কলম্বাস কী ভাবে আমেরিকা আবিষ্কার করেন

ভৌগোলিক আবিষ্কার
ইউরোপ যখন দ্বিগবিজয়ে বের হয় তখন রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের ছিল করুণ অবস্থা।
তাদের শত্রট্ট তুর্কি মুসলমানদের আঘাতে ইউরোপীয় দেশগুলো ছিল পর্যুদস্তু, তাদের অস্তিত্ব
ছিল হুমকির সম্মুখীন। ১৪৫৩ সালে তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের
পতন হয়। সার্বিয়া তুর্কিদের দখলে যায় ১৪৫৯ সালে, আলবেনিয়া একই ভাগ্য বরণ করে
১৪৭০ সালে। পশ্চিম ইউরোপীয়দের চরম দুঃস্বপ্ন শুরু হয় যখন তুর্কিরা ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে
ইতালিতে পদার্পণ করে। ইতালিয় শহর ওটরান্টো তাদের দখলে আসে। ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে
সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের মৃত্যু হলে তুির্করা ইতালি ত্যাগ করে। কিন্তু ইউরোপীয়রা আশঙ্কায়
দুলতে থাকে এই ভেবে যে তুর্কিরা আবার অক্রমণ করবে। পোপ দ্বিতীয় পিয়াস তুর্কিদের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গঠন করতে গিয়ে দুঃখে বলে উঠেছিলেন ’’আমি কোনো আশার আলো
দেখতে পাচ্ছিনা’’। একদিকে ইউরোপ যখন শুধুই অন্ধকার দেখছিলো তখন অন্যদিকে
ইউরোপের আশার আলো জ্বলে উঠেছিলো। কিছু দুঃসাহসী পর্তুগিজ এবং স্পেনীয় নাবিক
উত্তাল আটলান্টিক সাগর পাড়ি দেয়া শুরু করে। তাদের আবিষ্কার শীঘ্রই ইউরোপকে বিশ্বের
প্রভু বানাবার রাস্তা তৈরি করে দিলো।
পর্তুগিজদের আবিষ্কার
ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথে পর্তুগিজরা ছিল পথ প্রদর্শক। ইউরোপের দক্ষিণ পশ্চিম কোণায়
এবং আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত পর্তুগালের কিছু কিছু সামুদ্রিক অভিযান আগে থেকেই
পরিচালিত হচ্ছিল। এক সময় জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনীয় মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধে
লিপ্ত হয়। তারা আরো দক্ষিণে নৌযান চালিয়ে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছিলো। পুরো আফ্রিকা
মহাদেশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু তারা ধারণা করেছিল যে মহাদেশটি
বিশাল ও বিপদসঙ্কুল। তারপরও তারা ভাবত আফ্রিকার পশ্চিম উপক‚ল ধরে দক্ষিণে কিছুদূর
অগ্রসর হলে মহাদেশটির সর্বদক্ষিণের বিন্দুটি অতিক্রম করে তারপর পূর্ব দিকে জাহাজ চালিয়ে
গেলে তারা তাদের স্বপ্নের ভারত ও চীনে পৌঁছানো যাবে, এইভাবে তারা ইতালিয় নগরীগুলো
এবং মুসলিম বাণিজ্য বহরের উপর নির্ভরশীলতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। চর্তুদশ শতাব্দীর

মধ্যভাবে তারা আটলান্টিক দ্বীপ মাদেইরা (গধফবরৎধ) ও আজোরেস (অুড়ৎবং) দখল করে
এবং মদ ও চিনির ব্যবসা করে প্রচুর লাভবান হয়।
পর্তুগিজদের ভারতে এবং চীনে আসার স্বপ্নকে যিনি বাস্তবে রুপায়িত করার চেষ্টা করেন তিনি
হচ্ছেন পর্তুগিজ যুবরাজ হেনরি নেভিগেটর (১৩৯৪-১৪৬০ খ্রি:)। নেভিগেটর মানে হচ্ছেন
নৌপরিব্রাজক। কিন্তু হেনরি তেমন কিছু ছিলেন না। কিন্তু তাঁর হৃদয় মন জুড়ে ছিলো প্রচলিত
ভৌগোলিক তত্ত¡গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে খ্রিস্টান ধর্মকে ছড়িয়ে
দেয়া যায় এবং তাঁর দেশের সীমানা ও সম্পদ বাড়ানো যেতে পারে। তিনি নাবিকদের জন্য
একটা স্কুল খুলে ছিলেন এবং সেখানে জড়ো করেছিলেন দক্ষ ও প্রতিভাবান নাবিক এবং
ভ‚গোলবিদদের। এই স্কুল থেকে তিনি বছরের পর বছর ধরে ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক ও
যোদ্ধাদের দিয়ে অনেক নৌঅভিযান প্রেরণ করেছিলেন। হেনরির সময় পর্তুগিজ জাহাজগুলো
পশ্চিম আফ্রিকার উপক‚ল ধরে দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পর্তুগিজ নাবিকেরা
ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী গরমকে উপেক্ষা করে কিছু দুর্গ ও বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করতে সমর্থ
হয়েছিলো। কি প্রচন্ড গরম আর বিপদসঙ্কুল অভিযানে তারা বেরিয়েছিলো পঞ্চদশ শতাব্দীর
মধ্যভাগের একটি বিবরণ থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। এই বর্ণনায় লিখা রয়েছে
“কয়েক বছরের রসদপত্র ভর্তি করে চারটা জাহাজ রওয়ানা হয়। তিন বছর পর একটি জাহাজ
ফিরে আসে। ঐ জাহাজের অধিকাংশ নাবিকই মারা যায়। যারা বেঁচে ছিলো তাদেরকে মানুষ
বলে মনেই হতো না। তাদের মাংস ও চুল খসে পড়ে। হাতের ও পায়ের আঙ্গুলে নখ ছিল
না। তাদের মাথার কোঠরে চোখ ঢুকে পড়েছে এবং তারা কুচকুচে কালো হয়ে গিয়েছিলো।
তারা যে প্রচন্ড গরমের কথা বলছিলো সে অনুযায়ী জাহাজ ও নাবিকদের পুড়ে যাওয়া থেকে
রক্ষা পাওয়াই ছিল আশ্চার্যজনক। তারা আরো বলছিল তারা কোনো বাড়ি বা মাটির দেখা
পাচ্ছিল না। এক সময় তাদের পক্ষে আর জাহাজ চালানো সম্ভব ছিল না, কেননা তারা যতই
এগুচ্ছিলো ততই গরম বাড়ছিলো আর সমুদ্র উত্তাল হচ্ছিলো। তাদের মনে হচ্ছিল তাদের অন্য
যে জাহাজ গুলো বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে তা আর ফিরে আসবে না।’’ এরকম ভয়াবহ
বিবরণ পড়ার পরও নাবিকরা নতুন নতুন অভিযানে বের হচ্ছিল। হেনরির জীবদ্দশায় পর্তুগিজ
নাবিকরা আফ্রিকার পশ্চিম উপক‚লের উত্তরাংশের অর্ধেকে অভিযান সম্পন্ন করেছিল এবং
গোল্ড কোস্ট (বর্তমান ঘানা) ও দাস ব্যবসার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইধৎঃযড়ষড়সবি উরধু নামে এক পর্তুগিজ নাবিক আফ্রিকার সর্ব দক্ষিণের
বিন্দুতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। তিনি যখন ওখানে পৌঁছেন তখন প্রচন্ড ঝড়ের কবলে
পড়েন। তাই ঐ স্থানের নাম দিয়েছিলেন “ঝড়ের অন্তরীপ’’। পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন এর
মধ্যে আশার আলো দেখতে পান এবং এর নাম রাখেন “উত্তমাশা অন্তরীপ’’। রাজা জন আরো
কিছু পরিকল্পনা করেন যেন উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে পর্তুগিজরা ভারতের দিকে রাস্তা খুঁজে পায়।
রাজা জনের উত্তরাধিকারী রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের আনুক‚ল্যে ভাস্কো-ডা-গামা নামক এক
নাবিক ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে এক অভিযানে বের হন। দিয়াজের পথ ধরে তিনি উত্তমাশা অন্তরীপ
অতিক্রম করেন, তারপর তিনি আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ায় পৌঁছেন।
এখানে এক আরব নাবিক তাঁকে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছুতে সহায়তা
করেন। ১৪৯৮ সালের মে মাসে ভাস্কো-ডা-গামা ভারতের কালিকটে পদার্পণ করেন এবং

ইউরোপ থেকে দূর প্রাচ্য পর্যন্ত পৌঁছার নতুন রাস্তা আবিষ্কারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য
একটি মার্বেল পাথরের স্মরণিকা তৈরি করেন। দুই বছর পর ডা-গামা পর্তুগালে ফেরত যান,
কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর বহরের অর্ধেক জাহাজ হারিয়েছেন, লোকজনের তিনভাগের একভাগ মারা
গেছে। কিন্তু অভিযানে অর্থ যত খরচ হয়েছিল তার ষাটগুণ বেশি অর্থ পাওয়া যায় জাহাজে
করে ভারত থেকে আনা দারুচিনি ও মরিচ পর্তুগালের বাজারে বিক্রি করে। রাজ্য ম্যানুয়েল
ভাস্কো-ডা গামার এ আবিষ্কারকে দ্রæত কাজে লাগালেন। ১৪০০ সালের পর থেকে পর্তুগিজ
বাণিজ্য জাহাজ নিয়মিতভাবে ভারতে আসা যাওয়া শুরু করে। পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে
খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরাও সাথী হয়। ভারতের গোয়ায় প্রথম পর্তুগিজ মিশনারি আস্তানা গড়ে
ওঠে। শীঘ্রই পর্তুগিজরা সিংহল, সুমাত্রা, জাভা এবং মশলার দ্বীপে তাদের বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ
করে। ১৪১৭ সালে তারা চীনের ক্যান্টনে উপস্থিত হয় এবং ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপানে প্রবেশ
করে।
স্পেনীয়দের আবিষ্কার
ডিয়াজের আবিষ্কারের পর পর্তুগিজরা এশিয়ায় যাওয়ার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ভেবে
পর্তুগালের প্রতি›দ্বী স্পেনীয়রা পশ্চিম থেকে অন্য রাস্তা বের করা যায় কি না তা নিয়ে চিন্তা
শুরু করে। ইতালীয় জেনোয়ার অধিবাসী কলম্বাস এ ব্যাপারে এক পরিকল্পনা পেশ করেন।
তাঁর ধারণা ছিল আটলান্টিকের ওপর পশ্চিমে নৌযান চালিয়ে গেলে তিনি ভারত এবং চীনে
পৌঁছাতে পারবেন। তাঁর পরিকল্পনার জন্য তিনি পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জনের আর্থিক
সহায়তা চান। কিন্তু পর্তুগিজরা তখন আফ্রিকা অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছার রাস্তা নিয়ে
বিভোর ছিলো। কলম্বাস তখন স্পেনের রাজার নিকট সাহায্যের হাত বাড়ান। কাস্তিলের রাণী
