রাষ্ট্র গঠনের একটি পূর্বশর্ত হল জনসমষ্টি। যখন একটি রাষ্ট্র পূর্ণাঙ্গভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন সেই জনসমষ্টি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে এর নাগরিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। রাষ্ট্রের নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানের উপর রাষ্ট্রের কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। অতএব, নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কীভাবে সুনাগরিক হওয়া যায় তা আমাদের জানতে হবে।
ল্যাটিন শব্দ Civics থেকে Citizen বা নাগরিক শব্দটির উৎপত্তি হয়। পৌরনীতি পাঠের মূল বিষয়বস্তু হল নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্র। সাধারণত নাগরিক শব্দটি দ্বারা নগরে বসবাসরত অধিবাসীকে বোঝায়। যারা শাসনকার্যে সরাসরি জড়িত থাকতেন, তাদেরকে কেবল নাগরিক হিসেবে ধরা হত।
বর্তমানে নগর রাষ্ট্রের স্থলে জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ আয়তনে অনেক বড়, জনসংখ্যাও বেশি এবং নাগরিক সুবিধাসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকলেই ভোগ করে। কিন্তু এত বিপুল জনসমষ্টিকে সরাসরি শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের স্থলে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং যারা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেন সেই মাপকাঠি তুলে ধরা হয়েছে। আধুনিক ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড জে. লাস্কি নাগরিকের সংজ্ঞায় বলেছেন, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাকেই নাগরিক বলা হয়।” অধ্যাপক গেটেল বলেন,"নাগরিক হচ্ছে রাজনৈতিক সমাজের সেইসব সদস্য, যারা উক্ত সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকেন এবং সে সমাজ থেকে সকল প্রকার সু্যোগ সুবিধা লাভের অধিকারী হন।"
সুতরাং নাগরিকত্ব বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক সুবিধা ভোগ করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য হওয়া। নাগরিক হচ্ছেন তিনি যিনি ঐ রাষ্ট্রে স্থায়িভাবে বসবাস করেন এবং রাষ্ট্রের আইন, সংবিধান এবং অন্যান্য নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে নিজের কর্মের মাধ্যমে ভূমিকা রাখেন এবং রাষ্ট্র কর্তৃক বন্টনকৃত সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকলেই সমান এবং আধুনিক নাগরিকত্বে সমাজের নারীপুরুষ, সকল ধর্ম, গোত্র সকলেই নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে।
রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের বিবিধ সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার দিয়ে থাকে তেমনি রাষ্ট্রের প্রতিও নাগরিকদের কতগুলো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য নিচে আলোচনা করা হলঃ
নাগরিকের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সর্বদা সজাগ এবং চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান মেনে চলা এবং আইনের প্রতি সম্মান দেখানো নাগরিকদের অন্যতম দায়িত্ব। কেউ আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন, শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেক নাগরিককে আইন মেনে চলতে হবে।
সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভোট দেওয়া নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর ফলে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবে। অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীকে ভোটদানে বিরত থাকা উচিত।
রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস নাগরিকদের প্রদেয় কর ও খাজনা, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। নাগরিকদের যথাসময়ে কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করতে হবে।
রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা নাগরিকের কর্তব্য। সরকারের গৃহীত কোনো কাজ মানে হলো জনগণের কাজ। সরকারি কর্মকর্তা তদুপরি নাগরিকদের সততা ও কাজে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার উপর সরকারের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে।
প্রতিটি শিশুই রাষ্ট্রের নাগরিক। পিতামাতা তার অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। তাই সন্তানদের জীবনরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষেধক টীকাদান, সুস্থসবল রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে পাঠানো পিতামাতার দায়িত্ব। এতে করে সন্তান সুশিক্ষিত হয়ে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখবে।
প্রত্যেক নাগরিককেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ থাকতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অর্জন ও সফলতা এবং সবসময় দেশের মঙ্গল কামনা করা নাগরিকদের কর্তব্য। জাতীয় সংগীত, জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় বীর ও মনীষীদের অবদানকে স্মরণ করতে হবে।
প্রত্যেক নাগরিককে একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। ভিন্নমতকে মূল্যায়ন করা এবং সম্মান করার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি অর্জন করা সম্ভব। এটা প্রত্যেককেই বিশ্বাস করতে হবে যে বৈচিত্র্যের মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত।
প্রত্যেক নাগরিককেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এমনকি রাষ্ট্রের বেআইনী কোন কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে কোনক্রমেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। তাহলেই সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে।
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ও রাষ্ট্রের বসবাসরত জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে, সেগুলোকে অপরিহার্য বা মুখ্য কাজ বলা হয়। রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
আর.এম.ম্যাকাইভার তার 'The Modern State' গ্রন্থে বলেছেন,"আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব।" নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যাক্তিস্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, আইন ভংগকারীদের শাস্তির বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি- শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। রাষ্ট্র আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী গড়ে তোলে। বাংলাদেশে পুলিশ, র্যাব আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল ইত্যাদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা আর একটি অপরিহার্য কাজ। দেশের ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার জন্য এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন ও পরিচালনা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব। আধুনিককালে প্রতিটি রাষ্ট্রই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলেছে। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রকে পরিচিতি করা, রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে অবস্থিত সম্পদের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠিত করা, অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন, আঞ্চলিক কোর্ট গঠন, বহিঃ বিশ্বের অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করা, বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা অ সেবা প্রদান করা ইত্যাদি হচ্ছে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক অপরিহার্য কাজ।
আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যাবিচার প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ। রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন প্রণীত হয়। দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে জুডিশিয়াল কাউন্সিল, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজ কোর্ট প্রভৃতি বিচারালয়ের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজের মধ্যে পড়ে।
রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠূভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ, তাদের কর্ম বণ্টন ও নির্দেশ, কাজ তদারক এবং পরিচালনা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব।
অর্থ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি মুখ্য কাজ। রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান,মালিকানার উপর খাজনা ও কর নির্ধারণ, আদায় এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করা, রাষ্ট্রের বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন ও বিনিয়োগ, গণনা ও পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং মূল্য নির্ধারণ, অর্থনৈতিক পরিচালনা, মুদ্রাস্ফীতি রোধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণ এগুলোও রাষ্টের মুখ্য কার্যাবলি।