বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাগুলো কি? What are the obstacles in the way of economic development of Bangladesh?

Bangladesh Economy
একটি দেশের মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বিভিন্ন খাতসমূহ নিয়ে সে দেশের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠিত। একইভাবে বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন খাত-উপখাত নিয়ে গঠিত। জাতীয় আয়, ভোগ, বিনিয়োগ, সঞ্চয়, মূলধন গঠন, ব্যাংক ব্যবস্থা, মুদ্রাবাজার, মূলধন বাজার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত। এছাড়াও আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, মানব সম্পদ উন্নয়ন, নারী উন্নয়ন, বেসরকারী খাত, সুশাসন ইত্যাদি বিষয়গুলোও সেগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এক কথায় একটি দেশের কৃষি, শিল্প, সেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি, রপ্তানী ইত্যাদির সাথে জড়িত সকল খাত-উপখাত নিয়ে সে দেশের অর্থনীতি গঠিত । সে হিসাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, সেবা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত সকল খাত- উপখাত নিয়ে গঠিত । কে প্রধানত তিনটি খাতে ভাগ করা যায় । প্রত্যেকটি খাতের আবার অনেকগুলো উপখাত রয়েছে। নিম্নে র প্রধান খাত এবং উপখাতসমূহ একটি ছকে দেখানো হলো ।
(১) কৃষিখাত
(ক) ফসল উৎপাদন
(গ) মৎস্য চাষ

(২) শিল্পখাত
(ক) বৃহদায়তন
(খ) পশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন
(খ) মাঝারি
(গ) ক্ষুদ্রায়তন
(ঘ) বনায়ন
(ঘ) কুটির শিল্প
(ঙ) উদ্যান, নার্সারি, ফল-ফুল চাষ
(ঙ) তৈরি পোষাক শিল্প
(চ) ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প
(৩) সেবাখাত
(ক) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানব সম্পদ উন্নয়ন
(খ) সড়কপথ, জলপথ, পরিবহণ, রেলপথ, বিমান (গ) ডাক ও তার বিভাগ
(ঘ) বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিতরণ
(ঙ) ব্যাংক, বীমা ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (চ) বেতার, টেলিফোন, টেলিভিশন, স্যাটেলাইট,
মোবাইল ও ইন্টারনেট
র খাতসমূহ সাধারণত সরকারী ও বেসরকারী উভয় ধরনের মালিকানায় পরিচালিত হয়। সুতরাং সরকারী ও বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত বিভিন্ন খাতের সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করাই হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় ।

মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ Basic Features of Bangladesh Economy

পর্যালোচনা করলে যে সকল বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো ।
১। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি : বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির প্রায় ৪৭.৫% কৃষি শ্রমিক । ২০১২-১৩ অর্থবছরের জিডিপি'তে কৃষিখাতের অবদান ছিল ১৬.৭৮ শতাংশ, ২০১৩-
১৪ অর্থবছরে এ খাতের অবদান দাড়িয়েছে ১৬.৩৩ শতাংশ । সুতরাং কৃষির উপর অত্যাধিক নির্ভরশীল
২। অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকদের নিরক্ষরতা, প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কৃষি উপকরণের অভাব প্রভৃতি কারণে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধির হার খুব কম। নিম্নের তালিকায় তা স্পষ্ট বোঝা যাবে ।
৩। শিল্পে অনগ্রসরতা ঃ মূলধনের অপর্যাপ্ততা, দক্ষ উদ্যোক্তা ও দক্ষ শ্রমিকের অভাব ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের শিল্পখাত খুবই অনুন্নত ফলে জাতীয় আয়ে শিল্পখাতের অবদান খুবই কম। তবে ধীর গতিতে এ অবদান বাড়ছে । নিম্নের তালিকায় লক্ষ্যণীয় ।
৪। স্বল্পমাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান : র একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাথাপিছু আয় কম এবং জীবনযাত্রার মান নিম্ন । উন্নত দেশের তুলনায় তা খুবই কম। তবে মাথাপিছু আয় ধীর গতিতে হলেও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, সেই সাথে জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
৫। মূলধনের স্বল্পতা ঃ বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় কম বলে সঞ্চয় ক্ষমতা কম । ফলে মূলধন গঠনের হারও বেশ কম । তবে তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তালিকায় বিভিন্ন বছরে দেশের GDP এর মধ্যে জাতীয় সঞ্চয়ের অনুপাত দেখানো হল ।
৬। খাদ্য সমস্যা ঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষি ব্যবস্থার অনুন্নতি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এদেশে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বিদেশ থেকে প্রতিবছর খাদ্য আমদানি করতে হয়। তবে খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যবস্থায় বিগত কয়েক বছর ধরে একটি ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে । নিম্নের তালিকায় বিভিন্ন বছরের খাদ্যশস্য উৎপাদন ও আমদানির পরিমাণ দেখানো হল ৭। শিক্ষার হার কম : বাংলাদেশে শিক্ষার হার অত্যন্ত কম। এখনও দেশে অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও নিরক্ষর রয়েছে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী স্বাক্ষরতার হার (৭ বছর +) হল শতকরা ৫৭.৯ ভাগ মাত্র । উন্নত দেশে এ হার হল ৯০% ১০০% ।
৮। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঃ র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার অব্যাহত চাপ বিদ্যমান। ২০০৭ সালে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৪, ১৮ কোটি যা ২০১০ এ হয় ১৪.৭৭ কোটি এবং ২০১২ এ হয় ১৫.১৬ কোটি, ২০১৪ সালে তা ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে। ২০১১ সালে এদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৩৭% । ২০১১ সালে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কি.মি. এ ১০১৫ জন ।
৯। বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কার্যাবলি মূলত বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। উন্নয়ন বাজেটের ৫০% বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর। তবে বর্তমানে এ নির্ভরশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। তালিকায় বিভিন্ন বছরে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় আভ্যন্তরীণ সম্পদের যোগানের পরিমাণ বৃদ্ধি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দেশে বৈদেশিক সাহয্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে আভ্যন্তরীণ সম্পদের পরিমাণ
১০। বেকার সমস্যা : বাংলাদেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। এদেশে মোট শ্রমশক্তির ৩০% বেকার এবং ২৫% প্রচ্ছন্ন বেকার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ১ কোটির ঊর্ধ্বে ।
১১। মুদ্রাস্ফীতি ঃ বাংলাদেশে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান। গত কয়েক বছর ধরে খাদ্য শস্যের বাম্পার ফলন, চোরাকারবার প্রতিরোধ এবং সরকারের সঠিক মুদ্রানীতি কাজ করায় মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মুদ্রাস্ফীতির হার ২০০৭-০৮ এ ৯.৯৩% থেকে ২০০৯-১০ এ হয় ৭.৩১% যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৬.৭৮% এ । ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৭৫ (পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে) শতাংশে ।
১২। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো ঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো তেমন উন্নত নয় । অনুন্নত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপর্যাপ্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ শক্তি, শিক্ষার হার নিম্ন, স্বাস্থ্য সুবিধা অপ্রতুল, এসমস্ত কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে এ সমস্ত খাতে ধীরগতিতে উন্নয়ন হচ্ছে । যেমন- স্বাধীনতা উত্তরকালে যেখানে মাত্র ৪ হাজার কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক বিদ্যমান ছিল সেখানে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত ৩,৫৩৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে (ফেব্রুয়ারি ২০১২ পর্যন্ত) সরকারি খাতে ৯,৬৩২ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার এবং বেসরকারি খাতে ১২,০৮৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ মোট ২১,৭১৬ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার নীট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে যাতে লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে । ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নিট বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছিল ৪২,১৯৫.৭১ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার । ২০১৪-১৫ অর্থবছরে (ফেব্রুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত) মোট স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ১১,২৬৫ মেগাওয়াট এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ডিসেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছে ২২,৬৯১ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার ।
১৩। কারিগরী জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাব ঃ কারিগরী জ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে যা উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধক ।
১৪। প্রতিকূল বৈদেশিক বাণিজ্য : এদেশে কাঁচামাল রপ্তানী, শিল্পজাত পণ্য আমদানি, দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব, নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন, আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ে না উঠা প্রভৃতি কারণে বাণিজ্য ঘাটতি লেগেই রয়েছে । নিম্নের তালিকায় তা দেখানো হলো ।
১৫। প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ ও শিক্ষার হার কম থাকায় বাংলাদেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর মধ্যে কু-সংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী দেখা যায় যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে।
১৬। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ঃ অনেক অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র (vicious cycle of poverty) বিদ্যমান। আয় কম বলে সঞ্চয় কম, সঞ্চয় কম বলে মূলধন গঠনের হার কম, মূলধন গঠনের হার কম বলে বিনিয়োগ কম এবং কর্মসংস্থানও কম। এ কারণে আবার উৎপাদন ও আয় কম। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বাংলাদেশ, দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
১৭। বাজার সংকীর্ণতা ঃ র আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল পণ্যসামগ্রী ও সেবার বাজারের আয়তন ততটা বিস্তৃত নয় অর্থাৎ বাজার সংকীর্ণ। তাছাড়া বিদেশেও আমাদের পণ্যের বাজার খুব বেশি সম্প্রসারিত হয়নি ।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, অনুন্নত দেশের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশে বিদ্যমান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ এর ফলে আর্থ- সামাজিক অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে । যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুশাসন নিশ্চিত করা যায় তাহলে অচিরেই বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আমরা আশা করি ।

অনগ্রসরতা/পশ্চাৎপদতার কারণ Causes of Backwardness of Bangladesh Economy

পশ্চাৎপদ বা অনগ্রসর । এই পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী প্রধান কারণগুলো নিম্নে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল ।
১। ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ : র অনগ্রসরতার জন্য দায়ী ঐতিহাসিক কারণ হচ্ছে ২০০ বছরের বৃটিশ শাসন ও শোষণ । ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই দু'শত বৎসরে বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ (বিশেষত বাংলাদেশ) এর উন্নয়নে কোন কাজ করেনি এবং নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন করেছে । এই অঞ্চলে বৃটিশরা কোন শিল্প কারখানা গড়ে তোলেনি বরং এই অঞ্চলকে তারা তাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। কথিত আছে যে, এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শিল্প কলকারখানা ধ্বংস করে এবং নানাভাবে সম্পদ লুণ্ঠন করে বৃটিশ শিল্প বিপ্লবের ভীত রচিত হয়েছিল । তার উপর ভিত্তি করেই আজকের আধুনিক ও শিল্পোন্নত যুক্তরাজ্য
২। পাকিস্তানী শোষণ : র অনুন্নতির আরেকটি ঐতিহাসিক কারণ হল পাকিস্তানের ২৫ বৎসরের লুটপাট, শোষণ ও শাসন। বৃটিশ শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে মুক্ত হবার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বাধীনতার নামে নতুন করে পরাধীন হয়ে পাকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) ঔপনিবেশে পরিণত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করেনি। বরং এই ২৫ বৎসরের শাসনকালে এই অঞ্চল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সুকৌশলে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করেছে যার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে । সেখান থেকে বাংলাদেশ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি ।
৩। দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব ঃ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য দরকার একদল দক্ষ ও প্রগতিশীল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত। তার উপর এই সীমিত সম্পদকে দক্ষভাবে ব্যবহার করার জন্য যে একদল দক্ষ উদ্যোক্তার প্রয়োজন তা বাংলাদেশে নেই । দক্ষ উদ্যোক্তার অভাবে বাংলাদেশের সীমিত সম্পদকে দক্ষভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না ।
৪। সুশাসনের অভাব/দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব বা দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা র অনুন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ । লজ্জাজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছর ধরে পরপর দুর্নীতিতে বিশ্বের শীর্ষ পদ ধরে রেখেছে। দুর্নীতির কারণে এদেশের সরকারের অনেক ভাল উদ্যোগ এবং অর্জন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
৫। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ঃ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে সেদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তি-শৃংখলার উপর। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিগত ৪০ বছরে বাংলাদেশে কখনও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। বরং হরতাল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ, সংসদ বর্জন, হত্যা ইত্যাদি নানারকম রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কাঙ্খিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ হয়নি ।
8
৬। অনুন্নত অবকাঠামো ঃ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে অবকাঠামো । কিন্তু বাংলাদেশের অনুন্নত অবকাঠামো এদের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার প্রধান কারণ। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম, ঘনঘন লোডশেডিং, গ্যাস সংকট, পরিবহণ ও যোগাযোগের সমস্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করছে ।
৭ । মূলধনের অভাব ঃ মূলধনের অভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির প্রধান কারণ । মূলধনের স্বল্পতার কারণে বিনিয়োগ কম, কর্মসংস্থান কম এবং উৎপাদন কম । এজন্য অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দারিদ্রের দুষ্টচক্র এবং নিম্ন আয়স্তরের ভারসাম্য ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না ।
৮। অনুন্নত কৃষি ঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অথচ কৃষিতে উৎপাদন ও চাষব্যবস্থা খুবই অনুন্নত । আধুনিক চাষাবাদের পরিবর্তে কৃষিতে এখনও সেকেলে/সনাতন চাষ ব্যবস্থা চালু রয়েছে । আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বীজ ও সার এর ব্যবহার এখনও সার্বিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি । তাই বাংলাদেশের কৃষিতে একর প্রতি ফলনও খুবই কম । অর্থনীতির এই প্রধান খাতের অনগ্রসরতাই কে সামনে এগোতে বাধা দিচ্ছে
৯। প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ : বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী এখনও পুরানো ধাঁচের। বেশীরভাগ মানুষ সামাজিক কুসংস্কার ও বিভিন্ন গোঁড়ামীতে বিশ্বাস করে। এই প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনুকুল নয় । বর্ণ প্রথা, বাল্য বিবাহ, যৌথ পরিবার প্রথা ইত্যাদি বিপুল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে অনগ্রসর করে রেখেছে।
১০ । বেকারত্ব ঃ বাংলাদেশে বর্তমানে মোট শ্রমশক্তির এক তৃতীয়াংশ বেকার রয়েছে। তাছাড়া কৃষিতে কম বেকারত্ব এবং মৌসুমী বেকারত্বও রয়েছে। এই বিপুল বেকার জনগোষ্ঠীর চাপ বাংলাদেশকে অনুন্নত করে রাখতে অনেকটাই দায়ী ।
১১। অসম আয় বণ্টন : বাংলাদেশের সম্পদ ও পুঁজির বিরাট অংশ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় প্রায় ৪০% এর বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে, দিনে আনে দিনে খায় ।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
১১ < এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ সম্পদের মালিক মাত্র মুষ্টিমেয় কিছু লোক। আর বাকী ১০ ভাগ সম্পদের মালিক হচ্ছে ৯০ ভাগ মানুষ । এই ধারণা থেকেই পরিষ্কার বাংলাদেশে আয় বন্টনে অসমতা বা বৈষম্য কতটা প্রকট । আয় বন্টনে এরূপ অসমতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির জন্য কম দায়ী নয় ।
১২ । অনুন্নত শিল্প ঃ শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনুন্নত । মূলধনের অভাব, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষ শ্রমিক ও দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে শিল্পায়ন হচ্ছে না । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়নের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাংখিত শিল্পোন্নয়ন হয়নি । তেমন কোন ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়নি। যে সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতেও আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎপাদন ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হয়নি । শিল্পক্ষেত্রে এই দুরাবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার জন্য অনেকটাই দায়ী ।
১৩। অশিক্ষিত ও অসচেতন জনগণ : বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ এখন অশিক্ষিত । ২০১১ সালের হিসাবেও দেখা যায় বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও অশিক্ষিত এবং অসচেতন । জনগণের অশিক্ষা ও অসচেতনার কারণে সকল জনগণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না, তাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে ।
১৪। প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঃ বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর ফসল বিনষ্ট হয় এবং ঘরবাড়ী ও অন্যান্য সম্পত্তি ধ্বংস হয় । অনেক পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল মাত্র কয়েক মিনিটের ঝড়ের তান্ডবে ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার একটা অন্যতম কারণ ।

১৫। প্রাকৃতিক সম্পদের অসম্পূর্ণ ব্যবহার ঃ এমনিতেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অপর্যাপ্ত । তারপরেও উপযুক্ত নীতির অভাব, কারিগরী জ্ঞানের অভাব এবং মূলধনের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে পরিপূর্ণ ও দক্ষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি । বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অদক্ষ ও অপূর্ণ ব্যবহার এদেশকে অনুন্নত ও অনগ্রসর করে রেখেছে ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে ইহা সুস্পষ্ট যে, দীর্ঘদিনের সমস্যা এবং তা সমাধানের ক্ষেত্রে সাফল্যের অভাবে একটি দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছে। এর অনিবার্য ফলস্বরূপ এদেশের অর্থনীতি অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ বয়ে গেছে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]