ইসাবেলা এবং তার স্বামী আরাগনের ফার্দিনান্দ এই সময় স্পেনের রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করে
স্পেনে মুসলমানদের শক্ত অবস্থান গ্রানাডা থেকে বিতাড়নে ব্যস্ত ছিলেন। তারপরও তারা
কলম্বাসের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে স্পেনীয় বন্দর পালোস
থেকে তিনটি ক্ষুদ্র জাহাজ, সাতাশি জন নাবিক এবং ক্যাথির রাজার জন্য একটি চিঠি নিয়ে
রওয়ানা হন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তিনি পশ্চিম দিকে যাচ্ছিলেন, এক সময় তার সঙ্গী
নাবিকেরা বিরক্ত হয়ে বিদ্রোহ করে বসে, কিন্তু তবুও কলম্বাস তার পরিকল্পনা নিয়ে একাগ্র
চিত্ত। অবশেষে ১২ অক্টোবর ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসের জাহাজ মাটিতে নোঙর করল। তিনি
কল্পনা করতে পারেননি তার আবিষ্কৃত স্থানটির নাম বাহামা, ভারত ও চীন থেকে হাজার হাজার
মাইল দূরে। তাঁর ধারণ ছিলো তিনি এশিয়ার উপক‚লের কোথাও পৌঁছেছেন। এরপর তিনবার
কলম্বাস তাঁর আবিষ্কৃত স্থানে, ব্যবসায়ী, ধর্ম প্রচারক ও উপনিবেশকারীদেরকে নিয়ে
এসেছিলেন। স্বর্ণ, মশলা অথবা সিল্কের কোনো সন্ধান তারা পেলেন না। যে অদ্ভুত মানুষের
সঙ্গে তিনি মিশেছেন আসলে তারা ছিল আদিম ক্যারিব, সুসভ্য ভারতীয় কিম্বা চীনা নয়।
তারপরও কলম্বাস তাদেরকে ইন্ডিয়ান বা ভারতীয় বলতেন। আর এই ভাবে আমেরিকার
আদিম অধিবাসীরা ইন্ডিয়ান নামে অভিহিত হতে থাকে।
সত্যি বলতে গেলে এটা বলা যাবে না যে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। কেননা
বিশেষজ্ঞরা এখন একমত যে পশ্চিম গোলার্ধে ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম পা রেখেছিল
ভাইকিংরা। এক হাজার খ্রিস্টাব্দে তারা বর্তমান নিউফাউন্ডল্যান্ড, লব্রাডার এবং সম্ভবত নিউ
ইংল্যান্ডে জাহাজ চালিয়ে পৌছেছিলেন। দ্বিতীয়ত কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন নি,

কারণ তিনি নিজেও জানতেন না তিনি কি আবিষ্কার করেছেন। এই ধারণা নিয়ে তিনি মারা
যান যে তাঁর আবিষ্কৃত এলাকা এশিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চল। কিন্তু এরপরও কলম্বাসের কৃতিত্ব
কোনোভাবেই èান হওয়ার নয়। আমেরিকায় ভাইকিংদের উপস্থিতি ইউরোপে শত শত বছর
ধরে অবজ্ঞা বা ভুলে যাওয়া হয়েছে। আর কলম্বাস যদিও তাঁর আবিষ্কারের পরিচয় পান নি,
কিন্তু শীঘ্রই তাঁর পথ ধরে অনেক নাবিক অভিযান করে বুঝতে পারেন তাঁর আবিষ্কার কি
ছিলো। কলম্বাস এশিয়ার মশলা সাথে করে নিয়ে আসেননি বটে, কিন্তু সামান্য পরিমান স্বর্ণ
এবং দু’একজন আদিম অধিবাসী ধরে এনেছিলেন। এগুলো প্রমাণ করে এলাকাটির ওপর
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রচুর সম্পদের অধিকারী এবং দাস ব্যবসার একটা উৎস খুঁজে
পাওয়া যাবে। ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দের সহায়তায় আরো কয়েকটি অভিযান পরিচালিত হয়
