বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নৌ পরিবহণ ব্যবস্থার গুরুত্ব আলোচনা কর ।

নৌ পরিবহণ Water Transport
নৌপথের সর্বোচ্চ ব্যবহারের লক্ষ্যে নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে । অভ্যন্তরীণ নৌ রুটগুলোর ড্রেজিংয়ের এক বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের ভৌগলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারের লক্ষ্যে কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপিত হলে ভারত, চীন ও মায়ানমারসহ এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে । এছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তৃতীয় সমুদ্র বন্দর স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন নৌযান চলাচল নিশ্চিতকরণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং দক্ষ ও সাশ্রয়ী নৌ পরিবহণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান প্রভৃতি কার্য সম্পাদনের লক্ষ্যে নৌ পরিবহণ মন্ত্রাণালয়ের আওতাধীন নয়টি সংস্থা রয়েছে। এগুলো হলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ, সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ অভ্যন্ত রীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি), মেরিন একাডেমী এবং ন্যাশনাল মেরিটাইম ইন্সটিটিউট । ১১.২১ বাংলাদেশের জলপথ/নৌপথের বর্ণনা
Description of Waterways in Bangladesh
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌ পরিবহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । নিম্নে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণের বর্ণনা প্রদান করা হলো ।
১। নদ-নদীর সংখ্যা ঃ নদীমাতৃক বাংলাদেশের সমতল ভূমির ওপর দিয়ে প্রায় ২৩০টি নদী, উপনদী ও শাখা নদী জালের মত শাখা বিস্তার কারে আছে। এদের মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, মধুমতি, কর্ণফুলি ও সুরমা প্রধান নদী। এছাড়া বাংলাদেশের অসংখ্য বিল ও হাওর আছে। এগুলোও বর্ষার পানিতে ভরে যায় । ফলে বাংলাদেশের চলাচলের প্রধান মাধ্যম হলো নৌপথ ।
২। নৌযানসমূহ ঃ বাংলাদেশের বড় বড় নদীপথে স্টিমার ও বড় বড় লঞ্চ চলে। অপেক্ষাকৃত ছোট নদীগুলোতে ছোট ও মাঝারি লঞ্চ ও দেশী যন্ত্রচালিত নৌকা এবং অভ্যন্তরীণ খালবিল ও হাওড় এলাকায় প্রায় ৩/৪ লক্ষ দেশীয় নৌকা চলাচল করে থাকে ।
৩। নৌপথের পরিমাণ ৪ বাংলাদেশের মোট নৌপথের পরিমাণ প্রায় ৬০০০ কি.মি. । তবে শুষ্ক মৌসুমে হ্রাস পেয়ে এই নৌপথের পরিমাণ ৩৮০০ কি.মি. এ দাঁড়ায় । দেশের বিভিন্ন নদ নদীতে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ নৌপথ ক্রামাগত কমে যাচ্ছে । তবে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলোতে মাঝে মাঝে ড্রেজিং এর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে ।
৪। পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ : ২০০২-০৩ সালে BIWTA বাংলাদেশের প্রায় ১.৯ লক্ষ টন পণ্যদ্রব্য লঞ্চ, স্টিমার ও কার্গো বোটে বহন করে। এ সময় নদীপথে ১৮৪.১ লক্ষ যাত্রী চলাচল করে । তন্মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ মোটর লঞ্চে এবং ৬ শতাংশ স্টিমারে। এ ছাড়া BIWTA এর ফেরিগুলো চলতি সালে ১৭ লক্ষ ২৪ হাজার গাড়ি পারাপার করে। বাংলাদেশ বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ২ লক্ষ যাত্রীবাহী বিভিন্ন যান এবং ১ লক্ষ কার্গো বোট চলাচল করছে । এছাড়া বেশ কিছু দেশী নৌকা এবং কয়েকটি তেলবাহী যানও আছে ।
বাংলাদেশে নৌপথের মধ্যে বর্তমানে নিম্নোক্ত সার্ভিসগুলো চালু রয়েছে ।
(ক) যাত্রীবাহী সার্ভিস
১। ঢাকা-চাঁদপুর-বরিশাল-খুলনা ।
২ । নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-বরিশাল- হাতিয়া-রামগতি-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম । ৩। ঢাকা-বরিশাল-বাগেরহাট ।
৪ । নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-বরিশাল। ৫। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-গোয়ালন্দ । ৬। ঢাকা-গোপালগঞ্জ-মাদারিপুর । ৭ । নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ-লৌহজং । ৮। বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনা-গলাচিপা । ৯ । বরিশাল-ভোলা-পটুয়াখালী-আমতলী । ১০। খুলনা-চালনা-মংলা-বাগেরহাট । ১১। ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী । ১২। খুলনা-সাতক্ষীরা ।
১৩। ফরিদপুর-মধুখালী-গোপালগঞ্জ । ১৪। সিরাজগঞ্জ-নগরবড়ি-সিরাজগঞ্জ। ১৫ । চট্টগ্রাম-কুতুবদিয়া-কক্সবাজার । ১৬। আরিচা-নগরবাড়ি-সিরাজগঞ্জ । ১৭। কুষ্টিয়া-কামারখালী ইত্যাদি ।
এছাড়া বাংলাদেশের সকল স্থানে নৌপথে অসংখ্য নৌযান চলাচল করে ।
(খ) ফেরী সার্ভিস
১। আরিচা-নগরবাড়ি-আরিচা ।
২। আরিচা-চরজানাজাত- মাওয়া ।
৩। আরিচা-দৌলতদিয়া-আরিচা ।
৪। সিরাজগঞ্জ ভুয়াপুর- সিরাজগঞ্জ।
৫ । ফিরিংগী বাজার-চরপাথরঘাট-ফিরিংগী বাজার ।
৬। অন্যান্য ফেরি সার্ভিসসমূহ ।
(গ) কার্গো সার্ভিস
এ সার্ভিসের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হতে দেশের অভ্যন্তরে বণ্টন করা হয় এবং রপ্তানিকৃত পণ্যসামগ্রী উৎপাদনকারীদের নিকট হতে সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে প্রেরণ করা হয় ।
জলপথ/নৌপথের গুরুত্ব Importance of Waterways to the Economy of Bangladesh
নদীমাতৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থায় নৌ পরিবহণের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি বাংলাদেশের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল হতে অসংখ্য নদী ও এদের শাখা এবং উপনদী (প্রায় ২৩০টি) বাংলাদেশকে বিধৌত করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এ সকল নদীগুলোতে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে বলে নৌকা, স্টিমার ও লঞ্চের সাহায্যে প্রচুর যাত্রী ও মালামাল পরিবাহিত হয় । তদুপরি বাংলাদেশের সড়ক ও রেলপথ উন্নত নয় বলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের অধিকাংশই নদীপথে সম্পদিত হয়ে থাকে । নিম্নে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
১। যাত্রী পরিবহণ : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবহণ ব্যবস্থায় নৌ পরিবহণ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে । বাংলাদেশের যে সকল স্থানে সড়কপথ ও রেলপথ উন্নতি লাভ করেনি তথায় নৌ পরিবহণই যাত্রী পারাপারের একমাত্র মাধ্যম।
২। কাঁচামাল পরিবহণ ঃ বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চলে ব্যবহৃত কাঁচামালসমূহ অভ্যন্তররীণ নৌপথের মাধ্যমে সহজেই প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয় এবং শিল্পে প্রেরণ করা হয়, অপরদিকে শিল্পজাত দ্রব্যসমূহও নৌপথে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয় ।
৩। খাদ্যশস্য প্রেরণ ঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য শহরাঞ্চলে প্রেরণ করা হয় । এছাড়া দেশের এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে খাদ্যশস্য ও অর্থকরী ফসল প্রেরণের জন্য অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ ব্যবহৃত হয় ।
৪। স্বল্প ব্যয়ে পরিবহণ ঃ নৌপথে ভারী পণ্য সহজে এবং স্বল্পব্যয়ে এক স্থান হতে অন্যস্থানে পরিবাহিত হয়। এছাড়া নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের খরচও অনেক কম ।
৫। উপকূল এলাকা ঃ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় বা দ্বীপাঞ্চলে এমন কতকগুলো এলাকা রয়েছে যেখানে সড়ক বা রেলপথ নির্মাণ মোটেও সম্ভব নয়। তথায় অভ্যন্তরীণ বা উপকূলীয় নৌপথই পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের একমাত্র মাধ্যম ।
৬। পানি নিষ্কাশন সহজ ও দেশে অপরিকল্পিত ও অতিরিক্ত সড়ক, রেলপথ নির্মাণ করলে পানি নিষ্কাশনে বাধার সৃষ্টি করে বন্যার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে নদী সংস্কার করে নৌপথ বাড়ালে বা গভীর করলে পানি নিষ্কাশন আরও সহজ হয়।
৭। নির্মাণ খরচ নেই ঃ বাংলাদেশে অসংখ্য নদীনালা ও খালবিল রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই বর্ষাতে প্লাবিত থাকে। এ কারণে সড়কপথ ও রেলপথ নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য ও সময়সাপেক্ষ । ফলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নৌপথের ভূমিকা অত্যধিক ।
৮। অবিনশ্বর ঃ বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বা বহিঃশত্রুর আক্রমনে সড়ক বা রেলপথ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে নৌপথের স্থায়িত্ব বেশি, কারণ এটি সহজে নষ্ট হয় না ।
৯। মৎস্য সম্পদ সংগ্রহ : বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ সংগ্রহে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণের জাহাজগুলো দিয়ে মৎস্যকেন্দ্রে মাছ সরবরাহ করা হয়।
১০। প্রাকৃতিক পরিবহণ ও নৌ পরিবহণ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবহণ ব্যবস্থা। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি বলে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় ছাড়া নির্মাণের কোন খরচ নেই । ফলে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণে অতি স্বল্প মূল্যে পণ্য এবং যাত্রী পরিবহণ করা যায় ।
১১। বেকার সমস্যার সমাধান : বাংলাদেশে নৌ পরিবহণের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত থেকে বহু লোক তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে প্রায় ৫০ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ সংস্থার সাথে জড়িত আছে ।
১২। ভারি পণ্য পরিবহণ : শিল্পকারখানার ভারি যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা নৌপথে পরিবহণ করা অনেক সহজ ও নিরাপদ । যার ফলে এদেশের শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতিসমূহ নৌপথেই সাধারণত পরিবাহিত হয়।
১৩। বাণিজ্য কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ : বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো, নৌ পরিবহণকে কেন্দ্র করে নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে। এ সকল বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর মধ্যে পণ্যদ্রব্য বিনিময়ে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
১৪ । কৃষি উন্নয়ন ঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে কৃষি উপকরণ তথা সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, যন্ত্রপাতি পরিবাহিত হয়। এছাড়া কৃষিপণ্য পরিবহণ করেও নৌপথ বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৫। শিল্পোন্নয়ন ও শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং শিল্পপণ্য ভোক্তাদের নিকট পৌঁছে দিতে নৌ পরিবহণের গুরত্ব অপরিসীম।
১৬। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সাথে যোগযোগ : বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। দেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানির উদ্দেশ্যে বন্দরে সরবরাহ করা এবং বিদেশ হতে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী পশ্চাদভূমিতে প্রেরণ করতে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
১৭। ব্যবসায়-বাণিজ্যের উন্নতি : বাংলাদেশের প্রায় সকল বড় বড় হাট, বাজার, গঞ্জ, বাণিজ্য কেন্দ্র, শিল্প কেন্দ্রের সাথে নৌপথের সংযোগ আছে। ফলে এদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য উন্নয়নেও নৌপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, তে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের জলপথ/ নৌপথের অসুবিধা / সমস্যা Problems of Waterways in Bangladesh
বাংলাদেশে অসংখ্য খালবিল, নদীনালা থাকা সত্ত্বেও এ দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নতি লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে নিম্নোক্ত প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক অসুবিধাসমূহ বিদ্যমান।
১। মান্ধাতার আমলের নৌযান ও বাংলাদেশের নৌ পরিবহণের অন্যতম সমস্যা হলো পুরনো, চলার অযোগ্য এবং মান্ধাতার আমলের দেশীয় নৌকা। ফলে চলার পথে এসব নৌযানগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
২। নৌযানের স্বল্পতা ঃ বাংলাদেশের পরিবহণ ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণের গুরুত্ব অত্যধিক হলেও এদেশে প্রয়োজনের তুলনায় নৌযানের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ফলে নৌযানগুলোতে পণ্য ও যাত্রীর অত্যধিক ভিড় পরিলক্ষিত হয়।
৩। নদীর গভীরতা হ্রাস ও বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীতে পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে গিয়েছে। যা নৌযানগুলোর স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। শুকনো মৌসুমে অনেক নদীতে চর পড়ে বলে নৌযান চলতে পারে না ।
৪। পরিবহণ ব্যয় ও মাসুল বেশি ঃ যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার হার এবং নৌযানের ওপর নির্ধারিত মাসুলের হার অত্যন্ত বেশি। এ হার প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
