মডেল থেকে বিচ্যুতি
নিখুঁত প্রতিযোগিতার মডেলটি তার নিজের ভেতরে একটি যৌক্তিক কাঠামো দাঁড় করালেও তার
অনুমিতিগুলি পরীক্ষা করলেই আমরা বুঝতে পারি যে, এটি সাধারণভাবে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যমান
জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নির্দিষ্টভাবে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে বাস্তব জগতের সাথে এই মডেলটির
বিরোধ হচ্ছে সেটা আমাদের মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নিচের ছকে নিখুঁত বাজারের
জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছুশর্ত নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং আমরা এখানে দেখার চেষ্টা করছি কি কি
কারণে এই শর্তগুলো ভেঙে অনিখুঁত প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয়।
নিখুঁত প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম যে শর্ত সেটি হল এই বাজারে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সুবিধার মধ্যে
কোন বিরোধ নেই বরঞ্চ দুই-এর মধ্যে সুসামঞ্জস্য আছে। কিন্তুবাস্তব জগতে যখনই দেখা যায়
উৎপাদন বা বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক সুবিধার চাইতে ব্যক্তির সুবিধা বেশি হচ্ছে তখনই
এই শর্তটি আর কাজ করে না। দেখা যায়, সম্পদ বিতরণ অদক্ষ, অপচয়মূলক হয়। এর ফলে
সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে। ভেঙ্গে পড়ে নিখুঁত বাজার।
দ্বিতীয় শর্তে বলা হচ্ছে বাজারের ভোক্তা যে দামে পণ্য কিনবে তা সেই পণ্য থেকে প্রাপ্ত প্রান্তিক
উপযোগের সমান হবে। কিন্তুবাস্তবে যখন দেখা যায় ক্রেতা বা বিক্রেতা তার আপেক্ষিক শক্তি বা
প্রভাব বিস্তার করে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বা কমাচ্ছে তখন এই শর্ত ভেঙে যায় এবং অধিকতর
অস্বচ্ছতার সৃষ্টি হয়।
তৃতীয় শর্তে বলা হচ্ছে উৎপাদক যখন পণ্য উৎপাদন করেন তখন দাম প্রান্তিক ব্যয়ের সমান হয় কিন্তু
ক্রেতা বা বিক্রেতার আপেক্ষিক শক্তির কারণে যদি এই অবস্থায় ব্যত্যয় ঘটে তাহলে এই শর্ত ভেঙে
পড়ে এবং দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্তিশালী ব্যক্তির লাভ সমাজের ক্ষতির কারণ হয়। এই অবস্থাও
অধিকতর একচেটিয়াকরণের অবস্থা তৈরি করে।
চতুর্থ শর্তে বলা হচ্ছে কোন পণ্য উৎপাদনে ব্যক্তির প্রান্তিক ব্যয় ও সমাজের প্রান্তিক ব্যয় সমান হবে।
কিন্তুবাস্তবে যদি দেখা যায় ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যক্তিগত ব্যয় সমাজের উপর স্থানান্তর করা হয়
তাহলে সমাজের ব্যয়ে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক একচেটিয়া শক্তি তৈরী হতে থাকে।
পঞ্চম শর্তে বলা হয়েছে, কোন অর্থনৈতিক তৎপরতায় সমাজের যে ব্যয় হবে তা সমাজের প্রাপ্ত
সুবিধার সমান হবে। এই অবস্থাতেই এ্যাডাম স্মীথের অদৃশ্য হস্ত শর্ত কাজ করে অর্থাৎ এখানে ব্যক্তির
লাভ আর সমাজের লাভ সমার্থক। কিন্তুযদি কোন প্রভাবের ফলে সমাজের প্রাপ্ত সুবিধার তুলনায়
ব্যক্তির লাভ বেশি হয়ে যায় তাহলে পুরো মডেলটিই ভেঙে পড়ে।
ছক ৩ : নিখুঁত প্রতিযোগিতা ও দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শর্তাবলী ও এর ভাঙনের কারণ
দক্ষ বাজার ও নিখুঁত বাজারের
শর্তাবলী
সমীকরণে শর্ত ভেঙে পড়ার কারণ ফলাফল
১। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উপযোগ
সমান থাকে
গটং=গট যখন ব্যক্তির প্রাপ্ত উপযোগ
সমাজের চাইতে অনেক বেশি
হয়।
সম্পদ বিতরণ অদক্ষ ও
অপচয়মূলক হয়। সম্পদের
কেন্দ্রীভবন ঘটে।
২। ভোক্তারা এমন দামে পণ্য
কেনেন যখন তা প্রান্তিক
উপযোগের সমান হয়।
গট=চ ক্রেতা বা বিক্রেতা একক
শক্তিশালী হলে প্রভাব বিস্তার করে
সুবিধামতো দাম নির্ধারণ করতে
পারে।
গট≠চ
প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা
ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ক্রমে
একচেটিয়া ব্যবস্থা তৈরী হতে
থাকে।
৩। উৎপাদকেরা এমন খরচে
উৎপাদন করেন যেখানে পণ্য
উৎপাদনের প্রান্তিক ব্যয় তার
দাম এর সমান হয়।
চ=গঈ ক্রেতা বা বিক্রেতা একক
শক্তিশালী হলে প্রভাব বিস্তার করে
সুবিধামতো দাম নির্ধারণ করতে
পারে।
চ≠গঈ
প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা
ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ক্রমে
একচেটিয়া ব্যবস্থা তৈরী হতে
থাকে।
৪। যখন ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যয়
সমান হয়।
গঈ=গঈং ব্যক্তিগত লাভের জন্য যে ব্যয় তা
যখন সমাজের উপর স্থানাস্তর করা
হয়।
গঈ<গঈং
সামাজের ব্যয়ে ব্যক্তি
একচেটিয়া সম্পত্তিশালী শ্রেণী
তৈরী হতে থাকে।
৫। সামজিক ব্যয় ও সামাজিক
সুবিধা সমান হয়। এই
অবস্থাতেই এ্যাডাম স্মীথের
“অদৃশ্য হস্তক্ষেপ” কাজ করে
এবং ব্যক্তির সুবিধা সন্ধান
সমাজের সুবিধা নিশ্চিত করে।
গটং=গঈং সমাজের প্রাপ্ত সুবিধার চাইতে
যখন তার ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে
যায়।
গঈং<গঈং
সমাজের ব্যয়ে ব্যক্তি
একচেটিয়া সম্পদশালী শ্রেণী
তৈরী হতে থাকে এবং বাজার
ব্যবস্থায় দক্ষ এবং সকলের
জন্য সুবিধাজনক অর্থনৈতিক
ব্যবস্থার সম্ভাবনা তিরোহিত
হয়।
এখানে,
গটং = সামাজিক প্রান্তিক উপযোগ
গট = ব্যক্তির প্রান্তিক উপযোগ
গঈং = সামাজিক প্রান্তিক ব্যয়
গঈ = ব্যক্তির প্রান্তিক ব্যয়।
নিখুঁত বাজার বিরোধী বাস্তব উপাদান
নিখুঁত প্রতিযোগিতামূলক বাজার বাদে সব বাজার ব্যবস্থাকেই এককথায় অনিখুঁত (বা ক্রটিযুক্ত)
বাজারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিভাবে আদর্শায়িত নিখুঁত বাজার বর্তমান সময়ের
অনিখুঁত বাজারে এসে দাঁড়ায় সেটা উপরের ছক থেকেই বোঝা যায়। ১৯৩০ এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত
অর্থশাস্ত্রে তাত্তি¡কভাবে এই বাজারের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়নি। ৩০ দশকের প্রথম দিকের
মহামন্দা অর্থশাস্ত্রে এই বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির বাস্তব চাপ সৃষ্টি করে। উল্লেখযোগ্য তাত্তি¡ক কাজ করেন
এঁদের মধ্যে অন্যতম, জোয়ান রবিনসন, তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে।১৭
এই সময়কালে কেইনসের তত্ত¡ প্রকৃতপক্ষে বাজারের অনিখুঁত চেহারাকে স্বীকার করেই নির্মিত। এই
ক্ষেত্রের তাত্তি¡ক কাজ পরে আরও অনেক অগ্রসর হয়েছে। স্যামুয়েলসন বাস্তব দৃষ্টান্ত ব্যাখ্যা করে
বলেছেন কি কি উপাদান বা ব্যবস্থাবলী বাজারকে ক্রমান¦য়ে অনিখুঁত করে তোলে। সেগুলোর মধ্যে
আছে :
ক. বৃহদায়তন উৎপাদনের ব্যয় এবং প্রতিযোগিতায় অন্যদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থান;
খ. নতুন কোন উৎপাদনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাজারে প্রবেশ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠা;
গ. সরকারী আইন কাঠামো; এবং
ঘ. বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাজার দখলের ক্ষমতা।
বলাই বাহুল্য যে, এর সঙ্গে মালিকানা ব্যবস্থা ও সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাসসহ আরও বিভিন্ন উপাদানও
গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
বাস্তব দৃষ্টান্ত
এসব বিভিন্ন কারণে বাজার ক্রমে নিখুঁত বাজারের সকল শর্ত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
স্যামুয়েলসন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে কেন্দ্রীভবনের বিভিন্ন মাত্রার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের খরচ, মানোন্নয়ন
খরচ ও মুনাফার সম্পর্ক দেখিয়েছেন। নিচে এটির সারসংক্ষেপ দেয়া হল।
