গত কয়েক দশক ধরে নৃবিজ্ঞানে ‘ফলিত নৃবিজ্ঞান’ কথাটি ব্যাপক
প্রচলিত। এতে বোঝানো হয়ে থাকে ফলিত গবেষণার জগতে নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণকে। কিন্তু ফলিত
গবেষণা () বলতেই বা আমরা কি বুঝব? এখানে আর কয়েকটা শব্দ আমরা স্মরণ
করতে পারি। এই শব্দগুলো ফলিত গবেষণার সমার্থক বা কাছাকাছি অর্থে বোঝানো হয়ে থাকে।
সেগুলো হচ্ছে এ্যাকশন গবেষণা) এবং পলিসি গবেষণা
এই নামগুলো থেকে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব হয় যে ফলিত গবেষণা বলতে আসলে কি বোঝানো হয়ে
থাকে। সাধারণভাবে যে সকল গবেষণার উদ্দেশ্য থাকে কোনও সুপারিশমালা গ্রহণ কিংবা কোনও
সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব করা সেগুলিকে ফলিত গবেষণা বলা হয়ে থাকে। আর ফলিত গবেষণায়
নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণকে সংক্ষেপে ফলিত নৃবিজ্ঞান বলা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ফলিত নৃবিজ্ঞান কথাটি গত কয়েক বছর ধরে প্রচলিত থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই
শব্দটি ২/৩ দশক ধরে ব্যাপক চালু আছে। কিন্তু শব্দটি জনপ্রিয় হবার আগে থেকেই এই ধারার
গবেষণায় নৃবিজ্ঞানের অংশগ্রহণ রয়েছে। বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন শাস্ত্রের কিছু
পÐিত ও গবেষক নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন এমন ধরনের গবেষণায় যেখান থেকে কোনও না
কোনও সুপারিশ গৃহীত হয়ে থাকে। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। সুপারিশ কিংবা প্রস্তাব
গ্রহণ করা প্রশাসনিক কাঠামোর অঙ্গে বিজড়িত। তার মানে ফলিত নৃবিজ্ঞান বা ফলিত গবেষণার সঙ্গে
প্রশাসনিক কাঠামোর একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে।
ম্যালিনোস্কির বক্তব্য
নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রশাসনের সঙ্গে নৃবিজ্ঞানের সম্পর্কের এই ব্যাপারটা বেশ পরিষ্কার
হয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে নৃবিজ্ঞানীদের পেশাগত সম্পর্ক কি হবে Ñ সেটা নিয়ে
নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা এবং বিতর্ক চলছিল। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতিমালা গ্রহণে নৃবিজ্ঞানীরা
কিভাবে সাহায্য করতে পারে তা নিয়ে অনেক নৃবিজ্ঞানী নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে
ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্লো ম্যালিনোস্কির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবিদার। তিনি ১৯৩০ সালে
“দ্য র্যাশনালাইজেশন অব এ্যান্থ্রোপলজি এন্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশন” (নৃবিজ্ঞানের যৌক্তিকতা-প্রমাণ এবং
প্রশাসন) নামে একখানা প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসনকার্য
চালাবার জন্য প্রশাসন নৃবিজ্ঞানীদের সহায়তা নিতে পারেন।
ম্যালিনোস্কির বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করবার প্রধান কারণ হচ্ছে নৃবিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর
প্রভাব ব্যাপক। আলোচ্য প্রবন্ধটিতে কতকগুলো প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গগুলোই ফলিত
নৃবিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করবার ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া ম্যালিনোস্কির তাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ এই ধারাকে
অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সেটাও এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। ম্যালিনোস্কির চিন্তাভাবনা ক্রিয়াবাদী হিসেবে
খ্যাত। তিনি সংস্কৃতিকে অনুধাবন করেছিলেন জৈবিক ক্রিয়া হিসেবে। একই সাথে নৃবিজ্ঞানের গবেষণা
পদ্ধতি হিসেবে তিনি কোনও সমাজে সংঘটিত ক্রিয়াদি পর্যবেক্ষণের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
তাঁর প্রস্তাবিত এই পদ্ধতি সমকালীন নৃবিজ্ঞানের কোনও কোনও মহলকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
আমরা আলোচনায় লক্ষ্য করব, এখন অব্দি পলিসি গবেষণাতে ক্রিয়াবাদী ধারাই মূলত প্রভাবশালী। এ
ধরনের গবেষণায় এই তাত্তি¡ক ধারা সুবিধাজনক হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া নৃবিজ্ঞানকে বিজ্ঞান
হিসেবে দাঁড় করাবার ক্ষেত্রে যে সকল নৃবিজ্ঞানী তৎপর হয়েছিলেন ম্যালিনোস্কি তাঁদের অন্যতম। এই
সকল ভাবনা থেকেই ৭০ বছর আগে প্রকাশিত ম্যালিনোস্কির প্রবন্ধটির স্বতন্ত্র গুরুত্ব টের পাওয়া যায়।
ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামোতে নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা
আপনারা জানেন যে, নৃবিজ্ঞানীদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যে বিষয়টা এখানে
মনে রাখা দরকার তা হচ্ছে: সকল সময় এই সম্পর্কটা প্রত্যক্ষ নয়। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা
পরিষ্কার হতে পারে। ম্যালিনোস্কি যখন পলিনেশীয় এলাকাতে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন তখন সেখানে
ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত ছিল। কিন্তু ম্যালিনোস্কি কখনোই সে প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় আনেননি কিংবা এই
সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেননি। পরবর্তী কালের অনেক নৃবিজ্ঞানী এই বিষয়টাকে সামনে নিয়ে এসেছেন।
তাঁদের যুক্তি হচ্ছে: কোন নৃবিজ্ঞানী যদি প্রত্যক্ষভাবে কোন ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনে চাকরি নাও
করেন, যে ব্যবস্থার মধ্যে তাঁর মাঠকর্ম সাধিত হয়, যে অসম সম্পর্কের মধ্যে নৃবিজ্ঞানীর গবেষণা
ক্ষেত্রের মানুষজন এবং নৃবিজ্ঞানীর ‘নিজ’ সমাজের মানুষজন বসবাস করেন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের
প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নিপীড়ন Ñ এ সবই নৃবিজ্ঞানীর কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এগুলোকে বাদ দিয়ে
নৃবিজ্ঞানীর গবেষণাকে বোঝা যাবে না।
কিন্তু আলোচ্য প্রবন্ধে ম্যালিনোস্কি সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনে নৃবিজ্ঞানীদের সহযোগিতার কথা
বলেন। কেবল তাই নয়, যে সকল নৃবিজ্ঞানীরা এই কাজে সহায়তা করবার প্রচেষ্টা নেননি, ম্যালিনোস্কি
তাঁদের তিরস্কারও করেন। এক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য জ্ঞানকাÐ এবং প্রশিক্ষণ থেকে আসা বিশেষজ্ঞদের
ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। ম্যালিনোস্কির ভাষায়:
“...বিগত একটা প্রবন্ধে (আফ্রিকা, জানুয়ারী ১৯২৯) আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি যে আমাদের বর্তমানকালের বিদ্যাজাগতিক নৃবিজ্ঞান এখন অবধি ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণকে সহায়তা দান করবার জন্য আগ্রহী হয়ে
ওঠেনি। একই সঙ্গে আমি দেখিয়েছি যে নতুন একটা পদ্ধতি এবং নতুন একটা তত্ত¡, ক্রিয়াবাদী ধারা, খুব
দ্রæত আকৃতি পেয়ে যাচ্ছে, এবং এটা, যদি ঔপনিবেশিক-ক্ষেত্রের লোকজনের সহযোগিতা লাভ করে,
নিঃসন্দেহে পলিসি বানানোতে একই ভূমিকা নিতে পারবে প্রকৌশলের ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞান এবং ভূতত্ত¡বিজ্ঞান
যা করেছে।...”