৫। নিরাপত্তার অভাব ঃ বাংলাদেশে নৌ পরিবহণে চুরি, ডাকাতি, দুর্ঘটনা প্রভৃতির হার অনেক বেশি বলে যাত্রীরা নৌ পরিবহণে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। বিশেষ করে রাত্রি বেলায় লঞ্চ ডাকাতি এদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ।
৬। ঘাট ও জেটির অভাব ঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ ব্যবস্থার অন্যতম অসুবিধা হলো ঘাট ও জেটির অভাব। ফলে যাত্রী ও মালামাল ওঠানামায় খুব অসুবিধা হয় । বাংলাদশে এমন অনেক ঘাট আছে যেখানে যাত্রীদের দাঁড়ানোরও কোন ব্যবস্থা নেই ।
৭ । নৌযান নির্মাণ ও মেরামতের অসুবিধা : বাংলাদেশের নৌ পরিবহণ ব্যস্থার অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো নৌযান নির্মাণ ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় ডকইয়ার্ড ও শিপইয়ার্ডের অভাব । বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি নৌযান মেরামত কারখানা আছে। এগুলোতেও আবার, মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয়।
৮। নৌপথে চলাচলের সুযোগ-সুবিধার অভাব ঃ বাংলাদেশের নৌপথে চলাচলকারী নৌযানগুলো বিভিন্ন প্রকার নৌপথের সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে । যেমন- নৌপথে চলাচলকারী সংকেত প্রদর্শন, বিপদ সংকেত, রাত্রিকালীন আলোর সংকেত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি সুযোগ- সুবিধার ব্যাপক অভাব ।
৯। যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার অভাব : নৌ পরিবহণে যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামাগার ও পণ্য সংরক্ষণের জন্য গুদাম ঘরের তীব্র অভাব । বর্ষাকালে যাত্রীদের এ অসুবিধা তীব্রভাবে দেখা দেয় ।
১০। দক্ষ চালক ও নাবিকের অভাব ঃ বাংলাদেশের নৌযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ চালক ও নাবিকের তীব্র অভাব রয়েছে। দক্ষ চালক বা নাবিক না থাকলে নৌযান দূর্ঘটনার কবলে পতিত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নাবিকদের ট্রেনিং-এর জন্যও কোন উন্নত প্রতিষ্ঠান এদেশে নেই ।
১১। পানির উচ্চতা হ্রাস : শুকনো মৌসুমে উজানে ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহারের ফে বাংলাদেশে নদীগুলোতে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে নৌযান স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না।
১২। যন্ত্রাংশের অভাব ও বাংলাদেশে নৌযানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন হয় না বলে বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। ফলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে অনেক সময় লঞ্চ, স্টিমার অচল হয়ে পড়ে।
১৩। অধিক চাপ ও বাংলাদেশের সকল স্থানে সড়কপথ সমানভাবে উন্নত না হওয়ায় এবং জনসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় নৌযানগুলোতে অত্যধিক ভিড় পরিলক্ষিত হয়। ফলে এদেশে দুর্ঘটনার হার বেশি ।
১৪। নৌযানের শ্লথ গতি ও বাংলাদেশের নৌপথে যেসব নৌযান চলাচল করে তার অধিকাংশই দেশীয় নৌকার সাথে অগভীর বা গভীর নলকূপের ইঞ্জিন লাগিয়ে নির্মাণ করা হয়। এসব জলযান যান্ত্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং এদের গতি অত্যন্ত শ্লথ ।
১৫। বিনিয়োগকারীদের অভাব : প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগকারীগণ নৌযানের বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় না। ফলে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নৌপথে নৌযানের সংখ্যা যথেষ্ট কম ।
১৬ । যোগাযোগ ঃ বাংলাদেশে বেতার যোগাযোগ এখনো বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলানায় অনুন্নত। ফলে এদেশের নৌযানগুলোর সাথে বেতার যোগাযোগ সুযোগও সীমিত । এ কারণে দেশে দুর্ঘটনার হারও বেশি।
১৭ । প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঃ বাংলাদেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নৌপথে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এছাড়া শীতের মৌসুমে ঘন কুয়াশার সময়ও নাবিকদের দৃশ্যমানতা হ্রাস পায় এবং স্বাভাবিকভাবে নৌযান চালাতে পারে না ।
১৮। নদী খনন সমস্যা ঃ বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পলি পড়ে । কিন্তু সরকারি পরিকল্পনার অভাবে এসব পলি অপসরিত হয় না । অবশ্য এর জন্য প্রচুর অর্থেরও প্রয়োজন ।
১৯। প্রতিযোগিতা : সড়কপথ ও রেলপথ অত্যন্ত গতিসম্পন্ন বলে শ্লথ গতির নৌ পরিবহণ বর্তমানে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। তাই দেখা যায় যেসব স্থানে সড়ক পথের উন্নয়ন ঘটেছে সেসব স্থানে নৌপথ অচল হয়ে পড়েছে ।
মোটকথা, বর্তমানে বাংলাদেশের নৌ পরিবহণ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। তবে একথা সত্য যে, এতসব সমস্যা মোকাবিলা করেও নৌপথ এদেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।
১১.২৪ বাংলাদেশের জলপথ/নৌপথের সমস্যা সমাধানের উপায়
Means to Solve the Problems of Bangladesh Water Transport
নিম্নোক্ত উপায়ে বাংলাদেশে নৌ পরিবহণ ব্যবস্থা সমস্যাসমূহের সমাধান করা যেতে পারে ।
১। অধিক সংখ্যক আধুনিক নৌযান : পুরাতন নৌযানসমূহের স্থলে দ্রুতগতি ও আধুনিক সুযোগ- সুবিধা সম্পন্ন অধিক নৌযানের ব্যবস্থা করতে হবে। তদুপরি দেশীয় নৌকাগুলোতে গতি বৃদ্ধির জন্য ইঞ্জিন বসাতে হবে।
২। নৌপথের সংস্কার সাধন : ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদী ও খালের তলদেশে জমাকৃত পলি মাটি খনন করে নৌপথের নাব্যতা ঠিক রাখতে হবে। তদুপরি আঁকা-বাঁকা নদী ও খালগুলো কেটে সোজা করতে হবে।
৩। অধিক ঘাট ও জেটি নির্মাণ ঃ যাত্রী ও মালপত্র লঞ্চ ও স্টিমারে ওঠানো-নামানো এবং নৌযান নোঙর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঘাট ও জেটি নির্মাণ করতে হবে।
৪। চালক ও নাবিকদের প্রশিক্ষণ ও নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাতে কলনে নৌযানের চালক ও নাবিকদের সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নৌযান চালানোর জন্য প্রশিক্ষণ হবে।
৫। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার ঃ নৌ-দুর্ঘটনা ও চলাচলকালীন বাধাসমূহ দূর করার জন্য নৌপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
৬। নৌপথের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি : বর্তমান অবস্থার উন্নতির জন্য নৌপথের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এদের মধ্যে রাত্রিকালীন আলোর ব্যবস্থা, নৌপথ প্রদর্শক চিহ্নের ব্যবস্থা, নৌপুলিশ পাহারার ব্যবস্থা, দুর্যোগকালীন বিপদ সংকেত প্রদান ইত্যাদি অন্যতম ।
৭। যন্ত্রাংশ ও কলকব্জা উৎপাদন : নৌযানের খুচরা যন্ত্রাংশ ও কলকব্জা অধিক পরিমাণে দেশে উৎপাদন করতে হবে ।
৮। ডকইয়ার্ড ও শিপইয়ার্ড নির্মাণ ঃ নতুন নৌযান নির্মাণ ও পুরানো নৌযানসমূহ মেরামতের জন্য বর্তমানে ডকইয়ার্ড ও শিপইয়ার্ডসমূহের সংস্কার ও সম্প্রসারণ ছাড়াও নতুন ডকইয়ার্ড এবং শিপইয়ার্ড স্থাপন করতে হবে । ৯। যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ঃ নৌপথে চলাচলকারী যাত্রী সাধারণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ- সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন- বিশ্রামাগার ও শৌচাগারের ব্যবস্থা, মালপত্রের নিরাপত্তা, বন্দর ও ঘাটে গুদামজাতকরণের সুবিধা, অবসর বিনোদনের সুবিধা ইত্যাদি ।
১০। ভাড়ার হার নিয়ন্ত্রণ ঃ নৌযানের মালিকগণ যাতে যাত্রী ও মাল পরিবহণের জন্য অতিরিক্ত হারে ভাড়া আদায় করতে না পারে সেজন্য সরকারিভাবে ভাড়ার হার নির্ধারণ এবং নৌযান চালকদের তা
মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে ।
১১। উদ্ধার কার্য জোরদার : বিপদগ্রস্ত ও দুঘটনা কবলিত নৌযান ও যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য বর্তমান সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন- দ্রুতগামী নৌযানের সাহায্যে ত্বরিৎ দুর্ঘটনা স্থলে গমন, উদ্ধারকারী নৌযান ও ক্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি ।
১২। আর্থিক সাহায্য : বেসরকারি মালিকগণ যাতে অধিকহারে আধুনিক নৌযান নৌপথে চলাচলের জন্য দিতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় মূলধন ঋণের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে । এছাড়া অধিক মেরামত কারখানা স্থাপনের জন্যেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে ।
১৩। কড়াকড়িভাবে নৌ চলাচল আইন পালন : নৌপথে চলাচলকারী নৌযানগুলো যাতে নৌ চলাচল আইন যথাযথভাবে পালন করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- চলাচলের অযোগ্য ও যান্ত্রিক গোলযোগপূর্ণ নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা, চলার মাঝপথে চেকিং, অধিক যাত্রী বহনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]