বাংলাদেশের পরিবেশ

বাংলাদেশের পরিবেশ

ব্যতিক্রমধর্মী ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকার পানি নেমে আসে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী দিয়ে। এই পানির মাত্র শতকরা ৮ ভাগ নিষ্কাশন এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্গত। অধিকাংশ নিষ্কাশন অববাহিকা প্রতিবেশী দেশসমূহে অবস্থিত। বিশাল প্রবাহসহ নদ-নদীসমূহের গতি বাংলাদেশ ব-দ্বীপে হ্রাস পাওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটি অত্যন্ত পুরু পাললিক স্তর গঠন করে বাংলাদেশ গড়ে উঠে। নিম্নোক্ত বিষয়গুলি পরিবেশগত দিক থেকে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে: ১. অসংখ্য নদী, তাদের শাখা-প্রশাখা দ্বারা জালের ন্যায় বিস্তৃত বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপগুলির একটি; ২. অত্যন্ত পুরু পলিস্তর (বিশ্বে সবচেয়ে পুরু) দ্বারা গঠিত দেশটির সাধারণ ভূপৃষ্ঠ অত্যন্ত নিম্ন-উচ্চতাবিশিষ্ট; ৩. বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ও দীর্ঘতম বালুময় সৈকত; ৪. বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অত্যধিক চাপ; ৫. আর্দ্র ও শুষ্ক মৌসুমে (বন্যা ও খরা) ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির প্রাপ্যতার পরিমাণের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য; এবং ৬. বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পানির প্রবাহের ব্যাপকতা।

বাংলাদেশের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ দেশটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত সমস্যাপ্রবণ করে তুলেছে। এদেশের ভূমি বহুলাংশে নিম্ন-প্লাবনভূমি। ভূমির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক অবস্থান, অসংখ্য নদ-নদী ও মৌসুমি জলবায়ু বাংলাদেশকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কাপূর্ণ করে তুলেছে। বন্যা ও খরার চরমমাত্রা বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য। এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেশের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অর্জনে বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে।

বাহ্যিক পরিবেশ জলবায়ু-  বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ঋতুবৈচিত্র্যসহ উষ্ণমন্ডলীয় মৌসুমি জলবায়ু বিরাজমান। বর্ষা মৌসুমে (জুলাই-অক্টোবর) প্রচুর বৃষ্টিপাতের পর আসে শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি), তারপর গরম (মার্চ-জুন)। গ্রীষ্মকালে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪° সে এবং সর্বনিম্ন ২১° সে। শীতকালে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯° সে এবং সর্বনিম্ন ১১° সে।

এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতে সময় ও স্থানগত ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৭০% থেকে ৮০% হয় মৌসুমি ঋতুতে। গ্রীষ্মের পর ভারত মহাসাগর থেকে মৌসুমি উষ্ণ আর্দ্র বায়ু বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বিশ্বের কিছু এলাকায় সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এসব বৃষ্টিপাত প্রধানত সংঘটিত হয় উঁচু উজান অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যে এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে দেশের সর্ব পশ্চিমে প্রায় ১,১০০ মিমি থেকে উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে প্রায় ৫,৭০০ মিমি। হিমালয়ে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২,০০০ থেকে ১৫,০০০ মিমি।

পানি পরিস্থিতি (Hydrology)-  বাংলাদেশের রয়েছে একটি ব্যতিক্রমী জল-ভৌগোলিক অবস্থান। তিনটি বিশাল নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ভুটান, নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের (তিববত) উজান থেকে পানি বয়ে নিয়ে আসে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার নিষ্কাশন অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গ কিমি যার আনুমানিক ৬২% ভারতে, ১৮% চীনে, ৮% নেপালে, ৮% বাংলাদেশে ও ৪% ভুটানে অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়। এ প্রবাহ কেবল দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান নদী ব্যবস্থার পর দ্বিতীয়। প্রশস্ত ও বার্ষিক প্রবাহের মোট পরিমাণ উভয় দিক থেকে পদ্মা-নিম্ন মেঘনা নদী বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। সম্মিলিত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী সমুদ্রে পতিত হয়েছে শেষ ১০০ কিমি একক প্রবাহে মিলিত হয়ে যার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদী থেকে আড়াই গুণ বেশি। দক্ষিণ এশীয় বৃষ্টিবহুল এলাকার মোট আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অববাহিকার আয়তনের অর্ধেকের চেয়ে কিছুটা কম হলেও এখানে বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ চার গুণ বেশি।

বাংলাদেশে ২৫০টিরও বেশি বড় নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদ-নদীগুলি ‘পরিবর্তনশীল’ মেঘনা অথবা ‘খুবই পরিবর্তনশীল’ পদ্মা ও যমুনা হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা যায়। এতে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের উন্নয়নে পানি ও বন্যা প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

বাংলাদেশে তিন ধরনের বন্যা দেখা যায়: ১. আকস্মিক বন্যা হয়ে থাকে উজানে ভারি বৃষ্টিপাত থেকে যা নদীকে প্লাবিত করে। নদীর তীর ভাঙা, জমি বিলীন হওয়া ও ফসলহানি এক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যা। ২. মৌসুমি বন্যা সৃষ্টি হয় ভারি অবিরাম বৃষ্টিপাত থেকে আবদ্ধ বা নিম্নমানের নিষ্কাশনসম্পন্ন স্থানে যেখানে পানি চুয়ানো অপেক্ষা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অধিক। এ ধরনের বন্যা বার্ষিক এবং প্রত্যাশিত ঘটনা যার উপর দেশের কৃষি জমির ক্ষয়পূরণ এবং জলজ পরিবেশের ধান ও পাট চাষের প্রয়োজনীয় পানির জন্য ঐতিহ্যগতভাবে নির্ভর করে। ৩. ঘূর্ণিঝড়জনিত বন্যা বিভিন্ন ধরনের বন্যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। এসব বন্যা ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে এবং প্রধানত উপকূল অঞ্চলে দেখা যায়।

ভূপ্রকৃতি (Physiography)-  বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান ভূপ্রাকৃতিক এলাকায় ভাগ করা যায়: টারশিয়ারি পার্বত্য এলাকা (Tertiary hill area), প্লেইসটোসিন সোপান (Pleistocene terraces) ও নবগঠিত সমভূমি (Recent plains)।

টারশিয়ারি পাহাড়সমূহ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এসব পাহাড় প্রধানত চুনাপাথর, শেল (shale) ও কাদামাটির তৈরি। এসব পাহাড়ের গড় উচ্চতা ৪৫০ মিটার।

প্লেইসটোসিন সোপান প্রধানত মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চল, ভাওয়ালের গড় ও লালমাই-এর পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত। এসব সোপান ২৫,০০০ বছর আগে গঠিত হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের আনুমানিক আয়তন ৯,৩২০ বর্গ কিমি। পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমি থেকে এ অঞ্চলের গড় উচ্চতা ৬ থেকে ১২ মিটার। মধুপুর ও ভাওয়াল ৪,১০৩ বর্গ কিমি এর অধিক এলাকা নিয়ে বিস্তৃত, পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমি থেকে যার গড় উচ্চতা ৩০ মিটার। কুমিল্লা জেলার লালমাই পাহাড়ি এলাকা ৩৪ বর্গ কিমি নিয়ে গঠিত এবং পার্শ্ববর্তী প্লাবনভূমি থেকে গড়ে ১৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।

নবগঠিত সমভূমি দেশের ১,২৪,২৬৬ বর্গ কিমি (৮৬%) জুড়ে বিস্তৃত। এ সমভূমিকে আরও পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়: পাদভূমি, প্লাবন ভূমি, ব-দ্বীপ সমভূমি, জোয়ার প্লাবিত ভূমি (tidal plains) ও উপকূলীয় ভূমি। পাঁচ ধরনের ভূমিকে একটি সাধারণ নাম ‘প্লাবন ভূমি’ দ্বারা সাধারণত প্রকাশ করা হয়।

বন্যা সমভূমির উচ্চতা শূন্য থেকে ১০ মিটার এবং বন্ধুরতা (relief) কম। উত্তর-পূর্ব থেকে উপকূল পর্যন্ত গড় ঢালের মাত্রা প্রতি কিলোমিটারে ২০ সেমি এর কম। ঢাকার দক্ষিণে ঢালের গড় ১.৬ সেমি/কিমি। স্থলভাগের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগের উচ্চতা (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা) ১২ মিটারের কম এবং শতকরা ৭৫ ভাগ ২৯ মিটারের কম।

বাংলাদেশের প্লাবন ভূমি মূলত ব-দ্বীপ আকৃতির পলিঘটিত সমভূমি যা পাললিক ও সামুদ্রিক উপাদান থেকে গড়ে উঠেছে। ভূমির নিম্ন উচ্চতা ও বন্ধুরতার কারণে পানি অত্যন্ত ধীরে গড়ায় এবং নদ-নদীগুলির সর্পিলপথে এঁকেবেঁকে চলার প্রবণতা থাকে। ভাঙাগড়া ও বারবার বন্যা বা বিভিন্ন ধরনের প্লাবন দ্বারা নবগঠিত ভূমি গড়ে উঠছে এবং অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে।

মৃত্তিকাসমূহের ধরন ও বৈশিষ্ট্য-  প্রবাহমান নদীসমূহ দ্বারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমানো পলির পুরু স্তর দিয়ে সাধারণত দেশটি গঠিত। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বছরে ২.৪ বিলিয়ন টন পলি বাহিত হয়। ভূমিরূপ বিভাগসমূহ (physiographic divisions) বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা দ্বারা গঠিত। টারশিয়ারি পার্বত্য এলাকা গঠিত হয়েছে পাহাড়ি মাটি দ্বারা যা প্রধানত টারশিয়ারি শিলা ও অজমাটবদ্ধ টারশিয়ারি ও প্লেইসটোসিন পলি দ্বারা গঠিত। মৃত্তিকা সাধারণত অম্লীয়, অম্লমানের তারতম্য ৪.০ থেকে ৪.৫। মৃত্তিকার বুনটের কারণে পানির প্রবেশ্যতা (infiltration) তুলনামূলকভাবে কম। উচ্চ-রন্ধ্রতা (high porosity) আর্দ্রতা ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

প্লেইসটোসিন যুগের পলি থেকে গঠিত ‘পুরাতন পাললিক মৃত্তিকা’ দ্বারা প্লেইসটোসিন সোপানসমূহ গঠিত। বন্যা সীমার উপর উঁচুভূমিতে সেগুলি অবস্থিত। তাদের বুনট এঁটেল ধরনের এবং লৌহ ও এলুমিনিয়ামের উপস্থিতির কারণে বর্ণ লালচে থেকে হলুদাভ। এসব মৃত্তিকা দৃঢ়ভাবে জমাটবদ্ধ এবং উচ্চ ফসফেট আবদ্ধ করার ক্ষমতা (phosphate fixing capacity) সম্পন্ন। মৃত্তিকা অম্লীয়, pH ৬ থেকে ৬.৫।

নবগঠিত ভূমি ‘নবগঠিত পলিমাটি’ দ্বারা তৈরি। যেহেতু ভাটি অঞ্চলের মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে উজান অঞ্চলের মৃত্তিকার গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, বিভিন্ন নদীর অববাহিকায় মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা সাধারণভাবে দেখা যায়। গঙ্গা পলিভূমিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে। এতে মুক্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেটও রয়েছে। মৃত্তিকার নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের ঘাটতি ও ক্ষারীয়তা রয়েছে।

তিস্তা পলি অঞ্চলের মৃত্তিকা বেলে থেকে বেলে-দোঅাঁশ বুনট বিশিষ্ট, সুষম স্তরবিহীন। এসব মৃত্তিকা প্রতি বছর প্লাবিত হয়, ফলে প্রতি বছর নতুন পলি দ্বারা ক্ষয়পূরণ হয়। pH ৬ থেকে ৬.৫। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল সক্রিয় প্লাবনভূমির অংশ, কিন্তু জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি দ্বারা প্লাবিত হয়। এ অঞ্চলের একটি বিরাট অংশ নিয়ে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন যেখানে কতিপয় মৃত্তিকা তাদের স্তরে ব্যাপক পরিমাণ সালফাইড বহন করে। মৃত্তিকা সাধারণত নিরপেক্ষ কিন্তু কিছুটা ক্ষারীয়তা প্রদর্শনের প্রবণতা আছে।

মৃত্তিকার ব্যবহারযোগ্যতা এবং শস্যবিন্যাসের উপর এর প্রভাব-  প্লাবনভূমি মৃত্তিকার কৃষি সম্ভাবনা পানি পরিস্থিতি ও একইভাবে মৃত্তিকার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। মৌসুমি বন্যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি এবং বন্যায় ফসলহানির আপেক্ষিক আশঙ্কা শস্য বিন্যাসের প্রধান নির্ধারক। মৃত্তিকার উর্বরতার (গৌণ উপাদানের প্রাপ্যতা) ন্যায় মৃত্তিকার ভেদ্যতা ও আর্দ্রতা ধারণ ক্ষমতা সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ প্লাবনভূমি নিম্ন উচ্চতা সম্পন্ন (প্রায় ১ মি), অপেক্ষাকৃত উচ্চ ভূমিতে ভেদ্য দোঅাঁশ মৃত্তিকা এবং নিচু স্থানে অভেদ্য কর্দম রয়েছে। ভূমির উচ্চতার এ পার্থক্য মৌসুমি বন্যার গভীরতা ও ব্যাপ্তির স্থানীয় পার্থক্য নির্ধারণ করে। ভূমির উচ্চতার ক্ষেত্রে ৩০ সেমি এর মতো স্বল্প পার্থক্যও বিভিন্ন ফসল, ফসলের জাত ও প্লাবনের বৈশিষ্ট্য ভেদে মৌসুমি আবর্তের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

টারশিয়ারি মৃত্তিকার কৃষি সম্ভাবনা নিম্ন-নিষ্কাশিত মৃত্তিকায় ও গভীর উচ্চভূমি মৃত্তিকায় মাঝারি ধরনের। অগভীর উচ্চভূমি মৃত্তিকায় এ সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত অনেক কম। ভূমিক্ষয় (যা ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে গুরুতর রূপ ধারণ করে) ও বারবার জুম চাষের (পাহাড়ি অঞ্চলে জঙ্গল পরিষ্কার ও পোড়ানোর মাধ্যমে স্থানান্তর কৃষি) ফলে উর্বরতা হারিয়ে বেলে পাহাড়ি মৃত্তিকার কৃষি সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এ মৃত্তিকা বৃক্ষফসল বা বন উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

জীবজ পরিবেশ  বনসম্পদ-  গত তিন দশকে বনজ বৃক্ষের পরিমাণ ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। কৃষিজমির প্রসার এবং বনজ দ্রব্যের বর্ধিত চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক বনভূমি অবৈধভাবে ফসলি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। যদিও বন সম্পর্কিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, হিসাবে দেখা যায়, সত্তরের দশক থেকে বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগেরও অধিক হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭০ সালে মধুপুর অঞ্চলে ২০,০০০ একরেরও অধিক শালবন ছিল; বিশ বছর পর অবশিষ্ট থাকে আনুমানিক ১,০০০ একর। ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মাথাপিছু বনের পরিমাণ ০.০২ হেক্টরেরও কম; বিশ্বে জনসংখ্যা অনুপাতে সর্বনিম্ন বনের পরিমাণগুলির একটি।

অবস্থান বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে বনসমূহকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা যায় ১. পাহাড়ি বন, ১১ লক্ষ ৫০ হাজার একর জুড়ে যার মধ্যে রয়েছে তৈরি করা বন ২,৯৬,৩০০ একর, প্রধানত রাঙ্গামাটি ও সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত; ২. ম্যানগ্রোভ বন, ১৪ লক্ষ ৫০ হাজার একর প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ (সুন্দরবন) এবং বন্যা প্রতিরোধের জন্য উপকূল এলাকা ও উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা ২,৫০,০০০ একর ম্যানগ্রোভ বন; এবং ৩. সমতলভূমি শালবন প্রায় ৩ লক্ষ একর জুড়ে গাজীপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় বিস্তৃত। বন বিভাগ এসব এলাকায় ৩৬ লক্ষ ১৭ হাজার একর জমি নিয়ন্ত্রণ করছে।

জলাভূমি-  বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মৌসুমি জলাভূমি রয়েছে। বস্ত্ততপক্ষে দেশের অর্ধেককেই এ ধরনের ভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বহু বছর ধরে পানির নিচে থাকে এ ধরনের জলাভূমির পরিমাণ অনেক কম। বহুবর্ষীয় জলাভূমির মধ্যে রয়েছে মূলত স্থায়ী নদ-নদী ও ঝর্ণা, অগভীর স্বাদুপানির হ্রদ ও জলাশয় (হাওর, বাঁওড় ও বিল), মাছের পুকুর এবং বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে মোহনা পরিবেশ।

জলাভূমি সম্পদ বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বহুবর্ষীয় ও মৌসুমি জলাভূমি উভয় বিপুল সংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। জলাভূমি মৎস্য সম্পদের উপর টিকে আছে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। বাংলাদেশের জেলেরা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জলাভূমির অসংখ্য উদ্ভিদ ঔষধ, খাদ্য, পশুখাদ্য ও নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করা হয়। মানুষের আগ্রাসন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ স্কীমের ফলে জলাভূমির আবাসস্থল দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন।

জীববৈচিত্র্য-  বাংলাদেশের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে বন ও জলাভূমি এলাকায়। আনুমানিক ৫,০০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এদেশে বাস করছে ২৬৬ ধরনের স্বাদুপানির ও ৪৪২ ধরনের সামুদ্রিক মাছ, ২২ উভচর, ১০৯ অভ্যন্তরীণ ও ১৭ সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ স্থায়ী ও ২৪০ পরিযায়ী পাখি, ১১০ অভ্যন্তরীণ ও ৩ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। কিছু প্রজাতিকে হুমকির সম্মুখীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের জানা মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে ১৩টি সম্প্রতি এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য প্রজাতিসমূহের মধ্যে ৫৪টি হুমকির সম্মুখীন। বিপন্ন উভচর, অভ্যন্তরীণ সরীসৃপ, স্থায়ী পাখি ও অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি সংখ্যা যথাক্রমে ৮, ৫৮, ৪১ ও ৪০।

এদেশ থেকে কি পরিমাণ উদ্ভিদ প্রজাতি ইতোমধ্যে অবলুপ্ত হয়েছে তা এখনও বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় নি। বিপদাপন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি শনাক্ত করতে কতিপয় বিচ্ছিন্ন গবেষণা চালানো হয়েছে এবং এতে দেখা যায় প্রায় ১০০ প্রজাতির উদ্ভিদ হুমকির সম্মুখীন।

জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ-  মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে প্রাণীর বিচরণ পথ ও জলাভূমি আবাসস্থলের ক্ষতি; কৃষি, বাসস্থান ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মানুষের বনভূমি দখল; জ্বালানি ও নির্মাণের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ হ্রাস; কতিপয় বনজসম্পদ যেমন ভেষজ উদ্ভিদ, বাঁশ ও বেতের অতিরিক্ত আহরণের ফলে রক্ষামূলক বাসস্থান লোপ; অতিরিক্ত বন্যপ্রাণী শিকার; উফশী জাতসমূহের একক চাষ, বা বহুমুখী শস্য চাষ হ্রাস পাওয়ায় কৃষি রাসায়নিক দ্রব্যসমূহের ব্যবহার বৃদ্ধি; ৭. ম্যানগ্রোভ বন উজাড় এবং ৮. জুমচাষ।

আর্থ-সামাজিক পরিবেশ জনসংখ্যা-  বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর প্রায় ২% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি।

১৯৯৫ সালে জনসংখ্যার গড় ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৮৩৪ জন। দেশকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অবশ্যই একটি প্রধান প্রচেষ্টা হবে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা এবং যৌক্তিক ভূমিসম্পদ ব্যবস্থাপনা।

ভূমি ব্যবহার  জনসংখ্যার ঘনত্ব ও কৃষিভিত্তিক জীবিকার প্রভাবে দেশের সীমিত ভূমির ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ছে। এমনকি মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রবণ উপকূলীয় নিম্নভূমিতেও বসবাস ও চাষাবাদ করছে। বাংলাদেশের মোট ভূমির শতকরা ৬৩ ভাগের কিছুটা বেশি কৃষির অধীনে রয়েছে: অধিকাংশ জমি ব্যবহূত হচ্ছে ধান চাষে। বন (সামাজিক ও গ্রাম্য বনসহ) রয়েছে মোট ভূমির প্রায় ২০%। মানুষের বসতবাড়ি রয়েছে ১৬% জুড়ে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বর্ধিত বনজ দ্রব্যের আহরণ এবং বসতবাড়ি ও চাষাবাদের জন্য বনভূমির সরাসরি পরিবর্তনের ফলে বন ও জলাভূমি দ্বিমুখী হুমকির সম্মুখীন। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে বন এলাকা ব্যাপকভাবে দখল করে কৃষি ভূমি সম্প্রসারিত হয়।

আশির দশকে ধানের উচ্চফলনশীল জাতের মতো উন্নত প্রযুক্তির প্রবর্তন প্রচলিত শস্য বিন্যাসকে বদলিয়ে দেয়। এর ফলে অধিক জমি ব্যবহার না করে ফসলের সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়। এই উল্লম্ব সম্প্রসারণ (একই পরিমাণ জমিতে অধিক ফসল ফলানো) প্রায় এর সীমায় পৌঁছেছে। অনুভূমিক সম্প্রসারণ বনাঞ্চলে ও বর্ধিত হারে জলাভূমিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন জলাভূমি চাষাবাদের অধীন চলে আসছে। জলাভূমির পানি সরে গেলে ভূমির উর্বরতা রক্ষাকারী নাজুক বাস্তুসংস্থান বদলে যায়। এর ফলে উৎপাদন হ্রাস পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আরও নতুন কৃষি জমির প্রয়োজন হয় বা সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হয়।

চিংড়ি চাষীরা ক্রমান্বয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় কৃষি জমি দখল করেছে। সেখানে অর্থকরী চিংড়ির জন্য জমিতে বাঁধ দিয়ে লবণ-পানির পুকুর তৈরি করা হয়। চিংড়ির পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা মাটি এতই লবণাক্ত হয়ে যায় যে সেখানে ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অধিক কৃষি জমি বড় বড় চিংড়ির ঘেরে পরিবর্তিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]