[ম্যালিনোস্কি, ১৯৩০: পৃ. ৪০৮]
এই অংশটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লে ফলিত নৃবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার হওয়া
সম্ভব। এখানে ধরে নেয়া হয়েছে যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেইউরোপীয় শাসকদের উপনিবেশ স্থাপন
স্বাভাবিক। এবং এই উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় শাসকদের সহযোগিতা প্রদান করাই
নৃবিজ্ঞানীদের মুখ্য কাজ, তাঁদের পেশাগত সমৃদ্ধির বিষয়টাও এখানে যুক্ত। বিশ্ব জুড়ে ঔপনিবেশিক
শাসনের প্রতি নৃবিজ্ঞানীদের কারো কারো পক্ষপাত ভেবে দেখার মত। ইউরোপের সভ্যতা সংক্রান্ত
ভাবনা এখানে প্রাসঙ্গিক। সারা দুনিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে তারা যে যুক্তি দেখিয়েছে তা হ’ল:
সভ্যতা আনয়ন। তাদের দাবি ছিল সারা দুনিয়াতে তারা সভ্যতা বয়ে নিয়ে এসেছে। ম্যালিনোস্কির মত
অনেক নৃবিজ্ঞানীই এই ভাবনাকে সমর্থন করে গেছেন। আমরা পরবর্তী পাঠে দেখতে পাব কিভাবে
পরবর্তী কালের নৃবিজ্ঞানে একই বিষয় কিংবা একই ভাবনা কাজ করেছে। সেখানে মূল প্রতিপাদ্য
সভ্যতা আনয়ন নয়, উন্নয়ন। উদ্ধৃত বক্তব্যের একটু পরেই ম্যালিনোস্কি নাইজেরিয়ার একজন গভর্নরের
“...আমার প্রবন্ধ দুটো প্রত্যুত্তরে উৎসাহ যুগিয়েছে, দুটোই খুব কাজের। তার একটাতে বিশাল
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন প্রশাসক, মেজর রাক্সটন, এক কালে নাইজেরিয়ার দক্ষিণের প্রদেশগুলোর
লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ছিলেন, আমার দৃষ্টিকোণ প্রায় নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিয়েছেন, এবং নিজের অভিজ্ঞতা
হতে দেখিয়েছেন কিভাবে ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানী এবং প্রশাসকদের মধ্যকার সহযোগিতা সত্যকার ফলপ্রসূভাবে
গড়ে তোলা যেতে পারে।...”
[ম্যালিনোস্কি, ১৯৩০: পৃ. ৪০৮]
বোঝাই যায় যে, নাইজেরিয়ার এই সাবেক প্রশাসক আসলে ব্রিটিশ প্রশাসনের কেউ এবং ম্যালিনোস্কি
নৃবিজ্ঞানীদের সম্ভাব্য ভূমিকা ও পেশা দাঁড় করাবার জন্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। এই প্রচেষ্টা
থেকেই আমরা ফলিত নৃবিজ্ঞানের গড়ে ওঠা অনুমান করতে পারব। উদ্ধৃত অংশে আরও একটি জায়গা
মনোযোগ পাবার দাবিদার। ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীদের প্রসঙ্গ সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও
ম্যালিনোস্কির ভাবনায় নৃবিজ্ঞানকে একটি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হিসেবে প্রমাণ করবার তাগিদ রয়েছে।
বিজ্ঞানের শাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞান
ম্যালিনোস্কি যে সময়ে আলোচ্য প্রবন্ধখানি লেখেন সেই সময়ে জ্ঞানকাÐ হিসেবে নৃবিজ্ঞান নিয়ে একটা
বিশেষ বিতর্ক চলছিল। তা হচ্ছে, নৃবিজ্ঞান বিজ্ঞান কিনা কিংবা কিভাবে নৃবিজ্ঞান একটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞান
হয়ে উঠতে পারে। ম্যালিনোস্কি নিজে একে বিজ্ঞান হিসেবে দেখতে চাইতেন। প্রথম উদ্ধৃতিতে লক্ষ্য
করা যায়, তিনি ঔপনিবেশিক শাসকদের সহযোগিতা করবার জন্য নৃবিজ্ঞানীদের সম্ভাব্য দায়িত্ব-কর্তব্য
নিয়ে বলতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞান এবং ভূতত্ত¡বিজ্ঞান শাস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেবল ওইটুকুই
নয়। তাঁর ভাবনার আগাগোড়ায় এই তাগিদ ছিল। এবং তিনি অন্যান্য বিজ্ঞান শাস্ত্রেরও সমালোচনা
করেছেন যে সকল শাস্ত্র, তাঁর মতে, যথেষ্ট কাজে আসেনি।
“...এবং এখন, কুড়ি বছর ধরে নৃবৈজ্ঞনিক কাজ করবার পর, আমি নিজেকে দেখতে পাই, বিরক্তিসমেত,
মানুষের একটা কর্মসংঘ হিসেবে মানুষের বিজ্ঞানটাকে ততটাই খারাপ আর বিমানবিককারী হিসেবে তৈরি
করতে প্রচেষ্ট আছি যতটা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা কিংবা জীববিজ্ঞান করে এসেছে গত শতক ধরে কিংবা
প্রকৃতির প্রতি বিপ্রাকৃতিককারী হিসেবে। সংক্ষেপে, আমি নৃবিজ্ঞানকে একটা সত্যকার বিজ্ঞান হিসেবে গড়ে
তুলবার চেষ্টা করছি এবং অনিবার্যভাবে বিজ্ঞান যে সকল প্রপঞ্চ নাড়াচাড়া করে সেগুলোর মধ্যে তার
সামঞ্জস্যবিধান এবং যৌক্তিকতাবিধান করতে হবে।...”
[ম্যালিনোস্কি, ১৯৩০: পৃ. ৪০৬]
এই উদ্ধৃতি থেকে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়। এর পরে যদিও তিনি বিজ্ঞান নিয়ে সতর্কতা প্রকাশ করেছেন
কিন্তু একই সঙ্গে নৃবিজ্ঞানের বিজ্ঞান হয়ে ওঠাকে অনিবার্য হিসেবে দেখেছেন। আমাদের অবশ্যই মনে
রাখতে হবে যে, ম্যালিনোস্কি যখন কাজ করছেন তখন লেখাপড়ার জগতে ব্রিটেন বা অন্যান্য ইউরোপীয়
বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান দাঁড়ায়নি। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর এই আগ্রহের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া
যায়। কিন্তু তিনি সত্যকার বিজ্ঞানের কথা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন। তাঁর ভাবনা থেকে আমরা
দেখতে পাই যে তিনি সত্যকার বিজ্ঞান বলতে বুঝিয়েছেন যার প্রয়োজন আছে, যা প্রায়োগিক। বর্তমান
বিশ্বের নৃবিজ্ঞানে যে সকল বিতর্ক চালু আছে, সেখানেও এই যুক্তিটা খুবই প্রচলিত। এমনকি নৃবিজ্ঞানের
বাইরেও এই যুক্তিটা জোরেসোরে শোনা যায়। প্রয়োজনীয়তা কিংবা প্রায়োগিকতার প্রসঙ্গ ফলিত
নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ফলিত নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে যে সকল নৃবিজ্ঞানীর নাম
জড়িত তাঁদের অনেকেরই যুক্তি হচ্ছে: ফলিত নৃবিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক আছে, এর প্রয়োজন আছে।
এর পাশাপাশি এই যুক্তিটাও চলে আসে যে ‘বিশুদ্ধ’ বিজ্ঞান সবসময়েই প্রায়োগিক, এর প্রয়োজনীয়তা
আছে। আবার যে সকল নৃবিজ্ঞানী এই ব্যাপারে যথেষ্ট সমালোচনা করেন তাঁদের যুক্তি হচ্ছে: ফলিত
নৃবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা আসলে কিছু সংস্থার প্রয়োজনীয়তা, পলিসি নির্ধারণের প্রয়োজনে নৃবিজ্ঞানের আপনারা জানেন যে ম্যালিনোস্কি ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানী ছিলেন। এই পাঠের গোড়াতেও সে বিষয়ে উল্লেখ
করা হয়েছে। ক্রিয়াবাদী তাত্তি¡ক ধারার সঙ্গে ফলিত নৃবিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ম্যালিনোস্কি
ধারাবাহিকভাবে গুরুত্ব আরোপ করে গেছেন ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীদের উপর। তাঁর মতে, প্রশাসনকে
সহযোগিতা করবার জন্য ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানীরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। তিনি অপরাপর
ধারার নৃবিজ্ঞানীদের সমালোচনা করেছেন। এখানে মনে রাখা আবশ্যক ম্যালিনোস্কি যে সময়কালে কাজ
করেছেন তখন নৃবিজ্ঞানে অপর ধারা বলতে মূলত বিবর্তনবাদ বোঝাত। নানারকম ভিন্নতা সত্তে¡ও
নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারার ব্যাপক প্রভাব ছিল Ñ তা বলা যায়। ম্যালিনোস্কি এই ধারাকে নানা
কারণে সমালোচনা করেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন অতীত কালের মানুষের তুলনায় বর্তমান
কালের মানুষের জীবন নৃবিজ্ঞানীদের প্রধান আগ্রহ হওয়া উচিত। তিনি অন্যান্য ধারার অপ্রয়োজনীয়তা
বোঝাতে তাকে ‘রোমান্টিক’ বলেন। তাহলে ক্রিয়াবাদের মূল পরিচয় কি? ম্যালিনোস্কির ভাষায়:
“...একেবারে সরলতম নীতিমালার দিক থেকে দেখলে, ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সহজভাবে বোঝায় যে কোনও
একটি প্রপঞ্চ নিয়ে আলোচনা করবার জন্য তাকে সেভাবেই বুঝতে হবে ঠিক যেভাবে সেটা আছে; উদাহরণ
হিসেবে, বিয়ের উৎপত্তি খুঁজতে গেলে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এবং নানা রকমফেরের মধ্যে বিয়ে আসলে কী তা
জানতেই হবে; কোনও প্রথা, প্রতিষ্ঠান, কিংবা এমনকি কোনও একটা প্রয়োগ-হাতিয়ার অধ্যয়ন করতে
চাইলে, এটা অবশ্যই ভালভাবে বুঝতে হবে যে সংস্কৃতির এই এককটি সমগ্র সংস্কৃতি প্রকল্পের মধ্যে কোন
অংশটি পালন করে।...”
[ম্যালিনোস্কি, ১৯৩০: পৃ. ৪০৯]
উদ্ধৃত অংশটি ক্রিয়াবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৃঝবার জন্য সহায়ক। বর্তমান নৃবিজ্ঞানের মুখ্য ধারা কোনমতেই
বিবর্তনবাদ নয়। তাই বিবর্তনবাদকে বিরোধিতা করবার প্রশ্ন আসছে না। কিন্তু ক্রিয়াবাদী ধারার
গবেষণা বর্তমান কালের অন্যান্য তাত্তি¡ক ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে Ñ তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
ফলিত গবেষণায় ক্রিয়াবাদী ধারার চিন্তাভাবনা ব্যাপক জনপ্রিয়। যে সকল সংস্থা এই ধরনের গবেষণার
উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে তাদের বক্তব্য হচ্ছে তারা বাস্তবানুগ গবেষণা করাতে চায়। এর একটা মানে
দাঁড়িয়েছে: গবেষিত মানুষজন যা ভাবছেন। ফলিত গবেষণার বর্তমান ধারাতে বিভিন্ন রকম পলিসি বা
নীতিমালা গ্রহণের জন্য কোন অঞ্চলের মানুষের ভাবনা জানবার চেষ্টা করা হয়। ফলে আগে পরে
অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে বর্তমানকে সামনে নিয়ে আসা হয়। ক্রিয়াবাদী তাত্তি¡ক ধারা এই ব্যাপারে
একটা গোড়াপত্তন করে রেখেছে। ফলিত গবেষণায় বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নৃবিজ্ঞানীদের
অংশগ্রহণ বড় মাপের বিতর্ক তৈরি করেছে যা আগামী পাঠে উল্লেখ করা হবে।
সারাংশ
ফলিত নৃবিজ্ঞান বলতে বোঝায় ফলিত গবেষণায় নৃবৈজ্ঞানিক অংশগ্রহণ। ফলিত গবেষণা বলতে বোঝায়
যে সকল গবেষণা থেকে কোনও নীতিমালা বা সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। সে হিসেবে এর অন্য নাম
পলিসি রিসার্চ। ফলিত নৃবিজ্ঞান কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত সা¤প্রতিককালে। কিন্তু প্রশাসনিক
নীতিমালা গ্রহণে নৃবিজ্ঞানীদের অংশ নেয়ার নমুনা নৃবিজ্ঞানের প্রায় সূচনালগ্ন থেকেই আছে। এ ব্যাপারে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কির বক্তব্য। তাছাড়া তাঁর প্রদর্শিত ক্রিয়াবাদী ধারা
ফলিত নৃবিজ্ঞানের চিন্তাপদ্ধতি হিসেবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বর্তমান বিশ্বের নৃবিজ্ঞানে ফলিত
ধারার গবেষণা মুখ্যত ক্রিয়াবাদী ধারাতেই পরিচালিত হয়ে থাকে।
ক্রিয়াবাদী তাত্তি¡ক ধারার সঙ্গে
ফলিত নৃবিজ্ঞানের নিবিড়
সম্পর্ক রয়েছে।
সঠিক উত্তরের পাশে টিক () চিহ্ন দিন -
১। ম্যালিনোস্কির চিন্তাভাবনা ---------- হিসেবে খ্যাত।
ক. বিবর্তনবাদী খ. কাঠামোবাদী
গ. নারীবাদী ঘ. ক্রিয়াবাদী
২। ম্যালিনোস্কি যখন পলিনেশীয় এলাকাতে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন তখন সেখানে কাদের
উপনিবেশ স্থাপিত ছিল ?
ক. ডাচ খ. পুর্তুগীজ
গ. বৃটিশ ঘ. স্পেনীশ
৩। ---------- তাত্তি¡ক ধারার সাথে ফলিত নৃবিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
ক. ক্রিয়াবাদী খ. বিবর্তনবাদী
গ. কাঠামোবাদী ঘ. নারীবাদী
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ফলিত গবেষণা বলতে আপনি কী বোঝেন?
২। ক্রিয়াবাদ কাকে বলে?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রশাসনিক কাজকর্মে নৃবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে ম্যালিনোস্কির মূল বক্তব্য কী?
২। ঔপনিবেশিক স্বার্থের সঙ্গে ফলিত নৃবিজ্ঞানের সম্পর্ক আলোচনা করুন।
FOR MORE CLICK HERE
বাংলা রচনা সমূহ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
English Essay All
English Grammar All
English Literature All
সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলী
সাধারণ জ্ঞান আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ভূগোল (বাংলাদেশ ও বিশ্ব), পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
বি সি এস প্রস্তুতি: কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি
বি সি এস প্রস্তুতি: নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সু-শাসন
বি সি এস প্রস্তুতি: সাধারণবিজ্ঞান
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়
ভাবসম্প্রসারণ