বণ্টন ব্যবস্থা কীভাবে বিনিময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত? বিনিময় এবং বণ্টন-এর ধরনসমূহ কি?

অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানে বিনিময় এবং বণ্টন খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। আবার বিনিময় এবং বণ্টনকে
পরস্পর সম্পর্কিত মনে করা হয়। এর পেছনে একটা কারণ অনুমান করা যায়। আপনারা আগেই জানেন
নৃবিজ্ঞানীরা প্রধানত ইউরোপ থেকে অন্যান্য সমাজ দেখতে গিয়েছিলেন। ইউরোপের সমাজে তখন
বাজার ব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী। সমাজে উৎপাদিত দ্রব্যাদির বিনিময় হবে বাজারে Ñ এটাকেই স্বাভাবিক
মনে হয়েছে তাঁদের কাছে। কিন্তু ইউরোপের বাইরে অন্যান্য সমাজে গিয়ে এই ধারণাটা একেবারেই
পাল্টে গেছে তাঁদের জন্য। সকল সমাজে সেরকম বাজার ছিল না। ফলে কিভাবে ঐ বিশেষ সমাজের
মানুষজন উৎপাদিত দ্রব্যাদি আদান-প্রদান করে থাকে সেই জিজ্ঞাসাটা বড় হয়ে দেখা দিল। আবার,
আপনারা খেয়াল করে দেখবেন যে বিনিময় এবং বণ্টন ধারণা দুটো অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু
প্রচলিত অর্থশাস্ত্র এই সকল সমাজ নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি যে সকল সমাজে নৃবিজ্ঞানীরা কাজ
করেছেন। অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানের সূত্রপাত নিয়ে আলোচনায় তা আপনারা দেখেছেন।
এখানে আরেকটা ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার যা নিয়ে তালগোল বেধে যেতে পারে। বিনিময় এবং
বণ্টনকে একত্রে ভাবা হয় কেন? একটু চিন্তা করলেই এ দুয়ের সম্পর্কটা বোঝা যাবে। সমাজে যা কিছু
উৎপাদিত হয় তা ঐ সমাজের মানুষজনের কাছে আপনা-আপনি পৌঁছে যায় না। যে প্রক্রিয়ায় সেইসব
দ্রব্যাদি মানুষজনের কাছে যায় তার নাম বণ্টন। আবার সবাই সব কিছু উৎপাদন করেন না। যিনি
একটা বিশেষ জিনিস উৎপাদন করেন তাঁর জীবন যাপনের জন্য কেবল ঐ বিশেষ জিনিসের উপর নির্ভর
করলে চলে না। অন্যান্য জিনিসও দরকার পড়ে। সেক্ষেত্রে তিনি তাঁর উৎপাদিত দ্রব্যাদি অন্যের সঙ্গে
বদল করতে পারেন। এভাবে এটা বিনিময় করা হচ্ছে। সুতরাং, বণ্টনের সঙ্গে বিনিময়ের সম্পর্ক
রয়েছে। তবে এগুলো হচ্ছে আদর্শ অবস্থার কথা। বাস্তবে অগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে দেখা যায় বহু
সংখ্যক মানুষ উৎপাদনের জন্য খাটাখাটুনি করেন কিন্তু বিনিময় করবার জন্য তেমন কিছুই হাতে থাকে
না। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের এই অবস্থাকে বিবেচনায় রাখা দরকার। পুঁজিবাদী সমাজে সকল
বিনিময় হয়ে থাকে বাজারে এবং বিনিময় করবার জন্য শ্রমিকের কেবল নিজের শ্রম থাকে। সেই শ্রম
বিক্রি করে তিনি মজুরি পান। সে কারণে পুঁজিবাদী সমাজে এই শ্রমের বাজারকে শ্রমবাজার বলা হয়।
আবার পুঁজিবাদী সমাজেই এমন অনেক মানুষ এবং সামাজিক গোষ্ঠী আছেন যাঁরা তেমন কোন উৎপাদন
করেন না কিন্তু বিনিময় করবার জন্য অনেক টাকা হাতে থাকে তাঁদের। মুদ্রাব্যবস্থায় এটা সম্ভব হয়েছে।
আধুনিক বাজার ব্যবস্থায় এটা সম্ভব যে টাকার বিনিময়ে সকল কিছু কেনা যায়। এভাবে বিনিময় এবং
বণ্টনের ক্ষেত্রে বিরাট এক অসমতা আমরা লক্ষ্য করি।
১৯৬৮ সালে অর্থনৈতিক নৃবিজ্ঞানী কার্ল পোল্যানয়ি বিভিন্ন সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিন ধরনের
বণ্টনের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে : পারস্পরিক লেনদেন ), পুনর্বণ্টন এবং বাজার বিনিময় (কেউ কেউ এগুলোকে বণ্টনের ধরন
পুঁজিবাদী সমাজে সকল বিনিময়
হয়ে থাকে বাজারে এবং
বিনিময় করবার জন্য শ্রমিকের
কেবল নিজের শ্রম থাকে।
না বলে বিনিময়ের ধরন হিসেবে দেখে থাকেন। এই তিন ধরনের বণ্টনের মধ্যে প্রথম দুটিতে মুদ্রার
তেমন কোন ভূমিকা নেই। কিন্তু তৃতীয়টিতে মুদ্রার গুরুত্ব ব্যাপক। বলা চলে যে মুদ্রা ছাড়া বাজার
ব্যবস্থা অচল। ইউরোপীয় সমাজে গত কয়েক ’শ বছর এই ধরনের বণ্টন বা বিনিময় ব্যবস্থা চালু আছে।
মুদ্রার সবচেয়ে বড় সামর্থ্য হচ্ছে তা দিয়ে মানুষের শ্রম কেনা যায়। মুদ্রা থাকলে মানে টাকা জমানো
থাকলে তার নিজেরই একটা শক্তি থাকে। সেই টাকার পরিমাণ বিনিময় করলে কতটা সম্পদ পাওয়া
যাবে সেটারও হিসেব থাকে। অন্য কোন সমাজে ঠিক এইভাবে কোন শক্তি জমিয়ে রাখা যায় না।
এরকম নির্বিচারে শ্রমও কেনা যায় না। বাজার ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্যান্য ব্যবস্থার তুলনায়
এখানে মানুষজনকে ঠকাবার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। এর মানে হ’ল: অন্যান্য পদ্ধতির বিনিময়ে দুই বা
ততোধিক পক্ষের কারো ক্ষতিগ্রস্তহবার সম্ভাবনা কম থাকে। সেটাই ঐ পদ্ধতিগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য।
কারো কারো মতে বাজার ব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে কোন না কোন পক্ষকে ঠকানো বা শোষণ। ইদানিং
কালের নৃবিজ্ঞানে বাজার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে।
পারস্পরিক লেনদেন
যখন দুই পক্ষের মধ্যে দ্রব্যাদি (মড়ড়ফং) বা পরিষেবার প্রায় সমমূল্যের বিনিময় হয় তখন
তাকে পারস্পরিক লেনদেন বলা হয়। উপহার বিনিময়কেও এর অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। এখানে সমমূল্য
কথাটি নিয়ে একটু ভাববার দরকার আছে। আমাদের মাথায় মুদ্রার প্রচলন এত শক্তিশালীভাবে গেঁথে
আছে যে ‘সমমূল্য’ বললেই আমরা মুদ্রার সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে বসি Ñ ‘দাম কত’। যে সকল সমাজে
মুদ্রার একই রকম দাপট ছিল না সেখানে সমমূল্যের বলতে প্রয়োজনীয়তা ও মর্যাদা দিয়ে বুঝতে হবে।
এই ধরনের বিনিময় বা বণ্টন পদ্ধতিতে মুনাফা বা লাভের প্রসঙ্গ আসে না Ñ সেটা আপনারা আগেই
জেনেছেন। এখানে সামাজিক মান-মর্যাদার বিষয় কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আছে
প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা। অর্থাৎ, যে জিনিসটা বিনিময় করা হচ্ছে তার ব্যবহারিক গুরুত্ব কি।
কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পারস্পরিক লেনদেনের ৩টি ধরন চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলি হচ্ছে:
সাধারণীকৃত লেনদেন (, ভারসাম্যকৃত লেনদেন
এবং নেতিবাচক লেনদেন সাধারণীকৃত লেনদেনের
সবচেয়ে কার্যকরী উদাহরণ হচ্ছে খাবার-দাবার ভাগ করা যেখানে নিজের কোন ধরনের স্বার্থ কাজ করে
না। এটা এমন একটা লেনদেন যেখানে প্রদত্ত জিনিসের মূল্য হিসেব করা হয় না, ফিরতি পাওনার জন্য
কোন সময়কাল নির্দিষ্ট করা থাকে না। অস্ট্রেলীয় শিকারী স¤প্রদায় যখন কোন জন্তু হত্যা করে তখন
শিকারীদের পরিবারে এবং অন্যান্য পরিবারে মাংস ভাগাভাগি করে নেয়া হয়। একটা দলের সকলেই
এর ভাগ পায়। কে কতটা এবং কি পাবে তা নির্ভর করে শিকারীর সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্কের উপর।
যেমন, একটা ক্যাঙ্গারু হত্যা করা হলে এর পেছনের বাম পা ভাইয়ের পরিবারে যাবে, লেজ যাবে চাচাত
ভাইয়ের কাছে, পাছার মাংস এবং চর্বি যাবে শ্বশুরের কাছে, শাশুড়ির কাছে যাবে পাঁজর, সামনের পা
দুটো ফুপুর কাছে, মাথা যাবে শিকারীর স্ত্রীর কাছে এবং নাড়িভুঁড়ি ও রক্ত শিকারীর নিজের কাছে
থাকবে। যে সকল নৃবিজ্ঞানী অস্ট্রেলীয় এই সমাজ পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী এই হচ্ছে
সেই সমাজের নিয়ম। বণ্টনের এই সামাজিক নিয়ম মানা না হলে সেখানে এ নিয়ে তর্ক-বিবাদ হতে
পারে। এই ব্যবস্থায় শিকারী পরিবার ক্ষতিগ্রস্তমনে হতে পারে, কিন্তু অন্য একজন শিকার করলে তারা
আবার সুবিধাজনক ভাগ পাবে। দেয়া ও নেয়ার বেলায় এই রেওয়াজ হচ্ছে বাধ্যতামূলক। যেমনটা
কুরবানীর মাংসের বেলায় এই অঞ্চলে হয়ে থাকে। অনেকে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে
সাধারণীকৃত লেনদেনের সম্পর্ক হিসেবে বলে থাকেন।
ভারসাম্যকৃত লেনদেন বলতে বোঝানো হয়ে থাকে যেখানে কোন দেয়া-নেয়া মূল্যের হিসেবে এবং
ফেরতের সময়কালে নির্দিষ্ট করা থাকে। নৃবিজ্ঞানী রবার্ট লোঈ ক্রো ইন্ডিয়ান সমাজ থেকে এরকম
বিনিময়ের উদাহরণ টেনেছেন। ধরা যাক কোন বিবাহিত নারী তাঁর ভাইকে খাবার উপহার দিলেন, তাঁর কার্ল পোল্যানয়ি বিভিন্ন সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিন ধরনের বণ্টনের কথা উল্লেখ করেছেন... পারস্পরিক লেনদেন, পুনর্বণ্টন এবং বাজার বিনিময়।
ভাই তখন মহিলার স্বামীকে ১০টা তীর দিতে পারেন যাকে একটা ঘোড়ার সমতুল্য মনে করা হয় ঐ
সমাজে। এই ধরনের লেনদেনের সবচেয়ে খ্যাতিমান উদাহরণ হচ্ছে মালিনোস্কি বর্ণিত নিউ গিনির
ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জের কুলা চক্র। তবে এটাকেই কেউ কেউ আবার প্রাথমিক পর্যায়ের বার্টার (আধুনিক
মুদ্রার বদলে অন্য কোন দ্রব্যকে বিনিময়ের মান হিসেবে ব্যবহার) ভিত্তিক বাণিজ্য বলে আখ্যায়িত
করেছেন। কুলা চক্র বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। যখন কোন বিনিময়কারী গ্রহীতা হিসেবে বাড়তি
সুবিধা পাবার চেষ্টা করে থাকে তখন নেতিবাচক লেনদেন বলা হয়। এক্ষেত্রে লেনদেনের দুই পক্ষের
মধ্যে পরস্পর বিরোধী স্বার্থ কাজ করে। কোন কিছু জোর করে নিয়ে নেয়াকে এ ধরনের লেনদেনের
গুরুতর উদাহরণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানী ক্লাকহন নাভাজো সমাজের কথা উল্লেখ করেছেন
যেখানে কোন ভিনদেশী মানুষের সাথে দেনাপাওনার সময় তাকে ক্ষতিগ্রস্তকরা নৈতিকভাবে সমর্থন করা
হয়ে থাকে। ভারসাম্যকৃত লেনদেনের একটা ধরন হিসেবে সমতা বিধানের কৌশল (ষবাবষষরহম
সবপযধহরংস) উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এটার মূলনীতি হচ্ছে কোন সমাজে বিশেষ কারো হাতে সম্পদ
জমতে না দেয়া। এখানে একটা ব্যাপার ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এ ধরনের লেনদেন নিয়ে নৃবিজ্ঞানীদের
ব্যাখ্যায় অনেক সময়ই ব্যাপক অসঙ্গতি রয়েছে। যেমন, পারস্পরিক লেনদেন সম্পর্কে বলা হয় এটা
স্বার্থের ঊর্ধ্বে সমতুল দ্রব্যাদির বিনিময়, আবার নেতিবাচক লেনদেনের উদাহরণ হিসেবে লুণ্ঠন বা
চুরিকে উল্লেখ করা হয়। এই অসঙ্গতিগুলোর একটা কারণ হতে পারে; যে সকল সমাজ নৃবিজ্ঞানীরা
পর্যবেক্ষণ করেছেন তার অধিকাংশই দুর্বোধ্য লেগেছে তাঁদের কাছে। কারণ পশ্চিমা সমাজ থেকে এই
সমাজগুলো সবিশেষ ভিন্ন।
কুলা চক্র: ভারসাম্যকৃত লেনদেনের সাধারণ উদাহরণ হিসেবে উপহার বিনিময়ের কথা সবসময়ই উল্লেখ
করা হয়। নৃবিজ্ঞানের গবেষণার ইতিহাসে কুলা চক্রের কথা এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ভাবে বলা হয়ে থাকে।
ম্যালিনোস্কি নিউ গিনির ট্রব্রিয়ান্ড দ্বীপপুঞ্জে প্রচলিত এই প্রথা বর্ণনা করেছেন। একে বাণিজ্য হিসেবেও
দেখা হয়। কুলা হচ্ছে বৃত্তাকারে সজ্জিত কতগুলো দ্বীপে বসবাসরত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিয়াশীল
ব্যাপক একটি লেনদেন। এই লেনদেনে দুই ধরনের বস্তু প্রধান, এগুলো দুইটা ভিন্ন ভিন্ন গতিপথে
ভ্রমণ। লাল শামুক দিয়ে বানানো বড় কণ্ঠহার (ংড়ঁষধাধ) যা ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে এবং সাদা
শামুকে বানানো বাজুবন্দ্ (সধিষর) যা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘোরে। এক দ্বীপ থেকে আরেক
দ্বীপে কোন একটি বস্তু অন্যটার বিনিময়ে বিনিমিত হয়। এই লেনদেনের অপরাপর খুঁটিনাটি নির্ধারিত
হয় সমাজের প্রথা ও কানুন দ্বারা। অংশীদার প্রত্যেকটা গ্রামের কিছু পুরুষ কুলা চক্রে অংশ নিয়ে
থাকে। এরা এই প্রথার শরিকদের কাছ থেকে বাজুবন্দ্ কিংবা কণ্ঠহার গ্রহণ করে এবং কিছুক্ষণ নিজের
কাছে রেখে অন্য কারো কাছে চালান দেয়। কেউই কোন বস্তু চিরতরে দখল করে না। এই আদানপ্রদান সম্পর্ক সেখানে চিরস্থায়ী, জীবনব্যাপী সম্পর্ক।
ম্যালিনোস্কির মতে, কুলা বিনিময়ের সন্তুষ্টি জড়িয়ে আছে তাদের মর্যাদা আর অনুভূতিকে ঘিরে। তবে
কুলা বিনিময়কে সমাজ সংহতির একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। লেনদেনের সম্পর্কের মধ্য
দিয়ে অংশীদারবৃন্দ সামাজিকভাবে একে অপরের আপন থাকে। কুলার মূল দ্রব্যাদির পাশাপাশি অন্যান্য
দ্রব্যাদিও বিনিময় হয়ে থাকে। সেই বাণিজ্যের একটা স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে এই প্রথায়। কিন্তু সর্বোপরি,
কুলা প্রথার গুরুত্ব হচ্ছে একটা সমাজের মানুষজনের মধ্যকার সৌহার্দ্য। নৃবিজ্ঞানীদের সেরকমই অভিমত।
চিত্র - ১ : কুলা চক্র
সূত্র: সেরেনা নন্দা, কালচারাল এ্যান্থ্রোপলজি [৩য় সংস্করণ]
পুনর্বণ্টন
যখন দ্রব্যাদি কোন একটা কেন্দ্রীয় জায়গায় প্রথমে জড়ো করা হয় এবং পরে আবার বণ্টন করা হয়
তাকে পুনর্বণ্টন বলে। এভাবে পুনর্বণ্টন একটা “সামাজিক কেন্দ্র” ঘিরে গড়ে ওঠে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে,
যে সকল সমাজে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে চীফ (পযরবভ) বা বিগমেন (নরমসবহ) থাকে সেখানে এ ধরনের
বণ্টন রীতি প্রচলিত। প্রধান বা রাজা কয়েকটা পদ্ধতিতে সম্পদ জড়ো করে থাকেন। যেমন: উপহার
হিসেবে, কর বা খাজনা হিসেবে, যুদ্ধক্ষেত্রের অবশিষ্ট হিসেবে ইত্যাদি। এই সম্পদই আবার পুনর্বণ্টন
করা হয়ে থাকে। পুনরায় বণ্টন করার প্রক্রিয়া নানান ভাবে হতে পারে। কখনো কখনো দ্রব্যাদি
প্রত্যক্ষভাবে সমাজের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। কখনো আবার ভোজসভার আকারে
এই সম্পদ পুনর্বণ্টিত হয়। সম্পদ পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধান বা রাজার কয়েকটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাজ
করতে পারে। প্রথমত, সম্পদ বিতরণের এই ভূমিকায় গিয়ে সমাজে তাঁর মর্যাদা সমুন্নত রাখা। এখানে
দান-ধ্যান মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রতি সমর্থন আছে এমন মানুষের জন্য ন্যূনতম
একটা জীবন যাপন মান নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, নিজ এলাকার বাইরে মৈত্রী স্থাপন করা। নিউ গিনির
উদ্যান-কৃষিভিত্তিক সমাজে অতিথিদের শূকরের মাংস দিয়ে ভোজ এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন
করা হয়। কর সংগ্রহ এবং তারপর এর ব্যবহার পুনর্বণ্টনের একটা নমুনা। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে
প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে পেরুর ইংকা সাম্রাজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়। অনেকের মতে আধুনিক রাষ্ট্রের
কর বা খাজনা সংগহকেও এ ধরনের বণ্টন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে দেখা যায়। পুনর্বণ্টনের সবচেয়ে বহুল
ব্যবহৃত উদাহরণ হচ্ছে কোয়াকিউট্ল সমাজের পটল্যাচ প্রথা।
পটল্যাচ: উত্তর আমেরিকার উত্তরপশ্চিম উপকূলে কোয়াকিউট্ল ইন্ডিয়ানদের মধ্যে পটল্যাচ প্রথার কথা
উল্লেখ করেছেন কিছু নৃবিজ্ঞানী। এই প্রথাকে পুনর্বণ্টন ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে
বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কোয়াকিউট্ল ছাড়া অন্যান্য জাতির মধ্যেও এই প্রথার কাছাকাছি কিছু
ব্যাপার জানা গেছে। কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উদ্যাপনের ক্ষেত্রে পটল্যাচ হচ্ছে বহুল চর্চিত গণ-উৎসব।
সাধারণভাবে পটল্যাচ হচ্ছে একটা ভোজসভা যেখানে খাওয়ানো ছাড়াও মেজবান (যিনি দাওয়াত দিয়ে
থাকেন) অতিথিদেরকে নানান ধরনের উপহার দিয়ে থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন যে, বেশির
ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের আয়োজনে দাওয়াত দিয়ে থাকেন চীফ বা প্রধানেরা। তাঁর অতিথিরা একই গ্রাম
বা এলাকার অন্যান্য বাসিন্দারা এবং অন্যান্য গ্রাম বা এলাকার প্রধানেরা। সকলকেই তিনি উপহার দিয়ে
থাকেন। নৃবিজ্ঞানীরা এও উল্লেখ করেছেন, অতিথিরা তাঁদের নিজ নিজ সামাজিক মর্যাদার সাথে
সামঞ্জস্যপূর্ণ উপহার পেতেন। এখানে একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। তা হ’ল: কোয়াকিউট্ল
সমাজে টাকা-পয়সা বা ধন-সম্পত্তি মর্যাদার ভিত্তি নয়। বরং, পটল্যাচ উৎসব আয়োজন করাই হয়
কোন একজনের ধন-সম্পদ কমাবার স্বার্থে। অর্থাৎ, যাতে তাঁর ধন-সম্পদ বেশি জমে না থাকে সেই
উদ্দেশ্যে এবং সামাজিক স¤প্রীতি বজায় রাখার লক্ষ্যে এ ধরনের আয়োজন হ’ত।
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে কিংবা সাবালকত্ব লাভ Ñ ইত্যাদি উপলক্ষ্যে পটল্যাচ উৎসব হ’ত। উৎসব স্থানে
খাওয়ানো ছাড়াও খাবার বিলি করা হ’ত। অতিথিদের যে সকল উপহার দেয়া হ’ত তার মধ্যে রয়েছে
কম্বল, কাঠের বাক্স, নৌকা, মাছের তেল, ছাতু ইত্যাদি। বিপুল পরিমাণ সম্পদ খরচ করাই এই
উৎসবের মূল বৈশিষ্ট্য। এখানে মেজবানের মহত্ব কিংবা ইজ্জতও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর এই
আতিথেয়তার কারণে সম্মান লাভ করেন। কিন্তু মূল চেতনাটি আপনাদের খেয়াল রাখতে হবে। তা
হচ্ছে, কোনমতেই সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা সেই সমাজে কাম্য নয়। এই উৎসব নিয়ে অর্থনৈতিক
নৃবিজ্ঞানীদের আগ্রহের কারণ বুঝতেই পারছেন। সমাজের সম্পদের বণ্টন করবার জন্য এই উৎসব
বিশাল ভূমিকা রাখে।
বাজার বিনিময়
এই ব্যবস্থায় যাবতীয় দ্রব্যাদি এবং পরিষেবা টাকার বিনিময়ে কেনাবেচা হয়। এক্ষেত্রে দাম মোটামুটি
আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। আগে থেকে নির্ধারিত থাকার যুক্তি হিসেবে অর্থনীতিবিদগণ চাহিদা ও
যোগানের সূত্র উল্লেখ করে থাকেন। পুঁজিবাদী সমাজে এই ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ। নৃবিজ্ঞানের শুরুর লগ্নে,
অর্থাৎ উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত, কেবল ইউরোপের এবং উত্তর
আমেরিকা মহাদেশের সমাজে বাজার ব্যবস্থার বিনিময় চালু ছিল। নৃবিজ্ঞানীরা এই ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক
হিসেবে দেখে থাকেন। তাঁদের ভাবনা এবং অভিজ্ঞতায় এই ব্যবস্থার প্রভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে
পৃথিবীর অন্যান্য সমাজে প্রচলিত বিনিময় ব্যবস্থাকে তাঁরা প্রাচীন এবং রূপান্তরশীল মনে করেছেন। কেউ
কেউ বাজার ব্যবস্থাকেই একমাত্র “খাঁটি অর্থনৈতিক” বিনিময় প্রথা বলেছেন।
বাজার ব্যবস্থায় টাকা বা মুদ্রার গুরুত্বের কথা আগেই আপনারা জেনেছেন। নৃবিজ্ঞানীরা বাজার ব্যবস্থায়
ব্যবহৃত মুদ্রাকে সর্ব-কার্যের মুদ্রা (ধষষ-ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব সড়হবু) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর কারণ
হ’ল বাজার বিনিময় ব্যবস্থায় সকল কিছুর (সকল দ্রব্য এবং মানুষের সকল প্রকার দক্ষতা, যোগ্যতা)
মুদ্রামানে দাম ঠিক করা আছে। মুদ্রা দিয়ে সকল কিছু খরিদ করা যায়। মানুষের শ্রমও। কেবল তাই
নয়, সমাজে যে গোষ্ঠীর হাতে মুদ্রা থাকে তারাই শ্রমের দাম নির্ধারণ করতে পারে। অন্যান্য সমাজে
বিনিময়ের জন্য কখনো কখনো কোন একটা বস্তুকে মুদ্রার মত করে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তা নির্দিষ্ট
ক্ষেত্রেই কেবল চলে। বাজারভিত্তিক সমাজের নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকে। কোন
একটি অঞ্চলের সর্বত্র মুদ্রার মান এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার কাজ এই প্রতিষ্ঠান করে থাকে।
সাধারণভাবে ব্যাঙ্ক এই কাজ করে থাকে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা
ছাড়া এই কাজ সহজ নয়। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতা ছাড়া বাজার ব্যবস্থা ব্যবস্থায় যাবতীয় দ্রব্যাদি এবং পরিষেবা টাকার বিনিময়ে কেনাবেচা হয়। এক্ষেত্রে দাম মোটামুটি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে।
নিশ্চিতভাবে কায়েম করা সম্ভব নয়। এখানে আরো কিছু বিষয় খোলাসা করা দরকার। বর্তমান দুনিয়ার
বাজার ব্যবস্থায় কোন একটি দেশ বিচ্ছিন্ন নয়, থাকতে পারে না। গরিব ও ধনী বিশ্ব পরস্পর নানাভাবে
সম্পর্কযুক্ত। এবং, এই সম্পর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গরিব বিশ্ব আরো ক্ষতিগ্রস্তহচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু
আলোকপাত করা হবে পরবর্তী পাঠের আলোচনায়।
সারাংশ
অনেক নৃবিজ্ঞানীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সংক্রান্তভাবনা এসেছে অর্থশাস্ত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ, ধারণা
কিংবা তত্ত¡ থেকে। উৎপাদনের পাশাপাশি বণ্টন এবং বিনিময়কেও ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁরা।
বণ্টন এবং বিনিময় উভয়ক্ষেত্রেই মূল বিবেচ্য হচ্ছে কিভাবে মানুষজন উৎপন্ন দ্রব্য বা সেবা পেতে
পারেন। এই দুই-কে একত্রে আলোচনা করা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেছেন,
পুঁজিবাদী নয় এমন সমাজের মানুষজনের মধ্যে বণ্টনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বৈষম্য কম। বণ্টন এবং
বিনিময়ের তিনটা ধরনকে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা: পারস্পরিক লেনদেন, পুনর্বণ্টন এবং বাজার। এর
মধ্যে শেষেরটা পরিপূর্ণভাবে পুঁজিবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য। তবে অন্য অনেক নৃবিজ্ঞানী মনে করেছেন,
যদি বিনিময় এবং বণ্টন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা হয় তাহলে অবশ্যই মনোযোগ দেয়া দরকার গরিব এবং
ধনী দেশগুলোর সম্পর্কের দিকে এবং গরিব এবং ধনী শ্রেণীর সম্পর্কের দিকে।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। পারস্পরিক লেনদেনের কয়টি ধরন চিহ্নিত করা হয়?
ক. ২টি খ. ৩টি
গ. ৪টি ঘ. ৫টি
২। “সমতা বিধানের কৌশল” - ধরনটি কোন প্রকার লেনদেনের সাথে সম্পর্কিত?
ক. সাধারনীকৃত লেনদেন খ. ভারসাম্যকৃত লেনদেন
গ. নেতিবাচক লেনদেন ঘ. উপরের সবগুলোই
৩। কোন উপজাতি সমাজে পটল্যাচ প্রথা দেখা যায়?
ক. ইংকা খ. কারিমোজোং
গ. কোয়াকিউটল ইন্ডিয়ান ঘ. নান্দী
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। বণ্টন ব্যবস্থা কীভাবে বিনিময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত?
২। বিনিময় এবং বণ্টন-এর ধরনসমূহ কি?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। কোন কোন সমাজে উৎসবের মধ্য দিয়ে আর্থনীতিক কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়ে থাকে তা উদাহরণ
দিয়ে আলোচনা করুন।
২। ‘বর্তমান কালে বিনিময় ব্যবস্থার মুখ্য নির্ধারক হচ্ছে বাজার’ Ñ ব্যাখ্যা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]