গ্রিন হাউজ গ্রিন হাউজ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া গ্রীন হাউজ প্রভাব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট


কিয়োটো প্রটোকল Kyoto Protocol
কিয়োটো প্রটোকল হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যার অধীনে শিল্পোন্নত দেশসমূহ তাদের সম্মিলিত গ্রীন হাউজ গ্যাস কমপক্ষে ৫ শতাংশ হ্রাস করবে। ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী তারিখে জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত এই বহুপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০০৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ১৮৭টি দেশ উক্ত প্রটোকল অনুসমর্থন করেছে। এর মধ্যে ১৩৭টি উন্নয়নশীল দেশ । তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কাজাখস্থান এ প্রটোকল অনুসমর্থন করেনি। ২০১২ সালের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার হেক্সোফ্লোরাইড, এইচএফসি এবং পিএফসি-এই ৬টি গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করবে। জাতীয় পর্যায়ে এই হ্রাসকরণের হার হবে নিম্নরূপ ।
(ক) ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য ৮ শতাংশ; -
(খ) জাপানের জন্য ৬ শতাংশ;
(গ) যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ৭ শতাংশ;
(ঘ) রাশিয়ার জন্য ৩ শতাংশ ।
চীন এবং ভারত গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণে অন্যতম শীর্ষে থাকলেও তাদের ক্ষেত্রে নির্গমণ মাত্রা প্রযোজ্য নয় ।
কিয়োটো প্রটোকলের উদ্দেশ্য (Objectives of Kyoto Protocol)
কিয়োটো প্রটোকলের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা । কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণের মাত্রা যে হারে বেড়ে চলেছে তা পৃথিবীকে এক সময় ধ্বংস করে দিতে পারে। Inergovernment Panel on Climate Change 9 (IPCC) নামক সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমান হারে গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমণ হতে থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা ৫ থেকে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাবে। কিন্তু কিয়োটো প্রটোকলের শর্ত ও বিধি বিধান মেনে চললে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ০.০২ ডিগ্রী থেকে ০.২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে । ফলে পৃথিবীকে ও পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ ও প্রাণী জগতকে জলবায়ুর পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতি ও বিপদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
কিয়োটো প্রটোকলের মূলনীতি (Main principles of Kyoto Protocol )
জাতিসংঘের অধীনস্থ UNFCC এর আওতায় কিয়োটো প্রটোকলের মূলনীতি হচ্ছে ৬টি । যথাঃ
১। কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরকৃত দেশগুলোর সরকার কর্তৃক লিখিত এবং জাতিসংঘের UNFCC সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হবে।
২ । স্বাক্ষর করা রাষ্ট্রসমূহ দুইভাগে বিভক্ত । যথাঃ
(ক) শিল্পোন্নত দেশসমূহ যাদের গ্রীন হাউজ গ্যাস হ্রাস বাধ্যতামূলক ।
(খ) অনগ্রসর/স্বল্পোন্নত দেশসমূহ যাদের গ্রীন হাউজ গ্যাস হ্রাস বাধ্যতামূলক নয় ।
৩। প্রত্যেক শিল্পোন্নত দেশ ১৯৯০ সালে যতটুকু গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণ করতো ২০১২ সালের মধ্যে তার ৫% গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করতে হবে ।
৪ । শিল্পোন্নত দেশসমূহকে আলাদা আলাদা টার্গেট দেওয়া হয়েছে গ্রীন হাউজ গ্যাস হ্রাসের। কোনো শিল্পোন্নত দেশ যদি তার নির্ধারিত টার্গেট অনুসারে গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে পরবর্তী নতুন টার্গেট হিসেবে ৩০% গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করতে হবে ।
৫ । কোন শিল্পোন্নত দেশ গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করতে না পারলে তার ক্ষতিপূরণ বাবদ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উচ্চমূল্যের আর্থিক ক্ষতি পরিশোধ করতে হবে যা কিয়োটো প্রটোকলের Flexible Mechanism নামে পরিচিত ।
৬। কিয়োটো প্রটোকলের অধীনে জার্মানীর বনভিত্তিক Clean Development Mechanism (CDM) Project প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । এই কর্তৃপক্ষের কাজ হচ্ছে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমণের ফলে আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা এবং অনুন্নত দেশগুলোকে যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ সহায়তা করা ।
গ্রীন হাউজ প্রভাব
গ্রিন হাউজ Green House Effect

গ্রিন হাউজ শব্দটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে “সবুজ ঘর' । শীত প্রধান দেশে নির্দিষ্ট মাত্রায় তাপ ধরে রেখে উদ্ভিদ ও সবজি জন্মানোর জন্য 'গ্রিন হাউজ়' তৈরি করা হয় । কাচের তৈরি গ্রিন হাউজ সূর্যের আলো আসতে বাধা দেয় না, তবে এর কাঁচের আচ্ছাদন সূর্যের তাপশক্তি ধরে রাখে । শীত প্রধান দেশে সূর্যালোক খুব কম বলে সেসব দেশে এই কাঁচের ঘরে কৃত্রিমভাবে তাপ সৃষ্টি করেও গাছপালা জন্মানো হচ্ছে, যাকে আমরা ‘গ্রিন হাউজ' বলি ।
গ্রিন হাউজ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া
পৃথিবীতে সমস্ত তাপ ও শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্যরশ্মি পৃথিবী পৃষ্টে পড়ে মূলত দৃশ্যমান স্বচ্ছ আলো হিসেবে । এর সবটুকু অংশ পৃথিবীর কাজে লাগে না বলে, ভূ পৃষ্ঠে অতিরিক্ত অংশ ছেড়ে দেয়। তবে তা আর দৃশ্যমান আলো হিসেবে কাজ করে না, করে অবলোহিত বিকীরণের (Infrared radiation) মাধ্যমে ।
বায়ুমণ্ডলে কিছু গ্যাস আছে যেমন- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প, ওজোন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন যাদের অণু দৃশ্যমান আলোর জন্য স্বচ্ছ এবং তা সূর্যের আলো পৃথিবীতে পড়তে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। তবে এরা অবলোহিত রশ্মি শোষণ করে। ফলে বিকিরিত তাপের সবটুকু মহাকাশে ফিরে যেতে পারে না। একাংশ আবহাওয়া মণ্ডলে থেকে যায়। কতটুকু তাপ এভাবে থেকে যাবে তা নির্ভর করে, কি পরিমাণ এ ধরনের গ্যাস বায়ুমণ্ডলে রয়েছে তার ওপর। বায়ুমণ্ডলে এ ধরনের গ্যাস যতই বাড়বে, ততই সেখানে তাপ আটকে রাখার মতো একটি ঢাকনির সৃষ্টি হবে যা গ্রিন হাউজ ঢাকনির মতো কাজ করে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টি করছে গ্রিন হাউজ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া (Green house effect)।
গ্রীন হাউজ গ্যাস Green House Gas
গ্রীন হাউজ প্রভাব সৃষ্টিকারী গ্যাসগুলোকেই মূলত গ্রীন হাউজ গ্যাস বলে। পূর্বে গ্রীন হাউজ প্রভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূলত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে দায়ী করা হলেও বর্তমানে জানা গেছে, পুরো সমস্যার ৫০%-এর জন্য দায়ী কার্নব-ডাই-অক্সাইড এবং বাকি অর্ধেকের জন্য দায়ী অন্যান্য গ্যাসগুলো যেমন- মিথেন ১৯%, সিএফসি ১৭%, ওজোন ৮%, নাইট্রাস অক্সাইড ৪% এবং জলীয় বাষ্প ২% ।
এ সকল গ্রীন হাউজ গ্যাস যদি হঠাৎ বায়ুমণ্ডল থেকে উধাও হয়ে যায়, তবে পৃথিবী রাতারাতি পরিণত হবে প্রাণহীন শীতল গৃহে । ফলে ডাইনোসরদের মতো অতিকায় প্রজাতির বিলুপ্তির ন্যয় মানবজাতির ঘটবে করুণ বিলুপ্তি । তাই এ সকল গ্যাসের পরিমিত উপস্থিতি, পৃথিবীর স্বাভাবিক ও অনুকূল অস্তিত্বের জন্য খুব জরুরি । তবে লক্ষ্যণীয় যে, শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে বহু শিল্পকারখানা এবং যানবাহনের নির্গত ধোঁয়া থেকে এ জাতীয় গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বায়ুমণ্ডলে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলছে ।
গ্রীন হাউজ গ্যাসের উৎস/উৎপত্তি
Sources/Origin of Green House Gas

প্রতিনিয়ত পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন মানুষ প্রতিদিন দু'পাউন্ডের মতো কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিচ্ছে। আবার এই বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান ও চাষাবাদের জন্য উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল। অথচ এই বনাঞ্চলই সালোক-সংশ্লেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নির্দিষ্ট রাখছে। এই জনসংখ্যার সঙ্গে পালা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন এবং শিল্প-কারখানা । এগুলোর নির্গত ধোঁয়া থেকে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। তাছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানী যেমন- তেল, গ্যাস, কাঠ, কয়লা এগুলোর দহনের ফলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে চলছে । গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড হলেও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে নাইট্রাস অক্সাইডের তাপ ধারণ ক্ষমতা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ১৫০ গুণ বরং ২০৩০ সাল নাগাদ এ গ্যাসের মাত্রা ৩৪% বাড়বে। মিথেনের তাপ ধারণ ক্ষমতা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ২০ গুণ এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের ক্ষমতা ২০ হাজার গুণ বেশি। এসব গ্যাসের ঘনত্বও আনুপাতিক হারে বাড়ছে ।
পরিবেশ সচেতন মানুষ পৃথিবীর উষ্ণায়ন নিয়ে চিন্তিত। গ্রীন হাউজ গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় যে উষ্ণায়নের সৃষ্টি সে বিষয়ে এখন আর কোন দ্বিমত নেই। পানির বাষ্প, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি (ক্লোরোফ্লোরো কার্বন), ট্রোপমণ্ডলের ওজোন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্যাসগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আমাদের ব্যবহৃত ইন্ধন সৃষ্টি করেই উষ্ণায়ন ঘটিয়ে চলছে। এ গ্যাসগুলোর মাত্রা যত বাড়ছে নিম্ন বায়ুমণ্ডলে আমাদের ব্যবহৃত ইন্ধন শক্তির তাপমাত্রা তত বেশি ধরে রাখবে। ফলে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠবে এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবহাওয়ার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটবে যার মধ্যে আছে- তাপমাত্রা বাড়বে, বৃষ্টিপাতের ধারার পরিবর্তন হবে, সমুদ্রের বরফ কমে যাবে, উর্ধ্বমণ্ডলের তাপমাত্রা কমে যাবে, গ্রীষ্মকালে আর্দ্রতা কমে যাবে, সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির গড় বৃদ্ধি পাবে, ঝড়-ঝঞ্ঝা বৃদ্ধি পাবে, উদ্ভিদের পরিবর্তন আসবে, জলাধারগুলোর রাসায়নিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পৃথিবীর আবহাওয়ায় কার্বন জমে ওঠার কারণে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটছে। এই উষ্ণায়নের কারণে পানির বাধা ত্বরান্বিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন আদ্রতা হ্রাস পেয়ে ক্ষরা ও মরুকরণের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় অন্যদিকে বৃষ্টির কারণে মাটি ও জলাধারগুলোর রাসায়নিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয় । পৃথিবীর মাটি ও পানির রাসায়নিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়লে প্রাণ সম্পদ ক্ষয়িষ্ণু হবে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্থ হবে । বিশ্বের আবহাওয়ায় পানির বাষ্পের একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে ।
কার্বন-ডাই-অক্সাইড ঃ বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসই পানির বাষ্পের পর সবচেয়ে কার্যকর গ্রীন হাউজ গ্যাস। শিল্প বিপ্লবের কয়লা, তেল, গ্যাস ইন্ধন শক্তির দহন, বৃক্ষ নিধন বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাস সঞ্চয়ের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে । পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বর্তমানে ০.৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। ১৮ শতকের শিল্প বিপ্লবের সূচনা থেকে বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাসের সঞ্চয় প্রায় ২২৫ শতাংশ বেড়েছে ।
ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) ঃ সিএফসি গ্যাসগুলো হলো কার্বন নামে পরিচিত একশ্রেণীর রাসায়নিক পদার্থের অংশ। হ্যালো কার্বন বায়ুমণ্ডলের ওজোন আক্রমণ করে ধ্বংস করে এবং গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে বিশ্ব উষ্ণায়নে অবদান যোগায়। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাসগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ২০,০০০ গুণ বেশি তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে। এ গ্যাসগুলো বিভিন্ন ধরনের শিল্প উৎপাদনমূলক কাজে প্রধানত প্লাস্টিক ফোমের ফাঁপানোর উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে ও হিমায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে কাজ করে। এ গ্যাস ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ক্লোরিন ছাড়ে যা ওজোন ভাঙার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ওজোন স্তর পৃথিবীকে অতি বেগুনী রশ্মির কিরণ থেকে রক্ষা করে, বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে এ গ্যাসের সঞ্চয় ৫ শতাংশ হাড়ে বাড়ছে ।
মিথেন ঃ মিথেন গ্যাস প্রাকৃতিক গ্যাস যা বায়ুমণ্ডলে জৈব উৎস থেকে আসে । এই গ্যাস কার্বন- ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে। বিশ্বের জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ গ্যাসের সঞ্চয় মাত্রা বাড়ছে। বর্তমানে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মিথেন গ্যাসের মাত্রা প্রতি দশ লাখ ভাগের ১.১ শতাংশ হারে বাড়ছে। গবাদিপশুর জাবর কাটা এবং ধান চাষের এলাকা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মিথেন গ্যাস, বেড়ে চলেছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস বাতাসে বেশি পরিমাণ বেড়ে চলেছে । নাইট্রাস অক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড তাপ আটকে বা ধরে রাখতে পারে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তুলনায় ১৫০ গুণ বেশি। মাটিতে অণুজীব ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রাস অক্সাইড তৈরি হয় । বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসের উপস্থিতি কম। তারপরও আশঙ্কার কারণ এ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নিজের অবস্থান একটা দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে সক্ষম। উৎপাদন পদ্ধতির কারণে যে কোন পরিবেশ সৃষ্টি করে এই গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি বন্ধ করা গেলেও তা বহুদিন ধরে বায়ুমণ্ডলে বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। বর্তমানে এ গ্যাগ আনুমানিক ০.২৫
শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে।
ট্রপোসফিয়ারিক ওজোন ৪ ঊর্ণ বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর পৃথিবীকে অতি বেগুনি রশ্মির ক্ষতি থেকে প্রাণ রক্ষা করে। নিচের বায়ুমণ্ডলে গ্যাস তার আচরণ পরিবর্তন করে গ্রীন হাউজ গ্যাস হিসেবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান তৈরি করে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক ৬০ কিলোমিটার উচ্চতা অবধি স্থানে বিভিন্ন মাত্রার ওজোনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তবে ১০ থেকে ৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে অধিকাংশ ওজোনের সমাবেশ ঘটে থাকে। মোটরগাড়ি ও শিল্প-কারখানা থেকে বের হওয়া হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ওজোন সৃষ্টি হয়।
গ্রীন হাউজ 'গ্যাসের প্রতিক্রিয়া খুব বেশি হওয়ার কারণে শুক্র গ্রহের আবহাওয়ায় তাপ এত বেশি যে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আবার গ্রীন হাউজ গ্যাসের অস্তিত্ব না থাকার কারণে মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া শীতল। পৃথিবীতে গ্রীন হাউজ গ্যাসের নানা প্রতিক্রিয়ার কারণে আবহাওয়া মৃদুভাবাপন্ন। গ্রীন হাউজ গ্যাস বিশ্ব উষ্ণায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের কারণে গ্রীন হাউজ গ্যাসের সঞ্চয় বাড়ছে। মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য সারাদিন যা করে তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে বায়ুমণ্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাস জমা হচ্ছে। আগামীতে মানুষের কার্যকলাপ কি হবে তার ওপর নির্ভর করছে বায়ুমণ্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের সঞ্চয়ের মাত্রা কতটা বাড়বে এবং তার ফলে আবহাওয়া কতটা পরিবর্তন ঘটবে । তবে বিশ্ব উষ্ণায়নের একটা ধারণা সবার মধ্যে থাকা প্রয়োজন । তাপমাত্রার অতি নগণ্য গড় পরিবর্তন আমাদের আবহাওয়ায় খুবই চাঞ্চল্যকর পরিবর্তন ঘটতে পারে। বর্তমান বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৫৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট । এই গড় তাপমাত্রা যদি মাত্র ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তা পরিবেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যা মানুষ বিগত ১,০০,০০০ বছরে মোকাবিলা করেনি। আমাদের কর্মকাণ্ড সত্যিই পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে দিচ্ছে। গ্রীন হাউজ গ্যাস উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধিতে আমরা পরিবেশ অবনতির এক আশঙ্কাজক পরিস্থিতির সামনাসামনি হচ্ছি। আমাদের দরকার পরিবেশ সচেতন হয়ে বিশ্বমুখী মানসিকতার মাধ্যমে আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যতের রূপায়ণে ব্রতী হওয়া ।
গ্রীন হাউজ প্রভাব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট Green House Effect and Bangladesh Perspective
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের পুরোটাই বিশাল বঙ্গীয় বদ্বীপের অন্তর্ভূক্ত। বিভিন্ন দেশ থেকে নদ-নদীগুলো এই বদ্বীপে এসে মিলিত হয়েছে এবং দেশের প্রায় অর্ধেক ভূ-ভাগই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটার অপেক্ষা কম উঁচু। পরিবেশ গবেষকদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১৩ সে.মি. বাড়বে এবং দেশের ভূ-ভাগের মোট আয়তনের এক শতাংশেরও কম ভূমি এগিয়ে আসা সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে। সবচেয়ে চরম পরিস্থিতিতে এদেশের ১৮ শতাংশ জমি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেলে দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ১৫ শতাংশের স্থানচ্যুতি ঘটবে এবং সেই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। চরম প্রতিকূল অবস্থায় ২১০০ সাল নাগাদ জনগোষ্ঠীর ৩৫ শতাংশের স্থানচুতিসহ মোট উৎপাদনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ফসলসহ, ঘরবাড়ি, রাস্তা ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সাগরের বুকে বিলীন হয়ে যাবে। অধিক জনসংখ্যা, কল-কারখানা ও যানবাহনের নির্গত ধোয়া এবং নির্বিবাদে বন উজাড় করার ফলে মূলত গ্রীন হাউজ প্রভাবের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পরিবেশ দূষণের এই ভয়াল পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা যদি সতর্ক না হই তবে এ শতাব্দী হবে পৃথিবীর জন্য বিপর্যয়ের অশনী সঙ্কেত । বাংলাদেশের পাশাপাশি মালদ্বীপের মতো দ্বীপ প্রধান দেশ এবং লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিউল, বেইজিং ইত্যাদি শহরের জন্যও গ্রীন হাউজের মারাত্মক প্রভাব হবে হুমকিস্বরূপ। তাছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর পৃষ্ঠ উত্তপ্ত হওয়ার পাশাপাশি মেরু অঞ্চলের বরফ ক্রমান্বয়ে গলতে থাকবে, সেই সঙ্গে বাড়বে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা । অর্থাৎ আমাদের এই শ্যামল সুন্দর পৃথিবী শিকার হতে যাচ্ছে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে ।
বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা একবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ৩ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, ফলে সমগ্র বাংলাদেশের এক-দশমাংশ বঙ্গোপসাগরের অতলে তলিয়ে যাবে। বরিশাল ও খুলনা সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপে পরিণত হবে । পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এমনটাই আশঙ্কা করেন । যশোর, ফরিদপুর, চাঁদপুর, বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত । তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এই একবিংশ শতাব্দির শেষ নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৬.৯ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যাবে এবং ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, কুমিল্লার নিম্নাঞ্চল এবং সিলেট জেলা সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হবে; ফলে বহু লোক আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে । নদী-উপনদীর জলের লবণাক্ততা বেড়ে যাবে, ফলে পানীয় জলের দারুণ অভাব দেখা দেবে এবং মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হবে। ধানি জমি প্লাবিত হবার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। ঘন ঘন বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস দেখা দেবে। উপকূলীয় বনাঞ্চল এবং সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে, ধ্বংস হবে বনসম্পদ, এক কথায় বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির অস্তিত্ব চরম হুমকির সম্মুখীন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। আবার পরিবেশে অধিক হারে নাইট্রাস অক্সাইড এবং CFC-এর উপস্থিতি ওজন স্তরের দ্রুত ক্ষয়সাধন করছে । এই ওজন স্তর ভূপৃষ্ঠ হতে ১০-৫০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। ওজন স্তর সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মির ৯৯% শুষে নেয় এবং ২৯০ ম্যানোমিটারের চেয়ে কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট সৌর রশ্মিকে পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাধা দেয়। কিন্তু অধুনা ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে এই ওজন স্তরে গর্ত দেখা দিয়েছে। ফলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ঢুকে পড়ছে পৃথিবী পরিমণ্ডলে, বাড়ছে ধরিত্রীর তাপমাত্রা । মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চর্মের কর্কট রোগ, চোখের ছানি পড়াসহ অন্যান্য ঘাতক ব্যাধিতে। এই অতি বেগুনি রশ্মির ফলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বৃক্ষের সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া । তদুপরি মানুষের জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন এই অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে বিষাক্ত ওজোন গ্যাসে পরিণত হচ্ছে। যদিও Global warming একটি মহাজাগতিক প্রক্রিয়া তবু Green house effect এবং ওজোন স্তরের ক্ষয় এবং তদ্‌জনিত Global warming-এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন । নেদারল্যান্ড ইতোমধ্যে সমুদ্র উপকূল ঘিরে উঁচু দেয়াল তৈরি করেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে । কিন্তু বাংলাদেশের মতো দারিদ্র দেশের পক্ষে তা সর্বোতভাবেই দুঃসাধ্য, তাই International council of scientific union বিশ্বের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল সদস্য রাষ্ট্রের জন্য Global warming প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে কিছু প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যেমন- ফসিল জ্বালানীর পরিবর্তে সৌরতাপ এবং সৌরশক্তি, আণবিক শক্তি এবং জনশক্তির (hydraulic energy) এর ব্যবহার, উন্নতমানের মোটরযন্ত্র আবিষ্কার করা যা কম জ্বালানি খরচ করে অধিক পথ অতিক্রমে সক্ষম হবে, ডিজেল এবং পেট্রোলের পরিবর্তে সৌরশক্তির ব্যবহার, বনায়ন, রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের ব্যবহার, CFC-এর ব্যবহার রোধ ইত্যাদি ।
পরিশেষে বলা যায়, আজ পৃথিবীর যে গভীরতম অসুখ তার জন্য মানুষের কার্যকলাপই দায়ী। আর মানুষ তার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে হয়ে উঠতে পারে এক বিপন্ন প্রজাতি। এ ব্যাপারে যে সচেতনা, সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তা আমরা আজও গ্রহণ করিনি।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]