বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ

বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ

পরিবেশ দূষণ  মানুষের কর্মকান্ডের ফলশ্রুতিতে পরিবেশের উপাদানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। দূষণ বলতে সাধারণভাবে বোঝায় মানুষের নিজস্ব স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত করা যা প্রধানত বর্জ্য বা ক্ষতিকর পদার্থ দ্বারা বায়ু, পানি ও মৃত্তিকা দূষণের মাধ্যমে হয়ে থাকে। গত কয়েক দশকে জনসংখ্যা বিষ্ফোরণ দূষণ সমস্যা গুরুতর করে তুলেছে। অধিক জনসংখ্যা মানে প্রাকৃতিক সম্পদের অধিক ব্যবহার, যার পরিণাম অধিক দূষণ।

কঠিন বর্জ্যজনিত দূষণ বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা। বিভিন্ন শহরে বিপুল পরিমাণে কঠিন বর্জ্য জমা হয়। বর্তমানে কেবল ঢাকা নগরীতেই প্রতিদিন প্রায় ১,৫০০ মে টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর পরিমাণও বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্যের উচ্ছিষ্ট, ঘাস, গাছপালা, কাগজ, কাঠের টুকরা, কাপড়, প্লাস্টিক, পলিথিন জাতীয় পদার্থ, কাঁচ এবং নির্মাণ সামগ্রীর অবশিষ্ট।

ঢাকায় প্রায় ১,০০০ ছোট বড় শিল্প-কারখানা রয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর বর্জ্য তৈরি হয় এবং পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটায়। ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ১৪৯টি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে যেখানে প্রতিদিন প্রায় ১৮,০০০ লিটার তরল এবং ১১৫ মে টন কঠিন বর্জ্য জমা হয় এবং এসব বর্জ্য নিকটবর্তী নালা-নর্দমা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এসব বর্জ্যের মধ্যে সালফিউরিক এসিড, ক্রোমিয়াম, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, অ্যামোনিয়াম সালফেট, ক্যালসিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি রয়েছে। এগুলি মাটিতে শোষিত হয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির দূষণ ঘটাতে পারে। এছাড়াও তীব্র দুর্গন্ধ আশেপাশের মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, হ্রাস পেয়েছে মাটির স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতা। এসব স্থানের চারপাশের এলাকায় এখন আর তেমন কিছুই জন্মে না।

বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা মহানগরীর শব্দদূষণ মাত্রা নিরূপণে ২০টি বিদ্যালয় ও হাসপাতালে (এ জায়গাগুলির গ্রহণীয় শব্দমাত্রা ৪৫ ডিবি) ১৯৯৭ সালের ৯ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। এই জরিপে ভিকারুন নেসা নুন স্কুলের সামনে সর্বোচ্চ ৮৪ ডিবি মাত্রা, শাহবাগস্থ বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির কাছে ৮২ ডিবি ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছে ৮০ ডিবি রেকর্ড করা হয়। মোহাম্মদপুরের রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের কাছে ৮২ ডিবি শব্দ রেকর্ড করা হয়। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর আরও একটি জরিপ পরিচালনা করে শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায়। এ জরিপে তেজগাঁও এবং হাজারীবাগ এলাকায় ৭৫ ডিবি শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয়। অন্যদিকে ফার্মগেট, শাপলা চত্বর, মহাখালী ও বাংলামটর এলাকায় রেকর্ডকৃত শব্দমাত্রা ছিল ৮৫ ডিবি থেকে ৯০ ডিবি। ধানমন্ডি, ক্যান্টনমেন্ট, বনানী এবং গুলশান আবাসিক এলাকাসমূহে পরিমাপকৃত গড় শব্দমাত্রা ৬৫ ডিবি। মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ৬০ ডিবির সামান্য বেশি শব্দমাত্রা ধরা পড়ে। টিকাটুলি ও শাখারিপট্টিতে সর্বোচ্চ ৯০ ডিবি শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

