অতি মুদ্রাস্ফীতি সমাজে ধন বৈষম্য ত্বরান্বিত করে অর্থনীতিতে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথাঃ
১। রাজস্ব পদ্ধতি
২। আর্থিক পদ্ধতি এবং ৩। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ।
নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো ।
১। রাজস্ব পদ্ধতি ঃ সরকারের আয়ব্যয় নীতিকে রাজস্ব নীতি বলে। সরকার সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতির দ্বারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । রাজস্ব নীতির মধ্যে নিম্নরূপ ব্যবস্থা রয়েছে ।
(ক) সরকারি ব্যয় হ্রাস ঃ সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে দিতে পারে। আবার সমতা বাজেট বা উদ্ধৃত্ত বাজেট নীতি গ্রহণ করে সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে পারে। এতে অর্থনীতিতে আর্থিক প্রবাহ কমে যায় । আয় কমলে সামগ্রিক চাহিদা কমে, দামস্তর কমে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে ।
(খ) করের পরিমাণ বৃদ্ধি : সরকার জনগণের উপর আরোপিত করের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং নতুন নতুন কর আরোপ করে জনগণের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমাতে পারে। ফলে সামগ্রিক চাহিদা ও দামস্তর কমবে ।
২। আর্থিক পদ্ধতি ঃ কেন্দীয় ব্যংক আর্থিক নীতির মাধ্যমে অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করে থাকে ।
(ক) ব্যাংক হার বৃদ্ধি ঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের যোগান কমানোর জন্য ব্যাংক হার বৃদ্ধি করতে পারে । এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বাড়ে। আর সুদের হার বাড়লে ঋণের দাম বাড়ে । ফলে ঋণের পরিমাণ কমে অর্থের যোগান হ্রাস পেয়ে দামস্তর কমে ।
(খ) সংরক্ষণের হার বৃদ্ধি ঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য নগদ জমার অনুপাত বা সংরক্ষণ হার বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকে নগদ অর্থের পরিমাণ কমে । ফলে ঋণদান ক্ষমতা কমায় বাজারে অর্থের যোগান হ্রাস পায়, দামস্তর কমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে ।
(গ) খোলাবাজার নীতি : সরকার খোলাবাজার কার্যক্রমের মাধ্যমে ঋণপত্র বিক্রি করে জনগণের নিকট হতে নগদ অর্থ নিতে পারে এর ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে দামস্তর কমে এবং এভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
৩। প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি : রাজস্ব নীতি ও আর্থিক নীতি ছাড়াও সরকার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিম্নলিখিত প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করতে পারে ।
(ক) সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ ঃ সরকার মুদ্রাস্ফীতি রোধ করার জন্য পণ্যসামগ্রির দামের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিতে পারে। এর ফলে দামস্তর একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না । অবশ্য এক্ষেত্রে কালোবাজারি দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমস্যা আরও প্রকট হয় ।
(খ) ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন : সরকার মুদ্রাস্ফীতির সময় বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যসামগ্রি বিক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এতে বাজারে বেসরকারি খাতে চাহিদার চাপ কমে দামস্তর হ্রাস পাবে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
(গ) মজুরি নিয়ন্ত্রণ ঃ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মালিক পক্ষের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে মজুরি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দাবি করে। এর ফলে উৎপাদন খরচ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে সরকার আইন করে মজুরি হারের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে ।
(ঘ) উৎপাদন বৃদ্ধি ঃ ব্যবহৃত ও অব্যহৃত সম্পদের উৎকৃষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে দামস্তর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও কম উৎপাদন ক্ষেত্র হতে প্রয়োজনীয় ও বেশি উৎপাদন ক্ষেত্রে সম্পদ স্থানান্তর করতে পারলে উৎপাদনের হার বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতি রোধ হবে ।
(ঙ) আমদানি বৃদ্ধি : সরকার দ্রব্যের যোগান কম হলে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে দ্রব্যসামগ্রি আমদানি করে সাময়িকভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে ।
