শিষ্টাচার



(সংকেত: ভূমিকা; শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা; শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ; শিষ্টাচার মহামানবদের ভূষণ; ব্যক্তির সাফল্য অর্জনে শিষ্টাচার; বর্তমান উচ্ছৃঙ্খল সমাজজীবন ও শিষ্টাচারের ভূমিকা; রাষ্ট্র পরিচালনায় শিষ্টাচার; ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার; কর্মজীবনে শিষ্টাচার; শিষ্টাচার শেখার সময়; শিষ্টাচারহীনতার কুফল; মাত্রাতিরিক্ত শিষ্টাচার; উপসংহার।)
ভূমিকা: আদিমকালে মানুষ অত্যন্ত বর্বর জীবনযাপন করত। পরস্পরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ছিল আদিম মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। সর্বদা একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করে তারা বেঁচে থাকত। কালক্রমে মানুষ সভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলো অতিক্রম করে মনুষত্ব্যের বিকাশ ঘটেছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির হয়েছে আমূল পরিবর্তন। ক্রমাগত চর্চার ফলে মানুষ নানা রকম মানবীয় গুণাবলী অর্জন করেছে। এই সব গুণাবলীর সম্মিলিত রূপই হচ্ছে শিষ্টাচার।
শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা: শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। একজন মানুষ ভালো না মন্দ তা বিবেচিত হয় মূলত সে ব্যক্তির আচরণ দেখেই। শিষ্টাচার মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। শিষ্টাচার সম্পন্ন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করে। তাদের স্থান সমাজের উঁচু স্তরে, হোক সে ব্যক্তি অসুন্দর কিংবা গরীব। একমাত্র শিষ্টাচারই মানুষকে প্রকৃত মর্যাদায় ভূষিত করে।
শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ: মানুষের সকল মানবীয় গুণের সমন্বয়ের শিষ্টাচার গড়ে ওঠে আর এর প্রকাশ ঘটে মানুষের কথাবার্তা, চলাফেরার মধ্য দিয়ে। অনেক ছোটখাট বিষয় থেকেই একজন মানুষ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কথা বলার ধরণ, ভাষা, চেহারার অভিব্যক্তি সবকিছুর মধ্য দিয়েই মানুষের রুচি ও স্বভাবের প্রকাশ ঘটে। একজন মানুষের পোশাকের পারিপাট্য ও পরিচ্ছন্নতা, অঙ্গভঙ্গি সবকিছুই শিষ্টাচারের লক্ষণ বহন করে। সৎ পথে থাকা, সত্য কথা বলা, অন্যের মঙ্গলে কাজ করা সবকিছুই শিষ্টাচারের অংশ। এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই মানুষের শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
শিষ্টাচার মহামানবদের ভূষণ: পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসাবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, মহামানবের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের আচরণ স্বর্গীয় সুষমায় পরিপূর্ণ। মহানবী (স.) ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্ত প্রতীক। উন্নত ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। কখনো তিনি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, উদ্ধত আচরণ করেননি। এ কারণেই যুগে যুগে মানুষের কাছে তিনি এত শ্রদ্ধার পাত্র। জগদ্বিখ্যাত সকল ব্যক্তিই শিষ্টাচারকে তাদের চরিত্রে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে  শিষ্টাচার: কোনো মানুষই সর্বগুণ সম্পন্ন নয়। সব কাজ একা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। একজন মানুষের জীবনে উন্নতির পেছনে অন্য কোনো ব্যক্তির সামান্য সহযোগীতা লাগতেই পারে। এক্ষেত্রে একজন উদ্ধত ও রুক্ষ আচরণের ব্যক্তির অন্যের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগীতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যদিকে একজন মার্জিত ও বিনয়ী আচরণের ব্যক্তি সকলের প্রিয়। তাই তার কোনো কাজে বা বিপদে অন্যের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার অভাব হয় না। একজন শিষ্টাচার সম্পন্ন ব্যক্তি তার সুন্দর ও সংযত আচরণ দিয়ে সহজেই অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
বর্তমান সমাজে শিষ্টাচারের ভূমিকা: মানুষ দলবদ্ধভাবে সমাজে বাস করে। একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবনের আকাক্সক্ষা সবারই রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায়, নানা বিশৃঙ্খলা, কুশিক্ষা ও অসদাচরণে সমাজ পরিপূর্ণ। পৃথিবী যতই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সমাজজীবন ততই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। মাদকাসক্তি, খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং প্রভৃতি নানা অপকর্মে চারপাশ ছেয়ে যাচ্ছে। সমাজ দুর্নীতি ও অন্যায়ের জালে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ সংযম, ভদ্রতা ভুলে কুৎসিত ও নোংরা আচরণে লিপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের অশান্ত ও উচ্ছৃঙ্খল সমাজে শান্তি আনতে হলে সমাজের মানুষদের শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে হবে। কারণ শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি কোনো অন্যায়ের সাথে নিজেকে জড়ায় না, কারো সাথে শত্রুতা করে না বা কারো স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করে না।
