নিয়মানুবর্তিতা



(সংকেত: ভূমিকা; প্রকৃতিতে নিয়মানুবর্তিতা; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা; নিয়মানুবর্তিতা সাফল্যের পূর্বশর্ত; কর্মক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা; কৃষি কাজে নিয়মানুবর্তিতা; সৈনিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতা; শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় নিয়মানুবর্তিতা; ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা; নিয়মানুবর্তিতা চর্চার সময় ও ক্ষেত্র; অনিয়মের ফলাফল; অতি নিয়মের কুফল; উপসংহার।)
ভূমিকা: এ বিশ্বব্রহ্মা- নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের চারপাশের সবকিছুই নিয়মের সূক্ষ্ম জালে আবদ্ধ। প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে নানা নিয়ম শৃঙ্খলা। সবাইকেই এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়। নিয়ম ভঙ্গ করলে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে বসবাস করাকেই বলা হয় নিয়মানুবর্তিতা।
প্রকৃতিতে নিয়মানুবর্তিতা: প্রকৃতি একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আবর্তিত। প্রকৃতিতে ষড়ঋতু আসে তার নিজস্ব নিয়মে একটি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে। প্রতিদিন সূর্য ওঠে, তার আলো-উত্তাপ উজাড় করে দেয় পৃথিবীর বুকে। আবার দিন শেষে অস্ত যায়। নিয়ম ভঙ্গ করে কখনোই সে অসময়ে আবির্ভূত হতে পারে না। আবার সময়ের আগেই অস্ত যেতে পারে না। সৌরজগতের সকল গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয় তাদের নিজস্ব কক্ষপথে। কোথাও কোনো সূক্ষ্ম অনিয়ম ঘটলে ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু। প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের খাদ্যগ্রহণ বংশবিস্তার ঘটে প্রকৃত প্রদত্ত নিয়মে। কাজেই দেখা যায় প্রকৃতি সর্বত্র একটা ভারসাম্যমূলক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে তার বাহিরে যাওয়া অসম্ভব।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে নিয়মানুবর্তিতা: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে একত্রে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানা নিয়ম নীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব নিয়ম-নীতি মেনে চললে মানুষের মনে শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত হয়। এই শৃঙ্খলাবোধ সমাজ থেকে নানা অন্যায়-অবিচার দূরীভূত করতে সাহায্য করে। ফলে সমাজজীবন হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ। একইভাবে রাষ্ট্রীয় জীবনেও নিয়মানুবর্তিতার চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি রাষ্ট্রের কিছু নির্দিষ্ট অনুশাসন থাকে, যা সেই রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রতিটি নাগরিককে মেনে চলতে হয়। এসব অনুশাসন ভঙ্গ করলে সে নাগরিক রাষ্ট্রের আইনে অপরাধী বলে গণ্য হয় এবং রাষ্ট্র তার নিজস্ব নিয়মে ঐ অপরাধীর শাস্তি প্রদানের অধিকার রাখে। নিয়মানুবর্তিতা তাই সুনাগরিকের অন্যতম গুণ।
নিয়মানুবর্তিতা সাফল্যের পূর্বশর্ত: প্রতিটি মানুষই চায় জীবনে সাফল্য অর্জন করতে। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সফলতা কামনা করে। কেউ ধন-সম্পদে, কেউ মান-মর্যাদায় কেউবা বিদ্যায়। কিন্তু মানুষ যেভাবেই সফলতা আশা করুক না কেনো এর জন্য অবশ্যই তাকে নিয়মানুবর্তিতা চর্চা করতে হবে। শৃঙ্খলাহীন জীবনযাপন উন্নতির পথে অন্তরায়। শৃঙ্খলাবোধ মানুষের জীবনকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করে। ফলে নিয়মের অনুরাগী একজন মানুষ সহজেই তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা: জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিটি মানুষকেই কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। কর্মক্ষেত্রে নানা ধরণের নিয়ম-নীতি রয়েছে। প্রত্যেক কর্মচারীকেই এসব নিয়ম মেনে চলতে হয়। যেমন, সময় মতো কর্মস্থানে পৌঁছানো, নিজের কাজ ঠিক মতো করা, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্মস্থলে অবস্থান করা ইত্যাদি। কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীর নিয়মানুবর্তিতার অভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে যেতে পারে। এতে সে প্রতিষ্ঠানের মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অফিসের নিয়ম-শৃঙ্খলা ঠিক মতো পালন না করলে কর্মচারীদের উপর মালিক মনক্ষুণ্ন হয়। এমনকি বেতন কাটা, বহিষ্কার প্রভৃতির মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটারও সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রত্যেকের উচিত কর্মক্ষেত্রে সকল নিয়মশৃঙ্খলা মেনে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পূর্ণ করা।
কৃষিকাজে নিয়মানুবর্তিতা: আমাদের নিত্যদিনের ভোগ্য সামগ্রির অধিকাংশই আসে কৃষি থেকে। এই কৃষিকাজ অনেকটাই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত উৎপাদনের প্রায় প্রতিটি ধাপই প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। একজন কৃষককে ভালো উৎপাদন পেতে হলে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়। নিয়মের সামান্য ব্যাঘাত ঘটলে উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায়। নিড়ানী, পানি সেচ, কীটনাশক প্রয়োগ সব কিছু সঠিক সময়ে, সঠিক নিয়মে প্রয়োগ না করলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাই কৃষিকাজে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম।
সৈনিক জীবনে নিয়মানুবর্তিতা: সৈনিক জীবনের প্রধান কথা হচ্ছে শৃঙ্খলা। একজন সৈনিকের জীবনে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা। একটি দলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও দেশকে বহিঃশক্তির আক্রমন থেকে রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত থাকে সৈনিকদের উপর। দেশ, দেশের মানুষ ও দেশের সম্পদ রক্ষার পবিত্র কাজে সৈনিকরা নিয়োজিত। তাদের সামান্য একটু বিশৃঙ্খলা দেশ ও জাতির জীবনে মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। তাই সৈনিকদের কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা প্রদান করা হয়।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় নিয়মানুবর্তিতা: স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর সুস্থ থাকলে মানুষ সকল কাজে উদ্যম পায়। শরীর অসুস্থ থাকলে তার প্রভাব মনের উপরও পড়ে। ফলে সার্বিক সুখ-শান্তি নষ্ট হয়। সুস্বাস্থ্যই জীবনে উন্নয়নের প্রধান শর্ত। সুস্বাস্থ্য অর্জন করা সম্ভব নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে। শুধুমাত্র শারীরিক নয় মানসিক সুস্থতার জন্যও নিয়মানুবর্তিতার প্রয়োজন। একজন মানুষ বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে নানা রকম মানসিক চাপ তার উপর পড়ে। বিশৃঙ্খল মানুষ কোনো কাজই সঠিকভাবে সঠিক সময়ের মধ্যে করতে পারে না। ফলে সে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি সামাজিক মানমর্যাদার দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা: ছাত্রজীবন নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োগের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও ক্ষেত্র। আজকের ছাত্র  আগামী দিনে জাতির নেতৃত্ব প্রদানকারী। তাই তাদের যথাযথ নেতৃত্ব দানের জন্য উপযুক্তভাবেই গড়ে ওঠতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নিয়মানুবর্তিতা অর্জন ছাত্রজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু পড়াশুনার পাশাপাশি তাদের নিয়মিত পাঠক্রম বহির্ভূত আরো অনেক শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তাছাড়া সমাজের যে কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহণ করে থাকে। যে কোনো বিপদে-আপদে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের সেবায় তারা অগ্রগণ্য। এতো সব কাজের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হলে প্রয়োজন শৃঙ্খলাবোধ। শৃঙ্খলাবোধের মাধ্যমেই একজন ছাত্র যেমন তার শিক্ষাজীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে, তেমনি ভবিষ্যৎ জীবনেও হয়ে উঠতে পারে জাতির একজন যোগ্য পথ প্রদর্শক।
নিয়মানুবর্তিতা চর্চার সময় ও ক্ষেত্র: নিয়মানুবর্তিতা চর্চার শুরু হওয়া উচিত শিশুকাল থেকে। শিশু মন অত্যন্ত নরম; কাদা মাটির মতো। এ সময় মনে যে ছাপ লাগে তা সারাজীবনের জন্য স্থায়ী হয়ে যায়। শিশুকালে নিয়মানুবর্তিতায় অভ্যস্ত হলে মানুষ সারাজীবন এর প্রয়োগ ঘটাতে পারে। শিশুদের নিয়মানুবর্তিতা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। পরিবারই নিয়মানুবর্তিতা চর্চার প্রাথমিক ক্ষেত্র। এর পরেই ছাত্রজীবন নিয়মানুবর্তিতা চর্চার শ্রেষ্ঠ সময়। বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, কাব-স্কাউট, বিএনসিসি প্রভৃতি স্থান থেকে ছাত্ররা নিয়মানুবর্তিতা অর্জন করতে পারে।
অনিয়মের ফলাফল: নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের পরিণতি কখনো ভালো হতে পারে না। নিয়ম শৃঙ্খলার অভাব ব্যক্তিজীবন, সমাজ জীবন ও জাতীয় জীবনে চরম অরাজকতা বয়ে আনে। নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে জীবনযাপন না করলে মানুষ তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে না। শুধুমাত্র নিয়ম শৃঙ্খলার অভাবে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষ জীবনে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব ঘটলে সমাজ নানা অন্যায়-অবিচারে ছেয়ে যায়। মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে দুর্নীতির কালো থাবায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। নিয়মানুবর্তিতার অভাবে একটি দেশ ও জাতি ধাবিত হয় চরম অবনতির দিকে। পর্যাপ্ত জনবল ও সম্পদ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিয়ম-নীতির অভাবে তা কাজে লাগানো যায় না।
অতি নিয়মের কুফল: নিয়মানুবর্তিতা মানুষের জীবনকে উৎকর্ষতা দান করে। কিন্তু অতি নিয়মের বেড়াজাল মানুষকে অতিষ্ট করে তোলে। নিয়মানুবর্তিতা আর অতি নিয়ম বা নিয়মের বাড়াবাড়ি এক কথা নয়। নিয়ম যখন মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তখন তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে উন্নীত হয়। শৃঙ্খলিত মানুষ স্থায়ীভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে আত্মহত্যা প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। অতি নিয়মের বাড়াবাড়িতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। বাবা-মা অনেক সময় নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা দিতে গিয়ে শিশুদের অনেক বেশি শৃঙ্খলিত করে ফেলেন। ফলে তাদের বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। অনেক শিশুরা মানসিকভাবে নানা ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। অতি নিয়মের প্রভাব তাই মানুষের জীবনে মারাত্মক হুমকি।
উপসংহার: নিয়মানুবর্তিতা মানুষের চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। নানা নিয়ম পালনের মধ্য দিয়েই মানুষ সভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে; গড়ে তুলেছে মানব সভ্যতা। আজ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেসব জাতি তাদের সাফল্যের মূলে রয়েছে নিয়মানুবর্তিতা। নিয়মানুবর্তিতার চর্চা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরেই উন্নতির চাবিকাঠি।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]