বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণসমূহ Inflation in Bangladesh

ভূমিকা
Introduction
পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্বমন্দা-পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অনুসৃত সংকুলানমুখী মুদ্রানীতিতে (Accommodative monetary policy) প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মুদ্রাস্ফীতির হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ । আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি এবং বহিঃখাতে বৈদেশিক মুদ্রার নিট আন্তঃপ্রবাহের ফলে লেনদেন ভারসাম্যের উদ্ভূত চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে ২০১১-১২ মুদ্রানীতি প্রণীত হয় । মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্চ- ২০১২ পর্যন্ত সময়ে নীতি সুদ হার রেপো এবং রিভার্স রেপো দু'দফায় মোট ১০০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে যথাক্রমে ৭.৭৫ ও ৫.৭৫ শতাংশে পুনঃনির্ধারণ করে। সংযত মুদ্রানীতি গ্রহণের ফলে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে বছর ভিত্তিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পায় ১৮.১৯ শতাংশ, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে এ বৃদ্ধির হার ছিল ২১.৬৬ শতাংশ । এ সময় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই মাস শেষে ২৮.৩৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯.৫৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ সময়ে মোট আভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পায় ২৪.১৩ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬.৪৪ শতাংশ । এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই মাস শেষে ২৮.৩৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯.৫২ শতাংশে পৌঁছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে পুঁজিবাজারের মূল্য সূচক ও বাজার মূলধনের ব্যাপক সংশোধন (Market correction) ঘটে। বাজার মূলধন ২০১০-এ জিডিপি'র ৪৪.১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে এপ্রিল ২০১২-তে ৩৩.৭৭ শতাংশে নেমে যায়। Price Earnings (P/E) Ratio জানুয়ারি - ২০১১ এর ২৯.৩৫ থেকে হ্রাস পেয়ে ফেব্রুয়ারি-২০১২ এ ১২.০৪ এ দাঁড়িয়েছে। বাজার সংশোধন করে পুঁজি বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে এনে স্থিতিশীল ও যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ।
মুদ্রাস্ফীতি Inflation
সাধারণত পণ্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবার প্রবণতাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় । অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে মুদ্রাস্ফীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন । ফুলবর্ণ এর মতে, মুদ্রাস্ফীতি এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে "অত্যধিক পরিমাণ অর্থ অল্প পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রির পিছনে ধাবিত হয়" ।
ক্রাউথার এর মতে, “মুদ্রাস্ফীতি এমন এক অবস্থা যখন অর্থের মূল্য ক্রমাগত হ্রাস পায় অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়" ।
পিওর এর মতে, “যখন উৎপাদনশীল কার্য অপেক্ষা মানুষের আর্থিক আয় বেশি হারে বাড়ে তখনই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়" ।
কেইস এর মতে, “পূর্ণ নিয়োগ ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ স্থির থেকে মোট চাহিদা বৃদ্ধির দ্বারা যদি দামস্তর বাড়ে, তবে তা হবে প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতি। "
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধিই হলো মুদ্রাস্ফীতি অর্থাৎ কোন দেশে মোট অর্থের যোগান তার চাহিদার তুলনায় বেশি হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে। মনিটারিস্টরা মনে করেন, অর্থের অতিরিক্ত যোগান বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন একটি পরিস্থিতি যখন পন্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে একটি বা কয়েকটি পণ্যের দাম হঠাৎ কোন কারণে বৃদ্ধি পেলেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয় না। বরং সার্বিকভাবে পণ্যসামগ্রি ও সেবার দামস্তর বৃদ্ধি পেলেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়।
মুদ্রাস্ফীতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ ।
১। দামস্তর ক্রমাগত বাড়তে থাকে ।
২। অর্থের মূল্য তথা অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে ।
৩। অধিক অর্থ দিয়ে কম পরিমাণে পণ্যসামগ্রী ও সেবা ক্রয় করতে হয় ।
৪। সামগ্রিক যোগানের তুলনায় সামগ্রিক চাহিদা বেশি হয়।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি
Inflation in Bangladesh

বাংলাদেশে বর্তমানে কোন ধরনের মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান তা আলোচনা করতে হলে মুদ্রাস্ফীতির বিভিন্ন ধরন পর্যালোচনা করা দরদার। সাধারণত মুদ্রাস্ফীতির কারণ হিসেবে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি ও খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে পরিচিত। পূর্ণ নিয়োগের লক্ষ্য অর্জন এখানে একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয়। তাই এখানে প্রকৃত চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। তবে পূর্ণ নিযোগের পূর্বে সম্পদ ব্যবহারের অদক্ষতার কারণে মূল্যস্তর বৃদ্ধি পেতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির এরূপ অবস্থাকে বাধাজনিত মুদ্রাস্ফীতি বলে। বিভিন্নমুখী বাধার কারণে বাংলাদেশে উৎপাদন ও যোগান ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে পারে না। এজন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে তে চাহিদা বাড়লে মূল্যস্তর ও বাড়ে। সুতরাং বাংলাদেশে অর্থনীতিক বাধাজনিত অবস্থার কারণে চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করেছে। তাছাড়া স্বাধীনতার পর দেশের উৎপাদন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে যে পরিমাণ নতুন অর্থ সরবরাহ করা হয় সে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রি ও সেবা উৎপাদন হয়নি । এর ফলে অতিরিক্ত চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় যার গতি আজও অর্থনীতিতে বিদ্যমান । এখন দেখা যাক বাংলাদেশে খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি আছে কিনা। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান পুনরায় গড়ে তোলার জন্য সরকারকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অথচ উৎপাদন সে সময়ে একেবারে কম ছিল। পরবর্তীতে দেশী বিদেশী কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ইত্যাদির দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে সরকার শ্রমিক ও কর্মকতা কর্মচারীদের বেতন ভাতা কয়েকবার বৃদ্ধি করে অথচ সে অনুসারে শ্রমিকদের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি। ফলে দ্রব্য সামগ্রির উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় । এতে দামস্তর বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয় ।
তে আরও বিশেষ ধরনের মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায়। কোন কোন স্থানে প্রাকৃতিক অবস্থা, অনুন্নত ও অপর্যাপ্ত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরকারের পরিকল্পিত বন্টন প্রক্রিয়ার অভাব ইত্যাদির দরুন কোন কোন দ্রব্যের যোগান অপ্রতুল হয়। ফলে এসব অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় যাকে র‍্যাচেট মুদ্রাক্ষীতি বা স্থানীয় মুদ্রাস্ফীতি বলা যায়। আবার তে মার্কআপ মুদ্রাস্ফীতিও লক্ষ্যণীয় । কারণ ভোগ্যপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে চায়। সর্বোপরি বিশেষ কোন ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও জনসাধারণের প্রতিবাদহীনতা এ মার্কআপ মুদ্রাস্ফীতিতে উৎসাহিত করে ।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, বিভিন্ন ধরনের মুদ্রাস্ফীতি তে বিদ্যমান থাকলেও গুরুত্বে বিচারে খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি, চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি ও র‍্যাচেট মুদ্রাস্ফীতিই বেশি দেখা যায় ।
বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণসমূহ Causes of Inflation in Bangladesh
মুদ্রাস্ফীতির কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো ।
১। অর্থের যোগান বৃদ্ধি ঃ অর্থের যোগান বাড়লে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে । ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পায় । যদি দ্রব্য উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় তবে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দামস্তর বাড়ে অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
২। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ঃ অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ঘাটতি বাজেট নীতি গ্রহণ অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করতে হয় । এতে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে যেয়ে অর্থের যোগান বৃদ্ধি হেতু মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ।
৩। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি ঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতির কারণে (যেমন- ব্যাংক হার হ্রাস, রিজার্ভ অনুপাত হ্রাস ইত্যাদি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অধিক হারে ঋণ সৃষ্টি করতে পারে । এত জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বাড়ে অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
৪। কর হ্রাস ঃ সরকার জনগণের উপর থেকে করের পরিমাণ হ্রাস করলে তাদের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থেকে যায় । এতে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি হেতু দ্রব্যমূল্য বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
৫। উৎপাদন হ্রাস ঃ অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদি কারণে কৃষিপণ্য ও কাঁচামালের স্বল্পতা দেখা দেয়। আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যেমন- হরতাল, অবরোধ, শিল্পকারখানা ধর্মঘট ইত্যাদি কারণে শিল্পউৎপাদন হ্রাস পায়। অর্থের পরিমাণ ঠিক থেকে উৎপাদন হ্রাস পেলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
৬। ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব ঃ বর্তমানে শ্রমিক সংঘ খুবই শক্তিশালী । শ্রমিক কল্যাণ বিবেচনা করে ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা প্রায়ই মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। এতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে বাধ্য হলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে তথা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
৭। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত : বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হলে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন ভারসাম্যে উদ্ধৃত্ত দেখা দিলে জনসাধারণের আয় বেড়ে যায় । এতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় দামস্তর বেড়ে যায় অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
৮। যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহ ঃ যুদ্ধের সময় সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। সরকারের পক্ষে এ বিপুল অর্থ কর ধার্য, ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে যোগাড় করা কঠিন হতে পারে। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারকে অতিরিক্ত কাগজি মুদ্রা ছাপিয়ে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। আবার যুদ্ধের সময় ভোগ্য শিল্প থেকে যুদ্ধ শিল্পে কাঁচামাল ও মূলধন স্থানান্তরিত হয় । ফলস্বরূপ দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
৯ । বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য ও অনুদান বৃদ্ধি ঃ অধিক হারে বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য ও অনুদানের আগমন ঘটলে অর্থনীতিতে আর্থিক আয় প্রবাহ বেড়ে যায়। উৎপাদনশীল খাতের তুলনায় অনুৎপাদনশীল খাতে এ অর্থ বেশি ব্যবহৃত হলে চাহদা বাড়ে এবং সে তুলনায় উৎপাদন বড়ে না । ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় ৷
১০। মজুতদার ও চোরাকারবারি : অধিক মুনাফার আশায় মজুতদার পণ্য সামগ্রি সংরক্ষন করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে পারে। আবার বেশি লাভের আশায় চোরাকারবারি দেশে উৎপাদিত পণ্য দেশের বাহিরে পাচার করে পণ্য সামগ্রির ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে । এভাবে পণ্য সামগ্রির কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে মজুতদার ও চোরাকারবারিরা পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে ।
১১। বেতন কাঠামোর পরিবর্তন ঃ দেশের সরকারি বেসরকারি সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি করলে অর্থনীতিতে মুদ্রার যোগান বাড়ে। এতে সবধরনের ভোগ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় দামস্তর বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
১২। পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ঃ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হলে একস্থান হতে পণ্য সামগ্রী অন্যস্থানে স্থানান্তর করতে খরচ বেশি পড়ে । ফলে পণ্যমূল্য বাড়ায় মুদ্রাস্ফীতি ঘটে ।
১৩। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ঃ দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করলে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যহত হয়। ফলে সামগ্রিক যোগান হ্রাস পাওয়ায় দামস্তর বেড়ে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয় ।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতির এসব কারণগুলো একটি দেশের অর্থনীতির প্রকৃতির উপর অনেকটা নির্ভর করে । তবে এ কারণগুলোর বেশির ভাগকেই বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী করা যায় । অনেক ক্ষেত্রে কারণগুলো একে অপরের সাথে সহায়ক হয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে আরো গতিশীল করতে পারে ।
মুদ্রাস্ফীতির ফলাফল বা প্রভাব
Consequences or Effects of Inflation in Bangladesh Economy
নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে মুদ্রাস্ফীতির ফলাফল আলোচনা করা হলো ।
১। উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব ঃ মৃদু ও সহনশীল মুদ্রাস্ফীতিতে অব্যহত সম্পদ নিয়োগের সম্ভাবনা বাড়ে। প্রাপ্তির প্রত্যাশার উপর নির্ভর করে উৎপাদনকারী উৎপাদন বাড়ায় । ফলে পূর্ণ

মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক বাজার উন্ন
নিয়োগ ভরে না পৌছা পর্যন্ত উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়তে থাকে। কিন্তু অতি মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে তা উৎপাদন ও নিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে ।
(ক) দাম বৃদ্ধি ফটকা ব্যবসায়কে উৎসাহিত করায় মজুত বৃদ্ধি পায় ফলে প্রকৃত উৎপাদন নির্মিত হয় । (খ) দাম বৃদ্ধির দরুন জনগণের সঞ্চলা হ্রাস ও ভোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে পুঁজি গঠন বিঘ্নিত হয় ।
(গ) মুদ্রাক্ষীতির ফলে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শিল্পে অসন্তোষ সৃষ্টি হলে উৎপাদন হ্রাস পায়। (ঘ) মুদ্রাস্ফীতিতে কালোবাজারি প্রসারিত হয় বলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন হ্রাস পায়।
২। বণ্টনের উপর প্রভাব
(ক) শ্রমিক শ্রেণী : মুদ্রাস্ফীতির দরুন শ্রমিক শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ নির্দিষ্ট স্বল্প মজুরিতে তাদেরকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রি বেশি মূল্যে ক্রয় করতে হয় ।
(খ) কৃষক শ্রেণী ঃ মুদ্রাস্ফীতির সময় কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বল্পকালীন সময়ে যোগান বাড়ানো সম্ভব হয় না । সেজন্য এ সময় বিশেষ করে ধনী কৃষক শ্রেণী উৎপাদিত ফসল অধিক দামে বিক্রি করে লাভবান হয় । আবার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদেরকে স্বল্প আয়ে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করতে হিমশিম খেতে হয় ।
(গ) বিনিয়োগকারী ঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে শেয়ারে অর্থ বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়। কারণ শেয়ার ও মূলধন সম্পদের মূল্য বাড়ে এবং কোম্পানির লাভ বেশি হওয়ায় শেয়ারের ডিভিডেন্ডের হারও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকারি ক্ষণপত্র ও অর্থ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় । কারণ তারা যে নির্দিষ্ট হারে সুদ পায়, দাম বাড়ার দরুন সে সুদের প্রকৃতমূল্য কমে যায় ।
(ঘ) উৎপাদক শ্রেণী : দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদক শ্রেণী লাভবান হয় কারণ তাদের উৎপান ও মুনাফা বাড়ে ।
(ঙ) করদাতা ঃ মুদ্রাস্ফীতির ফলে করদাতারা লাভবান হয়। কারণ দাম বৃদ্ধির কারনে কর বাবদ প্রদেয় অর্থের মূল্য কর প্রদানকারীর নিকট কম অনুভূত হয় ।
(চ) ঋণদাতা ও ঋণগ্রহিতা : মুদ্রাস্ফীতির ফলে ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ফেরত পাওয়া আসল অর্থ দিয়ে পূর্বের সমান দ্রব্য ও সেবা ক্রয় করা যায় না। অপরদিকে, ঋণগ্রহিতা লাভবান হয় । কারণ ঋণগ্রহিতা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে পণ্যের আকারে কম সম্পদ পরিশোধ করে ।
৩। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর প্রভাব : মুদ্রাস্ফীতির ফলে অন্যান্য পণ্যসহ রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ ও দাম বৃদ্ধি পায়। ফলে রপ্তানি পণ্যের বৈদেশিক চাহিদা কমে রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ার
সম্ভাবনা দেখা দেয় ।
৪। সামাজিক প্রভাব : স্বল্পমাত্রার মুদ্রাস্ফীতিতে উৎপাদন ও নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। কিন্তু অতিমাত্রায় ও অব্যহত মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করলে ধীরে ধীরে সমাজে আয় বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং শ্রেণীগত বিরোধ ও অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবি উঠে। শ্রমিক- মালিক বিরোধ প্রকট হয় এবং সার্বিকভাবে সামাজিক অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কালোবাজারি, দুর্নীতি, অবৈধ পথে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলতে থাকে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজে একটি অসুস্থ পরিবেশ বিরাজ করে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, স্বল্পমাত্রার মুদ্রাস্ফীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক হলেও অধিকাংশে ক্ষেত্রে মুদ্রাক্ষীতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণহীন ও প্রকট হয়ে পড়ে। তখন উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদির স্বাভাবিক বিন্যাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সমগ্র অর্থনীতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি হয়। এজন্য সরকারকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]