উপসংহারে বলা যায়, এককভাবে কোন পদ্ধতি দ্বারা আজকাল সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না । কোন দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সরকার কর্তৃক যুগপৎ রাজস্ব নীতি ও আর্থিক নীতির সমন্বয় সাধন, প্রত্যক্ষ পদ্ধতি অবলম্বন এবং উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ।
মুদ্রাসংকোচন
Deflation
দামস্তর ক্রমাগত হ্রাস পাবার প্রবণতাকে মুদ্রাসংকোচন বলে । অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থান হলো মুদ্রাসংকোচন । পল এইনজিগ এর মতে, ”মুদ্রাসংকোচন হচ্ছে এমন একটি ভারসাম্যহীন অবস্থা, যখন দামস্তরের নিম্নগতির প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেশের অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সংকুচিত হয়ে আসে” । মুদ্রাসংকোচনের ক্ষেত্রে দ্রব্যসামগ্রি ও সেবাসমূহের উৎপাদন ও যোগানের তুলনায় সামগ্রিক চাহিদা কম হয়, সে অবস্থায় দামস্তর কমে ও অর্থের মূল্য বাড়ে ।
মুদ্রাসংকোচনের ফলাফল
Effects of Deflation
মুদ্রাসংকোচনের দ্বারা একটি অর্থনীতিতে নিম্নোক্ত ফলাফল সৃষ্টি হয় ।
১। উৎপাদন ঃ মুদ্রাসংকোচনের ফলে দামস্তর কমে যায় কিন্তু উৎপাদন ব্যয় তেমন কমে না । ফলে উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না । সমগ্র অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে।
২। কর্মসংস্থান : দামস্তর কমে যাওয়ায় সামগ্রিক উৎপাদন কমে যায় । ফলে প্রচুর শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে । তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয় এবং বেকার সমস্যা প্রকট হয় ।
৩। বণ্টন ব্যবস্থা ঃ মুদ্রাসংকোচনে দামস্তর কমে যাওয়ায় উৎপাদক শ্রেণী, শেয়ারে অর্থ "বিনিয়োগকারী, ধনী কৃষক, মজুতদার শ্রেণীর মুনাফা ও বর্ধিত আয় সংকুচিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে, নিম্ন ও স্থির আয়ভুক্ত মানুষ, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ইত্যাদি শ্রেণী লাভবান হয় । কারণ দ্রব্যসামগ্রীর দাম কমলে তাদের প্রকৃত আয় বাড়ে। তবে মুদ্রা সংকোচনের সময় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায় বলে দেশের সামগ্রিক আয় প্রবাহ কমে যায় । এজন্য তাদের এ সুবিধা কিছুটা সীমিত হয়ে পড়ে ।
৪। সামাজিক ফলাফল : মুদ্রাসংকোচনের ফলে উৎপাদন ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়ে বেকারত্ব বাড়তে থাকে । ফলে সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয় । সমাজের নিম্ন ও স্থির আয়ভুক্ত শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত আয় বাড়ে । তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সমাজের আয় প্রবাহ ও ভোগের পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে যায়। ফলস্বরূপ সমগ্র সমাজে হতাশা দেখা দেয় ৷
মুদ্রাসংকোচন নিয়ন্ত্ৰণ
Control of Deflation
মুদ্রাসংকোচন অর্থনীতিতে মন্দা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে । মুদ্রাসংকোচন নিয়ন্ত্রনের জন্য নিম্ন লিখিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যায় ।
১। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি : মুদ্রাসংকোচনের সময় সরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে যেমন- সড়ক, ব্রিজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় বাড়াতে পারে । এতে অর্থনীতিতে আর্থিক আয় প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে পণ্য সামগ্রি ও সেবার চাহিদা বাড়বে । ফলে দামস্তর, মুনাফা ও বিনিয়োগ বাড়ে এবং ধীরে ধীরে মুদ্রাসংকোচন দূর হয় ।
২। কর হ্রাস ঃ মুদ্রাসংকোচন দেখা দিলে সরকার জনসাধারণের উপর আরোপিত কর হার হ্রাস করতে পারে। এর ফলে জনসাধারণের ব্যয়যোগ্য আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে অর্থনীতিতে ভোগ ও বিনিয়োগ বেড়ে মুদ্রাসংকোচন তথা মন্দাবস্থা দূর হবে ।
৩। অর্থের যোগান বৃদ্ধি ঃ সরকার কাগজি নোট ছাপিয়ে অর্থের যোগান বৃদ্ধি করতে পারে । আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ জমার অনুপাত ও ব্যংক হার কমিয়ে দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণের প্রসার ঘটিয়ে অর্থের যোগান বাড়াতে পারে । এর ফলে অর্থনীতিতে ভোগ, বিনিয়োগ ও সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে। এভাবে দামস্তর হ্রাস তথা মুদ্রাসংকোচন নিয়ন্ত্রণ করা যায় ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত