ভোক্তার মূল্যসূচক ও মুদ্রাস্ফীতি Consumer Price Index and Inflation
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ভোক্তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত খাদ্য ও খাদ্য-বহির্ভূত পণ্য ও সেবা সামগ্রীকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI) প্রণয়ন করে থাকে। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে বর্তমান জাতীয় ভোক্তা মূল্যসূচক প্রকাশ করা হয়। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে পরিচালিত থানা ব্যয় জরিপ (Household Expenditure Servey, 1995-96) হতে এ মূল্যসূচকে ব্যবহৃত সূচক-ঝুড়ির (Index basket) পণ্য ও ভার (Weight) নেয়া হয়েছে। জরিপে প্রাপ্ত গ্রামীণ অধিবাসীদের ভোগ্যপণ্যের তালিকা ও নগর এলাকার অধিবাসীদের ভোগ্যপণ্যের তালিকা ব্যবহার করে যথাক্রমে সার্বিক গ্রামীণ (All rural) মূল্যসূচক এবং সার্বিক নগর (All urban) মূল্যসূচক নির্ণয় করা হয় । অতপর গ্রামীণ ও নগর এলাকার ভোগ-ব্যয়ের ভিত্তিতে ভারিত গড়ে মাধ্যমে (Weighted average) জাতীয় পর্যায়ের ভোক্তার মূল্যসূচক নির্ণয় করা হয়। সকল মূল্যসূচক ক্ষেত্র খাদ্য ও খাদ্য-বহির্ভূত এ দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যা আরও কতগুলো উপভাগে বিভক্ত। বাংলাদেশে ভোক্তা মূল্যসূচক থেকে মূল্যস্ফীতি নিরূপণ করা হয়। নিম্নে ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে জাতীয় ভোক্তা মূল্যসূচক ও মূল্যস্ফীতি সারণি নিম্নে দেখানো
ভোক্তা মূল্যসূচক অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার ৭.৩৫ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ছিল ৬.৭৮ শতাংশ । উক্ত সারণি থেকে দেখা যায় যে, ২০০২-০৩ অর্থবছর থেকে মূল্যস্ফীতির হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তা সর্বোচ্চ ১২.৩০ শতাংশে পৌছায়। এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক বেশী ছিল। উল্লেখ্য, ভোক্তা মূল্যসূচকে শহর এলাকার জন্য খাদ্য ও খাদ্য-বহির্ভূত অংশের ভার (Weight) যথাক্রমে ৪৮.৮ শতাংশ এবং ৫১.২ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকার জন্য যথাক্রমে ৬২.৯৬ শতাংশ এবং ৩৭.০৪ শতাংশ ।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে জুলাই মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.০৪ শতাংশ। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমণের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকারের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে । ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য চলতি বছরে জুলাই মাসের তুলনায় কিছুটা নেমে আসে। মার্চ ২০১৫-এ মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬.২৭ শতাংশে। এ সময়ের ব্যবধানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাই ২০১৪ এর ৭.৯৪ শতাংশ থেকে কমে মার্চ ২০১৫ এ দাঁড়িয়েছে ৬.৩৭ শতাংশে। কিন্তু একই সময়ে খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে মার্চ ২০১৫-এ দাঁড়িয়েছে ৬.১২ শতাংশে যা জুলাই ২০১৪-এ ছিল ৫.৭১ শতাংশ । চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬.৪৬ শতাংশে। মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো (এমটিএমএফ)-তে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে । ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মাস ওয়ারি মূল্যস্ফীতির ধারা নিম্নের সারণিতে দেয়া হলো ।
সাধারণত পণ্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবার প্রবণতাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় । অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে মুদ্রাস্ফীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন।
কুলবর্ণ এর মতে, মুদ্রাস্ফীতি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে "অত্যধিক পরিমাণ অর্থ অল্প পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রির পিছনে ধাবিত হয়" ।
ক্রাউথার এর মতে, “মুদ্রাস্ফীতি এমন এক অবস্থা যখন অর্থের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পায় অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়” ।
পিগুর এর মতে, “যখন উৎপাদনশীল কার্য অপেক্ষা মানুষের আর্থিক আয় বেশি হারে বাড়ে তখনই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়" ।
কেইস এর মতে, “পূর্ণ নিয়োগ ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ স্থির থেকে মোট চাহিদা বৃদ্ধির দ্বারা যদি দামস্তর বাড়ে, তবে তা হবে প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতি। ”
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধিই হলো মুদ্রাস্ফীতি অর্থাৎ কোন দেশে মোট অর্থের যোগান তার চাহিদার তুলনায় বেশি হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে । মনিটারিস্টরা মনে করেন, অর্থের অতিরিক্ত যোগান বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন একটি পরিস্থিতি যখন পন্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে । তবে একটি বা কয়েকটি পণ্যের দাম হঠাৎ কোন কারণে বৃদ্ধি পেলেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় না । বরং সার্বিকভাবে পণ্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর বৃদ্ধি পেলেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় ।
মুদ্রাস্ফীতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ ।
১। দামস্তর ক্রমাগত বাড়তে থাকে ।
২। অর্থের মূল্য তথা অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে ।
৩। অধিক অর্থ দিয়ে কম পরিমাণে পণ্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করতে হয়।
৪ । সামগ্রিক যোগানের তুলনায় সামগ্রিক চাহিদা বেশি হয় ।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণসমূহ Causes of Inflation in Bangladesh
মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।
১। অর্থের যোগান বৃদ্ধি ঃ অর্থের যোগান বাড়লে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে । ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায় । যদি দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় তবে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দামস্তর বাড়ে অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
২। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ঃ অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ঘাটতি বাজেট নীতি গ্রহন অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করতে হয়। এতে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে যেয়ে অর্থের যোগান বৃদ্ধি হেতু মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
৩। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতির কারণে (যেমন- ব্যাংক হার হ্রাস, রির্জাভ অনুপাত হ্রাস ইত্যাদি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অধিক হারে ঋণ সৃষ্টি করতে পারে । এত জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বাড়ে অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
৪। কর হ্রাস ঃ সরকার জনগণের উপর থেকে করের পরিমাণ হ্রাস করলে তাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থেকে যায় । এতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হেতু দ্রব্যমূল্য বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
৫। উৎপাদন হ্রাস ঃ অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদি কারণে কৃষিপণ্য ও কাঁচামালের স্বল্পতা দেখা দেয়। আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেমন- হরতাল, অবরোধ, শিল্পকারখানা ধর্মঘট ইত্যাদি কারণে শিল্পউৎপাদন হ্রাস পায় । অর্থের পরিমাণ ঠিক থেকে উৎপাদন হ্রাস পেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
৬। ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব ঃ বর্তমানে শ্রমিক সংঘ খুবই শক্তিশালী । শ্রমিক কল্যাণ বিবেচনা করে ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা প্রায়ই মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। এতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে বাধ্য হলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে তথা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
৭ । আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ঃ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হলে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন ভারসাম্যে উদ্ধৃত্ত দেখা দিলে জনসাধারণের আয় বেড়ে যায় । এতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় দামস্তর বেড়ে যায় অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
1
৮। যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহ ঃ যুদ্ধের সময় সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। সরকারের পক্ষে এ বিপুল অর্থ কর ধার্য, ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে যোগাড় করা কঠিন হতে পারে। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারকে অতিরিক্ত কাগজি মুদ্রা ছাপিয়ে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। আবার যুদ্ধের সময় ভোগ্য শিল্প থেকে যুদ্ধ শিল্পে কাঁচামাল ও মূলধন স্থানান্তরিত হয় । ফলস্বরূপ দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
৯ । বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য ও অনুদান বৃদ্ধি : অধিক হারে বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য ও অনুদানের আগমন ঘটলে অর্থনীতিতে আর্থিক আয় প্রবাহ বেড়ে যায়। উৎপাদনশীল খাতের তুলনায় অনুৎপাদনশীল খাতে এ অর্থ বেশি ব্যবহৃত হলে চাহদা বাড়ে এবং সে তুলনায় উৎপাদন বড়ে না । ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
১০। মজুতদার ও চোরাকারবারি ঃ অধিক মুনাফার আশায় মজুতদার পণ্য সামগ্রি সংরক্ষন করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে । আবার বেশি লাভের আশায় চোরাকারবারি দেশে উৎপাদিত পণ্য দেশের বাহিরে পাচার করে পণ্য সামগ্রির ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে পণ্য সামগ্রির কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে মজুতদার ও চোরাকারবারিরা পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে ।
১১। বেতন কাঠামোর পরিবর্তন ঃ দেশের সরকারি বেসরকারি সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি করলে অর্থনীতিতে মুদ্রার যোগান বাড়ে। এতে সবধরনের ভোগ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় দামস্তর বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
১২। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঃ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলে একস্থান হতে পণ্য সামগ্রী অন্যস্থানে স্থানান্তর করতে খরচ বেশি পড়ে । ফলে পণ্যমূল্য বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
১৩। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করলে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যহত হয় । ফলে সামগ্রিক যোগান হ্রাস পাওয়ায় দামস্তর বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতির এসব কারণগুলো একটি দেশের অর্থনীতির প্রকৃতির উপর অনেকটা নির্ভর করে। তবে এ কারণগুলোর বেশির ভাগকেই বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী করা যায় । অনেক ক্ষেত্রে কারণগুলো একে অপরের সাথে সহায়ক হয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে আরো গতিশীল করতে পারে ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]