বাংলা রচনা/ কৃষিকাজে বিজ্ঞান / কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা বা অবদান/ কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ



(সংকেত: ভূমিকা, মানুষের প্রাচীন পেশা কৃষির অবস্থান, কৃষিকাজে বিজ্ঞানের অবদান, বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান, বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা, কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রভাব, কৃষিতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব, উপসংহার।)
ভূমিকা
পৃথিবীকে আজ আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে যে বিজ্ঞান তা সর্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। জীবন এবং আজকের সভ্যতার এমন কোনো অধ্যায় নেই যেখানে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটে নি। বিজ্ঞান জীবনকে করেছে গতিশীল, সুন্দর, স্বাচ্ছন্দ্যময়। বিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে এবং প্রকৃতির বিপুল সম্পদে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে উন্নতির নব নব স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের শুভ কল্যাণকর শক্তি মানুষকে পশুস্তর থেকে উন্নীত করে পরিণত করে সভ্য মানুষে। সর্বত্র আজ বিজ্ঞানের জয় জয়কার। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে কিছু কুফল থাকলেও এর সুষ্ঠু সুন্দর ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে আজ অনস্বীকার্য। মানুষের আদিমতম পেশা কৃষিতেও তাই চাহিদার প্রেক্ষিতেই বিজ্ঞান অপরিহার্য। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি সাধনের জন্য কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগের অপরিহার্যতা সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
মানুষের প্রাচীন পেশা কৃষির অবস্থান
আদিম মানুষের যাযাবর জীবনে কৃষি দিয়েছিল স্থায়ী বসবাসের ধারণা। কৃষির মাধ্যমেই মানব সভ্যতার ভূমিকা। সেই কৃষি জীবনধারণের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে আজও টিকে আছে। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কলকারখানার কাঁচামাল সবই সরবরাহ করে কৃষি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের চাহিদাও বাড়তে থাকে। আর অধিক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কিভাবে চাহিদা পূরণ করা যায় তার জন্য কৃষিকাজের ওপর নানা দেশে গবেষণা চলছে। বহু দেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক। তাদের জাতীয় আয়, উন্নয়ন ও জীবন ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমেই আজ বহু দেশ উন্নতির শিখরে। তাই বলা যায়, কৃষির অবস্থান সবার ওপরে। আর কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নততর করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানের প্রয়োগ আবশ্যক।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের অবদান
মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগে যে অগ্রগতি ও উন্নতি সাধিত হচ্ছে কৃষির বিষয়টি তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সচেতন মানবসমাজ উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানের সহায়তায় কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। অগ্রসর বিশ্বে আবাদি জমি বাড়ায় বিজ্ঞানের অবদানকে কাজে লাগানো হয়েছে। উন্নতমানের বীজ উৎপাদনের জন্য প্রচুর গবেষণার কাজ চলছে। ব্যাপক জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন : চাষকাজের সুবিধার জন্য কলের লাঙল, পানিসেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ, বীজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রক্ষা করে প্রয়োজনমতো ব্যবহার, পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য কীটনাশক ইত্যাদি। এছাড়া গবেষণার মাধ্যমে ভালো জাতের ফসলের উদ্ভাবন, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উন্নতমানের সারের উদ্ভাবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিশেষ অবদান রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খাদ্য সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যার ভারসাম্য রক্ষা করে। এমনই একটি গবেষণার কেন্দ্র আই.আর.আর.আই। প্রতিষ্ঠানটি ধানের উচ্চফলনের জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান
উন্নত দেশসমূহে আজ কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। জমি কর্ষণ, বীজ বপন, সেচ কাজ, ফসল কাটা, মাড়াই এবং বাছাই ইত্যাদি সব কাজ যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয়। ট্রাক্টরের সাহায্যে জমি চাষ করে মেশিন দিয়ে জমিতে বীজ বপন করা হয়। তার আগে বপনের জন্য সংরক্ষিত বীজ বাছাই কাজ যন্ত্রের দ্বারা করা হয়। জমিতে প্রয়োজনমতো সার দেওয়া কিংবা ফসলে পোকা লাগলে তা দমনের জন্য ওষুধ ছিটানোর কাজও যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়। আজকের যুগে ফসলের জমি সেচের জন্য মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টি শস্য জন্মানোর অন্তরায় হয় না। আজ মানুষ গভীর নলকূপ এবং পাম্পের সাহায্যে জমিতে সেচ দেয়। ফসল কাটা যন্ত্রের সাহায্যে একদিকে ফসল কাটছে, অন্যদিকে যন্ত্রের সাহায্যে মাড়াই হয়ে শস্য ও খড় আলাদা হয়ে যাচ্ছে। শীতপ্রধান দেশে ‘শীত নিয়ন্ত্রিত’ ঘর বানিয়ে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের শাকসবজি এবং ফলমূল উৎপন্ন করছে। বিজ্ঞানের সাহায্যে বর্তমানে বিশুষ্কমরুভূমির মতো জায়গায় সেচ, সার ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করে সোনার ফসল ফলাচ্ছে। যেমন, সৌদি আরব মরুভূমিতে গম উৎপাদন করছে ব্যাপক ভিত্তিতে, বিজ্ঞানের প্রয়োগের ফলে ঐসব দেশের ফলন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাপানের জমির উর্বরতা আমাদের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ হলেও তাদের ফসলের ফলন ও গুণাগুণ বেশি। এভাবে বর্তমান বিজ্ঞান কৃষিকাজে এক যুগান্তকারী বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা
আধুনিক কৃষিতে বিজ্ঞানের কিছু প্রভাব পড়লেও এদেশের কৃষিব্যবস্থা এখনো মান্ধাতা আমলের। এদেশের একজন জীর্ণ কৃষক ততোধিক জীর্ণ দুটি বলদকে ঠেলে কৃষি উৎপাদনের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। উন্নত কৃষি প্রয়োগের প্রয়োজনীয় জ্ঞান তাদের যেমন নেই, তেমনি উন্নত কলাকৌশল প্রয়োগের জন্য ও উপযুক্ত আর্থিক সামর্থ্যরে তাদের দারুণ অভাব। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত কৃষক সমাজের কাছে উন্নত কৃষি পদ্ধতির আহ্বান পৌঁছায় নি। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত অধিকাংশ কৃষক আর্থিক কারণে উন্নত কলাকুশলতার চিন্তাও করে না। ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষিরা বেঁচে থাকার তাগিদে পরের জমিতে শ্রম দেয়। সেখানে উন্নত পদ্ধতির চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। কৃষকরা মহাজনের হাতে বাধা পড়ে আছে। ব্যাংক ঋণের বোঝা নিয়ে তাদের চলতে হয়। এসব কারণে কৃষকরা আবাদি জমি ভালোভাবে চাষ করতে পারে না, ভালো বীজ সংগ্রহে ব্যর্থ হয়, প্রয়োজনীয় সার ও সেচের অভাব ঘটে, কীটনাশক প্রয়োগও যথাযথ হয় না, ফসল মাড়াই ও সংরক্ষণের ভালো ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে জমি থেকে যে পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হয় তা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত এবং তা কৃষকের জীবনে সচ্ছলতা আনতে পারে না। সামগ্রিক পরিস্থিতি মিলিয়ে দেশের চাহিদা মেটাবার মতো খাদ্যশস্য জমি থেকে উৎপাদিত হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে অশিক্ষা আর দারিদ্র্যের কারণে কৃষিকাজে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলব্ধ কলাকৌশল প্রবর্তন করা পরিপূর্ণরূপে সম্ভব না হওয়ায় খাদ্য সমস্যা সমাধান ও সম্ভব হচ্ছে না। তাই, এদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়োগ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রভাব
স্বল্প পরিমাণে হলেও আমাদের দেশে এখন কৃষিকাজে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশেও উৎপাদন কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য জমির খণ্ড-বিখণ্ডতার কারণে ব্যাপকভাবে ট্রাক্টর ব্যবহার করা যাচ্ছে না, তবে সেচকার্যের জন্য মানুষ এখন আর চাতকের ন্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। এখন জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপ এবং মেশিনচালিত পাম্প। উপযুক্ত না হলেও কৃষকরা বর্তমানে কীটনাশক ব্যবহার করছে এবং উন্নত বীজ ব্যবহারের ব্যাপকতা বাড়ছে। দেশে কৃষি গবেষণা ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ও দ্রুত ফলনশীল ফসলের বীজ উদ্ভাবনে সফলকাম হয়েছে। কিছুদিন আগে একটি উন্নতমানের সার উদ্ভাবিত হয়েছে ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও ক্রমান্বয়ে কৃষির মাধ্যমে উন্নতির পথে ধাবিত হচ্ছে।
কৃষিতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব
আমাদের দেশে শিল্পায়ন সুদূরপরাহত। তাই জাতীয় উন্নয়ন একান্তই কৃষি মুখাপেক্ষী। কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আমাদের পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ১৭৪ টি দেশের মধ্যে উন্নয়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫-তে। সুতরাং দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের কৃষিতে বিজ্ঞানের ব্যবহার অপরিহার্য। খণ্ড খণ্ড জমি একত্রিত করে ট্রাক্টরের সাহায্যে উন্নত বীজ সরবরাহ ও কৃষিঋণের ব্যবস্থা, পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিরক্ষরতা দূর করে কৃষকদের কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে।
উপসংহার
মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি দিন দিন বাড়ছে। প্রকৃতিকে কীভাবে আরো ব্যাপকভাবে মানব কল্যাণে কাজে লাগানো যায় তার জন্য ব্যাপক গবেষণা চলছে। আকাশের মেঘকে নিয়ন্ত্রণে এনে কৃষি উৎপাদনের কাজে লাগাবার চেষ্টা মানুষ করছে। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের অবদান অনন্য। দেশের পঁচাশি ভাগ লোক কৃষিকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। আধুনিক বিশ্বের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভাণ্ডার দিয়ে কৃষিকে উন্নতমানের করা সম্ভবপর হলে জাতির অনগ্রসরতা কাটানো সম্ভব। দেশে বিদেশে কৃষি সম্পর্কিত  বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কৃষকদের জীবনে যাতে অর্থবহ প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন থাকতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মুক্তি তখনই সম্ভব যখন আমরা ব্যাপকভত্তিতে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকাজ শুরু করব।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]