শিল্পদূষণ  কারখানা ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত দ্রব্য বা বিষাক্ত বর্জ্য থেকে পরিবেশের অবক্ষয়। বাংলাদেশে শিল্পখাত থেকে অর্জিত জিডিপির ২০ শতাংশের মধ্যে কারখানা শিল্পের অংশ ১১%। প্রধানত তৈরি পোশাক, বস্ত্র, চামড়া ও অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পপণ্য উৎপাদক খাতসমূহে এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। শক্তিশালী শিল্পখাতের বিকাশ কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির নিরিখে লাভজনক হলেও এগুলি পরিবেশের অবক্ষয়ও ঘটায়।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় পরিচালিত একটি সমীক্ষা বাংলাদেশে সর্বাধিক কলুষিত এলাকাগুলি শনাক্ত করেছে। পরিবেশগতভাবে সর্বাধিক দূষিত ৬টি জেলা হলো: ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া। সারা দেশের মোট দূষণে এই জেলাগুলির অংশভাগ: ৬টি দূষকপুঞ্জের মধ্যে ৪টিতে ৫০ শতাংশের বেশি এবং মোট ধুলাবালি ও জৈব অক্সিজেন চাহিদার (BOD) ৩৫%। দূষকপুঞ্জের ৬টি শ্রেণী: ভূমিতে নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ (প্রায় ৩০০ রাসায়নিক দ্রব্য একত্রে); বায়ুতে উৎক্ষিপ্ত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ; বায়ুতে মিশ্রিত মোট কণাপুঞ্জ; সালফার ডাই অক্সাইডের নির্গমন; পানিতে বিদ্যমান জীবসঞ্চিত (bio-accumulative) বিষাক্ত ধাতুসমূহ (আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ ও দস্তা); এবং পাঁচ দিনের জৈব অক্সিজেন চাহিদা।

জাতীয় দূষণ তথ্যচিত্র থেকে জানা যায় যে, শিল্প-উপখাতসমূহের একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশে দূষণ সমস্যার একটি বড় অংশের জন্য দায়ী। বাংলাদেশের সেসব শিল্প-উপখাতকে সর্বাধিক দূষণপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে যেগুলি দেশের এক বা একাধিক দূষক দ্রব্যাদির মোট অংশভাগের অন্তত ৫% ছড়ায়।

সর্বমোট ১২টি সর্বাধিক দূষণপ্রবণ শিল্প উপখাত ছড়ায় ৩টি (ভূমিতে বিষাক্ত রাসায়নিক, পানিতে বিষাক্ত ধাতু ও SO2) দূষকের ৮৫ শতাংশের বেশি, আরও ২টি দূষকের (বাতাসে বিষাক্ত রাসায়নিক ও জৈব অক্সিজেনের চাহিদা) ৭০ শতাংশের বেশি এবং ৬ষ্ঠ দূষকের (মোট কণাপুঞ্জ) ৫০ শতাংশের বেশি।

বায়ুদূষণ  বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন ছাড়াও বায়ুদূষণের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি, কাগজ, পাট ও বস্ত্র কারখানা, সুতা কল, চামড়া শিল্প, পোশাক, রুটি ও বিস্কুট কারখানা, রাসায়নিক ও ঔষধ তৈরি শিল্প, সিমেন্ট উৎপাদন ও প্রসেসিং কারখানা, দালানের জন্য গ্রিল ও দরজা-জানালা নির্মাণ ওয়ার্কশপ, করাত কলের কাঠের গুঁড়া, চাষকৃত জমির ধুলাবালি, উপকূলবর্তী দ্বীপ ও উপকূলাঞ্চলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের লবণকণা ইত্যাদি। এসব উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধূলিকণা ইত্যাদি বাতাসে মিশে ধোঁয়া সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে।

বাংলাদেশের কোন কোন শিল্প কারখানা হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S), অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন এবং আরও কিছু দুর্গন্ধযুক্ত, বিষাক্ত বা বিরক্তিকর রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করে যেগুলি সর্বসাধারণের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঢাকা ও অন্যান্য শহরের মানুষ কখনও কখনও এ ধরনের গন্ধের ব্যাপারে এতটা অভ্যস্ত যে তারা এগুলিকে আর অনেক সময় বায়ুদূষক হিসেবে বিবেচনা করে না। উদাহরণ হিসেবে ঢাকার হাজারীবাগের চামড়ার কারখানাগুলির কথা বলা যায়। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় ক্লোরিন, SO2, H2S ও অ্যামোনিয়ার মতো বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। কোন কোন ভবন তৈরির পরিকল্পনা নিম্নমানের এবং সেগুলিতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা না থাকায় তামাকের ধোঁয়া, চুল্লি ও উনুনের গ্যাস, প্রাত্যহিক গৃহস্থালির কর্মকান্ডে তৈরি বিভিন্ন গ্যাসীয় বর্জ্য বেরিয়ে আসতে পারে না। এভাবে অনেক সময় বাইরের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর তুলনায় ঘরে অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ ৫-১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে মাথা ব্যথা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দেয়।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা (প্রায় ১ কোটি বাসিন্দা) পৃথিবীর সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ নগর। তাদের প্রাত্যহিক পরিবহণ হলো মোটরগাড়ি, বেবিট্যাক্সি ও টেম্পো, যাদের সিংহভাগই ২-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত। নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহার দক্ষতাসম্পন্ন এসব ইঞ্জিন ৪-স্ট্রোক ডিজেল ইঞ্জিনের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি হাইড্রোকার্বন ও অধিক কার্বন মনোঅক্সাইড বায়ুতে ত্যাগ করে। বর্তমানে সরকার ২০০২ সালের মধ্যেই সব ২-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত পরিবহণ ঢাকা শহর থেকে অপসারণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশের জন্য বায়ুর নিম্নোক্ত মান নির্ধারণ করেছে। সারণিতে উল্লিখিত স্থানসমূহে বায়ুদূষণের ঘনত্ব এই মাত্রার অধিক (মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) বাঞ্ছনীয় নয়।

সারণি  সর্বোচ্চ সহনীয় বায়ুদূষণের মাত্রা (মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার)।

স্থান SPM SO2 CO NO
শিল্পাঞ্চল ও মিশ্রএলাকা ৫০০ ১২০ ৫০০০ ১০০
বাণিজ্যিক এলাকা ৪০০ ১০০ ৫০০০ ১০০
আবাসিক এলাকা ও গ্রামাঞ্চল ২০০ ৮০ ২০০০ ৮০
স্পর্শকাতর এলাকা  (হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ১০০ ৩০ ১০০০ ৩০

 

শব্দদূষণ (Noise pollution)  শব্দদূষণের প্রকোপ বাংলাদেশের জন্য এক সুদূরপ্রসারী পরিণতিবহ সমস্যা হয়ে উঠছে। গাড়ির হর্ন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোন ট্রাফিক আইন না থাকায় শহরের অনেক অংশে শব্দসমস্যা অত্যন্ত তীব্র আকার ধারণ করেছে। শব্দদূষণের উৎস হচ্ছে মোটরগাড়ি, ট্রাক, বাস, উড়োজাহাজ, মোটর সাইকেল, রেলগাড়ি, নির্মাণকাজ ও শিল্পকারখানা।

শব্দ পরিমাপের একক হলো ডেসিবেল। ডেসিবেল মাত্রা হতে পারে ১ থেকে ১৬০ পর্যন্ত। এক থেকে ৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত সহনীয়, ৬০ থেকে ১০০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ বিরক্তিকর এবং ১০০ থেকে ১৬০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ শ্রবণশক্তির জন্য ক্ষতিকর। উত্তর আমেরিকায় শব্দের গড়মাত্রা প্রতি ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বাড়ছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশেও শব্দের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।  [এম আমিনুল ইসলাম]

তেজস্ক্রিয়তাজনিত দূষণ (Radiation pollution)  মানুষের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর এক ধরনের অদৃশ্য দূষণ। তেজস্ক্রিয়তার উৎস সূর্য ও মহাশূন্য যেখান থেকে তা পৃথিবীতে পৌঁছয়। ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয়তার অধিকাংশ বিকরিত হয় বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বিশেষত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ (তেজস্ক্রিয় ভস্ম বা ধূলিকণা), পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী থেকে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেজার রশ্মি, এক্সরে মেশিন, রঙিন টেলিভিশন সেট, মাইক্রো-ওয়েভ ওভেন ইত্যাদি।

স্বল্পমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে তা এখনও জানা যায় নি। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা রেম (rem) একক দ্বারা পরিমাপ করা হয়: ১ রেম = ১০,০০০ জনের মধ্যে ১ জনের সম্ভাব্য ক্যান্সারজনিত মৃত্যু; শূন্য থেকে ২০০ রেম = ক্যান্সারের ঝুঁকি অধিক; ৩০০ থেকে ৫০০ রেম = তেজস্ক্রিয়তাজনিত রোগে মৃত্যু।

তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতিকর প্রভাব ভালভাবে লক্ষ্য করা যায় কোষ গঠনের ক্ষেত্রে। তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত কোষ মরে গেলে বা আপনা আপনি সুস্থ হয়ে উঠলে পরবর্তী সময়ে কোন সমস্যা ঘটে না। কিন্তু একটি ক্ষতিগ্রস্ত কোষ পরবর্তী পর্যায়ে ক্যানসার প্রবণ হয়ে ওঠে। মানুষের জননকোষ তেজস্ক্রিয়তায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেগুলি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে, নবজাতক বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

বিশ্বজুড়ে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য অপসারণের সমস্যা জনসমাজে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে যা সমুদ্রের চারপাশে বসবাসরতদের জন্য একটি বড় আতঙ্কের বিষয়।

বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপের ঘটনায় দক্ষিণ এশিয়াসহ ভারত উপমহাদেশের জনগণের উদ্বেগ বেড়েছে। অধুনা পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট দূষণ বিশ্বব্যাপী মানুষের আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়েছে এবং মানবজাতি ও সামগ্রিকভাবে প্রাণিজগতের নিরাপত্তার স্বার্থে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

মৃত্তিকাদূষণ (Soil pollution) মৃত্তিকা বা মাটি ভূত্বকের উপরিভাগের একটা পাতলা আবরণ। মাটির বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে কৃষি ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় কৃষিকাজের উপযুক্ত মৃত্তিকা গঠনে দীর্ঘ সময় লাগে। বাংলাদেশের মাটি স্তরে স্তরে গঠিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলি অবলয়িত (azonal) বৈশিষ্ট্যের। প্রতি বছর বন্যার ফলে মাটিতে নতুন নতুন স্তর সঞ্চিত হতে থাকে, আবার পুরানো স্তরগুলির বিন্যাসের বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন বা রূপান্তর আসে। ব্যবস্থাপনার অভাবে ইদানিং বাংলাদেশে মৃত্তিকাদূষণ একটি গুরুতর বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মাটির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস ছাড়াও মৃত্তিকা দূষণের আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে ভূমিক্ষয় যা মাটির গুণগত পরিবর্তন ঘটায় এবং বন্ধনকে দুর্বল করে। উপরন্তু, বৃক্ষ, মাটির উপরের ঘাস ও অন্যান্য উদ্ভিজ্জ আবরণ (যা মাটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখে) সেগুলি অপসারিত বা ধ্বংস হলে মৃত্তিকা ক্ষয়ের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টির পানিতে মাটি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। বন্যার ফলেও মাটি স্থানান্তরিত হয়, এতে মাটির গঠনের গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয়।

ভূমিক্ষয় ও ভূমি অপসারণ দুটি প্রক্রিয়াই মাটিকে ক্রমশ অনুর্বর করে তোলে যা ঐ অঞ্চলের প্রাকৃতিক বাস্ত্তসংস্থানের ভারসাম্যও বিনষ্ট করে। অপরিকল্পিত ও অসমন্বিত ভূমি ব্যবহার এবং চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণ। একইভাবে রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য জমি পরিষ্কার, গাছকাটা, বন-উজাড়ের জন্যও মৃত্তিকাক্ষয় ঘটে।

উন্নত জাতের নানা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার ও বালাইনাশক ব্যবহার প্রয়োজন। সার মাটিতে অতিরিক্ত উর্বরতা যোগায় এবং অধিক ফসল উৎপাদনে সহায়তা করে। কিন্তু অধিক পরিমাণে সার প্রয়োগের ফলে হিউমাস ভেঙ্গে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে পরিণত করতে ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা হ্রাস পায়।

বিভিন্ন ফসল, বিশেষত খাদ্যশস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অধিক ফলন লাভের জন্য অধুনা বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফসলের ক্ষতিকর আগাছা ও কীটপতঙ্গ দমনে বালাইনাশকের প্রয়োগ প্রায়ই প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এগুলির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মাটির ব্যাকটেরিয়া ও উপকারী অণুজীব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে ফসলের পরিমাণ হ্রাস পায়।  [এম আমিনুল ইসলাম]

পানিদূষণ  পানির গুণাগুণের যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ও ক্ষতিকর পরিবর্তন। গৃহস্থালির আবর্জনা, শিল্প ও কৃষিখামারের বর্জ্য এবং মানুষ ও পশুর মলমূত্র থেকে পানিদূষণ ঘটে। শিল্পে ব্যবহূত এসিড, বালাইনাশক, তেল ও বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস করতে পারে। ফসফেট, রাসায়নিক সার, সাবানজাতীয় দ্রব্য (detergent) ও বিষ্ঠা জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদকে মাত্রাতিরিক্ত পুষ্টি যোগানোর মাধ্যমে পানি দূষিত করে। অধিক পুষ্টির ফলে জলজ শেওলার অত্যধিক বৃদ্ধি ও পরবর্তী সময়ে মৃত্যু ঘটে, ব্যাকটেরিয়া এসব মৃত শেওলার পচন ঘটাতে অত্যধিক পরিমাণে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে। যার ফলে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এ ধরনের দূষণকে সুপুষ্টিকরণ (eutrophication) বলে।

শিল্প ও পৌর বর্জ্য বাংলাদেশের নদী ও জলাশয়গুলিকে দূষিত করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর উল্লেখ করেছে যে চট্টগ্রামের টিএসপি সার কারখানা থেকে সালফিউরিক ও ফসফরিক এসিড এবং চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলি কাগজ মিল, সিলেট কাগজ মিল, দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোম্পানি, খুলনার শিপাইয়ার্ড ও মাছ-প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ঢাকার অলিম্পিক ও কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস লক্ষ লক্ষ গ্যালন তরল বর্জ্য পার্শ্ববর্তী নদী ও জলাশয়ে নিক্ষেপ করে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, পতেঙ্গা, কাপ্তাই, ভাটিয়ারি, বাড়বকুন্ড, ফৌজদারহাট ও ষোলশহরের প্রায় ১৪০টিরও অধিক শিল্পকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলি নদী ও বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হয়। চট্টগ্রামে ১৯টি চামড়া শিল্প, ২৬টি বস্ত্রকল, ১টি তেলশোধনাগার, ১টি টিএসপি সারকারখানা, ২টি রাসায়নিক কারখানা, ৫টি মাছ-প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ২টি সিমেন্ট কারখানা, ১টি পেপার রেয়ন মিল, ১টি ইস্পাত মিল, ২টি সাবান কারখানা, ২টি কীটনাশক কারখানা, ৪টি রঙের কারখানা ও প্রায় ৭৫টি অন্যান্য ছোট শিল্প কারখানা রয়েছে।

ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পোস্তগোলা ও ফতুল্লার ৫৩টি কারখানা এবং হাজারীবাগের ১৫১টি চামড়া শিল্প দ্বারা দূষিত হচ্ছে। চামড়া শিল্পের বর্জ্যে সালফিউরিক এসিড, ক্রোমিয়াম, অ্যামোনিয়াম সালফেট, ক্লোরাইড ও ক্যালসিয়ামের অক্সাইড থাকে। এগুলি চুয়ানোর মাধ্যমে ভূগর্ভের পানিতে মিশে মাটির উপরের ও নিচের উভয় পানির উৎসকে দূষিত করতে পারে। ট্যানারির দুর্গন্ধ আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্তত ২৯টি শিল্পকারখানা টঙ্গী অঞ্চলের তুরাগ নদী এবং ৪২টি বৃহৎ শিল্প শীতলক্ষ্যা নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ করে।

খুলনার রূপসা শিল্পনগরীর বেশ কয়েকটি শিল্প ও দিয়াশলাই কারখানা রূপসা নদীতে বর্জ্য নিক্ষেপ করে দূষণ ঘটাচ্ছে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, গোয়ালপাড়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, খালিশপুরের পাট ও লোহাশিল্প কারখানাগুলি তাদের উৎপাদিত যাবতীয় বর্জ্য ভৈরব নদীতে ফেলছে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ঘণ্টায় প্রায় ৪,৫০০ ঘনমিটার বর্জ্যমিশ্রিত পানি ভৈরব নদীতে ফেলে। শহরাঞ্চলের শিল্পবর্জ্য ছাড়াও গঙ্গার উজানের নিক্ষিপ্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানিতে পদ্মাও দূষিত হয়ে পড়ছে। গঙ্গা ভারত থেকে প্রায় ৮,৬২,০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত গঙ্গা অববাহিকার বর্জ্য বয়ে নিয়ে আসে। তীরবর্তী ৭০০ শহরের প্রায় ১২০ কোটি লিটার বর্জ্য প্রতিদিন গঙ্গানদীর প্রবাহে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের মানুষ সেই দূষিত পানি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীতে মাছের বংশবৃদ্ধি পানি দূষণের ফলে হ্রাস পেয়েছে এবং রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী ও আনোয়ারা উপজেলার অনেক মৎস্যজীবী বেকার হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার উপকূল জুড়ে রয়েছে ‘জাহাজ ভাঙা শিল্প’। জাহাজ ভাঙার সময় প্রচুর পরিমাণ অব্যবহূত ইঞ্জিন তৈল ও তলায় সঞ্চিত তৈল বঙ্গোপসাগরে পড়ে এবং বিস্তৃত অঞ্চলের পানি দূষিত হয়। বিভিন্ন ধরনের ধাতু সমুদ্রের পানিতে মিশে পানি আরও দূষিত হয়। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে যাতায়াতকারী জাহাজগুলি কঠিন ও তরল বর্জ্য নির্বিচারে সাগরে ফেলে নিয়মিত পানির দূষণ ঘটাচ্ছে। মংলা বন্দর অভিমুখী জাহাজগুলি সুন্দরবনের ভিতর পশুর নদী দিয়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার সময় পানিতে তরল ও কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপ করে বনাঞ্চলে দূষণ ঘটায়।

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর্সেনিক দূষিত পানির মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি। ১৯৮৩ সালে এ সমস্যা প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ (SOES) ১৯৯৫ সালে কলকাতায় এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করে যা বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর জরুরি ভিত্তিতে গবেষণা পরিচালনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। পরে পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েকটি জেলায় আর্সেনিক দূষণ দেখা দেয়। ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ও পশ্চিমবঙ্গের SOES ১৯৯৫ সালের আগষ্ট থেকে ২০০০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ নিরূপণে মাঠপর্যায়ে জরিপ পরিচালনা করে। প্রায় ২৪০ দিন ধরে এই জরিপ চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, পানিতে আর্সেনিকের নিরাপদমাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম/লিটার এবং অনুমোদনযোগ্য সর্বোচ্চসীমা ০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটার। গত ৫ বছরে মোট ৬৪টি জেলায় পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায় ৫৪টি জেলার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকমাত্রা ০.০১ মিলিগ্রাম/লিটার এর অধিক, এর মধ্যে ৪৭টি জেলায় ০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটারের অধিক। অবশিষ্ট ১০টি জেলা এখনও নিরাপদ।

ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে ও বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃক ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে যৌথভাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ১.৮৫ থেকে ২.২৭ কোটি মানুষ ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক দূষণযুক্ত পানি ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণ সমস্যা এতটাই জরুরি হয়ে উঠেছে যে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করছে। আর্সেনিক দূষণের সমাধান ও বিষক্রিয়ার প্রকোপ হ্রাসের কৌশল উদ্ভাবনই এ গবেষণার লক্ষ্য। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ও অন্যান্য স্থানে বর্জ্য খনিজ স্ত্তপীকরণ এবং বালিখননকে মাটিতে আর্সেনিক দূষণের কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ও SOES-এর নিকট বাংলাদেশের ০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটার মাত্রার আর্সেনিক দূষণ সম্পন্ন ৪৭টি জেলার ১৫,৯৬৯ নলকূপের (৬.৪ মিটার থেকে ৪০ মিটার গভীর) বিশ্লেষণমূলক তথ্য রয়েছে। নলকূপের পানি পরীক্ষা ও আর্সেনিক আক্রান্তদের শনাক্তকরণসহ কর্মসূচির স্বাস্থ্যবিষয়ক দিকগুলি দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল পালন করে।

পরিবেশের অবক্ষয় (Environmental degradation) ভৌত-পরিবেশীয় সমস্যাগুলি উন্নয়ন সমস্যার সঙ্গে অদৃশ্যভাবে মিশে যাওয়ার দরুন প্রকৃতির অসতর্ক ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশ আরও বিঘ্নিত হয়েছে, সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবহারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসাম্য। অনেক জমির অপব্যবহার হচ্ছে, অতি ব্যবহারের ফলে অনেক জমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। সমস্যাটি অবশ্য জমির প্রকৃষ্ট ব্যবহারের নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। জমির ব্যবহার ও আচ্ছাদন পরিবর্তনের ফলে দেখা দিচ্ছে সম্পদহানি, গ্রামীণ ভূমিহ্রাস, ভূমি অবক্ষয়, বনউজাড়, মরুকরণ, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, জলাভূমি, হ্রদ ও জীববৈচিত্র্য লোপ। মূল বিষয় হলো ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনজনিত অবস্থান্তরের বিস্তার। পরিবেশগত চাপের ফলে উদ্ভূত পরিবেশের অবক্ষয়, যেমন পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, বিশেষত রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার কিছু এলাকায় ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা আজ বাংলাদেশে একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়।

এ অঞ্চলের মানুষের কর্মকান্ড ও ভূমির ব্যবহার জীবপরিবেশে নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা ও মরুপ্রবণতার আশঙ্কা বৃদ্ধি করেছে। সাম্প্রতিক জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা ও বালুময় অঞ্চলের প্রসার উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু শুষ্ক হওয়ার দরুনই মরুপ্রবণতার এই বিস্তার বলে ধারণা করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রকট বর্ধমান শুষ্কতার মূলে রয়েছে প্রধানত ভূমিরূপের পরিবর্তন, চরভূমি গঠন, নদীর পানিশূন্যতা ও নাব্যতা হ্রাস যার কারণ গঙ্গার পানি অপসারণ, গাছপালার আচ্ছাদন হ্রাস (বনসম্পদ উজাড়), ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা (দেশের আরও অভ্যন্তরে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ)। পরিবেশের এ ধরনের গুণমানের দ্রুত অবনতির ফলে ইতোমধ্যেই জমির উৎপাদনশীলতা  হ্রাস পেয়েছে।