ছক ৪ : যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীভবনের অনুপাত
কেন্দ্রীভবনের মাত্রা এবং শিল্প শাখা চারটি প্রতিষ্ঠানের
কেন্দ্রীভবনের অনুপাত
বিজ্ঞাপনের পেছনে
শতকরা ব্যয়
গবেষণা ও উন্নয়নের
পেছনে শতকরা ব্যয়
মুনাফা, বিক্রির
শতকরা হার
উচুঁ (গাড়ী ও সিগারেট)
মোটামুটি (কাগজ, পাথর, রাসায়নিক দ্রব্য)
নীচু (কাপড়, মুদ্রণ, আসবাবপত্র)
নিখুঁত প্রতিযোগিতামূলক (চাল ও গম খামার)
চিত্র ৭.৫ : যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীভবন ঃ যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি প্রধান কোম্পানী বাজারের কত অংশ নিয়ন্ত্রণ করে
স্যামুয়েলসনের অন্য হিসাবে পাঁচটি প্রধান কোম্পানীর হাতে নির্দিষ্ট খাতগুলোতে কি পরিমাণ সম্পদের
কেন্দ্রীভবন হয়েছে তার চিত্র দেওয়া হয়েছে। এই হিসাব অনুযায়ী, সিগারেট: ৯২%, রেফ্রিজারেটর :
৮৫%, মোটরগাড়ী: ৯০%, ভাল্ব : ৯১%, সাবান : ৬৫%।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা এই একচেটিয়াকরণ ও নিয়ন্ত্রণ দেখি দুইভাবে। এক
হলো, দেশীয় শিল্প ও বণিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খুব অল্প কয়েকটিই শিল্প, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ঋণ
ইত্যাদির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে আবার সমগ্র দেশীয় অর্থনীতির উপর অল্প কয়েকটি শিল্পোন্নত
দেশের বহুজাতিক সংস্থাগুলোর একক কর্তৃত্ব আছে।১৮
বিভিন্ন কারণে নিখুঁত প্রতিযোগিতার মডেলটি বাস্তবে কাজ করে না। স্যামুয়েলসনসহ বিভিন্ন
অর্থনীতিবিদ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে: বৃহদায়তন উৎপাদনের ব্যয় ও প্রতিযোগিতায়
অন্যদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থান; নতুন কোন উৎপাদনী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাজারে প্রবেশ
অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁিকপূর্ণ; সরকারী আইন কাঠামো; বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে
বাজার দখলের ক্ষমতা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর উপস্থিতি দ্বৈতভাবে ঘটে।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক (√) চিহ্ন দিন
১. সমাজের লাভের তুলনায় ব্যক্তির লাভ এর মধ্যে অসঙ্গতি সৃষ্টি হলেক. নিখুঁত প্রতিযোগিতার মডেলের কিছুঅসুবিধা হয় না।
খ. নিখুঁত প্রতিযোগিতার মডেল ভেঙ্গে পড়ে।
গ. নিখুঁত প্রতিযোগিতা আরও শক্তিশালী হয়।
ঘ. সাময়িক সমস্যা হয়।
২. অনিখুঁত বাজার নিয়ে জোয়ান রবিনসনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয় কত সালে?
ক. ১৯২০ সালে খ. ১৯৫০ সালে
গ. ১৯৩৩ সালে ঘ. ১৯৮০ সালে
৩. পল স্যামুয়েলসনের উদাহরণ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীভবনের মাত্রা কোন্ শিল্পে বেশিক. গাড়ী ও সিগারেট খ. চাল ও গম খামার
গ. কাগজ, পাথর ও রাসায়নিক দ্রব্য ঘ. কাপড়, মুদ্রণ ও আসবাবপত্র
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. সম্পদের কেন্দ্রীভবন কি? নিখুঁত প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এর প্রভাব কি?
২. এ্যাডাম স্মীথের ‘অদৃশ্য হস্তক্ষেপ' নিখুঁত প্রতিযোগিতায় কিভাবে কাজ করে?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. “নিখুঁত প্রতিযোগিতার শর্তগুলো খুবই ভঙ্গুর। বাস্তব জগতে এগুলোর বিচ্যুতিই প্রধান প্রবণতা।”
ব্যাখ্যা করুন।
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজারের বাস্তব চিত্র কি ধরনের বাজারকে ইঙ্গিত করে? দৃষ্টান্ত সহ ব্যাখ্যা
করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
পাঠ - ১ : ১. ক ২. গ ৩. ঘ
পাঠ - ২ : ১. ঘ ২. খ ৩. গ
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত