ঋণের গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশে ঋণের উৎসসমূহ

ঋণের গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা Importance of Credit
বর্তমান যুগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে ঋণের গুরুত্ব অনেক বেশী। বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে উৎপাদনের সকল খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । নিম্নে ঋণের গুরুত্ব সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল ।
১। উৎপাদন বৃদ্ধি ঃ মূলধন ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয় । অনেক সময় অলস মূলধন ব্যাংকে বা অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকে । ঋণের মাধ্যমে সেই মূলধন অযোগ্য হাত থেকে যোগ্য হাতে স্থানান্তরিত হয় । এ মূলধন উৎপাদন কাজে নিয়োজিত করে বহুগুণে উৎপাদন বাড়ানো যায় ।
২ । বিনিয়োগ বৃদ্ধি ঃ ব্যবসায়ী বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা যদি সহজ শর্তে ও অল্প সুদে ঋণ পায় তাহলে বিনিয়োগ বাড়ে ।
৩। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ঃ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণ হয় । তার মাধ্যমে কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে । কুটির শিল্প ও আত্মকর্মসংস্থানের বিভিন্ন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় । ফলে অর্থনীতিতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয় এবং বেকার সমস্যার কিছু সমাধান হয় ।
৪ । ভোগ বৃদ্ধি ঃ সীমিত আয়ের মানুষেরা ভোগ্য ঋণ (consumer loan) গ্রহণের মাধ্যমে তাদের পছন্দের আসবাবপত্র, ফ্রীজ, গাড়ী, ফ্ল্যাট বা প্লট, ফার্ণিচার, কম্পিউটার ইত্যাদি ক্রয় করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে । এর ফলে ভোক্তাদের বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করার চাহিদা বাড়ে ও ভোগ প্রবণতা বৃদ্ধি পায় ।
৫। ব্যাংক ব্যবসার প্রসার ঃ ব্যাংক ব্যবস্থা মূলত ঋণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংকগুলো যত বেশী ঋণ প্রদান করতে পারবে ততই তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের শাখা সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে বেশী লোককে ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে পারবে।
৬। বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবিধা : বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি ক্ষেত্রে এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশে গ্রহণযোগ্য হয় না । তাই চেক, হুণ্ডি, ব্যাংক ড্রাফট ইত্যাদির সাহায্যে ব্যাংক সহজেই তাদের মক্কেলদের পক্ষে লেনদেন করে । ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে ।
৭। বিনিময় ব্যবস্থা সহজীকরণ ঃ ঋণের আদান-প্রদানের ফলে বিনিময় বা লেনদেন ব্যবস্থা অনেক সহজ ও নিরাপদ করা সম্ভব হয়েছে। কারণ একস্থান থেকে অন্যস্থানে নগদ অর্থ আনা-নেয়া ঝুঁকিপূর্ণ চেক, ছণ্ডি, ব্যাংক ড্রাফট ইত্যাদি ঋণপত্রের সাহায্যে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সহজে ও নিরাপদে লেনদেন করা যায় । তাছাড়া ঋণ এর মাধ্যমে বিনিময় ব্যবস্থা সহজ হবার কারণে লেনদেনও বৃদ্ধি পায় ।
৮। সঞ্চয় বৃদ্ধি ও মূলধন গঠন ও ঋণ সঞ্চয় বৃদ্ধিতে ও মূলধন গঠনে সহায়তা করে । সাধারণত অধিকাংশ মানুষ সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যে ও উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে বা অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী হয় না । কিন্তু ঋণ ব্যবস্থায় বাজারে ট্রেজারী বিল, প্রাইড বও, সঞ্চয় পত্র ইত্যাদি ঋণপত্র ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। এর মাধ্যমে মূলধন গঠন ত্বরান্বিত হয়। এভাবে ঋণ ব্যবস্থা একটি দেশের সাধারণ জনগণকে সঞ্চয়ে আগ্রহী করে তুলে এবং মূলধন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৯। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ঃ অনেক সময় প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সরকারের পক্ষে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। তাই আভ্যন্তরীণ কিংবা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করতে পারে এবং তার মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হয়। ১০। মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা ঃ ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি দেশের মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভবপর হয় । কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থের যোগান কমিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । আবার খোলাবাজারে ঋণপত্র ক্রয়ের মাধ্যমে অর্থের যোগান বাড়িয়ে মন্দা ও বেকারত্ব কমাতে পারে । এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খোলাবাজার নীতির মাধ্যমে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয় । উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, আধুনিক অর্থনীতিতে ঋণের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
বাংলাদেশে ঋণের উৎসসমূহ Sources of Credit in Bangladesh
বাংলাদেশে ঋণের উৎসগুলোকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায় । যথাঃ
(ক) প্রাতিষ্ঠানিক উৎস এবং
(খ) অ-প্রাতিষ্ঠানিক উৎস ।
প্রাতিষ্ঠানিক উৎস (Institutional Sources)
প্রাতিষ্ঠানিক উৎস দুই প্রকার । যথাঃ
(i) উপানুষ্ঠানিক উৎস ও
(ii) আনুষ্ঠানিক উৎস ।
উপানুষ্ঠানিক উৎস ঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে সাধারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নয় এমন কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নিয়ম অনুসরণ করে ঋণ দিচ্ছে । ঋণের এ উৎসগুলোকে বলা হয় উপানুষ্ঠানিক উৎস। যেমন- বিভিন্ন এন.জি.ও এবং গ্রামীণ ব্যাংক ।
আনুষ্ঠানিক উৎস : বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন-কানুন ও শর্তাবলীর অধীনে কর্মরত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনুষ্ঠানিক উৎস বলা হয় । যেমন-
১। বাংলাদেশ ব্যাংক
২। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
৩। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ৪। ভূমি বন্ধকী ব্যাংক
৫। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৬। সমবায় ঋণদান সমিতি
৭। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড
৮। সমবায় ব্যাংক লিমিটেড
৯ । বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেমন- সঞ্চয়ী ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, বীমা কোম্পানী ইত্যাদি ।
১০ । বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান যেমন- পুঁজি বিনিয়োগ সংস্থা, শিল্প ঋণ সংস্থা এবং গৃহ নির্মাণ ঋণদান সংস্থা ইত্যাদি । ১১ । আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা যেমন- বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (IDB) ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুধুমাত্র সরকার ঋণ গ্রহণ করে ।
অ-প্রাতিষ্ঠানিক উৎস বা অনানুষ্ঠানিক উৎস : বাংলাদেশের ঋণের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক । কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন-কানুন ও শর্তের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজস্ব নিয়মকানুন অনুযায়ী যে ঋণের আদান-প্রদান হয় তাকে ঋণের অনানুষ্ঠানিক উৎস বা অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস বলে। ঋণের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলো নিম্নরূপ ।
১। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন : অনানুষ্ঠানিক উৎসের মধ্যে এটা একটা বড় উৎস । এ উৎস থেকে কৃষকেরা মোট কৃষি ঋণের প্রায় ৯৩% পেয়ে থাকে। এ ঋণের জন্য কোন জামানত নেই, মুনাফা বা সুদ দিলেও খুব কম ।
২। গ্রাম্য ব্যবসায়ী ও দোকানদার : গ্রাম্য ব্যবসায়ী ও দোকানদার কৃষকদের ফসল কম দামে বন্ধক রাখে, যা ফসল উঠলেই তাদের নিকট বিক্রয়ে বাধ্য হয়। এরূপ অবস্থায় ঋণ প্রদান করে এবং কৃষকদেরকে প্রায় ২% থেকে ৩% ঋণের যোগান দিয়ে থাকে ।
৩। গ্রাম্য মহাজন ঃ এ উৎস কৃষকদেরকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । কৃষকদের নিকট থেকে জমি, সোনার অলংকার ও অন্যান্য দ্রব্যাদি জামানত রেখে চড়া সুদে ঋণ প্রদান করে । কিন্তু সুদের হার অধিক বলে অধিকাংশ কৃষক এ ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় ।
৪। ভূস্বামী ও গ্রাম্য ধনী লোক ঃ এ উৎস থেকে কৃষকদেরকে ঋণ গ্রহণের জন্য অনেক সময় মূল্যবান জিনিসপত্র অথবা ফসল বন্ধক রাখতে হয় ।
৫। ধনী ও বিত্তশালী কৃষক ঃ ধনী ও বিত্তশালী কৃষকগণ অনেক সময় মাঝারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদেরকে অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ প্রদান করে ।
৬। ফড়িয়া ও বেপারী ঃ গ্রাম্য ফড়িয়া ও বেপারীগণও কৃষকদেরকে ঋণ দিয়ে থাকে । তবে এদের ঋণের পরিমাণ স্বল্প ।
BRDB এর লুৎফুল হকের কোতায়ালী থানা জরিপ' হতে দেখা যায় যে, ৮৮% কৃষক গ্রাম্য মহাজন থেকে
ঋণ গ্রহণ করে । ১৯৭৮ সালে BIDS এর গবেষণায় দেখা যায়, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ২২%, মহাজনদের কাছ থেকে ৫৪% ঋণ কৃষকেরা গ্রহণ করে ।
অভ্যন্তরীণ খान Domestic Credit
বার্ষিকভিত্তিতে ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১০.৩৩ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছর শেষে এ বৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৫৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস শেষে বছরভিত্তিতে ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ ১১.১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই মাস শেষে এ ১১.৯০ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০১৪ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১০.৭৩ শতাংশ, পূর্ববর্তী অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩.৯৬ শতাংশ। তবে এ সময়ে সরকারি খাতে নীট খুল বৃদ্ধি পায় ১৯.৫২ শতাংশ, গত অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৩ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০১৪ শেষে সরকারি খাতের নিট ঋণের পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রায় ১৯.০৫ শতাংশ। ফলে সরকারি খাতের উচ্চ ঋণের প্রবৃদ্ধি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব (crowding-out effect) ফেলবে না বলে আশা করা যায়। অধিকন্তু, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের নির্ভরশীলতা হ্রাসের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে সঞ্চয় পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। বাজেটে ভর্তুকি ব্যয় ও কৃচ্ছতা সাধনের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেক্ষিতে বাজেট ঘাটতি হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণও হ্রাস পাবে। বেসরকারি খাতে ঋণ যাতে উৎপাদনশীল খাতগুলোতে ব্যবহৃত হয় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করেছে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]