মংলা ও চট্টগ্রাম। মংলা বন্দরের সাথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর নির্ভর করতে হয় বেশি। পদ্মাসেতু নির্মিত হলে বেনাপোল স্থলবন্দর ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে অধিক বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যাবে। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও পদ্মাসেতুর ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।
জিডিপি বৃদ্ধি: পদ্মাসেতু বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। পদ্মাসেতুর মধ্য দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির অবস্থান দাঁড়াবে ১.২ শতাংশ। যদি এভাব জিডিপি বৃদ্ধি পায় তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে।
বাজার সৃষ্টি: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ৩০ মিলিয়ন লোকের বসবাস। পদ্মাসেতু নির্মিত হলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই ব্যাপক মানুষের চাহিদা মেটাতে সৃষ্টি হবে নতুন বাজার।
যানবাহনের চলাচল বৃদ্ধি: জাইকার সমীক্ষা মতে, পদ্মাসেতুর মাধ্যমে প্রতিদিন ২১,৩০০ যানবাহন যাতায়াতে সক্ষম হবে আর ২০২৫ সালে এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪১,৬০০ তে। দেশের ১.২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাঁড়াবে ৩.৫ শতাংশে।
জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৪ মতে মোট জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৩৫৩৮ কি.মি আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৪২৭৬ কি.মি আর রেলপথের দৈর্ঘ্য ২,৮৩৫ কি.মি। পদ্মাসেতু নির্মাণ হলে সরকারের রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে তেমনি ঢাকা বিভাগের ৫টি জেলা, খুলনার ১০ জেলা এবং বরিশালের ৬ জেলার জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
উপসংহার: পদ্মাসেতু বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সোনালী স্বপ্নের এই পদ্মাসেতু শুধু দক্ষিণবঙ্গের সাথে ঢাকার সংযোগ নয়, বরং উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশসহ এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অনেক দূর।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]