বাংলাদেশের বনজ সম্পদের বিবরণ দাও ।

বনজ সম্পদ Forest Resources
পৃথিবীর যে সকল স্থানে ছোট, মাঝারি বা বড় ইত্যাদি অসংখ্য প্রকারের বৃক্ষের সমাবেশ ঘটে তাকে বনভূমি বলে । আর বনভূমিতে উৎপাদিত বা প্রাপ্ত সম্পদকে বনজ সম্পদ বলা হয়। বনজ সম্পদ প্রকৃতির একি উল্লেখযোগ্য অবদান । এটি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জাতীয় জীবনের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে খনিজ সম্পদের মতো বনজ সম্পদ সীমাবদ্ধ নয়, মানুষ ইচ্ছা করলেই নতুন নতুন বন সৃষ্টি করে এ সম্প বাড়াতে পারে। যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য মোট জমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা একান্ত প্রয়োজন । বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ৯৬৮৬ কিলোমিটার বা ২৫০৮৭ বর্গ কিলোমিটার যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৭% । বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদগুলো হলো আসবাবপত্র নির্মাণের কাঠ, জ্বালানির কাঠ, বাঁশ, বেত, হোগলা পাতা, মধু, মোম, ঘাস, বন্য পশু, কুম্বি পাতা ইত্যাদি । এছাড়া ভেত সামগ্রী, কাগজ, দিয়াশলাই ও রেশম শিল্পের কাঁচামালও বন হতে সংগ্রহ করা হয় ।
বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ
যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভৌগলিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির ২৫% বন এলাকা থাকার প্রয়োজন । ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ছিল ৯৬৮৬ বর্গ মাইল বা প্রায় ২৫ হাজার ৮৭ বর্গ কিঃমিঃ এবং এটি দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ । বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি অত্যন্ত কম এবং দেশের প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত । আবাস্থল নির্মাণ ও মানুষের বৈষয়িক কার্যাবলি বৃদ্ধির ফলে বনাঞ্চলের পরিমাণ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বনাঞ্চলের পরিমাণ অত্যন্ত কম। পাশের সারণিতে তা দেখানো হলো । মালিকানার ভিত্তিতে বাংলাদেশের বনভূমিকে নিম্নোক্ত ৯টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ।
১। সংরক্ষিত বনভূমি (Protected forest) : বতর্মানে বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনভূমির পরিমাণ ১৫ হাজার ২২৬ বর্গ কিঃমিঃ । এটি মোট বনভূমির প্রায় ৬০ শতাংশ এবং দেশের মোট আয়তনের ১০.৩২ শতাংশ । এ বনভূমি দেশের বনবিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ও পরিচালিত হয় ।
২। অর্পিত বনভূমি (Vested forest) : এ বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৮৩ বর্গ কিঃমিঃ এবং দেশের মোট বনভূমির প্রায় ০.৩৩ শতাংশ । বেসরকারি মালিকানাধীন এ বনভূমিগুলোর ব্যবস্থাপনার ভার সরকারের হাতে ন্যস্ত । ব্যবস্থাপনার খরচ ব্যতীত মোট আয়ের বাকী অংশ প্রকৃত মালিকদের দেওয়া হয়।
৩। দখলীকৃত বনভূমি (Acquired forest) : বর্তমানে এ বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩৩৪ বর্গ কিঃমিঃ। এটি দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৯.৯৬ শতাংশ । ব্রিটিশ শাসনকালে এ সকল বনভূমির মালিকানা জমিদারদের হাতে ছিল । কালক্রমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এদের মালিকানা সরকার দখল করে ।
৪। আশ্রিত বনভূমি ঃ এ বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৫০০ বর্গ কিঃমিঃ। এটি দেশের মোট বনভূমির ১.৯৯ শতাংশ এবং মোট আয়তনের ০.৩৪ অংশ। সরকারের বন বিভাগ কৃর্তক সাধারণভাবে নিয়ন্ত্রিত এ বনভূমিগুলোতে মানুষ প্রবেশের অধিকার থাকে । ফলে মানুষ আশ্রিত বনভূমিতে পশুচারণ করতে পারে । তবে প্রাণী ও মানুষ কর্তৃক ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করার জন্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । প্রয়োজনে সরকার এ বনভূমিকে বিশেষ সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে এর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেন ।
৫। শ্রেণী বহির্ভূত বনভূমি (Unclassed state forest) : এ সকল বনভূমি আশ্রিত বা সংরক্ষিত বনভূমির অন্তর্ভূক্ত নয় । সাধারণত এ বনভূমিগুলোর ব্যবস্থাপনার ভার স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে । এর পরিমাণ প্রায় ৬৫৫০ বর্গ কিঃমিঃ এবং মোট বনভূমির প্রায় ২৬.১৫% ।
৬। বাগান, নার্গারি ইত্যাদি (Garden area, Nursary etc.) : বাংলাদেশ উদ্যান উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কিছু বাগান ও নার্গারি রয়েছে । জনসাধারণকে স্বল্পমূল্যে বিভিন্ন গাছের চারা সরবরাহ করাই এর উদ্দেশ্য ।
৭। ব্যক্তিগত বনভূমি (Private forest) : ১৯৬৫/৬৬ সাল হতে ১৯৭০/৭১ সাল পর্যন্ত এদেশের প্রায় ৫২ বর্গ কিঃমিঃ বনভূমি ব্যক্তিগত মালিকানায় ছিল । বর্তমানে ব্যক্তিগত মালিকানায় কোন বনভূমি নেই ৷
৮। ওয়াপদা এবং খাস বনভূমি (Wapda & Khas land forest) : এ সমস্ত বনগুলো বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এর পরিমাণ ৩৯৪ বর্গ কিঃমিঃ এবং মোট বনভূমির ১.৫৭ শতাংশ । বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার অধীনে ওয়াপদা এ সকল বনভূমি সৃষ্টি করে থাকে ।
৯। নিয়ন্ত্রিত বনভূমি ( Controlled forest) : ১৯৭০/৭১ সালে বাংলাদেশে ৩৬ বর্গ কিঃমিঃ নিয়ন্ত্রিত বনভূমি ছিল । বর্তমানে কোনো নিয়ন্ত্রিত বনভূমি নেই ।
৭.৪৩.২ বাংলাদেশের বনভূমি/বনজ সম্পদের বিবরণ
Description of Forest Resources of Bangladesh
উদ্ভিজ্জের জন্ম ও বৃদ্ধি নির্ভর করে জলবায়ু ও মৃত্তিকার ওপর । জলবায়ুর তারতম্য ও মৃত্তিকার গঠন প্রকৃতির পার্থক্যহেতু বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্ভিদ জন্মে । নিম্নে উদ্ভিদের গোষ্ঠী অনুসারে বাংলাদেশের বনভূমির শ্রেণীবিভাগ দেখানো হলো ।
১. ক্রান্তীয় চিরহরিৎ ও পতনশীল বনভূমি ঃ নিম্নে ক্রান্তীয় চিরহরিৎ ও পতনশীল বনভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
(ক) অবস্থান ও আয়তন ৪ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভাগের জেলাগুলোর পাহাড়িয়া এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এ বনভূমি গড়ে উঠেছে। এ বনভূমির আয়তন প্রায় ১২ হাজার ৪১০ বর্গ কিঃমিঃ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ২ হাজার ১০০ বর্গ কিঃমিঃ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১ কিঃমিঃ হাজার ৩০৭ বর্গ কিঃমিঃ এবং সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভী বাজার জেলার ১ হাজার ৩ এলাকা জুড়ে এ বনাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মোট বনভূমির ৭৫
শতাংশের অধিক অবস্থিত। ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বনাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বনভূমির প্রায় ৬৫ শতাংশ।
(খ) গড়ে উঠার কারণ ৪ পাহাড়িয়া এলাকার মৃত্তিকা, অত্যাধিক উত্তাপ (34° সেঃ), অত্যাধিক বৃষ্টিপাত (২৫০ সেঃমিঃ), স্বল্প জনবসতি, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মানুষের বৈষয়িক কার্যাবলি হওয়ায় এ এলাকায় নিরক্ষীয় বনাঞ্চলের মতো চিরহরিৎ গভীর অরণ্য সৃষ্টি হয়েছে ।
(গ) বনজ সম্পদসমূহ ঃ উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের দরুন এ অঞ্চলে বনভূমি গড়ে উঠেছে। চিরহরিৎ বৃক্ষের মধ্যে ময়না, তেলসুর, চাপালিস প্রভৃতি প্রধান । পর্ণমোচী বৃক্ষের মধ্যে গর্জন, গামারি, জারুল, সেগুন, কড়াই প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
