আর্থিক নীতি
Monetary Policy
সাধারণ অর্থে, অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের (বাড়ানো বা কমানো) জন্য সরকার এবং দেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ (বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংক) যে নীতিমালা গ্রহণ করে, তাকে বলা হয় আর্থিক নীতি । আর্থিক নীতি হচ্ছে মূলত আর্থিক বিষয় সংক্রান্ত নীতি। যে নীতির সাহায্যে অর্থের যোগান, মুদ্রা ও ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাকে আর্থিক নীতি বলে । অর্থাৎ অর্থের যোগানের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত যে পদক্ষেপসমূহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয় সেগুলোকে একত্রে আর্থিক নীতি বলে ।
অর্থ সমাজে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের উপায় হিসাবে, মূল্যের পরিমাপক হিসাবে, সঞ্চয়ের বাহন হিসাবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ অর্থের ভূমিকা নিরপেক্ষ নয়। অর্থ শুধুমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ভূমিকা পালন করে না। বরং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে নানাভাবে প্রভাবিত করে । যেমন- অর্থের যোগান এবং ঋণের পরিমাণ বাড়ালে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় । আর অর্থের যোগান এবং ঋণের পরিমাণ কমালে দেশে মন্দা, মুদ্রাসংকোচন এবং বেকারত্ব দেখা দেয়। তাই অর্থের যোগান এবং ঋণের পরিমাণকে একটি গ্রহণযোগ্য বা কাম্য পর্যায়ে রাখা দরকার। সুতরাং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সরকার ও আর্থিক কর্তৃপক্ষ অর্থের যোগান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে বলা হয় আর্থিক নীতি ।
বিভিন্ন অর্থনীতিবিদগণ আর্থিক নীতি সম্পর্কে যে সকল সংজ্ঞা বা মতামত প্রদান করেন তার ভিত্তিতে আর্থিক
নীতিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১। সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি,
২। সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি এবং
৩। নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি ।
১। অর্থের যোগান এবং ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে গৃহীত আর্থিক নীতিই সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি (Expansionary monetary policy)। উৎপাদন, নিয়োগ, আয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি বাড়ানোর লক্ষ্যে এবং মন্দা ও বেকারত্ব নিরসনের জন্য সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতি গ্রহণ করা হয়। ২। অর্থের যোগান এবং ঋণের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে গৃহীত আর্থিক নীতিকে বলা হয় সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি (Contractionary monetary policy)। উৎপাদন, নিয়োগ, আয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি কমানোর লক্ষ্যে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি গ্রহণ করা হয় ।
৩। যে ধরনের আর্থিক নীতি গ্রহণ করলে দেশের আয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, মন্দা, বেকারত্ব ইত্যাদি উপাদানসমূহ প্রভাবিত হয় না, তাকে বলা হয় নিরপেক্ষ আর্থিক নীতি। প্রধানত উন্নত দেশসমূহ পূর্ণ নিয়োগস্তরে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এ ধরনের আর্থিক নীতি গ্রহণ করে ।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক নীতির উদ্দেশ্য
Objectives of Monetary Policy in Developing Countries like Bangladesh অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই মূলত আর্থিক নীতির লক্ষ্য। কতগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি দেশের সরকার ও আর্থিক কর্তৃপক্ষ নীতি গ্রহণ করে। আর্থিক নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। নিম্নে আর্থিক নীতির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হলো ।
১। দামস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা : দামস্তরের স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য্য। কারণ, দামস্তরের উঠানামা বা উত্থানপতনে অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে । দামস্তরের ক্রমাগত উত্থান দেশে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে। আবার দামস্তরের ক্রমাগত পতন দেশে মন্দা ও বেকারত্ব সৃষ্টি করে। অর্থাৎ দামস্তরের পরিবর্তন অর্থনীতিতে বাণিজ্য চক্রের সৃষ্টি করে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাম্য নয়। তাই বাণিজ্য চক্র নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে, দামস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আর্থিক নীতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
২। বৈদেশিক বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ : বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হার অত্যধিক উঠানামা করলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্থিতিশীল রাখার জন্য দেশীয় মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে হবে যার জন্য আর্থিক নীতির ভূমিকা খুবই জরুরি।
৩। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঃ একটি দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিনিয়োগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিনিয়োগ এর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে দেশের সরকার বা আর্থিক কর্তৃপক্ষ আর্থিক নীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন ।
৪। পূর্ণ নিয়োগ অর্জন ও উপকরণের পূর্ণ নিয়োগ স্তর অর্জন করানো আধুনিককালে আর্থিক নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য । অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সামগ্রিক চাহিদার ঘাটতির কারণে উপকরণগুলোর যথাযথ ব্যবহার এবং পূর্ণ নিয়োগ অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে আর্থিক নীতি প্রয়োগ করে অর্থের যোগান বৃদ্ধি করে পূর্ণ নিয়োগ স্তর অর্জন করা যেতে পারে। যদিও কেইস মনে করেন, এককভাবে আর্থিক নীতি নয় বরং আর্থিক ও রাজস্ব নীতি পাশাপাশি প্রয়োগ করে পূর্ণ নিয়োগ স্তর অর্জন করা সম্ভব হবে।
৫। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা : সরকারের অন্য সকল নীতির মতো আর্থিক নীতিরও অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্যে সুদের হার হ্রাস করলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়ে যা চুড়ান্তভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে ।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীদেশে আর্থিক নীতির সীমাবদ্ধতা
Limitations of Monetary Policy in Developing Countries like Bangladesh মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বেকারত্ব রোধ, মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা অর্জন, পূর্ণ নয়োগ অর্জন, আয় বণ্টনে বৈষম্য রোধে আর্থিক নীতির ভূমিকা থাকলেও বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক নীতি কার্যকর করতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নিয়ে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক নীতির সীমাবদ্ধতাসমূহ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হলো ।
১। অসংগঠিত ও অনুন্নত মুদ্রাবাজার ঃ আর্থিক নীতির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন একটি সংগঠিত ও উন্নত মুদ্রা বাজার। কিন্তু বাংলাদেশের মত বেশীর ভাগ উন্নয়নশীল দেশে মুদ্রা বাজার অনুন্নত ও অসংগতি ফলে এসব দেশে আর্থিক নীতির কার্যকারীতা কম। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে আর্থিক নীতির বিভিন্ন হাতিয়ার সুষ্ঠু এবং কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয় । তাছাড়া অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় কোন ঋণ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার যেদিকে কাজ করছে, অপরাপর হাতিয়ার হয়তো তার বিপরীত দিকে কাজ করছে ।
২। জনগণের হাতে নগদ অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা : বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের নগদ অর্থ আকারে হাতে অলসভাবে অর্থ ধরে রাখার প্রবণতা রয়েছে । তাই কেন্দ্ৰীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক আর্থিক নীতিও দেশের অর্থের যোগানের উপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না ।
৩। সমন্বয়ের অভাব : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আর্থিক লেনদেন বিভিন্ন উপায়ে সংগঠিত হয়। যথাঃ প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন (যেমন- আত্নীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, গ্রাম্য মহাজন ইত্যাদি)। অর্থাৎ আর্থিক লেনদেনের একটি বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আর্থিক নীতি কার্যকর কষ্টসাধ্য।
৪। আর্থিক সংযমের অভাব : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে আর্থিক সংযম প্রয়োজন । কিন্তু তা সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় এবং বিভিন্ন সরকারী সংস্থার ঋণ গ্রহণের ফলে লঘু হয়ে যায় । স্বাধীনতার পর আর্থিক নীতির কার্যকারীতার ব্যাপারে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ।
৫। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ : আর্থিক নীতি মূলত মূল্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার কথা । কিন্তু বাংলাদেশের মতো বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে পরিকল্পনার অভাব বাজার ব্যবস্থার কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। ফলে মুক্ত বাজার অর্থনীতি এসব দেশে ততটা কার্যকরী হয় না ।
৬। আর্থিকায়নের অভাব ৪ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনও অর্থনীতির এক উল্লেখযোগ্য অংশ আর্থিকায়নের ( monetarization) আওতায় আসে নাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ খাতের এক বৃহৎ অংশ এখনও ব্যাংকিং কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দেশের অনেক অঞ্চলে বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে ব্যাংক ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থাও আর্থিক নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগের পথে অন্যতম বাধা হিসাবে কাজ করছে বলা যায়। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আর্থিক নীতির প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আর্থিক নীতি একেবারেই অকার্যকর তা নয়। এক কথায়, এসব দেশে আর্থিক নীতির কার্যক্রম সীমিত ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত