(সংকেত: ভূমিকা, স্বদেশ প্রীতি? স্বদেশ প্রীতির বহিঃপ্রকাশ, স্বদেশ প্রীতির উন্মেষ, স্বদেশ প্রীতির প্রকৃত স্বরূপ, অন্ধ স্বদেশ প্রেমের ছিন্নমস্তা রূপ, স্বদেশ প্রেম ও বিশ্বপ্রেম, রবীন্দ্রনাথের মতে স্বদেশ প্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে সম্পর্ক, উপসংহার।)
ভূমিকা
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে॥ (রবীন্দ্রনাথ)
যে দেশ আলো দিল, বাতাস দিল, মুখে দিল অন্ন জল, দিল পরনের বস্ত্র, তাঁর প্রতি যদি সেই দেশের শ্যামলস্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের ভালোবাসা না থাকে, তবে তারা কেবল অকৃতজ্ঞ নয়, - অধন্য। স্বদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপ প্রকৃতি, তাঁর পশুপাখি, তার, প্রতিটি ধূলিকণা তাঁর সন্তানদের কাছে প্রিয়, পরম পবিত্র। দেশ মাতৃকার মৃন্ময়ী মূর্তি কেবল কাদা মাটি জলে নির্মিত প্রতিমা মাত্রই নয়, হৃদয়ের নিবিড় ভালোবাসায় এবং গভীর মমত্ববোধে সে সন্তানের অন্তরের অন্তঃস্থলে পরিগ্রহ করে চির আরাধ্যা চিন্ময়ী মূর্তি। স্বদেশের কাছে মানুষ সকল দিক দিয়েই ঋণী। স্বদেশ প্রীতি সেই ঋণ স্বীকার ও ঋণ শোধের উপায় মাত্র।
স্বদেশ প্রীতি
যে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং বড়ো হয়ে ওঠে, তাঁর প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি তাঁর একটা স্বাভাবিক অন্তর আকর্ষণ গড়ে ওঠে। স্বদেশের পশুপাখি, তরুলতা থেকে শুরু করে তাঁর প্রতিটি ধূলিকণা পর্যন্ত তাঁর পরম কামনার ধন। সে তখন আবেগবিহ্বল কণ্ঠে গেয়ে ওঠে ‘আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।’ দেশের প্রতি এই আজন্ম আকর্ষণ থেকেই স্বদেশ প্রীতির উন্মেষ। তখন মানুষ উপলব্ধি করে, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদর্পি গরীয়সী।’
স্বদেশ প্রীতির বহিঃপ্রকাশ
স্বদেশ প্রীতি মানুষের অন্তরে কখনো থাকে স্প্তু, কখনো জাগ্রত। কিন্তু স্বদেশ প্রীতির মূল প্রোথিত থাকে অন্তরের অন্তস্থলে। ঐক্যবদ্ধভাবে যখন দেশের সকল মানুষ একই জীবনধারায়, একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় পুষ্ট হয়ে একই আদর্শের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে, তখনই মৃন্ময়ী দেশ হয়ে ওঠে চিন্ময়ী। ‘ফুলে ও ফসলে, কাদা মাটি জলে’ দেশ তখন যথার্থ মাতৃভূমি হয়ে ওঠে। গরীয়সী জননী জন্মভূমিকে তখন সবাই পূজা করে; সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা দেশের তখন অভিষেক হয় জননী রূপে।
স্বদেশ প্রীতির উন্মেষ
সুখের দিনে স্বদেশ প্রেম থাকে সুপ্তিমগ্ন। কিন্তু দুঃখের দিনে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে স্বদেশ প্রেমের হয় শুভ উদ্বোধন। পরাধীনতার দুঃখ বেদনায়, পরদেশীয় অকথ্য নির্যাতনে অন্তরের সুপ্ত স্বদেশ প্রেমের ঘুম ভাঙে। কিংবা, দেশ যখন বিদেশিশত্রুর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়, তখন সমগ্র জাতি স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের লাঞ্ছনা মোচন ও মর্যাদা রক্ষাকল্পে প্রাণ বিসর্জন দেবার জন্যে দলে দলে ছুটে যায়। ১৯৭১ সালে প্রিয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে সেটাই প্রমাণ রেখেছে প্রিয় স্বদেশ ও বিশ্বমানবতার কাছে তখন মনে হয়, ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই, তাঁর ক্ষয় নাই’ দেশ দেশান্তরের ইতিহাসই তাঁর সাক্ষী। এক সাগরই রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা তারা সেই মন্ত্রেই উজ্জীবিত।
স্বদেশ প্রীতির প্রকৃত স্বরূপ
বস্তুত, দেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্ভ্রম বোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্ভ্রমবোধ যত প্রখর, সেই জাতির স্বদেশ প্রেম তত প্রবল। স্বদেশ প্রেম একপ্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাবিহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশ প্রেম। ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর স্বার্থের দিকে যখন মন পরিচালিত হয়, তখন আত্ম কল্যাণের চেয়ে বৃহত্তর কল্যাণবোধ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখনই জ্বলে ওঠে স্বদেশ প্রেমের নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা। স্বদেশের মান মর্যাদা এবং তাঁর গৌরব রক্ষাকল্পে শহীদ হয়েছে কত অমর প্রাণ। দেশ সেবার পথে বাধা বিস্তর, অত্যাচার সীমাহীন। কিন্তু পথের ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্রপাত তাদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কাছে মিথ্যা। পরদেশী শাসকের রক্তচক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র তাদের নিবৃত্ত করতে পারে না। প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বীর সূর্যসেন এবং তাদের উত্তরসূরী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় স্বদেশ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
অন্ধ স্বদেশ প্রেমের ছিন্নমস্তা রূপ
স্বদেশ প্রেম দেশ ও জাতির গৌরবের বস্তু, পরম শ্লাঘার বিষয়। কিন্তু অন্ধ স্বদেশ প্রেম ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ সে জাতিতে জাতিতে অনিবার্য করে তোলে সংঘাত ও সংঘর্ষ। অন্ধ স্বদেশপ্রেমে কেবল স্বদেশের কথাই চিন্তা করে। আমার স্বদেশের জয়গান যদি অপরের স্বদেশ প্রেমকে আহত করে, তবে সেই অন্ধ স্বদেশ প্রেম বিভিন্নদেশ ও জাতির মধ্যে ডেকে আনে ভয়াবহ রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব সংঘাত। মানুষের বক্ষ ক্ষরিত রক্ত পিচ্ছিল পথে চলতে থাকে উগ্র দেশপ্রেমের নৃশংস অভিযান। হিটলারের জার্মানি এবং মুসোলিনীর ইতালি উগ্র জাতীয়তার সেই নগ্ন বীভৎস প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেদিন বিশ্ব মানবতার বক্ষে পদস্থাপনে উদ্যত হয়েছিল। যখন অন্ধ জাতীয়তার মোহে উন্মত্ত ইউরোপে পরস্পর হানাহানিতে ব্যস্ত, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর উগ্র ছিন্নমস্তা রূপের সমালোচনা করে ও তাঁর বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে অনেকের বিরাগভাজন হন।
স্বদেশ প্রেম ও বিশ্বপ্রেম
আসল কথা, স্বদেশ প্রেমের সঙ্গে বিশ্ব প্রেমের কোনো অমিল নেই, কোনো সংঘাত নেই। স্বদেশ প্রেম তো বিশ্বপ্রেমেরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। স্বদেশ বলাবাহুল্য বিশ্বেরই অন্তর্ভুক্ত। স্বদেশের মধ্যস্থতায় বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। আমরা স্বদেশকে ভালোবেসে তাঁর পদমূলে যে ভক্তিপুত পূজা নিবেদন করি, তা গিয়ে পৌঁছায় বিশ্ব দেবতারই পদতলে। কাজেই, স্বদেশ প্রেম বলা যায় বিশ্ব প্রেমেরই প্রথম সোপান। স্বদেশ প্রেমের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আমরা বিশ্বপ্রেমেরই জগতে উপনীত হই। স্বদেশবাসীকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতে পারলে আমরা বিশ্ববাসীকেও মনেপ্রাণে ভালোবাসতে পারি। আবার যে স্বদেশবাসী সে বিশ্ববাসীও বটে। স্বদেশের নদী নির্ঝর, বন উপবন, গিরি পর্বত, তাঁর মানুষ এবং তাঁর সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিশ্বেরও মহাসম্পদ। কাজেই স্বদেশ প্রেম ও বিশ্বপ্রেমের উৎস এক ও অভিন্ন। তাদের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।
রবীন্দ্রনাথের মতে স্বদেশ প্রেম ও বিশ্ব প্রেমের মধ্যে সম্পর্ক
জাতীয়তা ও স্বদেশ প্রেম যখন সংকীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দী হয়ে উগ্র ছিন্নমস্তা রূপ ধারণ করে, তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়। স্বদেশকে একমাত্র পরম প্রিয় মনে করে আমরা বিশ্বকে শত্রু মনে করি এবং তাকে ধ্বংস করবার জন্যে ধাবিত হই। তখন শুভ বিচার বুদ্ধি স্বদেশ প্রেমের অন্ধ আবেগে লুপ্ত হয়। ফলে, পরস্পর হানাহানি এবং অবারিত রক্তক্ষয় অনিবার্যরূপে দেখা দেয়। আর নানা মারণাস্ত্র আবিষ্কারের ফলে সেই হানাহানি অচিরেই ধারণ করে চরম বিভীষিকাময় রূপ। বিংশ শতাব্দীতে অনুষ্ঠিত দুই/দুটি বিশ্বমহাযুদ্ধ সেই উগ্র জাতীয়তাবোধেরই নির্মম ফলশ্রুতি। কাজেই, উগ্র জাতীয়তাবোধে কল্যাণ নেই, শান্তি নেই, নেই বাঞ্ছিত জাতীয় সমৃদ্ধি। তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে শুনি:
‘ও আমার দেশের মাটি, তেমার পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’
দেশজননী ও বিশ্বজননী এক ও অভিন্ন। কারণ, দেশজননীর বক্ষের ওপর বিশ্ব জননীরও আঁচল পাতা। স্বদেশ ও বিশ্ব আমাদের ঐক্য চেতনার এপিঠ আর ওপিঠ।
উপসংহার
স্বদেশ প্রেম আমাদের অন্তরের জ্বলন্ত বহ্নিশিখা। সেই বহ্নিশিখায় একই সঙ্গে আমাদের দেশমাতৃকার হয় মঙ্গল আরাধনা এবং বিশ্ব জননীর হয় পূজার আরতি। ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে আমাদের স্বদেশ প্রেম ছিল ঘুমন্ত। পরে, বিদেশিদের নির্মম অত্যাচার ও ইংরেজ বিদ্বেষের ফলে ঘটে তাঁর ঘনীভূত প্রকাশ।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