বাংলাদেশের চিনি শিল্পের সমস্যা সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বাংলাদেশের চিনি শিল্পের বর্ণনা Description of Sugar Industries in Bangladesh
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান ইক্ষু উৎপাদনকারী দেশ। এ দেশের প্রায় প্রত্যেক জেলাতেই কম বেশি ইক্ষু উৎপন্ন হয় । তন্মধ্যে মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ইক্ষুর চাষ করা হয় । চিনি শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হলো ইক্ষু । বাংলাদেশে প্রচুর ইক্ষু উৎপাদিত হলেও ১৯৩৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে কোন চিনিকল ছিল না । ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রধানত জাভা হতে চিনি আমদানি করে এদেশের চাহিদা মিটানো হতো । প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলে ১৯৩৩ সাল হতে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানায় ৫টি চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয় ।
চিনিকলগুলো হলো- (১) উত্তর বঙ্গ চিনিকল, (২) দেশবন্ধু চিনিকল, (৩) সেতাবগঞ্জ চিনিকল, (ঘ) কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ও (৫) ন্যাশনাল সুগার মিলস ।
১৯৭০-৭১ সালে এদেশে চিনিকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টিতে । বর্তমানে বাংলাদেশে চিনিকলের সংখ্যা ১৮টি । এদের মধ্যে ১৭টি জাতীয়করণকৃত এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন কর্তৃক পরিচালিত এগুলোর মধ্যে কিশোরগঞ্জের ন্যাশনাল ও কালি চাপড়া চিনিকল দু'টি বন্ধ আছে। অপর চিনিকলটি অতি সম্প্রতি জয়পুরহাটের বটতলীতে স্থাপিত হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র তরল চিনি প্রস্তুতকারী কারখানা ।
উৎপাদন ঃ বাংলাদেশের চিনিকলগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২.১০ লক্ষ মেট্রিক টন। ১৯৮১-৮২ সালে বাংলাদেশে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ ৮৪ হাজার টন। অন্যান বছরগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন করতে পারেনি । বর্তমানে বাংলাদেশে চিনি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯-১০ সালে চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬২.২০ হাজার মেট্রিক টন ।
চিনি শিল্প গড়ে ওঠার কারণ : নিম্নলিখিত প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানগুলোর কারণে বাংলাদেশের চিনি শিল্প গড়ে উঠেছে।
১। প্রাকৃতিক কারণ
(ক) কাঁচামালের সহজলভ্যতা ঃ বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রচুর ইক্ষু উৎপন্ন হয়। তন্মধ্যে অধিক পরিমাণে ইক্ষু উৎপাদনকারী অঞ্চলে চিনিকলসমূহ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে চিনি শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নিকটবর্তী অঞ্চল হতে সহজেই সংগ্রহ করা যায়।
(খ) শক্তি সম্পদের সরবরাহ : বাংলাদেশে চিনিকলগুলো বর্তমানে তাপবিদ্যুৎ, কয়লা ও পেট্রোলিয়াম দ্বারা পরিচালিত হয়। বর্তমানে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে গ্রীড প্রথার মাধ্যমে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
২। অর্থনৈতিক কারণ
অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ চাহিদা, সুলভ ও দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ, মূলধনের প্রাচুর্যতা, সরকারি উদ্যোগ, পরিবহণ ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে চিনি শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করেছে ।
চিনি শিল্পের বণ্টন : বাংলাদেশের চিনিকলগুলো প্রধানত রাজশাহী এবং খুলনা বিভাগে অবস্থিত । এছাড়া ফরিপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা প্রভৃতি জেলায়ও চিনিকল আছে । ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে মোট ৫টি চিনিকল ছিল। এ মিলগুলোর দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ছিল ৩৯০০ মেট্রিক টন। পাঁচটি মিলই ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হতো। চিনি মিলে বেসরকারি উদ্যোক্তার অভাব থাকায় ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০টি নতুন চিনিকল স্থাপন করে । ফলে দৈনিক আখ মাড়াই ক্ষমতা ১৬৯০০ মেট্রিক টনে উন্নীত হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সরকার ১৯৭৭ ও ১৯৮৫ সালে ফরিদপুরের মধুখালী এবং নাটোরে ২টি চিনিকল স্থাপন করে । এদের দৈনিক ইক্ষু মাড়াই ক্ষমতা যথাক্রমে ১০১৬ ও ১৫০০ টন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে সেতাবগঞ্জ চিনিকল, উত্তরবঙ্গ চিনিকল, কেরু অ্যান্ড কোম্পানি এবং দেশবন্ধু চিনিকলকে সম্পূর্ণ নতুন যন্ত্রপাতি দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয় । এদিকে কিশোরগঞ্জে অবস্থিত ন্যাশনাল সুগার মিলস পুরাতন ও অকেজো হওয়ায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৫ সালে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন আরো ৪টি চিনিকল রাজশাহী, যশোর এবং কুষ্টিয়া জেলায় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে ।
বাণিজ্য : অতীতে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী দেশে চিনি উৎপাদিত হতো না বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে চিনি আমদানি করা হতো। কিন্তু ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রচুর চিনি উৎপন্ন হওয়ায় প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিন টন চিনি বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক বছর দেশে চিনি উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায় । ফলে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। দেশে বর্তমানে চিনির চাহিদা বছরে ১২-১৪ লক্ষ মেট্রিক টন। কিন্তু দেশে উৎপাদিত চিনি চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলে বিদেশ হতে চিনি আমদানি ক্রমশ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের চিনি শিল্পের সমস্যা Problems of Sugar Industry in Bangladesh
বাংলাদেশে চিনি শিল্প যথেষ্ট উন্নতি লাভ করলেও বতর্মানে এ শিল্প বিশেষ কতকগুলো সমস্যার সম্মুখীন। তন্মধ্যে নিম্নোক্তগুলো প্রধান ।
১। বাংলাদেশের চিনি শিল্পের প্রধান সমস্যা হলো কাঁচামাল প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা। কারণ প্রতি বছর সমপরিমাণ ইক্ষু উৎপাদিত হয় না। অপরদিকে ইক্ষু উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ইক্ষুর ন্যায্যমূল্যের অভাবে কৃষকগণ আখ চাষে অনিহা প্রকাশ করছে।
২ । চিনিকলগুলো হতে আখ উৎপাদনকারী ক্ষেত্রগুলো অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থিত বলে পরিবহণ ব্যয় অধিক হয় । ফলে চিনি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় ।
৩। চিনি উৎপাদনকারী এলাকায় আখের গুড় কারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে মিলগুলোতে আখের সরবরাহ হ্রাস পায়। ফলে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না ।
৪। চিনি শিল্পের অন্যতম প্রধান বাধা হলো নিয়মিত বিদ্যুৎ বিভ্রাট । ফলে উৎপাদন হ্রাস পায় ও উৎপাদন খরচ বাড়ে ।
৫। বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ইক্ষু উৎপন্ন হয় বলে চিনিকলগুলোতেও মৌসুমি উৎপাদন হয়। এছাড়া আমাদের অধিকাংশ মিলের চিনি উৎপাদন পদ্ধতিও মান্ধাতার আমলের । ফলে চিনি উৎপাদন কম হয় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায় ।
চিনি শিল্পের সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা Solution of Problems and Future Propects of Sugar Industries
নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে বাংলাদেশে চিনি শিল্পের উন্নতি সম্ভব হবে ।
(ক) আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে ইক্ষুর উৎপাদন বাড়াতে হবে ।
(খ) চিনিকল এলাকায় অতিরিক্ত গুড় তৈরি কারখানা বন্ধ করতে হবে ।
(গ) ইক্ষু উৎপাদনকারী ক্ষেত্রগুলোর নিকট অধিক সংখ্যক চিনিকল স্থাপন করতে হবে ।
(ঘ) দ্রুত কাঁচামাল সরবরাহ করার জন্য ইক্ষু ক্ষেত্র ও চিনিকলের মধ্যে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।
(ঙ) বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে ।
(চ) ইক্ষু চাষ ও উৎপাদন পদ্ধতি এমনভাবে সম্প্রসারিত করতে হবে যাতে বার মাস ইক্ষু উৎপাদন ও কাটা সম্ভব হয় ।
(ছ) কৃষকদিগকে ইক্ষু উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য মৌসুমি মূলধন সরবারহ করা ছাড়াও ইক্ষুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
(জ) দেশে এবং বিদেশে চিনি বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা জোরদার ও সম্প্রসারিত করতে হবে।
(ঝ) চিনি উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন, সংস্করণ, সম্প্রসারণ করে রস নিষ্কাশন ও চিনি উৎপাদন পদ্ধতি উন্নত করতে হবে।
(ঞ) গবেষণার মাধ্যমে ইক্ষুর উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ও ব্যয় হ্রাস এবং চিনি উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে ব্যয় সংকোচ করতে হবে।
উপরিউক্ত পরামর্শসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বাংলাদেশে চিনি শিল্পের সমস্যাদির সমাধানই কেবল সম্ভব হবে না, বাংলাদেশ প্রচুর উদ্বৃত্ত চিনি উৎপাদন করে বিদেশেও রপ্তানি করতে সক্ষম হবে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]