দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাঁচামালের উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশ শিল্পে আশানুরূপ উন্নতি করেনি। ১৯৪৭ সালের পূর্বে বৃটিশ শাসিত বাংলার প্রধান নগরী কলিকাতার আশে পাশে বেশির ভাগ শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে দেশ বিভাগের পরও
ঔপনিবেশিকদের উপেক্ষিত দৃষ্টির ফলে এ অঞ্চলে পর্যান্ত শিল্প গড়ে উঠেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প কারখানার সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে এগুলোর উন্নতি পরিবর্তে অবনতিই লক্ষ্য করা গেছে। এ অচলাবস্থার নিরসনে ১৯৭৭ সালে নুতন শিল্প নীতি ঘোষিত হওয়ার পর দেশে ছোট বড় কিছু কিছু নতুন শিল্প
স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। নিমে বাংলাদেশে শিল্পের অনগ্রসরতার কারণসমূহ বর্ণিত হলো।
১। ঐতিহাসিক কারণ : বাংলাদেশ শিল্পে অনগ্রসর থাকার কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে ঐতিহাি বিষয়টি উপেক্ষা করা চলে না । বৃটিশ আমলে এদেশের কাঁচামালের উপর নির্ভর করে কলিকাতার আশে পাশে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশ বিভাগের পর এ অঞ্চলে কিছু কিছু শিল্প স্থাপিত হলেও চাহিদার তুলনায় তা নিতান্ত কম ছিল।
২। ঔপনিবেশিক শাসন ও ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ বাংলায় যত শিল্প স্থাপিত হয়েছে তার অধিকাংশের মালিক ছিল বিদেশী। বাঙালী মালিকানাধীন গুটিকয়েক শিল্প স্থাপিত হলেও এদের প্রায় সবই বিদেশী ঘেঁষা ছিল। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দেশ স্বাধীনতা অর্জন করছে হানাদারদের সহযোগী সকল দেশী বিদেশী মালিকেরা দেশ ত্যাগ করে। ফলে শিল্প কারখানা পরিচালনার জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাবে দীর্ঘ দিন যাবৎ শিল্প উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হয় । তাছাড়া যুদ্ধে বেশ কিছু বিধ্বস্ত শিল্প মেরামতের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ায় নবীন সরকারের পক্ষে নতুন নতুন কোন শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি ।
৩। পর্যাপ্ত উদ্যোক্তার অভাব : এদেশে শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য যথাযথ উদ্যোক্তার অভাব বরাবর লক্ষ্য করা গেছে । স্বাভাবিক অর্থে মানুষ কম ঝুঁকি বা পরিশ্রমে বেশি মুনাফা করতে চায় । এ কারণেই অতীতে অর্থবান ব্যক্তিরা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে জমি এবং ব্যবসাকে বেশি প্রাধ্যান্য দিয়েছে । বৃটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত এ প্রথাটির জনপ্রিয়তা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ।
৪। স্থিতিশীলতার অভাব : ১৯৪৭ সালের পর থেকে বিভিন্ন কারণে এদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। কখনো জাতিগত সমস্যা নিয়ে, কখনো ধর্মের নামে কিংবা কখনো গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি দুর্নীতির অভিযোগ বারবার জনগণের শাসন বিঘ্নিত হয়েছে । তাছাড়া ১৯৭১ সালের পরবর্তী সরকারের রাষ্ট্রীয়করণ নীতি এক শ্রেণীর শিল্প উদ্যোক্তাদের দারুণ ভাবে হতাশ করেছিল । তাই অনেক দেশী বিদেশী উদ্যোক্তাদের নিকট সরকারের শিল্পনীতি আস্থা অর্জনের ব্যর্থ হওয়ায় এখাতে পুঁজি বিনিয়োগ স্বচ্ছল লোকেরা এগিয়ে আসেনি।
৫। পুঁজির অভাব : বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান থাকায় বৃটিশ সরকারের দমন এবং শোষণ নীতির প্রায় সব কয়টিতে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই অর্থনৈতিক ভাবে এরা কখনো শক্তিশালী হতে পারেনি। এদের ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ কম থাকায় শিল্প ক্ষেত্রে এখানে বিনিয়োগও খুব সীমিত ছিল । বৃটিশ শাসনের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের সামাজিক অবস্থার আমুল পরিবর্তনের ফলে সঞ্চয় বৃদ্ধির পরিবর্তে আরো হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দেশে শিল্প কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ বারবার বিঘ্নিত হচ্ছে।
৬। পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিকের অভাব ঃ অনেক আগে থেকেই এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার পরিবর্তে অদক্ষ শ্রমিক তৈরির শিক্ষাকে প্রাধ্যান্য দেয়া হয়েছে। দুঃখ জনক হলেও সত্যি যে সরকারের নীতি আজ পর্যন্ত তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। তাই আধুনিক কলকারখানা চালনার জন্য চাহিদানুযায়ী দক্ষ
শ্রমিক সংগ্রহ করা অনেক মালিকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠে। ফলে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে আমাদের শিল্পোন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ।
৭। বিদ্যুতের ঘাটতি ঃ শিল্প উন্নয়নের জন্য বিদ্যুতের কোন বিকল্প নেই। এত জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ হয়েও আজ পর্যন্ত এ দেশে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনা সম্ভব হয়নি ।স্বাধীনতা পূর্বকালে এদেশের প্রধান প্রধান শহর ও অল্প কয়েকটি এলাকাকে বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়েছিল। এ সকল বিদ্যুতায়ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ কম ছিল বিধায় তখন অনেক উদ্যোক্তাই শিল্প স্থাপনের সুবিধা লাভ করেনি ।
৮। ঋণ প্রদানে বৈষম্য : যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারি সহযোগিতা আবশ্যক। উদ্যোক্তাদেরকে পরিমাণমত ঋণ সরবরাহ করে দেশে শিল্পোন্নয়ন করা যায়। বৃটিশ শাসন অবসানের পর এ দেশে যত শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়েছে তার বেশির ভাগের মালিক ছিল অবাঙালী। একই দেশের অধিবাসী হয়েও এতদাঞ্চলের উদ্যোক্তারা শিল্প ঋণসহ সরকারি বিভিন্ন আনুকূল্য পায়নি বলে এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্প গড়ে উঠেনি ।
৯। অনুন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে ১৯৭৮ সালের পর থেকে জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। এর পূর্বে উপযুক্ত যোগাযোগ ও পরিবহণের অভাবে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো প্রয়োজনীয় সংখ্যক কাঁচামাল সরবরাহের জন্য সক্ষম হলেও সহজ যোগাযোগের কথা চিন্তা করে কোন শিল্প উদ্যোক্তা ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসেনি।
১০। কারিগরি জ্ঞানের অভাব ঃ দক্ষ শ্রমিকের কথাটি বাদ দিলেও শিল্প কারখানা পরিচালনার জন্য শিল্প সম্পর্কিত উচ্চ জ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলীর অভাব আমাদের দেশে রয়েছে । বর্তমানে বাংলাদেশে যত ভারী ও মাঝারি শিল্প রয়েছে তার বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে স্থাপন করা হয়েছে । তাই এ সকল শিল্প কারখানা পচিালনার জন্য বারবার বিদেশী কারিগরের উপর আমাদের নির্ভরশীল হতে হয় । স্থানীয় ভাবে যে সকল দক্ষ কারিগর সৃষ্টি হয় তাদেরও অধিকাংশ অর্থের লোভ বিদেশে পাড়ি জমানোর ফলে এদেশে দক্ষ কারিগরের অভাব দেখা যায় ।
১১ । খুচরা যন্ত্রপাতির অভাব ঃ শিল্পের যে কোন ত্রুটি দ্রুত মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য অনেক উদ্যোক্তা এ লাইনে পুঁজি বিনিয়োগ করছে না ।
১২। সীমিত বাজার পরিধি ঃ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এদেশে সীমিতভাবে ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদতি দ্রব্য দ্বারা স্থানীয় চাহিদা মিটানো সম্ভব হলেও সরকারের অবাধ বাজার নীতিতে বিদেশী পণ্যও খোলা বাজারে বিক্রির অনুমতি লাভ করেছে । তাই স্থানীয় মালামালের চাহিদা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ দেশের শিল্প উন্নয়নের গতি মন্থর হওয়ায় বিদেশী পণ্যের ন্যায় স্থানীয় পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাই বিদেশী বাজারে বাংলাদেশী শিল্প পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেনি। ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকেরা ব্যবসায়িক দিক থেকে অলাভজনক অবস্থায় পড়ে থাকায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান অংকুরেই বিনষ্ট হয়েছে।
১৩। ব্যবস্থাপনার অভাব : শিল্প কারখানা চালু রাখার জন্য ব্যবস্থাপনা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পূর্বে এ দেশের লোকজন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে উদাসীন থাকায় ব্যবস্থাপনার সঠিক গুণাগুণ
অর্জন অনেক দেরীতে লাভ করেছে । তাই ঝুঁকিপূর্ণ কোন পদক্ষেপ নিতে অনেক সক্ষম ব্যক্তিও এখাতে
বিনিয়োগ করছে না ।
উপরে বর্ণিত কারণগুলো ছাড়াও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কিংবা সকল ধরনের দুর্নীতি এবং বারে বারে শিল্প
নীতির পরিবর্তন ইত্যাদিও শিল্পে অনগ্রসরতার কারণে ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত