বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ



(সংকেত: ভূমিকা, প্রাকৃতিক সম্পদ কি, খনিজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, প্রাণি সম্পদ, বনজ সম্পদ, ভূমি সম্পদ, পানি সম্পদ, সৌরশক্তি, উপসংহার।)
ভূমিকাঃ বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। এটি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ খুবই কম। আবার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, মূলধন এবং প্রযুক্তি বিদ্যার অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ এবং সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু একটি দেশের উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাই আমাদের দেশের শ্রম-মূলধন এবং প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।
প্রাকৃতিক সম্পদ কীঃ সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে প্রকৃতি প্রদত্ত সকল সম্পদকে বুঝানো হয়। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা, নদ-নদী, কৃষিজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ, প্রাণি সম্পদ এবং সৌরশক্তি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের অন্তর্ভূক্ত। এই সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে মানুষ আহরণ এবং ব্যবহার করতে পারে। দেশের উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব সম্পদ পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের প্রধান-প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
খনিজ সম্পদঃ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে খনিজ সম্পদ অন্যতম। উল্লেখযোগ্য খনিজ দ্রব্যগুলো হলো- প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল, চুনাপাথর, চীনা মাটি, কঠিন শিলা, সিলিকা বালি, তামা, ইউরেনিয়াম, গন্ধক ও লবণ ইত্যাদি। এই খনিজ দ্রব্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা করা হলো-
প্রাকৃতিক গ্যাসঃ প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদ। ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুর সর্বপ্রথম গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। ১৯৫৭ সালে এই গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের জ্বালানী চাহিদার প্রায় ৭৬ ভাগ পূরণ করে। দেশে মোট আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৫টি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সিলেটের হরিপুর, সুমাগঞ্জের ছাতক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস, কুমিল্লার বাখরাবাদ, চট্টগ্রামের কুতুবদিয়া ইত্যাদি। গ্যাস সম্পদের অনুসন্ধান এবং দ্রুত সম্প্রসারণের ১৯৮৮ সালে সারা দেশকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করা হয়। ২০১১-২০১২ অর্থ বছরে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৪৩.৫৭ বিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৩২.০৭ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ১৯টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৮৩টি কুপ থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে।
কয়লাঃ বাংলাদেশের কয়লা সম্পদ তেমন উন্নত নয়। আমাদের দেশে যে কয়লা পাওয়া যায় তা অত্যন্ত নিম্নমানের। ফরিদপুরের বাসিয়া এবং চান্দাবিল ও খুলনার কুলাবিলে প্রচুর পীট জাতীয় কয়লা পাওয়া গেছে। এছাড়াও রাজশাহী, নওগাঁ এবং সিলেটে বিটুমিনাস এবং লিগনাইট নামক উৎকৃষ্টমানের কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৮৬ সালে দিনাজপুর জেলার বড় পুকুরিয়া এলাকায় বিরাট কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত মোট ৫টি কয়লা ক্ষেত্রের কয়লা মজুদের পরিমাণ প্রায় ৩৩০০ মিলিয়ন টন, যা প্রায় ৪৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমতুল্য। ২০১০-২০১১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত মোট উত্তোলিত কয়লা ৩.৯৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
খনিজ তেলঃ অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাংলাদেশে প্রচুর খনিজ তেল পাওয়া যাবে। এ জন্য দীর্ঘ দিন ধরে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। ১৯৮৬ সালে সিলেট হরিপুর প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রের ৭ম কূপ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু খনিজ তেল পাওয়া যায়। কুপটির ২০২০ থেকে ২০৩০ মিটার গভীরতায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুদ আছে। তবে উত্তোলনযোগ্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৬ মিলিয়ন ব্যারেল। এছাড়াও ফেঞ্চুগঞ্জ-৩ এবং কৈলাশটিলা-২ কূপে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু কারিগরি জটিলতার কারণে উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না।
চুনাপাথরঃ সিলেট জেলার জাফলং, জকিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ভা-ারঘাট, টাকের ঘাট, লালঘাট, বাগলিবাজার, চট্টগ্রাম জেলার সীতাকু- এবং কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপে চুনা পাথর পাওয়া গেছে। এছাড়া জয়পুরহাট চুনাপাথর প্রকল্প থেকে বছরে প্রায় ১৬ লাখ টন চুনাপাথর উত্তোলিত হয়ে থাকে।
চীনা মাটিঃ দেশের সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল চীনামাটি বা সাদামাটি উত্তোলনের জন্য খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো হতে কোয়ারী ইজারা প্রদান করা হয়। বর্তমানে ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায় মোট ১৩টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এরূপ ইজারা রয়েছে।