এছাড়া এ বনাঞ্চলে নারিকেল, জলপাই, চম্পা, টুন, তালি, চিকরাশি, মৌল, তাপাতি, কাঞ্চন, সাজনা, বানর, সিধা, কদম, বড়মালা, ছাতিয়ানি, টোনা, সোনালু, পিটালি, বাদাম, ভাইলা, ডুমুর, আমলকি, জাম, রিটা, বহেরা, রক্তণ, বাটনা, কনক, থালি, হরিনা প্রভৃতি প্রচুর জন্মে ।
বাঁশ, বেত, হোগলা, ঘাস, মুরতা, মোম, মধু, বন্যজন্তু, শিং, চামড়া, দাঁত, ঔষধ তৈরির গাছপালা, রবার ও অন্যান্য প্রচুর বনজ সম্পদ এ বনভূমি হতে সংগ্রহ করা হয় ।
(ঘ) ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ঃ এ বনাঞ্চলে সম্পদের ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো ।,
১। এ বনভূমিতে অসংখ্য উৎকৃষ্ট শ্রেণীর ডলু, মিতিবঙ্গা, পেচা ও কালিছেড়ি বাঁশ জন্মে। এদের উপর নির্ভর করে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজের কল “চন্দ্রঘোনা পেপার মিল” এ অঞ্চলের রাঙ্গামাটি জেলায় গড়ে উঠেছে। ২ । সিলেটের কাগজ ও বিভিন্ন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বাঁশ, বেত, ঘাস এ অঞ্চল হতে সংগৃহীত হয়। ৩ । চন্দ্রঘোনার রেয়ন কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এ বনাঞ্চল হতে সংগৃহীত হয় ।
৪ । এ অঞ্চলের গর্জন ও সেগুন কাঠ রেলওয়ে স্লিপার, ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ।
৫ । বিভিন্ন কুটির শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এ বনাঞ্চল সরবরাহ করে থাকে
৬ । এ অঞ্চলের কাঠ ও বেতের উপর নির্ভর করে বহু কেইন ও বেম্বু ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠেছে ।
৭ । বাংলাদেশের সমুদয় প্রাকৃতিক রাবার এ বনাঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয় ।
২. প্লাবন বা স্রোতজ বনভূমি বা সুন্দরবন ঃ নিম্নে সুন্দররবনের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হল ।
(ক) অবস্থান ও আয়তন ঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় এ বনাঞ্চল অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং বিশ্বের অন্যতম প্রধান গরান বৃক্ষের বনভূমি । এর আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিঃমিঃ । তন্মধ্যে একমাত্র সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলাতেই মোট বনভূমির প্রায় ৯৯ শতাংশ অবস্থিত । বাকি অংশ বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার আওতায় পড়েছে ৷
সুন্দরবনের পশ্চিমে রায়মঙ্গল ও পূর্বে বুড়িশ্বর নদী অবস্থিত। সমুদ্র উপকূল থেকে এটি স্থলভাগের দিকে প্রায় ১২৩ কিঃমিঃ পর্যন্ত প্রসারিত এবং পূর্ব ও পশ্চিমে এটি প্রায় ১৬১ কিঃমিঃ লম্বা ।
(খ) গড়ে উঠার কারণ ঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমকোণে এ বিশাল আয়তনের বনাঞ্চল গড়ে উঠার কারণ হলো বিভিন্ন নদীর মোহনার অবস্থিতি, পলি গঠিত উর্বর কর্দমাক্ত মাটি, সমুদ্রের জোয়ারভাটা ও লোনা পানি, স্বল্প জনবসতি, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং মানুষের স্বল্প বৈষয়িক কার্যাবলি ।
(গ) সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্য ঃ সুন্দরবনে দুই ধরনের অরণ্য দেখা পাওয়া যায়। যথা- স্বাদু পানির অরণ্য ও লোনা পনির অরণ্য। স্বাদু পানির অরণ্যের মধ্যে সুন্দরী ও লোনা পানির অরণ্যের মধ্যে গেওয়া বৃক্ষই প্রধান। এছাড়া এ বনাঞ্চলে প্রচুর গড়ান বৃক্ষ জন্মে। এ বনাঞ্চলের অভ্যন্তরভাগে প্রচুর নদী ও খাড়ি বিদ্যমান। ফলে বনাঞ্চলের একাংশ হতে অপর অংশ বিচ্ছিন্ন। সুন্দরবনের নিচু অংশ প্রতিদিন দু'বার করে সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় । এ কারণে এ বনাঞ্চলে আগাছার সংখ্যা একেবারেই কম। সুন্দরবনের তিনটি এলাকা বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। এলাকাগুলো হলো কটকা কচিখালী (৩৯,২২৭ হেক্টর), হিরন পয়েন্ট (৩৬,৯৭০ হেক্টর) এবং মান্দার বাড়ি (৭১,৫০২) হেক্টর ।
