বাঙালি জাতির উদ্ভব
বাঙালি জাতির মূল কাঠামো সৃষ্টির কাল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুসলমান অধিকারের পূর্বপর্যন্ত বিস্তৃত। সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দু ভাগে করা যায়-প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী এবং আর্য নরগোষ্ঠী। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত চার শাখায় বিভক্ত-নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় অস্ট্রো এশিয়াটিক বা অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে ধারনা করা হয়। এদের নিষাদ জাতি নামে অভিহিঁত করা হয়।
প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি নেগ্রিটোদের পরাজিত করে। অস্ট্রিক জাতির সম কালে বা কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি খাইবার গিরিপথ দিয়ে আসে এবং সভ্যতায় উন্নততর বলে তারা অস্ট্রিক জাতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে আর্যপূর্ব বাঙালি জাতি। অর্থাৎ বাংলার প্রাচীন জাতি অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এদের ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা। নৃতাত্ত্বিকভাবে এরা আদি অস্ট্রোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে মঙ্গোলীয়দের আগমন ঘটে। বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতীয়দের বড় অংশ মঙ্গোলয়েড।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে ককেশীয় অঞ্চলের (ইউরাল পর্বতের দক্ষিণের তৃণভূমি অঞ্চল-বর্তমান মধ্যএশিয়া, ইরান) স্তেতকায় আর্যগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। উপমহাদেশে আগমনের অন্তত চৌদ্দশত বছর পরে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে বঙ্গ ভূখন্ডে আর্যদের আগমন ঘটে।
স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আর্যগণ সাফল্য লাভ করে এবং বঙ্গ ভূখন্ড দখল করে নেয়। পরবর্তীতে এরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়। এভাবে আর্য ও অনার্য আদিম অধিবাসীদেগর সংমিশ্রণে এক নতুন মিশ্র জাতির উদ্ভব ঘটে। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে সেমীয় গোত্রের আরবীয়গণ ধর্মপ্রচার ও বাণিজ্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়। কাজেই বর্তমান বাঙালি জাতি অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলীয়, সেমীয়, নিগ্রো ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির রক্তধারায় এক বিচিত্র জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এর সাথে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীও মিশে যায়।
উয়ারী বটেশ্বরঃ
উয়ারী বটেশ্বর নামক প্রত্নস্থলটি নরসিংদী জেলায় বেলাব উপজেলায় অবস্থিত। এটি কয়রা নদীর তরে অবস্থিত। ধারণা করা হয় এই প্রত্নাবশেষ ৪৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের।
ময়নামতিঃ
ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। ময়নামতি প্রত্নস্থল হলো লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন। বর্তমানে ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংসস্তুপ দেখা যায় তা প্রকৃত পক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ সভ্যতার অবশিষ্টাংশ। প্রত্নতাত্বিকদের মতে ইহা ‘জয়বর্মান্তবসাক’ নামক একটি প্রাচীন নগরীর অংশ বিশেষ। ধারণা করা হয় ময়নামতির ধ্বংসস্তূপে প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহ অষ্টম শতাব্দীর।
সিন্ধু সভ্যতাঃ
সিন্ধু সভ্যতা ছিল ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা ১৬০০-১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। প্রথম দিকে এই সভ্যতা পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায় বিকাশ লাভ করে। বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ, ভারতের পশ্চিমদিকের রাজ্যগুলো, আফগানিস্তানের দক্ষিন-পূর্ব অংশ এবং ইরানের বেলুচিস্তান এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায়, দয়ারাম সাহানী, স্যার জন মার্শাল, এইচ ম্যাকাল প্রমুখ ব্যাক্তিগণ পাকিস্তানের করাচি এবং লাহোরের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা আবিস্কার করেন।
ইবন বতুতাঃ
মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ভারতবর্ষে আগমন করেন। ৮ বছর তিনি মুহম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে কাজী পদে চাকরি করেন। তিনি ১৩৪৫ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে বাংলায় আগমন করেন তার মতে, চতুর্দশ শহতকে পূর্ববঙ্গে দ্রব্যমূণল্য যত কম ছিল দুনিয়ার অন্য কোথাও তিনি তেমন দেখেননি। এ সময়ে ফকির-দরবেশগণ বিনাভাড়ায় নৌকা ভ্রমণ করতেন এবং প্রয়োজন মত অর্থ পেতেন। তিনি বাংলাকে দোযখপুর নিয়ামত বা ধনসম্পদ পূর্ণ নরক বলেছেন। তার রচিত বইয়ের নাম কিতাবুল রেহালা। ইবনে বতুতার বর্ণনায় শ্রীহট্ট (সিলেট), সুনুরকাও (সোনারগাও) সাত-আল গাও (চট্টগ্রাম), সুরুনদ্বীপ প্রভৃতি স্থানের বর্ণনা রয়েছে।
