বাংলা রচনা/ বইমেলা / একুশের বইমেলা



(সংকেত: ভূমিকা, ইতিকথা, জাতীয় জীবনে বইমেলার গুরুত্ব, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে বইমেলার গুরুত্ব, বইমেলার গুরুত্ব, বইমেলার গুরুত্ব, বইমেলা, বইমেলা-আনন্দমুখর পরিবেশ, বইমেলা-কয়েকটি সমস্যা, বইমেলার উন্নয়ন-কয়েকটি প্রস্তাব, উপসংহার)
ভূমিকা
দুনিয়ার সভ্যতা বিকাশের পেছনে  প্রাচীনকাল থেকে যে বিষয়টি প্রধান ভূমিকা পালন করছে তা হচ্ছে বই। বই জ্ঞানচর্চার অন্যতম মাধ্যম। বই সভ্যতার মাপকাঠি; যোগাযোগের মাধ্যম, বই এক কালের সাথে অন্য কালের পরিচয় করিয়ে দেয়। বই মানব সভ্যতার বাহন। বই মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মানুষের জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। আর বইমেলা হচ্ছে প্রাণের মেলা, মননের মেলা, সৃষ্টিশীল চিন্তা বিকাশের উৎসব। বইমেলায় বিচিত্র ধরনের বইয়ের সমাবেশ হয়। বইমেলাকে ঘিরে সারাদেশে  লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এক আনন্দ ও চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বই সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি, বই পাঠের প্রসার, লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বইমেলার ভূমিকা অনন্য।
ইতিকথা
বাংলাদেশে বইমেলা বলতে অমর একুশ উপলক্ষে বর্ধমান হাউসের ওই বাংলা একাডেমীর বইমেলাকেই আমরা বুঝি। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, যা আজকের বাংলা একাডেমী সেই বাংলা একাডেমীর বহু কর্মকাণ্ডেরই একটি কর্মসূচি অমর একুশে বইমেলা। আজকের এই ব্যাপক বিস্তৃত বইমেলা গড়ে উঠতে সময় লেগেছে প্রায় পঞ্চাশ বছর। তিল তিল করে গড়ে উঠেছে মনন ও সৃজনের ভিত্তিভূমি হিসেবে। ১৯৬০ সাল থেকে বাংলা একাডেমীর অধীনে অমর একুশে উদযাপন শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক ব্যাপ্তি লাভ করে। ১৯৭২ সালে বাংলা একামেডী প্রথম একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে। ১৯৭৪ সালে এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমীতে একুশের অনুষ্ঠানমালার ব্যাপ্তি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ এবং এক নতুন দিগন্তের ভূমিকা করে। সরকার এই বইমেলাকে পূর্ণাঙ্গ একটি মেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গ্রন্থমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমীর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণীত হয় এবং গ্রন্থমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। বর্তমনে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়।
জাতীয় জীবনে বইমেলার গুরুত্ব
বই জ্ঞান ও বিজ্ঞনের আধার। বইয়ের মধ্যে জ্ঞানের রাজ্য অবস্থিত। বই পড়ে আমরা অতীত সম্বন্ধে অবগত হই, বর্তমানকে উপলব্ধি করি এবং ভবিষ্যতকে জানবার প্রয়াস খুঁজে পাই। বই মানুষের চিন্তার প্রসার ঘটায়, বুদ্ধিবৃত্তি সমৃদ্ধ করে, মনের গভীরতা বাড়ায়। বই মানুষকে সুপথে চালিত করে। চেতনা জাগ্রত করে। বই মানুষের ভুল ভ্রান্তি নিরসন করে, মানুষকে পরিবর্তিত করে, সংশোধিত ও মার্জিত করে, শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখে, চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে, সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে উৎসাহিত করে। বইমেলাকে তাই নানান রকম জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মেলা হিসেবে অভিহিত করা যায়। চারদিকে থরে থরে সাজানো জ্ঞানের এই সমাহারের মাঝে চিন্তাশীল যে কোনো মানুষই অভিভূত হতে বাধ্য।
বইমেলায় একই সঙ্গে বহু ও বিচিত্র ধরনের বইয়ের সমাবেশ ঘটে। তাছাড়া প্রকাশক বিক্রেতাগণ মেলা উপলক্ষে ক্রেতাদের সামান্য হলেও ছাড় প্রদান করেন। তাই অনেক পাঠক বই কেনার জন্য বইমেলা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। বইমেলায় প্রচুর সংখ্যক বই বিক্রি হয় বলে প্রকাশকগণও অপেক্ষায় থাকেন বইমেলার জন্য। সব মিলে জাতির সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা, মেধা ও মননের বিকাশ এবং প্রকাশনা শিল্পের ভিত্তি মজবুতকরণে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম।
সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে বইমেলার গুরুত্ব
বইমেলা নিছক একটি আনন্দ মেলা নয়। এই মেলার ঐতিহ্য আমাদের হৃদয়ে লালিত। বইমেলা লেখক লেখিকা, প্রকাশক বিক্রেতা, কবি সাহিত্যিক এবং পাঠকের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। বইমেলা গড়ে তুলেছে বিশাল পাঠক সমাজ। কবি কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ইত্যাকার মননশীল সৃজনশীল মানুষ তৈরিতেও বইমেলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ মেলাতেই মিলন ঘটে লেখক পাঠকের, প্রকাশক লেখকের। বইমেলায় লেখক, কবি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ থাকে। একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমীর কর্মীরা বইমেলার দর্শকদের জন্য মাসব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠান হয় বাংলা একাডেমীর মঞ্চে। এ মঞ্চেই ঘোষিত হয় বাংলা একাডেমী পুরস্কার, বইমেলা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় গান, কবিতা, আবৃত্তি, প্রবন্ধ পাঠ করা হয়, যা বইমেলায় আগত দর্শকেরা আনন্দের সাথে উপভোগ করে। গানের মধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, আধুনিক গান, লালন গীতি, পল্লি গীতি, পালা গান ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। এছাড়া আরো থাকে নাট্যাভিনয়, নৃত্যগীত, গদ্য পাঠ এবং বিভিন্ন রকমের বই পরিচিতির আলোচনা ও সমালোচনা। এতে দেশের খ্যাতনামা শিল্পী কুশলীবর্গ, বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করেন। আর এভাবেই বইমেলা দেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বইমেলার গুরুত্ব
পাঠক সমাজের কাছে বইমেলার উৎসবে যোগ দিয়ে পাঠক পরিচিত হন নিত্য নতুন বইয়ের সঙ্গে বিচিত্র লেখকের বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র বিষয়ের উন্নতমানের বই মন কেড়ে নেয় পাঠকদের। বইয়ের প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়ে, বই কেনার মানসিকতা তাদের তীব্র ভাবে পেয়ে বসে। বইমেলায় পাঠক ক্রেতা বই কেনার প্রত্যাশায় বই নেড়ে চেড়ে দেখার সুযোগ পান এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী সুন্দর বইটি কিনে নিতে পারেন। কিংবা মেলা শেষ হলেও পছন্দের বইটি সামর্থ্য বুঝে দোকান থেকে কিনে নেয়ার মন প্রস্তুত করতে পারেন।
সাধারণ বাজারের গতানুগতিক পরিবেশ বই কেনার বিষয়ে পাঠকের মনে অনেক সময় অরুচি ধরিয়ে দেয়। কিন্তু বইমেলার রুচিকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ক্রেতার বই কেনার রুচি ও শখকে উৎসাহিত করে। জ্ঞনের অনুসন্ধিৎসু ক্রেতার মনে বইমেলার সৌন্দর্য বাড়তি আনন্দ দান করে। বইমেলায় বহু ধরনের বইয়ের সমাবেশ ঘটে। ফলে উৎসাহী ক্রেতা নিজের পছন্দের বইটি সহজেই নির্বাচিত করতে পারেন। এছাড়া কোন বিষয়ে কোথায় কার নতুন লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার তালিকা সহজেই বইমেলা থেকে সংগ্রহ করা যায়। অনেক সময় বিখ্যাত লেখকবৃন্দও মেলায় উপস্থিত হন। তারা বইমেলার বিভিন্ন স্টলে বসেন। তাদের কেউ কেউ নিজ নিজ স্বাক্ষরসহ ভক্তক্রেতাদের নিকট বই বিক্রি করে ক্রেতাদের দেন বিমল আনন্দ, এক দুর্লভ মুহূর্তের স্মৃতি। আর এ সকল আকর্ষণের কারণেই বই প্রেমিক জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তিদের কাছে বইমেলার কদর দিন দিন বাড়ছে।
বইমেলার গুরুত্ব
লেখক প্রকাশকদের কাছে: বইমেলা লেখক ও প্রকাশকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। প্রায় সকল বিখ্যাত লেখক বইমেলা উপলক্ষে নতুন নতুন গল্প, কবিতা, উপন্যাস এবং অন্যান্য বিষয়ে তাদের নতুন লেখা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে প্রকাশকদের ব্যস্ততা থাকে সবচেয়ে বেশি। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রকাশিত হয় বহুসংখ্যক নতুন বই। ছপাখানাগুলোতে তখন কাজ চলে দিনরাত সর্বক্ষণ। লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক ও ডিজাইনার সকলেই থাকে তখন অত্যন্ত ব্যস্ত। বই ছাপা, বাঁধাই, ভাঁজাই কাটিং, ক্রিজিং, লেমিনেটিং ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় বই যাতে পাঠকদের হাতে তুলে দেয়া যায় সেজন্য এসকল বিষয়ের প্রতি প্রকাশককে গুরুত্ব দিতে হয়। মেলা উপলক্ষে যেমন নতুন বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায় তেমনি অনেক উৎসাহী সাহিত্যকর্মী প্রকাশ করেন লিটল ম্যাগাজিন। অনেক পুরাতন বইয়ের নতুন সংস্করণও প্রকাশ করা হয় বইমেলাকে সামনে রেখে। দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো বইমেলা বিষয়ক প্রতিদিনের সংবাদ প্রকাশ করে বিশেষ গুরুত্বের সাথে। বইমেলায় দেশের প্রতিষ্ঠিত খ্যাতিমান কবি লেখকদের পাশাপাশি তরুণ ও নবীন লেখকদের বইও প্রকাশিত হয়। বইমেলায় শিশুদের জন্য ছড়া, কবিতা, কার্টুন, রূপকথা, বিজ্ঞান ও ভূতের গল্পের বই থাকে। আর বড়দের প্রকাশনার মধ্যে উপন্যাসের চাহিদাই থাকে সর্বাধিক। আর এক্ষেত্রে কয়েকজন জনপ্রিয় লেখকের বই থাকে বিক্রির শীর্ষে।
বইমেলা
লেখক পাঠক প্রকাশকের মিলন মেলা: বইমেলা লেখক পাঠক প্রকাশকদের মিলন মেলাও বটে। এ মেলাকে লক্ষ্য করে সারা দেশ থেকে মেলায় আসেন লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মননশীল লোকজন। সবার মিলনের দিনক্ষণ হয়ে দাঁড়ায় বইমেলা। তাই বইমেলা পরিণত হয় প্রাণের মেলায়। বইমেলাতে লেখক পাঠক প্রকাশকগণ পরস্পর ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান। ফলে তারা একে অপরের চাহিদা বুঝতে পারেন। এই মেলাতে অনুষ্ঠিত হয় নতুন প্রকাশিত বইয়ের ওপর আলোচনা, বিখ্যাত লেখকদের ওপর আলোচনা। সেই সঙ্গে এখানে আলোচিত হয় বই প্রকাশনার অসুবিধাসমূহ। এখানে লেখকবৃন্দ স্মৃতিচারণ করেন তাদের জীবনের স্মরণীয় ঘটনা, স্মরণীয় লেখা সম্পর্কে। লেখকের অসুবিধা, প্রকাশকের প্রকাশনা সংকট, পাঠকের বই কেনার অনাগ্রহ সম্পর্কে এখানে আলোচনা সমালোচনা হয়। আর এ সবের মধ্যে দিয়েই আগামী বছরের বইমেলার জন্য, বইয়ের কাটতি বাড়াবার জন্য নতুন কর্মপন্থা ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়।
বইমেলা-আনন্দমুখর পরিবেশ
আমাদের কর্মব্যস্ততাপূর্ণ বর্তমান জটিল সমাজে বাজারে একসঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবা মা অনেক সময় বই কেনার সুযোগ পান না। নিজের সখের বইটি, প্রিয় লেখকের সর্বশেষ বইটি কিনে আনতে সময়ের বড়ই অভাব। কিন্তু বইমেলায় তারাই ছেলেমেয়েসহ ছুটে আসেন। সেখানে নিজের পছন্দের বই কেনার আনন্দের পাশাপাশি ছেলেমেয়ে স্ত্রীসহ বেড়িয়ে বাড়তি আনন্দটুকুও পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে পাওয়া যায় পুরনো বন্ধু বান্ধবের সান্নিধ্য, জ্ঞানীগুণী দর্শনের বিরল সৌভাগ্য। লেখক চত্বরে প্রতিদিন নতুন নতুন বই-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয় আনন্দঘন ছোট ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার বিভিন্ন আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানও দর্শকরা প্রাণভরে উপভোগ করে। সবমিলিয়ে বইমেলার বিচিত্র ও মনোরম পরিবেশ সবাইকে দেয় এক নির্মল আনন্দ।
বইমেলা-কয়েকটি সমস্যা
প্রতি বছর আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব বইমেলা বইয়ের প্রচার ও বিক্রির প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এ সকল মেলায় সাধারণ কয়েকটি সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। যেমন:
১. অমর একুশে বইমেলা ও ঢাকা বইমেলায় ক্রেতাদের কাছ থেকে একটি অভিন্ন প্রশ্ন সম্প্রতি উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের মেলায় আকর্ষণীয় কমিশনে পণ্য বিক্রি হচ্ছে অথচ বইমেলার ক্ষেত্র ঘটছে তার উল্টোটি। এটি কেন? ক্রেতাদের এই অভিযোগ সর্বাংশেই সত্যি। বই বাজার বলে খ্যাত ঢাকার বাংলাবাজারে সৃজনশীল বই শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশনে বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু বইমেলায় সেখানে ২০ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রির রীতিটা বেশ বেমানান বৈকি। মেলায় যেখানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি বরং সেখানেই কমিশন বেশি দেওয়া সম্ভব। এতেকরে বইয়ের ক্রেতাও বহুলাংশে বেড়ে যাবে। প্রকাশকদের এই বিশেষ কমিশন যদি সরাসরি ক্রেতারা পান তাহলে তা বই বিক্রির প্রসারে বিরাট ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে। তাই প্রকাশকদের উচিত এ বিষয়টি ভেবে দেখা।
২. বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা বইমেলার আরেকটি সমস্যা। কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার কারণে অনেক সময় বইমেলার শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোও ঠিকমত হয় না।
৩. রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যের কারণেও অনেক সময় বইমেলায় অনিয়ম হয়ে থাকে। দল মত নির্বিশেষে সকল লেখক, গবেষক, কবি সাহিত্যিক বইমেলার আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের সমর্থক ব্যক্তিরাই এসকল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না।
৪. বখাটে ছেলেদের উৎপাতের ফলে মেয়েরা বইমেলায় যেতে উৎসাহ বোধ করেন না। বিশেষ করে ভীড়ের মাঝে অনেক সময় মেয়েরা তাদের হাতে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হয়। এটা বইমেলার একটি গুরুতর সমস্যা।
৫. বইমেলার স্টল বরাদ্দ নিয়ে প্রায়ই অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়। স্টল বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য অনেক প্রকাশনা সংস্থা মেলায় স্টল বরাদ্দ পায় না। আবার অনেক অযোগ্য ও অখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা দলীয় কারণ বা অন্যান্য দুর্নীতির কারণে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পায়। স্টল বরাদ্দে এ ধরনের অনিয়মের ফলে অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত প্রকাশনা সংস্থা নতুন নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
৬. স্বল্প পরিসরে অধিক সংখ্যক স্টল বরাদ্দ দেওয়া বইমেলার আরেকটি সমস্যা। এর ফলে পর্যান্ত খোলামেলা জায়গার অভাবে বইমেলায় স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করা সম্ভব হয় না।
৭. অনেক ক্ষেত্রে বইমেলায় বইয়ের স্টলের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম খাবার, পানীয়, কুটির শিল্প, হস্তশিল্প তাঁতশিল্প, নানা রকম গান কবিতার ক্যাসেট ইত্যাদির স্টলও থাকে। এর ফলে বইমেলার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। এ ছাড়াও ধূলাবালির আধিক্য, অত্যাধিক হৈ চৈ, আলোর স্বল্পতা ইত্যাদিও বইমেলার সাধারণ সমস্যা।
বইমেলার উন্নয়ন-কয়েকটি প্রস্তাব
বইমেলা প্রাণের মেলা, মননের মেলা। লেখক পাঠক প্রকাশক তথা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বই সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি এবং বই পাঠের ব্যাপক প্রসারে বই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে বইমেলার সার্বিক উন্নয়নের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করা হলো:
১. বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আকর্ষণীয় কমিশনে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। ২০ শতাংশের পরিবর্তে কমপক্ষে ৩৫-৪০ শতাংশ কমিশনে বইমেলায় বই বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এর ফলে বই বিক্রি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করা হয়।
২. বইমেলার সার্বিক শঙ্খলা যাতে বজায় থাকে, সকল কার্যক্রম যাতে সুচারুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সেজন্য কর্তৃপক্ষকে আরো তৎপর হতে হবে।
৩. দল মত নির্বিশেষে সকল লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীকে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বইমেলার সকল কার্যক্রমে নির্বিঘ্নে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করতে হবে।
৪. বইমেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। মেয়েদের জন্য মেলায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বখাটে ছেলেদের উৎপাত বন্ধ করতে হবে।
৫. বইমেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে সকল প্রকার অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। কেবল প্রকৃত এবং যোগ্য প্রকাশনা সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
৬. বইমেলার দর্শক এবং স্টল সংখ্যা বাড়লেও মেলা প্রাঙ্গণের জায়গা বাড়েনি। এর ফলে মেলায় আসা জনগণের হাঁটা চলা কষ্টকর হচ্ছে। বিশেষত মহিলাদের অবস্থা শোচনীয়। তাই বইমেলার জায়গা প্রশস্ততর করা প্রয়োজন।
৭. মেলা প্রাঙ্গনে অনেক সময় হরেক রকম মনোহারী সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে। যত্রতত্র স্টল বসে। বইমেলার সঙ্গে এগুলো সামঞ্জস্যহীন। তাই বইমেলার প্রাঙ্গনে এগুলো নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। কারণ এগুলোর উপস্থিতি বইমেলার গাম্ভীর্য ও স্নিগ্ধতাকে নষ্ট করে।
৮. একুশের সকল অনুষ্ঠানে দেশের সর্বত্রই বইমেলাকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের প্রতিটি জেলা, থানা, বড় বড় বাজার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বইমেলার আয়োজন করা দরকার। এর ফলে দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের মাঝে বই কেনা ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে। অন্যদিকে এসব মেলায় স্থানীয় বই বিক্রেতাগণও অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন।
৯. স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের সরকারি ও বেসরকারি পুরস্কার বিতরণীতে নগদ অর্থ বা মেডেলের পরিবর্তে বই উপহার দেয়ার রীতি প্রচলন করা দরকার। এর ফলে বই বিক্রি বাড়বে।
১০. প্রতিটি থানা, জেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গণগ্রন্থাগার স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। সরকারি অনুদানের দিকে না তাকিয়ে উৎসাহী জনপ্রতিনিধি এবং দেশপ্রেমিক সমাজ কর্মীগণ স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলেই তা করতে পারেন।
১১. স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসকবৃন্দ এবং ঐতিহ্য সন্ধানী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের খ্যাতিমান প্রয়াত শিল্পী, সাহিত্যিকদের নাম বইমেলা প্রবর্তন করলে তরুণ সম্প্রদায় নিজ নিজ অঞ্চলের ঐহিত্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধাবান হবে-পড়বে তাদের গ্রন্থাবলী, প্রকাশকগণও পাবেন উৎসাহ।
১২. ফেব্রুয়ারি মাসকে ‘বই উপহার ও বইমেলার মাস’ ঘোষণা করে প্রিয়জনকে বই উপহার দিন আহ্বান সম্বলিত বহুরঙা পোস্টার ও স্টিকার শহর বন্দর নগরে, গাড়ির কাঁচে, ঘরের দরজায়, অফিস আদালতে, বিপনি বিতানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দর্শনীয় স্থানে লাগানো যেতে পারে।
১৩. ঢাকা মহানগরীসহ মফস্বলে ছোটবড় শহরের ব্যস্ততম সড়ক দ্বীপ ও দর্শনীয় স্থানকে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়া সম্পর্কিত ব্যানার, হোল্ডিং ও ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা যেতে পারে।
১৪. সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব যেমন লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী আইনজীবী, রাজনীতিবিদ এবং গুণীজনদের সমন্বয়ে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বই কেনা, বই মেলা ও বই উপহার দেওয়ার ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্ণাঢ্য র‌্যালি করা যেতে পারে।
১৫. প্রিন্টিং মিডিয়া তাদের পত্রিকায় প্রিয়জনকে বই উপহার দেবার পক্ষে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ছেপে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে পারে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিটিভি, বিভিন্ন স্যাটেলাইট টিভি এ সম্পর্কিত রিপোর্টিং, সাক্ষাৎকার প্রভৃতি অনুষ্ঠান প্রচার করে সর্বসাধারণকে এ কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন কেন্দ্র প্রচার প্রচারণার কাজে প্রভূত সহায়তা করে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
১৬. দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনী শুরু হবার আগে, বিরতিতে বইমেলা, বই কেনা এবং বই উপহার সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন স্লাইড দেখানো যেতে পারে।
১৭. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক অভিভাবক সমন্বয়ে এ সম্পর্কে বাড়ি বাড়ি প্রচার প্রচারণা চালানো যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা, পিতামাতা ও নিকট আত্মীয় স্বজনকে ফেব্রুয়ারি মাসের বই মেলা ও বই উপহার কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
১৮. শহরের ব্যস্ততম এলাকায় তারকা শিল্পীদের নিয়ে ‘রিডিং ম্যারাথন’ কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে।
উপসংহার
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী পাল্টে যাচ্ছে অতি দ্রুত। জীবন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে যাচ্ছে। মানুষ স্বল্প পরিশ্রমে বেশি সাফল্য অর্জন করতে চায়। কমপিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীটাকে হাতের মধ্যে এনে দেয়, চোখ মেললেই দেখা যায় জাপান থেকে জার্মনি কোথায় কি ঘটছে। অনেকেরই আশঙ্কা আগামী দিন এই মুদ্রিত বই, এই উৎসবমুখর বইমেলা থাকবে তো, থাকলে কেমন হবে? মানুষ বই দেখবে, না পড়বে? বই থাকবে, কারণ বই অনন্তকালের। বই চিরকালের স্বজন, ভালোবাসা। তাই বইমেলাও থাকবে। আরো সমারোহে, নতুন নতুন বই নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে। কারণ বইমেলা আমাদের জাতীয় আশা আকাঙ্কার উদ্দীপনার, জাগরণের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক। বইমেলা শুধু পাঠক প্রকাশক লেখকের মেলা নয়, বইমেলা সমগ্র জাতির।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]