(ঘ) সম্পদসূমহ ঃ এ বনাঞ্চলে সুন্দরী, গেওয়া, রাইন, কেওড়া, বালপাশা, গড়ান নোনাঝাউ, সিউরা, ওড়া, কাঁকড়া, বায়ন, ধুন্দল, আমুর, পশুর, খলসি, কিরপা, ভোলা, হেতাল, দারুল, গরাইয়া, তাল ইত্যাদি বৃক্ষ প্রচুর পরিমাণে জন্মে । তাছাড়া শন, কুম্বিপাতা, গোলপাতা, মধু, মোম, ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির সামগ্রীও সুন্দরবন হতে সংগ্রহ করা হয়। বাঘ, হরিণ, বানর, ভোদর, বনবিড়াল, কুমির, সাপ ও বিভিন্ন প্রকারের পাখি এ বনাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য জীবজন্তু ।
২। মধ্য অঞ্চলের আধা লবণাক্ত অঞ্চল
(ঙ) ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব ঃ তে সুন্দরবনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি । কেননা বাংলাদেশের মোট কাষ্ঠ সম্পদের প্রায় ৬০ শতাংশ এ বনাঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয় । নিম্নে এ বনাঞ্চলের সম্পদের ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো ।
১। এ বনের সুন্দরী বৃক্ষ গৃহ ও নৌকা নির্মাণ এবং বৈদ্যুতিক ও টেলিগ্রামের থাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরী কাষ্ঠের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩ লক্ষ ঘনফুট ।
২। ধুন্দল গাছ পেন্সিল তৈরি করার জন্য এবং গরান বৃক্ষের বাকলের রস চামড়া পাকা করার জন্য ব্যবহৃত হয় ।
৩ । গেওয়া বৃক্ষ নিউজপ্রিন্ট ও দিয়াশলাই তৈরির কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।
৪ । বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণে গোলপাতা ও শন ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । ৫। এ বনাঞ্চল হতে মধু, মোম, গাম ও রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির গাছ-গাছড়াও সংগ্রহ করা হয় ।
৬। এ অঞ্চলের গজারি বৃক্ষ রন্ধনশালায় ব্যবহৃত হয় ।
৭। এছাড়া সুন্দরবন হতে হরিণ, বনবিড়াল, অজগর সাপ এবং সৌন্দর্য ও হিংস্রতায় বিশ্বের অদ্বিতীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার সংগ্রহ করা হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ।
৩. ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমি ঃ পর্যাপ্ত উত্তাপ ও পরিমিত বৃষ্টিপাতের অভাবে শীতকালে এ বনাঞ্চলের পাতা ঝরে যায় বলে একে ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের অরণ্য বলা হয় বাংলাদেশের এ বনভূমি দু'টি অংশে বিভক্ত। যথা- (ক) মধুপুর ও ভাওয়ালের বনভূমি এবং (খ) ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বনভূমি। নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো ।
(ক) মধুপুর ও ভাওয়ালের বনভূমি ঃ ময়মনসিংহ জেলার প্রায় ২০৮ বর্গ কিঃমিঃ, টাঙ্গাইল জেলার প্রায় ৪১২ বর্গ কিঃমিঃ এবং গাজীপুর জেলার প্রায় ৩৩৫ বর্গ কিঃমিঃ জুড়ে এ বনাঞ্চল অবস্থিত। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় মধুপুর গড় এবং গাজীপুর জেলায় ভাওয়ালের গড় নামে পরিচিত। এ অঞ্চ প্রচুর গজারি বৃক্ষ জন্মে বলে একে গজারি বৃক্ষের বনভূমিও বলা হয়। এ অরণ্যের অন্যান্য বৃক্ষগুলোর মধ্যে কড়াই, হিজল, বহেরা, হাড়গজা, কেলিকদম্ব, হরিতকী, কাঁঠাল, কুম্বী, নিম ইত্যাদি প্রধান। গজারি বৃক্ষ প্রায় ১৫ হতে ২২ মিঃ পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি জ্বালানি কাঠ, বাড়িঘর নির্মাণ ও বৈদ্যুতিক থাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ বনাঞ্চলে কিছু কিছু ঘাস ও শন জন্মে । শন ঘর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ বনাঞ্চলে পশুপাখি ও জীবজ নেই বললেই চলে । স্বল্প সংখ্যক বানর, শৃগাল ও বনবিড়াল এ অঞ্চলে বাস করে।
(খ) ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার বনভূমি : বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের
বরেন্দ্রভূমিতে এ বনাঞ্চল দেখা যায়। এর আয়তন প্রায় ২২ বর্গ কিঃমিঃ। ভাওয়াল ও মধুপুরের বনভূমির মতো এ বনভূমির প্রধান বৃক্ষ শাল ও গজারি। এ জন্য একে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়ের বর্ধিত অংশ (extension) বলা হয় । ঘড়বাড়ি নির্মাণ ও জ্বালানি হিসেবে এ বনাঞ্চলের কাষ্ঠ ব্যবহৃত হয় ।
৭.৪৪ তে বনজ সম্পদের গুরুত্ব
Importance of Forest Resources in the Economy of Bangladesh
যে কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে বনজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বনজ সম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। দেশের মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ৫ ভাগ বনজ সম্পদ হতে আসে। বনভূমি হতে মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য যথা- বাঁশ, বেত, জ্বালানি কাঠ, মধু, মোম ইত্যাদি সংগ্রহ করে। এছাড়া ভেষজ সামগ্রী ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল বনভূমি হতে সংগ্রহ করা
হয় । বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে ভূমিক্ষয়, ঘূর্ণিবার্তা ও বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হয় । নিমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা আলোচনা করা হলো ।
১। প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহ ঃ বনজ সম্পদ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য সরবরাহ করে থাকে । মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তথা ফলমূল, জ্বালানি কাষ্ঠ, বাঁশ, বেত, হোগলা, মুরতা, ঘাস, মধু, মোম, পশুপাখি, চামড়া, শিং, ভেষজ দ্রব্য ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বনজ সম্পদ হতে সংগ্রহ করে থাকে ।
২। শিল্পের উন্নতি ঃ শিল্পোন্নয়নে বনজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বাংলাদেশে বহু শিল্পের কাঁচামাল বনজ সম্পদ সরবরাহ করে থাকে । যেমন- কাগজ, নিউজপ্রিন্ট, প্লাইউড, রেয়ন, রবার, ফাইবার বোর্ড, দিয়াশলাই ও খেলাধুলার সরঞ্জাম ইত্যাদি । এ ছাড়া বস্ত্র, আলকাতরা, স্পিরিট, এসিড, বারুদ ইত্যাদি যাবতীয় সামগ্রীও বনজ সম্পদ হতে সংগৃহীত হয় ।
৩। ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র নির্মাণের উপকরণ ঃ ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাষ্ঠ সরবরাহের উৎস হলো বনজ সম্পদ । বাংলাদেশ বন হতে সেগুন, গর্জন, জারুল, গামারি, তেলসুর চাপালিস, ময়না, কড়াই ইত্যাদি মূল্যবান কাষ্ঠ সংগ্রহ করে থাকে ।
"
৪ । কৃষি উন্নয়ন : বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে বনভূমির ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। বনভূমি বাতাসের আর্দ্রতা রক্ষা ও বৃষ্টিপাতের সামঞ্জস্য বিধান করে । এছাড়া বনভূমি ভূমিক্ষয় নিবারণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণও করে থাকে । গাছের পাতা পঁচিয়ে উৎকৃষ্ট জৈবিক সার তৈরি করা হয় ।
৫। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : পরিবহণ শিল্পের উন্নয়নে বনজ সম্পদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে । রেললাইনের স্লিপার, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ ইত্যাতি কাঠামো, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ছোট ছোট পুল ইত্যাদি নির্মাণের জন্য প্রচুর কাঠের প্রয়োজন হয় । বাংলাদেশের বনভূমি হতে এ সকল কাঠ সরবরাহ করা হয় ।
৬। কর্মসংস্থান ঃ দেশের কর্মসংস্থানের ওপরও বনজ সম্পদের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। বনাঞ্চলের আশপাশের বহু লোক বন হতে ফলমূল, মধু, মোম, পাতা, কাঠ, ঔষধ তৈরির সামগ্রী, জীবজন্তু, চামড়া, শিং, পশু খাদ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে । ফলে দেশের বেকার সমস্যা দূর হয় ।
৭। পর্যটন শিল্প ঃ পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বনাঞ্চলের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশের বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ফলে প্রতিবছর বহু পর্যটক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এ দেশে আসে । এতে একদিকে যেমন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়, অপরদিকে দেশের পর্যটন শিল্প উন্নয়নেও সহায়ক ।
৮। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন : বনজ সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে । সাপ ও অন্যান্য জীবজন্তুর চামড়া, দাঁত, শিং, লোম, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালা, বন্যজন্তু বিশেষ করে হাতি, বানর ও বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গলের চাহিদা বিশ্বব্যাপী ।
"
৯। সরকারের আয় বৃদ্ধি ঃ বনজ সম্পদ সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি করে। সরকার ভ্রমণকারীদের উপর এবং সম্পদের উপর কর ধার্য করে প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ করে ।
১০। জ্বালানি সরবরাহ ঃ বাংলাদেশের বনাঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহের প্রধান উৎস। এদেশের
বনাঞ্চল হতে মোট জ্বালানির ৯৫% ভাগ সংগৃহীত হয় ।
১১। ঔষধ তৈরির উপকরণ : বাংলাদেশে কবিরাজি, হেকিমী ও আয়ুর্বেদীয় ঔষধ তৈরির
প্রয়োজনীয় উপকরণ বনজ সম্পদ হতে সংগ্রহ করা হয়। করে
১২। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাস ঃ বনভূমি বাতাসের আর্দ্রতা রক্ষা করে এবং জলীয় বাষ্প সঞ্চিত বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হ্রাস করে। ফলে দেশ আর্থিক ক্ষতি হতে মুক্তি পায় ।
১৩। ভূমি ক্ষয় রোধ ঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বনভূমিসমূহ ভূমিক্ষয় হতে দেশকে রক্ষা করছে । বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভূমিক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১৪ । প্রতিরক্ষা ঃ বাংলাদেশের বনজ সম্পদের রাজনৈতিক গুরুত্ব কম নয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের বনভূমি এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বহুদূরে এগিয়ে দিয়েছিল। এমনকি বর্তমানেও বনভূমি বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ হতে দেশকে রক্ষা করছে ।
১৫। পশুচারণ শিল্প ঃ বনজ সম্পদগুলোর উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে কিছু কিছু পশুচারণ শিল্প গড়ে উঠেছে । বনাঞ্চল এলাকায় পর্যাপ্ত ঘাস ও অন্যান্য লতাপাতা, পশুখাদ্য শিল্পের উন্নতির সহায়ক ।
১৬ । পরোক্ষ ভূমিকা ঃ বনভূমি মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, বায়ুতে আর্দ্রতা বৃদ্ধি ও অক্সিজেনের ভারসাম্য রক্ষা করে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে । উপরিউক্ত সমালোচনা হতে এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনজ সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]