বাংলাদেশ নদীমাতৃক। এ দেশ বিশাল জলসম্পদে সমৃদ্ধ। সারাদেশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুর। তার দক্ষিণে অন্তহীন সমুদ্র। মৎস্য উৎপাদনের বিস্তৃত ক্ষেত্র পড়ে আছে এ দেশের সর্বত্র। তাতে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির মাছ। এ সব মাছ সুস্বাদু ও সহজপাচ্য। মাছ তাই বাঙালিদের কাছে অতি প্রিয়। মাছ আর ভাত ছাড়া বাঙালির খাবার মনঃপূত হয় না। তার তৃপ্তি মেটে না। বাঙালির খাদ্যে মাছ এবং ভাতেরই প্রাধান্য। অনাদিকাল থেকে মাছ এবং ভাতের উপর বাঙালিদের নির্ভরতার কারণে এ দেশের মানুষের পরিচয় হয়েছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’।
জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রফতানি আয়ে মৎস্য খাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য মোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের উন্নয়ন নিতান্ত অপরিহার্য।
বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রকে প্রধানত অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক এ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে মুক্ত জলাশয় ও বদ্ধ জলাশয়। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে প্লাবন ভূমি, নদী, বিল, কাপ্তাই হ্রদ ও সুন্দরবন। এর আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ। বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে আছে পুকুর, মরা নদীর অংশ বা বাঁওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি খামার। এর আয়তন ৫.২৮ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ১১.৫৪ শতাংশ। আমাদের সমুদ্র তটরেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট সামুদ্রিক জলসম্পদের আয়তন ১৬৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জলসম্পদের ৭৮.৩৯ শতাংশ।
জলাশয়গুলো ঋতু, আবহাওয়া, জলবায়ু ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে অহরহই আকৃতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু বছর ভিত্তিক প্রদত্ত পরিসংখ্যানে তার তেমন প্রতিফলন ঘটছে না। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে জলাশয়ের পরিমাণ হালনাগাদ করা উচিত।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ, ২৪ প্রজাতির মিঠা পানির চিংড়ি এবং ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতির মিঠা পানির মাছ ইতিমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, যার মধ্যে কেবল ৬৫ প্রজাতির মাছ আহরণযোগ্য। তাছাড়া আছে ৩৬ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লবস্টার, ২৫ প্রজাতির কাছিম ও ১১ প্রজাতির কাঁকড়া। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক জলাশয় মৎস্য সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং এর জীব-বৈচিত্র্য অত্যন্ত বিস্তৃত। তবে এর উৎপাদন ক্ষমতা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
এ দেশে মাছের বার্ষিক উৎপাদন ২৫.৬৩ লাখ মেট্রিক টন (২০০৭-২০০৮ সালের তথ্য অনুসারে)। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ ৮০.৫৯ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা ১৯.৪১ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ৩৯.২৩ ভাগ আসে বদ্ধ জলাশয় থেকে। সামুদ্রিক মৎস্যের শতকরা ৯৩.১৩ ভাগ যোগান আসে আর্টিশনাল বা চিরায়ত আহরণ পদ্ধতির মাধ্যমে, আর বাকি ৬.৮৭ শতাংশ আসে ট্রলার কেন্দ্রিক শিল্পায়িত আহরণের মাধ্যমে। বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ আহরণের হিস্যা বেড়েছে। এর কারণ সামুদ্রিক আহরণের প্রবৃদ্ধির হার কম, অভ্যন্তরীণ আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে বদ্ধ জলাশয় তথা চাষাধীন জলাশয় থেকে আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি বিধায় মোট মৎস্য উৎপাদনে এ হিসস্যা দ্রুত বেড়েছে। গত দশকে (১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০০৭-০৮) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে মৎস্য আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে শতকরা ৫.৪৪, ৫.৮৬ এবং ৫.২৬ ভাগ। এ সময় মাছের মোট উৎপাদন বেড়েছে বার্ষিক শতকরা ৫.৫৭ শতাংশ হারে ।
মাছের জীববৈচিত্র্য (Fish biodiversity): উন্মুক্ত জলাশয়ে (নদী, প্লাবনভূমি, হাওর, বিল, হ্রদ, নদীর মোহনা ও সমুদ্র) বাস করে বিভিন্ন জাতের মাছ ও চিংড়ি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্বাদুপানিতে প্রায় ২৬৬ প্রজাতির পাখনাযুক্ত মাছ রয়েছে। শফি ও কুদ্দুস (১৯৮২) বাংলাদেশের স্বাদুপানির ৩৬টি গোত্রের ১৪৮ প্রজাতির মাছ ও ১০ প্রজাতির Palaemonidae গোত্রের চিংড়ি শনাক্ত করেছেন, যাদের প্রায় সবগুলিই খাবারযোগ্য ও জনপ্রিয়। অভ্যন্তরীণ স্বাদুপানির উল্লেখযোগ্য মাছের মধ্যে রয়েছে বড় কার্প (রুই, কাতলা ও মৃগেলসহ ৬ প্রজাতি) এবং ছোট কার্প ও স্বাদুপানির ছোট মাছ (পুঁটি, চেলা, মলা ও বার্বেলযুক্ত মাছসহ ৪১ প্রজাতি), Perch (মেনি, বেলা, চেওয়া ও চান্দাসহ ৩১ প্রজাতি), Catfish (পাঙ্গাশ, বোয়াল, মাগুর, শিং, আইড়, রিটা, পাবদা ও বাচাসহ ২৯ প্রজাতি), Shad (অভ্যন্তরীণ মাছের ৪০% সরবরাহকারী ইলিশ, চাপিলা, কাঁচকি ও ফ্যাসাসহ ১০ প্রজাতি), টাকিজাতীয় (গজার, টাকি ও শোলসহ ৫ প্রজাতি), Loach (৭ প্রজাতি) ও Featherback (চিতলসহ ২ প্রজাতি)। রহমান (১৯৮৯) বাংলাদেশের স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছ তালিকাভুক্ত করেছেন। Bernascek ও তাঁর সঙ্গীরা (১৯৯২) বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ৩১ গোত্রভুক্ত ১৩৭ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ শনাক্ত করেছেন। স্বাদুপানির চিংড়ির Macrobrachium গণভুক্ত অন্তত ৯টি প্রজাতি রয়েছে।
কয়েকটি বড় নদী (হালদা, পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র) বড় কার্পের ডিম, রেণু ও পোনা উৎপাদনের স্থান। পুকুরে মৎস্যচাষের চাহিদা মিটানোর জন্য এগুলি সংগ্রহ করা হয়। মৎস্যচাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের পুকুর ও হ্রদে কতকগুলি বিদেশী মাছ তেলাপিয়া (২টি প্রজাতি), চীনা সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড কার্প, ব্ল্যাক কার্প, সাধারণ কার্প (৪টি প্রজাতি), থাই পুঁটি, থাই পাঙ্গাশ, আফ্রিকার মাগুর ইত্যাদিরও চাষ প্রবর্তন করা হয়েছে।
হুসেইন (১৯৬৯) বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদীমোহনার পানিতে ১৩৩ গোত্রের ৪৭৫ প্রজাতির মাছ তালিকাভুক্ত করেছেন। কুদ্দুস ও শফি (১৯৮৩) কর্তৃক সমুদ্র ও স্বল্পলোনাপানি থেকে শনাক্তকৃত ১৬৯ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৯ গোত্রভুক্ত ১৪৮ প্রজাতির মাছ অস্থিময় ও ১০ গোত্রভুক্ত ২১ প্রজাতির মাছ কোমলাস্থিবিশিষ্ট। এদের মধ্যে বেশির ভাগই সামুদ্রিক Perch-জাতীয় (৩০ গোত্রের ৬৩ প্রজাতি) মাছ। এরপর রয়েছে Herring ও Shad (৩ গোত্রভুক্ত ২১ প্রজাতি), Catfish (৩ গোত্রভুক্ত ১৯ প্রজাতি) ও Flatfish (৫ গোত্রভুক্ত ১৬ প্রজাতি)। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের শতকরা ৬০ ভাগ হলো ইলিশ। বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকায় রয়েছে ১০ প্রজাতির হাঙ্গর। সামুদ্রিক মাছের প্রায় ৬৫% বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সামুদ্রিক চিংড়ির ১৭ প্রজাতির মধ্যে Penaeus গণের ৬, Metapenaeus-এর ৫, Parapenaeopsis-এর ৪ এবং Solenocera-এর ২টি প্রজাতি রয়েছে। অবশ্য, মাত্র ৫ প্রজাতির চিংড়ি যেমন, Penaeus monodon, Penaeus semisulcatus, Penaeus indicus, Metapenaeus monoceros এবং Metapenaeus brevicornis বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরে ৫ প্রজাতির লবস্টারের (crustacean) মধ্যে সাধারণত কেবল ২ প্রজাতিই ('Panulirus polyphagus, Scyllarus nearctus) সহজলভ্য।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