মা-হুয়ানঃ
ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে মা-হুয়ান নামক একজন চীনা পর্যটক বাংলাদেশে আগমন করেন। তার বিবরণ হতে জানা যায়, এদেশের সূক্ষ বস্ত্র ও রেশম শিল্প বিখ্যাত ছিল। গাছের ছাল হতে মসৃণ কাগজ তৈরি হতো। লোকেরা রৌপ্য মুদ্রা দ্বারা কেনাবেচা করত।
হিউয়েন সাংঃ
চীন দেশীয় বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাং সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে উপমহাদেশে আসেন। তিনি ৬৩০ থেকে ৬৪৪ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশে অবস্থান করেন। তিনি হর্ষবর্ধনের রাজধানী পাটলীপুত্রের দক্ষিণে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান পাটনা শহরের অদূরে বড়গাঁও নামক স্থানে) পাঁচ বছর অধ্যয়ন ও পুঁথি নকল করেন। বাঙালি পন্ডিত শীলভদ্র ছিলেন তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। এটি ছিল তৎকালে বৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র।
ফা-হিয়েনঃ
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে (৩৮০-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন বৌদ্ধ ধর্মের মূল গ্রন্থের সন্ধানে ও তীর্থ দর্শনে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি তৎকালীন সমাজের অবস্থা ও গুপ্ত শাসনের বিভিন্ন দিক লিপিবদ্ধ করেন। তিনি বাংলার প্রথম চৈনিক পরিব্রাজক।
মেগাস্থিনিসঃ
আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস খ্রিস্টপূর্ব ৩০২ অব্দে মেগাস্থিনিস নামক একজন গ্রিক দুতকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় প্রেরণ করেন। মেগাস্থিনিসের বিবরণই প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। তিনি তার’ ইন্ডিকা’ গ্রন্থে ভাতবর্ষের তৎকালীন পরিক্ষিতির বিবরণ দেন।
বঙ্গদেশে জনবসতির প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রত্ন-প্রস্তর যুগ, নব্য প্রস্তর যুগ এবং তাম্র যুগের কিছু অস্ত্রশস্ত্র এখানে পাওয়া গিয়েছে। পন্ডিতেরা অনুমান করেন যে, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এখানে এক সুসভ্য জাতির বাস ছিল। এরা ধান চাষ করত, সম্বর ও নীলগাই শিকার করত এবং শূকর পালন করত। এরা পাথর ও তামা ব্যবহার করত এবং ইট-পাথরের ভিতের উপর প্রশস্ত ঘর তৈরি করত। প্রাচীন পুন্ড্র ও বঙ্গ জাতি আর্যপূর্ব যুগের মানুষ ছিল বলে ধারনা করা হয়। আর্য-পূর্ব যুগে বাংলার অধিবাসীরা সভ্যতায় যথেষ্ট উন্নত ছিল। বাংলায় কৃষিকাজ, নৌকা নির্মাণ, বয়নশিল্প, ধাতুশিল্প প্রভৃতি আর্যপূর্ব যুগের লোকেরাই প্রচলন করে কুমার, কামার, সূত্রধর, তাম্রকার, স্বর্ণকার, মণিকার, কাঁসারী, শাখারী ইত্যাদি পেশাদারদের কারিগরী কাজে এরা সুদক্ষ ছিল।
যারা আর্য ভাষা অর্থাৎ ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ফরাসি ভাষায় কথা বলত তারা আর্য জাতি। এদের বসবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণের তৃণভূমি অঞ্চলে। এদের প্রাচীন সাহিত্যিক ধর্মীয় গ্রন্থ হলো ঋকবেদ। খ্রিস্টাপূর্ব ১৫০০ অব্দে আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে আর্যগণ ভারতবর্ষে প্রভেশ করে। ভারতবর্ষে প্রবেশের চৌদ্দশত বছর পর খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দে আর্যগণ বাংলায় প্রবেশ করে। এ সময় বঙ্গদেশ অস্ট্রিক জাতির প্রভাবাধীন ছিল। ধারণা করা হয় যে, মৌর্যযুগ হতে গুপ্ত বংশের শাসনামল পর্যন্ত প্রায় আটশত বছর বঙ্গদেশে আর্যীকরণ ঘটেছিল।
* আর্যপূর্ব বঙ্গ জনগোষ্ঠী ছিল অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির মিশ্রণ।
* আর্যদের আগমনের পরে বঙ্গদেশে আসে ভোটচীনীয় জাতি। এরা হলো গারো, কোচ, চাকমা ত্রিপুরা প্রভৃতি।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচার উপলক্ষে আর্যরা ক্রমশ অধিক সংখ্যায় এদেশে এসে বসবাস আরম্ভ করে। আর্যরা এদেশে আসার ফলে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর আর্যদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও সভ্যতার অন্যান্য ক্ষেত্রে দারুণ প্রভাব পড়তে থাকে। ক্রমে বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম প্রচারিত হয় এবং বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা অনুসারে সমাজ গঠিত হয়। আর্য ভাষার প্রভাবে বাংলায় আদি ভাষাগুলো লুপ্ত হয় এবং কালক্রমে বহুযুগ পরে বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে। তা সত্ত্বেও বাংলার আদি ভাষা, ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি, বরং সংমিশ্রিত আকারে বিকাশ লাভ করেছে।
গ্রিস অঞ্চলের ম্যসিডনের রাজা ছিলেন মহাবীর আলেকজান্ডার। তার প্রাচ্যদেশীয় নাম সিকান্দার শাহ বা বাদশা সিকান্দার। তার শিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত গ্রীক পন্ডিত এরিস্টটল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দে পিতার মৃত্যুর পর তিনি ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরহন করেন। দিগ্বিজয়ী বীর হিসেবে তিনি পূর্বদিকে রাজ্য জয় এবং ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। ৩২৭ অব্দে সিন্ধু নদের পশ্চিমাঞ্চল জয়লাভের পর তার সেনাবাহিনী পূর্বদিকে আর অগ্রসর হয়নি। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার সেনাপতি সেলুকাসের হস্তে ন্যস্ত করে তিনি ম্যাসিডনে ফিরে যাবার পথে ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনের নিকটে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ বছর। আলেকজান্ডারের শাসনামল থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণকালে বাংলায় গঙ্গারিডই নামে এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল। পন্ডিতদের ধারণা, গঙ্গা নদীর যে দুইটি ধারা এখন ভাগীরথী ও পদ্মা নামে পরিচিত, এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গঙ্গারিডই জাতির লোক বাস করত। এদের রাজা খুব পরাক্রমশালী ছিল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল ‘বঙ্গ’ নামে একটি বন্দর নগর। এখান থেকে সূক্ষ সুতী কাপড় সুদুর পশ্চিমা দেশে রফতানি হতো। গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস গঙ্গারিডই রাজ্যকে দক্ষিন এশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে সমৃদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, গঙ্গারিডই রাজ্যটি আসলে বঙ্গ রাজ্যই ছিল, গঙ্গারিডই ছিল শুধু এর নামান্তর।
গুপ্তবংশের প্রথম রাজা ছিলেন শ্রীগুপ্ত। শ্রীগুপ্তের পৌত্র চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩২০ সালে মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র। তিনি মগধ হতে এলাহাবাদ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন।
চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত (৩২০-৩৭৫) ছিলেন বিচক্ষণ কুটনীতিবিদ ও কুশলী যোদ্ধা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শক্তিমান মাত্রই যুদ্ধ করবে এবং শত্রু নিপাত করবে, অন্যথায় সে একদিন বিপন্ন হবে। সমগ্র পাক-ভারতকে একরাষ্ট্রের পরিণত করার তীব্র আকাঙ্খা এবং এ লক্ষে রাজ্যজয়ের কারণে তাকে "প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ান" আখ্যা দেয়া হয়। তিনি মগধ রাজ্যকে উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে নর্মদা নদী এবংপশ্চিমে চম্বল নদী পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৪) উপমহাদেশ থেকে শক শাসন বিলোপ করেন। মহাকবি কালিদাস ছিলেন তার সভাকবি। তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন এবং বিক্রমাব্দ নামক সাল গণনা প্রবর্তন করেন। তিনি মালব, গুজরাট সৌরাষ্ট্র জয় করেন। তার সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য উন্নতির শিখরে পৌছে। তার সামরিক শক্তির সাফল্য তাকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে। তার আমলে চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতবর্ষে আগমন করেন।
স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭) হুনদের আক্রমণ প্রতিহত করে সাম্রাজ্যের অখন্ডতা রক্ষা করেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী নরপতি। গুপ্ত বংশের শেষ শাসক ছিলেন বুধগুপ্ত (৪৭৭-৪৯৬) । তিনি ছিলেন দুর্বল শাসক এবং তার সময়ে মধ্য এশিয়ার দুর্ধষ্য যাযাবর হুনদের আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বঙ্গদেশ দুটি স্বাধীন অংশে বিভক্ত হয়-প্রাচীন বঙ্গরাজ্য ও গৌড়।দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চল ছিল বঙ্গ রাজ্য এবং বাংলার পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল জুড়ে ছিল গৌড়। সপ্তম শতকে গৌড় বলতে বাংলাকে বুঝাতো।গৌড় রাজ্যে প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা শশাঙ্ক।তিনি প্রথম বাঙ্গালী রাজা। তিনি হলেন প্রাচীন বাংলার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নরপতি। সপ্তমশতাব্দীর প্রথম ভাগে রাজা শশাঙ্ক গৌড় রাজ্য শাসন করেন। তিনি ছিলেন গৌড়ের স্বাধীন সুলতান তার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী ‘কর্ণসুবর্ণ’। এটি বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি অঞ্চল। তার রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে পুন্ড্রবর্ধন, দক্ষিণে উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলা,পশ্চিমে বারানসী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ শশাঙ্কের রাজ্য ছিল না।রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে পূর্ব ভারতের সম্রাট হন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন।৬৩৭ সালে রাজা শশাঙ্ক মারা যান। কথিত, গয়ায় বোধিবৃক্ষ ছেদন করায় শশাঙ্কের গায়ে ক্ষতরোগ হলে তিনি মারা যান। কূটনীতি ও সামরিক দক্ষতার মাধ্যমে শশাঙ্ক গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরী রাজবংশের উচ্ছেদ রাজ্য তিনি সাধন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট হর্ষবর্ধনের মোকাবেলায় নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন। তিনি বাংলার প্রথম রাজা যিনি বাংলার বাইরে উত্তর ভারতে বাংলার আধিপত্য ও গৌরব বিস্তারে সমর্থন হন তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। তবে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং হিন্দু ধর্মের অনুসারী রাজা শশাঙ্ককে বৌদ্ধ ধর্মের নিগ্রহকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
৬০৬ সালে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে নিহত হলে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সিংহাসন আরোহণকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য তিনি ‘হর্ষাব্দ’ নামক সাল গণনার প্রচলন করেন।
সিংহাসন আরোহণ করেই তিনি ভগ্নি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারে ব্রতী হন এবং মিত্র কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের বাহিনীসহ গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন। তীব্র আক্রমণের আশংকায় শশাঙ্ক সম্মুখযুদ্ধ এড়াতে বন্দী রাজ্যশ্রীকে মুক্তি দিয়ে পূর্বদিকে সরে যান। ভগ্নি উদ্ধার করে হর্ষবর্ধন থানেশ্বরে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন গৌড় রাজ্য দখল করেন। প্রথম জীবনে হর্ষবর্ধন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও পরবর্তীতে ‘মহাযানী বৌদ্ধ’ ধর্ম গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে এক বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের আয়োজন করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তার রাজত্বকালে ৬৩০-৬৪৪ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ সফর করেন এবং তার শাসনের বিভিন্ন দিক লিপিবদ্ধ করেন।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশত বছর অর্থাৎ সপ্তম-অষ্টম শতকের অরাজকতা ও আইনশৃঙ্খলাহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা হল মাৎস্যন্যায়। এ সময় বড় কোন সাম্রাজ্য বা শক্তিশালী রাজা ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গ্রাস করে, সবল রাজ্য এখানে দুর্বল রাজ্যকে গ্রাস করত বলে এ অবস্থাকে মাৎস্যন্যায় বলা হয়। এই শোচনীয় অবস্থা দুর করার জন্য তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ গোপাল নামে একজন ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করেন।
গোপাল (৭৫৬-৭৮১) ছিলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন উত্তরবঙ্গের একজন শক্তিশালী নেতা। রাজ্যের কলহ ও অরাজকতা দূর করার জন্য অমাত্যগণ ও সামন্ত শ্রেণী গোপালকে রাজা নির্বাচন করেন। তিনি বাংলায় প্রথম বংশানুক্রমিক শাস শুরু করেন। । ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণকারী গোপাল প্রায় সমগ্র বাংলায় প্রভুত্ব স্থাপন করেন। বাংলার প্রথম দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ হল পাল বংশ। এ বংশের রাজাগণ প্রায় চার শত বছর রাজত্ব করেন।
ধর্মপাল (৭৮১-৮২১) ছিলেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বা নরপতি। তিনি বাংলা থেকে পাঞ্চাবের জলন্ধর পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তার করেন। পাহাড়পুরের বিখ্যাত বৌদ্ধবিহার সোমপুর বিহার তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এছাড়া মগধের বিখ্যাত বিক্রমশীলা বিহারও (বর্তমান ভাগলপুরে) তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
মহীপাল (৯৮৮-১০৩৮) বেনারস ও নালন্দার ধর্মমন্দির, দিনাজপুরের মহীপাল দিঘি. ফেনীর মহীপাল দিঘি খনন করেন।ফেনীতে এখনও মহীপাল স্টেশন নামে বাস স্টেশন আছে।
রামপালের সময়ে (১০৭৭-১১২০) তার মন্ত্রী ও সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিখ্যাত ‘রামচরিত কাব্য’ রচনা করেন। গোবিন্দপাল ছিলেন (১১৫৫-১১৬১) পাল বংশের শেষ রাজা।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