মে দিবসের তাৎপর্য



(সংকেত: ভূমিকা; মে দিবসের ইতিহাস; আন্তর্জাতিক মে দিবস; মে দিবসের প্রভাব; মে দিবস ও শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ; মে দিবস ও পুঁজিবাদী দাসত্বমুক্তি; মে দিবসের তাৎপর্য; বিশ্বব্যাপী মে দিবস উদযাপন; বাংলাদেশে মে দিবস; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ প্রতিবছর মে মাসের প্রথম তারিখে বিশ্বব্যাপী পালিত ঐতিহাসিক দিবসটি ‘মে দিবস’ নামে পরিচিত। শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দুর্বার আন্দোলনের রক্তস্রোত স্মৃতি বিজড়িত এই মে দিবস। শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রতি অবিচারের অবসান ঘটাবার সুতিকাগার বলা হয় মে দিবসকে। প্রায় দেড়শত বছর আগে শ্রমিকদের মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় শ্রমজীবী মানুষের বিজয়ের ধারা। সেই বিজয়ের ধারায় উদ্ভাসিত বর্তমান বিশ্বের সকল প্রান্তের প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় সারাবিশ্বে প্রতি বছর উদযাপিত হয়ে আসছে মহান মে দিবস।
মে দিবসের ইতিহাসঃ শ্রমের শোষণের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রাম সবসময় সকল সমাজে ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে শ্রমজীবীরা ধীরে ধীরে তাদের শ্রমের মর্যাদা পেতে শুরু করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শ্রমের কোনো সময় নির্ধারণ করা ছিল না। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে ১৬-১৮ ঘণ্টার শ্রম আদায় করে নিত, যা স্বভাবতই তারা মেনে নিতে পারতো না। এক সময় শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। তাদের এই প্রতিবাদের সুর ধীরে ধীরে বিপ্লবে পরিণত হয়। ১৮৮০ সালে প্রথম আমেরিকার শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৮৮৪ সালে তারা সংগঠিতভাবে ৮ ঘণ্টা দৈনিক শ্রম নির্ধারণের জন্য মালিকপক্ষের কাছে প্রস্তাব করে। আর এ প্রস্তাব কার্যকরের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তাব কার্যকর না হওয়ায় সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে ঐদিন রাস্তায় নেমে আসে। শ্রমিক নেতা জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ ও লুই লিং-এর নেতৃত্বে ১ মে শিকাগোতে তারা মহা-সমাবেশের মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। এসময় পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু শ্রমিক হতাহত হলে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক অধিকার।
আন্তর্জাতিক মে দিবসঃ শ্রমিক নেতাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মে দিবসকে আর্ন্তজাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর মাধ্যমে প্রথম বারের মতো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে রক্তঝরা মে দিবস। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সালের ১ মে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক মে দিবস পালন করা হয়। সেই থেকে আজ অবধি মে দিবস সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
মে দিবসের প্রভাবঃ মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের উপর এ দিবসের প্রভাব সুদূর প্রসারী। এর প্রভাবে শ্রমিকদের কাজের দৈনিক সময় ১৮ ঘণ্টা থেকে নেমে আসে ৮ ঘণ্টায়। বিশ্বের সব দেশের শ্রমিকরা এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পেতে শুরু করে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা এগিয়ে যায় সামনে। মেহনতি মানুষ মুক্তি পেতে শুরু করে তাদের শৃঙ্খলিত জীবন থেকে। বিশ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় সামাজিক পরিবর্তনের আরেকটি নতুন অধ্যায়।
মে দিবস ও শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপঃ মে দিবস হচ্ছে গোটা শ্রমজীবী সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করার দিন। শ্রেণিবৈষম্যের বেঁড়াজালে যখন তাদের জীবন বন্দি ছিল তখন মে দিবসের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খুলে যায় তাদের শৃঙ্খল। এর ফলে আস্তে আস্তে লোপ পেতে লাগলো সমাজের শ্রেণিবৈষম্য। পুঁজিবাদীদের আগ্রাসী দংশন থেকে রেহাই পেল হাজার হাজার শ্রমিক। বৈষম্য ও শোষণমুক্ত একটি সমাজ গোটা বিশ্বকে উপহার দিল এই মে দিবস। মালিকপক্ষের সাথে শ্রমিকের যে উঁচু-নিচু সম্পর্ক ছিল তা এক সময় সমতলে চলে আসলো একমাত্র মে দিবসের স্বীকৃতির ফলেই।
মে দিবস ও পুঁজিবাদী দাসত্বমুক্তিঃ মে দিবসকে বলা যায় পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে শ্রমিকদের মুক্তি লাভের সনদ। পুঁজিবাদীরা এক সময় শ্রমিকদেরকে নিজেদের দাস হিসেবে ব্যবহার করার হীন প্রবণতা প্রকাশ করতো। শ্রম বিপ্লবের পর মে দিবস যখন প্রতিষ্ঠা লাভ করলো তখন এই দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটলো। শ্রমজীবীরা এর মাধ্যমে এক নতুন জীবন লাভ করলো, যা তাদেরকে কিছুটা হলেও স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করার সুযোগ করে দিল। মে দিবসের প্রতিষ্ঠার ফলে পরবর্তীতে কোনো পুঁজিবাদী যেনো শ্রমিকদের সাথে দাসত্বমূলক আচরণ করার প্রয়াস পায়না।
মে দিবসের তাৎপর্যঃ বর্তমান শ্রেণি বৈষম্যহীন সভ্য সমাজের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে মূলত ১৮৮৬ সালের সেই শ্রম আন্দোলন এবং মে দিবসের জন্ম বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে তাই মে দিবসের তাৎপর্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সারা পৃথিবীজুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তির সংগ্রামের মহান ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ মে দিবস। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী অমানবিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার মন্ত্র বিশ্ববাসীকে শিখিয়ে দিয়েছে এই দিবস। মে দিবসের কারণে শ্রমিক শ্রেণির চিন্তা ও চেতনায় বৈপ্লবিক উন্নতির উদয় হয়েছে। তাদের সংগ্রামী চেতনার আলোয় আলোকিত হয়েছে পুরো মানবসমাজ। শ্রমিক শ্রেণির সামনে উন্মোচিত হয়েছে এক নতুন দিগন্ত। শ্রমিক সংহতি ও ঐক্য হয়েছে আরো বেশি দৃঢ় ও মজবুত। মে দিবস সমাজ থেকে দূর করতে সক্ষম হয়েছে কলুষিত ও বিভীষিকাময় অন্ধকার।
বিশ্বব্যাপী মে দিবস উদযাপনঃ ১৮৮৯ সালের প্যারিস সম্মেলনে স্বীকৃতির পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মে দিবস উদযাপন শুরু হয়। ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাউড পার্কে বিশাল সমারোহে উদযাপন করা হয় প্রথম আন্তর্জাতিক মে দিবস। যুক্তরাষ্ট্রেও প্রথম মে দিবস পালন করা হয় একই বছর। ফ্রান্সে দিবসটি পালন করা হয় শ্রমিকদের বিশাল মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে। রাশিয়ায় প্রথম ১৮৯৬ সালে এবং চীনে ১৯২৪ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবস উদযাপন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরে এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি মহাদেশে। বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা ও ওশেনিয়া মহাদেশের প্রায় প্রতিটি উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত ছোট বড় সব দেশেই প্রতি বছর পালিত হয় আন্তর্জাতিক মে দিবস।
বাংলাদেশে মে দিবসঃ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা অনেক। বর্তমানে মে দিবসের সম্মানার্থে বাংলাদেশেও ১ মে সরকারি ছুটির দিন। এদিন শ্রমিকরা মহা উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে মে দিবস। তারা তাদের পূর্বসূরীদের স্মরণে আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসে আয়োজন করে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমুখী কর্মসূচীর। বাংলাদেশের শ্রমিকরা এদিন তাদের নিয়মিত কাজ থেকে সাময়িক অব্যহতি পেয়ে থাকে। আনন্দঘন পরিবেশে তারা উদযাপন করে মহান মে দিবস।
উপসংহারঃ ঐতিহাসিক মে দিবসের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান আজকের শ্রমিক শ্রেণিকে আগলে রেখেছে। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা এখন শ্রমজীবীদের ভূষণ। ১৮৮৬ সালের রক্তঝরা সেই ১ মে এখন সবার কাছে অবিচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোর সংগ্রামের শপথ গ্রহণের দিন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়নমুখী পরিবর্তন সূচনার অঙ্গিকারের প্রয়াস পায়।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]