রাষ্ট্র পরিচালনায় শিষ্টাচার: সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে রাষ্ট্র। এই বৃহৎ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন অল্প কিছু সংখ্যক ব্যক্তি। তাঁরা জাতির পথ প্রদর্শক। নিজ রাষ্ট্রের সুরক্ষা ও রাষ্ট্রের জনগণের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করার মহান দায়িত্বে তাঁরা নিয়োজিত। তাঁদের আচরণ যদি সংযত ও রুচিসম্মত না হয় তাহলে তারা দেশ পরিচালনার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রনায়ক যদি উন্নত আচরণের অধিকারী না হয় তাহলে দেশের জনগণ যেমন শান্তিতে বসবাস করতে পারে না তেমনি বাহিরের দেশগুলোর সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচার: আজকের ছাত্র আগামী দিনে জাতির কর্ণধার। তাই একজন ছাত্রের শুধু বিদ্যা অর্জন করলেই চলবে না, তাকে বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলীও অর্জন করতে হবে। একজন খুব ভালো ছাত্র যদি শিষ্টাচার সম্পন্ন না হয় তাহলে তাহলে সে শিক্ষক কিংবা সহপাঠী কারো কাছ থেকেই ভালোবাসা বা অনুপ্রেরণা পাবে না। উদ্ধত আচরণের কারণে সে সবার কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠবে। ফলে সে শিক্ষাজীবনে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে পারবে না। শিষ্টাচার একজন ছাত্রকে বিনয়ী ও নম্র করে তোলে যার মাধ্যমে সে সহপাঠী ও শিক্ষকদের হৃদয়ে সহজে স্থান করে নিতে পারে।
কর্মজীবনে শিষ্টাচার: মানুষ জীবিকা নির্বাহের তাগিদে নানা কর্মে নিযুক্ত হয়। শিষ্টাচার একজন মানুষের কর্মজীবনকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলে। শিষ্টাচার সম্পন্ন ব্যক্তি সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সদ্যবাদীতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা, উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু নিয়েই শিষ্টাচার। একজন শিষ্টাচার সম্পন্ন ব্যক্তি তার কর্মক্ষেত্রে সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করে। যা তার পদোন্নতিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শিষ্টাচার শেখার সময়: মানুষের জীবনের এক একটি গুণকে এক একটি ফুলের সাথে তুলনা করা যায়। একটির পর একটি ফুল গেঁথে যেমন মালা তৈরি করতে হয় তেমনি মানুষের মানবীয় সকল গুণগুলো যত্ন সহকারে একটির সাথে অপরটির সমন্বয় সাধন করে সবগুলো একত্রিত করলে অর্জিত হয় শিষ্টাচার। শিষ্টাচার হঠাৎ করে কারো মধ্যে গড়ে উঠতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপন হয় শিশুকালেই। আর এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারের বড়রা যেরকম ব্যবহার করে শিশুরা তাই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে।
শিষ্টাচারহীনতার কুফল: যে ব্যক্তি শিষ্টাচার অর্জন করতে পারে না, তার মানুষ হয়ে জন্মানোর কোনো সার্থকতা নেই। শিষ্টাচারহীন উদ্ধত মানুষ কেবল আকৃতির দিক থেকেই মানুষ, তাদের মনুষ্যত্বের কোনো বিকাশ ঘটে না। ফলে তারা সমাজের চোখে হয়ে থাকে ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ সাদৃশ্য। সমাজ এদের কোনো মর্যাদায় ভূষিত করে না, কুরুচিপূর্ণ এসব মানুষকে ফেলে রাখে আস্তাকুঁড়ে। সমাজে শিষ্টাচারের অভাব নৈতিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। সমাজজীবন হয়ে উঠে অশান্তিপূর্ণ। নানা কদর্যতা, অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ফলে সমাজে বসবাসকারী মানুষরা ভোগে অস্তিত্বের সংকটে। শিষ্টাচারহীনতা একটি দেশ ও জাতির উন্নয়নের অন্তরায়।
মাত্রাতিরিক্ত শিষ্টাচার: শিষ্টাচার মহৎ হৃদয়ের প্রকাশ। শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ স্বভাবতই অন্যের সামনে বিনম্র ও ভদ্র ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের এ সুসভ্য আচরণের সুযোগ নিয়ে অনেক সময় অন্যরা তাদের উপর নানা অন্যায়-অবিচার করে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তিরা লজ্জায় অনেক সময় তা মেনে নেয়। কিন্তু এটা গুরুতর অপরাধ। শিষ্টাচারের নামে অন্যায়কে ন্যায় বলে স্বীকার করা বা শত অত্যাচারে মুখ বুঝে থাকা উচিত নয়। এটা মাত্রাতিরিক্ত শিষ্টাচার যা অন্যায়কারীর সাহস আরো বৃদ্ধি করে। তাই শিষ্টাচারের সাথে অবশ্য সত্য স্বীকার করা ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো শক্তি থাকা দরকার। শিষ্টাচার মানে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে থাকা নয়। বরং সাহসিকতা ও বিনয়ের সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা।
উপসংহার: শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তির আবেদন সমাজের সব মানুষের কাছেই চিরস্থায়ী, হোক সে ব্যক্তি গরিব কিংবা অসুন্দর। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি সহজেই অন্যের মন জয় করে নিতে পারে। বর্তমানে কদর্য ও পঙ্কিলতায় মলিন সমাজ বসবাসের উপযোগী করে তুলতে শিষ্টাচার অত্যন্ত জরুরী। শিষ্টাচার মানুষের ক্ষুদ্র জীবনকে তাৎপর্যময় করে তোলে; মানুষের মন থেকে আত্ম-অহংকারের কালিমা মুছে মনকে করে পবিত্র; মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে উন্নীত করে দেবত্বের মর্যাদায়।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]