ভূমি অবক্ষয়ের আরেকটি কারণ চাষাবাদ ও বসবাসের জন্য জলাভূমির পরিবর্তন। কয়েক’শ জলাভূমি ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে এবং আরও বড় বড় কয়েকটি বিলীন হওয়ার পথে। বর্তমানে বাংলাদেশে জলাভূমির মোট পরিমাণ ৭০-৮০ লক্ষ হেক্টরের মতো। এতে রয়েছে নদী, হ্রদ, মোহনা, পুকুর অন্যান্য ভূমি যা বর্ষা মৌসুমে ৩০ সেমি বা আরও অধিক গভীরতায় প্লাবিত হয়। ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিকভাবে জলাভূমি বাংলাদেশের মনুষ্যবসতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে জলাভূমির সম্পদ, বিশেষত মাছ, বনভূমি ও বন্যপ্রাণী অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনাঘটিত পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত কৃষি সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশের জলাভূমি-সম্পদ মান ও পরিমাণ উভয় দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত।

নগরায়ণ প্রক্রিয়া পরিবেশের ওপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশে নগরায়ণের প্রসার নিম্নগতিতে হলেও গত কয়েক দশকে শহরে জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহরের সীমিত অবকাঠামোর উপর অত্যধিক চাপ পড়ছে। অধিকন্তু, অধিকাংশ শহরের ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ বসবাস করছে বস্তিতে, যেখানে সেখানে। বায়ু ও পানি দূষণ, বর্জ্য নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকটরূপ ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বায়ু ও পানি লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। কর্মসন্ধানী গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী অভিযাত্রা শহরের দুর্বল অবকাঠামো ও পরিবেশের অবক্ষয় বাড়িয়েই চলেছে।

বন্যা (উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ) এবং উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড়ও পরিবেশের অবক্ষয় ঘটায়। বিশাল সামাজিক সমস্যা ছাড়াও বন্যার ফলে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান ও পরিবেশের গুণগত অবনতি ঘটে। খরাও পরিবেশের অবনতি ও জীবনযাত্রার মানের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়া ভূমি ব্যবহারের নানা রূপান্তরজনিত প্রক্রিয়া জীব-ভূরাসায়নিক চক্র, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু প্রণালীতে পরিবর্তন ঘটায়।

প্লাবন ও বন্যা (Inundation and flood)  বন্যা বাংলাদেশের আরেকটি ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। প্লাবনভূমিতে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি ও নদীপৃষ্ঠ উঁচু হওয়ার ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বন্যার স্থায়িত্বকাল, বিস্তার, পরিধি ও মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় দেশের মোট এলাকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্বভাবত বন্যাপ্রবণ, যেখানে সাড়ে তিন কোটির অধিক লোকের বাস।

জলমগ্নতার দুটি বিশেষ দিক আছে। একটি বর্ষা, অন্যটি বন্যা। বর্ষা (জুন-অক্টোবর) স্বাভাবিক প্লাবনের মৌসুম। কৃষিকাজের জন্য বর্ষা উপকারী। পানি বসতবাড়িতে না উঠা পর্যন্ত এবং বিশেষত ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অবস্থাকে স্বাভাবিক প্লাবন বলা হয়। প্লাবনের সময়, স্থায়িত্ব ও বিস্তার অস্বাভাবিক হলে, বসতবাড়ি ও সংলগ্ন ভূমিতে পানি উঠলে এবং ফসলের ক্ষেত পানির কয়েক সেন্টিমিটার নিচে তলিয়ে গেলে যে অবস্থা দেখা দেয় তাই বন্যা এবং এই পরিস্থিতি দুর্যোগপূর্ণ ও ক্ষতিকর। প্রাচীনতম বন্যা হিসেবে ১৭৬৯ সালের বন্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে বড় বড় বন্যা হয়েছে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭৪, ১৯৭৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৭ ও ২০০০ সালে।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]