ঐ সম্ভাবনাকে সামনে রেখে। শীঘ্রই আমেরিকার মূল ভ‚খন্ড এবং দ্বীপসমূহ আবিষ্কৃত হয়।
যদিও কলম্বাস আমৃত্যু মানতে রাজি ছিলেন না। তারপরও ১৫০০ সাল নাগাদ সবার কাছে
প্রতিভাত হয় যে একটা নতুন পৃথিবী আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৫০৩ সালে আমেরিগো ভেসপুচি
নামে এক ইতালীয় নাবিক একটি চিঠিতে দাবি করেন যে তিনি এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার
করেছেন। আসলে তিনি ছিলেন মেডিসি ব্যাঙ্ক পরিবারের একজন এজেন্ট। স্পেন ও পর্তুগালে
তিনি মাঝে মাঝে সল্প সময়ের জন্য থাকতেন। চার বছর পর এক জার্মান অধ্যাপক ভূগোল
বিষয়ক এক নিবন্ধে প্রস্তাবনা করেন যে নতুন আবিষ্কৃত পৃথিবীর চতুর্থ ভাগকে আমেরিকা বলা
উচিত, কেননা আমেরিগো এটা আবিষ্কার করেছেন। আর এই ভাবে আটলান্টিকের অপর
পাড়ের ভ‚ভাগ একজন মিথ্যা দাবিকারীর নাম অনুসারে আমেরিকা চিরস্থায়ী হয়ে পড়ে। ১৫০০
শতাব্দী নাগাদ নতুন বিশ্ব আবিষ্কৃত হওয়ায় স্পেনীয় শাসকরা যতটা খুশি হওয়ার কথা ততোটা
হলেন না। তাঁরা নৌঅভিযানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। ইউরোপ আর এশিয়ার মধ্যবর্তী যদি
একটা বিরাট ভ‚মির অবস্থান হয় তাহলে স্পেন তার শত্রট্ট পর্তুগালের সঙ্গে মশলার
প্রতিযোগিতায় কিছুতেই পেরে উঠবে না। আর এদিকে যখন ১৫১০ সালে ভাস্কো নুয়েজি ডি
বালবোয়া পানামা দ্বীপের (রং ঃযরং সঁং) দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করলেন এবং দাবি করলেন যে
ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়ায় যেতে হলে একটা নয় বরং দু‘দুটো মহাসাগর (আটলান্টিক ও
প্রশান্ত মহাসাগর) পাড়ি দিতে হবে। তখন তাদের মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। ভাস্কো
নুয়েজি ডে বালবোয়া (াধংপড় ঘঁঁবু ফব ইধষনড়ধ) এরপরও ইসাবেলা ও ফার্দিনান্দের দৌহিত্র
রাজা চার্লস ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে ম্যাগেল্লানকে (গধমবষষধহ) নিয়োগ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা
ঘুরে এশিয়ায় পৌছা যায় কিনা তা দেখার জন্য। ম্যাগেল্লান বিশ্বাস করতেন আফ্রিকার সর্ব
দক্ষিণ বিন্দুটি ডিয়াজ এবং ডা গামা যেমন অতিক্রম করতে পেরেছিলেন তিনিও তেমনি দক্ষিণ
আমেরিকার কেন্দ্রটি ঘুরতে পারবেন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি আটলান্টিক অতিক্রম করেন, পরে
দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে তার নাম বহনকারী প্রণালী অতিক্রম করেন। তারপর তিনি তিয়েরা
ডেল ফুয়ে গো (ঞরবৎৎধ ফব ঋঁবমড়) থেকে প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে নব্বই দিন পর
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামে উপস্থিত হন। সেখান থেকে আরো সাতদিনের অভিযান
চালিয়ে তার নাম দেয়া দ্বীপপুঞ্জ সেন্ট লাজরাসে (ঝঃ. খধুৎঁং) উপস্থিত হন। এই দ্বীপপুঞ্জের
পরবর্তী নাম হয় ফিলিপাইন। ম্যাগেল্লান (গধমবষষধহ) স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত
হন। কিন্তু তাঁর একটি জাহাজ পর্তুগিজদের আবিষ্কৃত রাস্তায় ভারত মহাসাগর এবং উত্তমাশা
অন্তরীপ ঘুরে ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে পৌঁছে। এই প্রথম জাহাজে করে পৃথিবী পরিক্রমার
ঘটে।

মধ্য আমেরিকা ও কনকুইসটাডোর অভিযানকারী (পড়হয়ঁরংঃধফড়ৎবং)
যদিও স্পেনীয়দের চোখে এশিয়ায় পৌঁছার জন্য আমেরিকা ছিল একটি প্রতিবন্ধক, ক্রমেই
তারা বুঝতে পারল নতুন বিশ্ব সম্পদে পরিপূর্ণ। কলম্বাস সামান্য কিছু স্বর্ণ নিয়ে এসেছিলেন,
এর সঙ্গে গুজবের সংমিশ্রণে স্পেনে একটা ধারণা জন্মে যে সেখানে প্রচুর স্বর্ণ আছে। কিছু
দুঃসাহসী স্পেনীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বর্ণের লোভে অভিযান শুরু করে এবং ছলেবলে কল্পনার
অতীত স্বর্ণ হস্তগত করে। ১৫১৯ থেকে ১৫২১ সালে পর্যন্ত হারনাদো কর্তেজ (ঐবৎহধফড়
ঈড়ৎঃবং) নামক একজন কনকুইস্তাদোর (স্পেনীয় ভাষায় ঈড়হয়ঁরংঃধফড়ৎবং মানে
অভিযানকারী) ছয়শত লোক, সাতটা কামান এবং তেরটি ঘোড়া নিয়ে আজতেক সাম্রাজ্য
মেক্সিকো আক্রমণ করে। আজটেকরা কামান বা ঘোড়া ইতিপূর্বে দেখে নি। ঘোড়া দেখে তারা
ভয় পেয়ে যায়। তারা মনে করেছিল ঘোড়ার চালক এবং ঘোড়া এক সঙ্গে এক অদ্ভুত জন্তু।
এক মিলিয়ন আজটেক খুব সহজে পরাজিত হয় এবং কর্তেজ তাদের জমানো সমস্ত সম্পদ
লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেক কনকুইসটাডোর ফ্রান্সিসকো পিজারো
(ঋৎধহপরংপড় চরুধৎৎড়) মাত্র একশত আশি জন যোদ্ধা দিয়ে ইনকাদের সাম্রাজ্য আক্রমণ করে
পেরু অধিকার করে নেয়। বন্দী ইনকা-রাজা স্পেনীয়দেরকে তাদের চাহিদা মতো স্বর্ণ দিতে
রাজি হয়। স্বর্ণ নেওয়ার পর তারা রাজাকে হত্যা করে এবং আরো স্বর্ণ পাওয়ার জন্য
ইনকাদেরকে দাস বানাতে শুরু করে। এই দুই কনকুইস্তাদোর শুধুমাত্র কামান ও ঘোাড়ার
কারণে জয়ী হয় নি, তাদের সাহস, বিশ্বাসঘাতকতা ও নৃশংসতা তাদেরকে জয় এনে
দিয়েছিলো। এবং এর আেেগ এত অল্প লোক এতো বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এতো বিশাল
এলাকা দখল করে নি এবং এতো নৃশংসতা ও বর্বরতাও প্রদর্শন করে নি।
কর্তেজ, পিজারো ও অন্যান্য কনকুইস্তাদোরগণ তাদের নিজেদের স্বার্থে অভিযান চালিয়েছিলো,
স্পেনের জন্য নয়। তারা জানত কি করে লুণ্ঠন করতে হয়, উৎপাদন করে সম্পদ আহরণ করা
তারা জানত না। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্য ভাগে স্পেনের রাজা মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার
(ব্রাজিল বাদে, ওটা ছিল পর্তুগিজদের উপনিবেশ) উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মূল্যবান
ধাতব দ্রব্য লুণ্ঠন নয় বরং খনি থেকে উত্তোলন করে তা তারা স্পেনে পাচার করতে শুরু করে।
স্বর্ণ যদিও সবার আরাধ্য ছিল, কিন্তু স্পেনীয়রা এর সন্ধান কমই পেয়েছে। স্থানীয় সভ্যতার
আমলে স্বর্ণ প্রচুর উত্তোলিত হয়েছিল। শীঘ্রই স্পেনীয়রা বুঝতে পারলো বলিভিয়া এবং
মেক্সিকো এলাকায় তারা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রোপ্য খনির উপর বসে আছে। আরো জোর করে
শ্রম আদায় এবং পূর্বের তুলনায় উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা এত রোপ্য উত্তোলন
করেছিল যে স্বর্ণ না পাওয়ার শোক তারা ভুলতে পেরেছিলো। গো-মহিষের এবং ইক্ষুর খামার
প্রতিষ্ঠা করেও তারা প্রচুর লাভবান হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্য ভাগ সময়ে ইউরোপীয়রা পৃথিবীর আকার, প্রকৃতি, সমুদ্র, বড় বড় মহাদেশ
গুলোর অবস্থান এবং আফ্রিকা ও আমেরিকায় যাওয়ার দুটো রাস্তা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা
লাভ করে। ইউরোপীয় বাণিজ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলো। ভ‚মধ্যসাগরের পরিবর্তে
আটলান্টিক এখন পশ্চিমা দেশগুলোর অর্ন্তদেশীয় সমুদ্রে পরিণত হলো।

সারসংক্ষেপ
ভারত ও চীনের মশলা, স্বর্ণ, সিল্ক ইত্যাদির সন্ধানে ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক অভিযান শুরু হয়।
অসংখ্য নাবিক প্রচন্ড ধৈর্য, সাহস, বুদ্ধি এবং মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে মহাসমুদ্রের নৌকায় পাল
তুলেছে। দিয়াজ, ভাস্কো দা গামা, কলম্বাস, ম্যাজেল্লান প্রমুখ নাবিকদের প্রচেষ্টায় শুধু এশিয়ায় আসার
পথই আবিষ্কৃত হয় নি, ইউরোপ নতুন এক বিশ্বের সন্ধান লাভ করেছে। এখানকার সম্পদ ও কর্তৃত্ব
ক্রমেই ইউরোপকে সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রকের আসনে বসিয়েছে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার করেন
(ক) হেনরি নেভিগেটর (খ) কর্তেজ
(গ) কলম্বাস (ঘ) দিয়াজ
২। ভাস্কো দা গামা কালিকটে পৌঁছান
(ক) ১৪৯৮ সালে (খ) ১৫৯৮ সালে
(গ) ১৬৯৮ সালে (ঘ) ১৭৯৮ সালে
৩। স্পেনীয়রা উৎসাহী ছিল
(ক) আমেরিকায় পৌঁছানোর জন্য (খ) জাপানে পৌঁছানোর জন্য
(গ) ভারতে পৌঁছানোর জন্য (ঘ) ল্যাটিন আমেরিকায় পৌঁছানোর জন্য।
৪। কলম্বাস ’’ইন্ডিয়ান’’ নাম দিয়েছিলেন
(ক) আমেরিকার আদি অধিবাসীদের (খ) ভারতীয়দের
(গ) চীনাদের (ঘ) আরবদের
রচনামূলক প্রশ্ন
১। কলম্বাস কী ভাবে আমেরিকা আবিষ্কার করেন
২। আমেরিকা আবিষ্কার কীভাবে স্পেনীয়দেরকে ভারতে না পৌঁছানোর দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছিলো
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (ঘ), ২। (ক), ৩। (গ), ৪। (ক)।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ভৌগোলিক আবিষ্কারে ম্যাগগিলানের অবদান মূল্যায়ন করুন।
২। কনকুইস্তাদোরগণ কিভাবে সম্পদশালী হয়েছিলেন বর্ণনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]