কঠিন শিলাঃ রংপুর জেলার রাণীপুকুর ও শ্যামপুর এবং দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশে বার্ষিক কঠিন শিলার চাহিদা প্রায় ৬০-৭০ লাখ মেট্রিক টন। ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট উৎপাদিত কঠিন শিলার পরিমাণ মাত্র ১৮.১১ লাখ মেট্রিক টন।
সিলিকা বালুঃ সিলেটের নয়াপাড়া, ছাতিয়ানী, শাহজী বাজার ও কুলাউড়া, চট্টগ্রামের দোহাজারী, জামালপুরে বালিঝুরি প্রভৃতি স্থানে সিলিকা বালু পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুট সিলিকা বালু উৎপাদিত হয়।
ইউরোনিয়াম ও গন্ধকঃ মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পাহাড়ে ইউরেনিয়াম এর সন্ধান পাওয়া গেছে। আর চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায় বাংলাদেশের একমাত্র গন্ধক খনি অবস্থিত।
মৎস্য সম্পদঃ মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বাংলাদেশকে নদী মাতৃক দেশ বলা হয়। এ দেশে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল এবং হাওর রয়েছে। আর এই সকল জলাশয়গুলোতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলের লোনা পানিতেও প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি মাছের চাষ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে চিংড়ি মাছের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হবে বলে আশা করা যায়। ইলিশ, রুই, কাতলা, মাগুর, বোয়াল, গজার, শোল, পুঁটি, শিং, চিংড়ি, পাবদা, টেংরা প্রভৃতি বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ। আবার এদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ভেটকি, রূপচাঁদা, লাক্ষা, চুরি, কোরাল, গলদা চিংড়ি প্রভৃতি মাছের জন্য প্রসিদ্ধ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্য সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ থেকে গুণগত ও মানসম্মত হিমায়িত চিংড়ি এবং মৎস্য জাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, হংকং, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
প্রাণি সম্পদঃ প্রাণি সম্পদকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ বলা যায়। প্রাণী সম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) বন্য প্রাণী এবং (২) গৃহপালিত প্রাণী। বন্য প্রাণী বলতে হাতি, বাঘ, হরিণ, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, শিয়াল, বানর, সরীসৃপ এবং নানা ধরণের পাখিকে বুঝানো হয়। আবার গৃহপালিত প্রাণীদের মধ্যে গরু, ছাগল, মেষ, ঘোড়া, হাস, মুরগি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সকল প্রাণী পালন করে যেসব প্রাণিজ দ্রব্য পাওয়া যায় তার মধ্যে মাংস, দুধ, ডিম, চামড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বনজ সম্পদঃ সাধারণত যে সকল ভূমিতে ছোট, মাঝারি ও বড় ইত্যাদি অসংখ্য বৃক্ষের সমাবেশ ঘটে তাকে বনভূমি বলা হয়। আবার বনভূমি থেকে প্রাপ্ত সম্পদকে বনজ সম্পদ বলা হয়। কোনো একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে আমাদের দেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ১৭.০৮%। বাংলাদেশের বনজ সম্পদ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার সাথে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ু, মাটি এবং উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বনজ সম্পদকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি।
২. ক্রান্তীয় পত্র-পতনশীল বৃক্ষের বনভূমি।
৩. স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন।
পানি সম্পদঃ এ দেশে বহু নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর, পুকুর, ডোবা এবং জলাশয় রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, কর্ণফুলী ও মধুমতি প্রভৃতি এ দেশের বড় বড় নদী। এই সব নদীর জলধারা বা স্রোত প্রবাহ বাংলাদেশের ভূমিকে উর্বর করে। ১৯৬২ সালে কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এটি ১৯৬৫ সালে কার্যক্রম শুরু করে। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। এছাড়াও ২০১১-২০১২ অর্থবছরে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ৬৫.১৫ লক্ষ হেক্টর।
সৌরশক্তিঃ বায়ুম-লের তাপ ও শক্তির প্রধান উৎস হলো সূর্য। সূর্য প্রতিনিয়ত প্রচুর নিঃসরণ ত্যাগ করছে। কিন্তু খুব অল্প পরিমাণই পৃথিবীতে আসে। বায়ুমন্ডলের মোট শক্তির ৯৯.৯৭ শতাংশই সূর্য থেকে আসে। সূর্য থেকে আগত শক্তিকে বায়ুমন্ডল তাপীয় শক্তি বা গতিশক্তি হিসেবে ধারণ করে। সূর্য থেকে বিকিরণের মাধ্যমে পৃথিবী যে শক্তি ক্ষুদ্র তরঙ্গ আকারে পায় তাকেই সৌর শক্তি বলে। বাংলাদেশে প্রথম সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয় নরসিংদী জেলার করিমপুর ও নজরপুরে। বাংলাদেশের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে অবস্থিত।
উপসংহারঃ প্রাকৃতিক সম্পদকে একটি দেশের উন্নতি ও জাতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি বলা যায়। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এ দেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম নয়। কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। তাই দেশের উন্নতি করতে হলে এখন থেকেই প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেও আরো উদ্যোগী হতে হবে।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]