বাংলাদেশের শিল্প

বাংলাদেশের শিল্প

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে শিল্পখাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পসমূহের পুনর্সহাপন ও পুনর্বাসনের ব্যয় হিসাব করা হয়েছিল ২৯১ মিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্পসমূহের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ২২৩ মিলিয়ন টাকা। ৭২টি পাটকল (৭৯,২০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন), ৪৪টি বস্ত্রকল (১৩.৪ মিলিয়ন পাউন্ড), ১৫টি চিনি কল (১,৬৯,০০০ টন), ২টি সার কারখানা (৪,৪৬,০০০ টন), একটি ইস্পাত কল (৩,৫০,০০০ টন), একটি ডিজেল ইঞ্জিন ইউনিট (৩,০০০) এবং একটি জাহাজনির্মাণ কারখানা নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাতের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। অবশ্য রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কলকারখানাগুলি প্রধানত অব্যবস্থা ও সম্পদ পাচারের ফলে শীঘ্রই লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

সরকারকে অতি তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপর কর্তৃত্বসংক্রান্ত নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হয় এবং শিল্পসমূহের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেও ব্যক্তিগত বিনিয়োগের অনুমোদনযোগ্য সর্বোচ্চ সীমা বৃদ্ধি করা হয়। এতে অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয় নি। রাষ্ট্রীয় নীতিতে বহু সমন্বয় ও সাময়িক পরিবর্তন আনয়ন করে সরকার অবশেষে ১৯৮২ সালে একটি নতুন শিল্পনীতি প্রণয়ন করে। এই নীতি অনুসরণে ১,০৭৬টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা হয়। নব্য সম্পদশালীদের অনভিজ্ঞতার কারণে হস্তান্তরিত শিল্পসমূহ রুগ্ন হয়ে পড়লে বিরাষ্ট্রীয়করণ নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। ব্যক্তিমালিকদের অনেকেই শিল্প উন্নয়ন ও চালু রাখার পরিবর্তে সস্তায় প্রাপ্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে নগদ অর্থ অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে শিল্পরুগ্নতা দেখা দেয় এবং খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্পসমূহের ৫০%, বস্ত্র শিল্পসমূহের ৭০%, পাট খাতের শিল্পসমূহের ১০০%, কাগজ ও কাগজ বোর্ড শিল্পসমূহের ৬০%, চামড়া ও রাবার শিল্পসমূহের ৯০%, রসায়ন ও ঔষধ শিল্পসমূহের ৫০%, গ্লাস ও সিরামিক্স শিল্পের ৬৫% এবং প্রকৌশল শিল্পসমূহের ৮০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৪ সালে এই শ্রেণির শিল্পের সংখ্যা ছিল ৯,৩২,২০০টি। এর মধ্যে ২০.৭% ছিল তাঁত, ১৫.৪% বাঁশ ও বেতের কাজের কারখানা, ৮.১% কাঠমিস্ত্রির কাজের কারখানা, ৬.১% পাট ও তুলার সুতায় তৈরি দ্রব্য উৎপাদনের কারখানা,  ৩.৪% মৃৎশিল্প, ০.৩% তেলভাঙ্গা কল, ৩.২% কামারের কারখানা, ০.৮% তামা ঢালাই কারখানা এবং অবশিষ্ট অন্যান্য ধরনের শিল্প। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই তাঁতিদের বসতি আছে, কিন্তু নরসিংদী, বাবুরহাট, হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, বাজিতপুর, টাঙ্গাইল, শাহাজাদপুর এবং যশোর এলাকায় তাদের অধিক সংখ্যায় কেন্দ্রীভূত রূপে দেখা যায়। রেশম শিল্প রাজশাহী ও ভোলাহাটে প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশে ১৯৮০-র দশকে অন্যান্য যে সকল স্থান কুটির শিল্পের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিল সেগুলির মধ্যে রয়েছে চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও ইসলামপুর (তামা ঢালাই), সিলেট (মাদুর ও বেতের আসবাবপত্র), কুমিল্লা (মৃৎশিল্প ও বাঁশের কাজ), কক্সবাজার (সিগার), বরিশাল (নারিকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিত দ্রব্য) এবং রংপুর (নকশাযুক্ত কার্পেট)।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ৬,০০০ তাঁত এবং ১,০২৫,০০০ টাকুবিশিষ্ট ৫৮টি বস্ত্রকল ছিল। এই বস্ত্রকলগুলির বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১০৬.২ মিলিয়ন পাউন্ড সুতা, ৬৩ মিলিয়ন মিটার কাপড়। বস্ত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খাতের অন্যতম শিল্প এবং অন্যান্য অধিকাংশ শিল্পখাতের মতোই বস্ত্রখাতকে লোকসানের বোঝা বহন করতে হয়েছে। ১৯৮৪ সালে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩৫৩.৪ মিলিয়ন টাকা। এই খাতের অসুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির অসুবিধা, কাঁচামাল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ২৩,৭০০টি টাকুবিশিষ্ট ৭০টি পাটকল ছিল। ওই বছর এই পাটকলসমূহে ১,৬৮,০০০ জন শ্রমিক এবং ২৭,০০০ জন অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল। এই মিলসমূহে ওই বছর ৫৪৫০০০ টন কাঁচাপাট ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আলোচ্য বছরে এই সকল পাটকলের উৎপাদন ১৯৬৯ সালের ২১,৫০৮টি টাকুবিশিষ্ট ৫৫টি পাটকলের ৫৬১০০০ টন উৎপাদন অপেক্ষা কম ছিল। বাংলাদেশের পাট শিল্পের প্রধান তিনটি কেন্দ্র ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অবস্থিত। পাটজাত দ্রব্যের পরিবর্তে এখন সস্তা ও অধিক টেকসই প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহূত হচ্ছে। ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আন্তর্জাতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পাট শিল্প ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

১৯৮৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশে সালফিউরিক এসিড, রাসায়নিক দ্রব্য, কাগজ, কস্টিক সোডা, গ্লাস, সার, চীনামাটি দ্বারা প্রস্ত্তত বাসনকোসন, সিমেন্ট, ইস্পাত এবং প্রকৌশলের মতো নতুন শিল্পের উন্নয়ন ছিল মন্থর। ১৯৮৫ সালে সালফিউরিক এসিড উৎপাদনের জন্য দেশে মাত্র দুটি কারখানা ছিল এবং তাদের মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫,৯৯৫ মেট্রিক টন, যদিও সাবান, কাগজ, ঢালাই লোহা ও ইস্পাতের মতো শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ এই উপকরণটির উৎপাদন ১৯৭০ সালে ছিল ৬,৪৬৬ মেট্রিক টন। ১৯৮৫ সালে কস্টিক সোডার উৎপাদন ছিল ৬,৭৮৭ মেট্রিক টন, এর প্রায় সবটাই কাগজকলসমূহে ব্যবহার করা হতো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বালু, লবণ ও চুনাপাথর সহজলভ্য হওয়ায় দেশে কাচ শিল্প উন্নয়নের বেশ সম্ভাবনা রয়েছে। এই শিল্প স্থাপনের জন্য দুটি প্রধান স্থান হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত স্বয়ংক্রিয় গ্লাস ফ্যাক্টরিতে ১৯৮৫ সালে ১২.৯ মিলিয়ন বর্গফুট শিট গ্লাস উৎপাদন করা হয়।

দেশের সার শিল্পে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ১৯৮৫ সালে সার কারখানাসমূহের মোট উৎপাদন ছিল ৮,০৮,৬৬০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৭,৪১,৪৬৩ মেট্রিক টন ছিল ইউরিয়া, ৯,৬৩৪ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়াম সালফেট, এবং ৫৭,৫৬৩ মেট্রিক টন ট্রিপল সুপার ফসফেট। ফেঞ্চুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জে তিনটি প্রধান সার কারখানা অবস্থিত ছিল। ১৯৮৫ সালে দেশের মোট সিমেন্ট উৎপাদন ছিল ২,৯২,০০০ মেট্রিক টন এবং দেশের প্রধান সিমেন্ট কারখানাদ্বয় ছাতক ও চট্টগ্রামে অবস্থিত। পাবনার পাকশী এবং চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনায় রয়েছে বাংলাদেশের কাগজ শিল্পের প্রধান কারখানা এবং ১৯৮৫ সালে কাগজের মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ৭৫,০০০ মেট্রিক টন। খুলনায় আছে একটি নিউজপ্রিন্ট মিল (১৯৮৫ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫৫,০০০ মেট্রিক টন) এবং একটি হার্ড বোর্ড মিল (১৯৮৫ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১,৬২১ বর্গমিটার)। ১৯৮৫ সালেই বাংলাদেশে পার্টিকেল বোর্ড ও পারটেক্স উৎপাদনের জন্য কয়েকটি মিল ছিল। ম্যাচ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ঢাকা, খুলনা, খেপুপাড়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া ও রাজশাহী ম্যাচ উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৮৫ সালে ম্যাচের মোট উৎপাদন ছিল ১.৩০ মিলিয়ন গ্রোস বাক্স। একই বছরে বাংলাদেশের ৮টি চিনিকলের উৎপাদন ছিল ৮৭,০০০ টন। দর্শনার (ঈশ্বরদী) চিনিকলে চিনি ছাড়া আরও উৎপন্ন হয় অ্যালকোহল, মেথিলেটেড স্পিরিট এবং রেক্টিফাইড স্পিরিট। বাংলাদেশের লৌহ ও ইস্পাত মিলগুলির অধিকাংশই ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের অধীনে চট্টগ্রাম ও ঢাকাতে কেন্দ্রীভূত। অবশ্য খুলনা, কুষ্টিয়া ও বগুড়াতেও কিছু ইস্পাত ও লোহার কাজের প্রতিষ্ঠান আছে।

১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশে জাহাজনির্মাণ শিল্প, মোটরগাড়ি সন্নিবেশ শিল্প, তৈল শোধনাগার, ইনসুলেটর ও চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির কারখানা, টেলিফোন যন্ত্রপাতি তৈরির শিল্প, বৈদ্যুতিক দ্রব্যাদি তৈরির কারখানা, টেলিভিশন সন্নিবেশ কারখানা, সিগারেট কোম্পানি এবং উদ্ভিজ্জ তেল কল বিশেষ স্থান অধিকার করে। এই সময় দেশে তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করে। সরকার পরিকল্পিত উন্নয়নের সাথে মুক্তবাজার অর্থনীতির মিশ্র কৌশল অনুসরণ করে। ১৯৯০-এর দশকে উৎপাদন খাতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায় এবং ১৯৯৬ সালে দেশের মোট জাতীয় আয়ে এই শিল্পখাতের অংশ ১১%-এ উন্নীত হয়। এই খাতে ১৯৯৭ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫৭.৮ বিলিয়ন টাকা এবং ১৯৯১ সালে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২২.৫ বিলিয়ন টাকা। দেশের শিল্পসমূহের মোট  বিনিয়োগে সরকারি খাতের অংশ ১৯৯১ সালের ৩৭.০৩% হ্রাস পেয়ে ১৯৯৭ সালে দাঁড়ায় ৮.৬৩%।

বিস্তারিত

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]