ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপের একাকীকত্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। সমুদ্রপথে
ইউরোপের সঙ্গে দূরপ্রাচ্য এবং আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো। অর্থনৈতিক ও
ব্যবসায়িক যে পরিবর্তন ইউরোপ প্রত্যক্ষ করলো তাকে ঐতিহাসিকেরা বলেছেন “বাণিজ্যিক
বিপ্লব’’।
বাণিজ্যিক কেন্দ্রের পরিবর্তন
ভৌগোলিক আবিষ্কারের পূর্বে-ইউরোপের সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিল ভুমধ্যসাগর কেন্দ্রিক। এখন
তা পরিবর্তিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চলকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। এটি গড়ে ওঠে নতুন
নতুন ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে। ইতালীয় শহর ভেনিস ও জেনোয়া দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যে
তার পূর্ব প্রাধান্য বজায় রাখতে পারলো না দুটো কারণে। প্রথমত: ত‚র্কি মুসলমানদের কর্তৃত্বে
ভ‚মধ্যসাগরের পথ মুসলমানদের অধীনে আসলে দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে ভেনিস ও জেনোয়ার
যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত: পর্তুগিজ এবং স্পেনীয়দের আবিষ্কত উত্তমাশা
অন্তরীপ হয়ে ভারতে পৌঁছার রাস্তা আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতালীয় শহরগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার
মুখে পড়ে। এখন অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা ভেনিস ও জেনোয়ায় না গিয়ে পণ্যের জন্য
লিসবন ও সেভিলে যেতে শুরু করল। অবশ্য পর্তুগাল ও স্পেনের বাণিজ্যিক প্রাধান্য বেশি
দিন রইল না, ক্রমেই হল্যান্ড ও ফ্রান্স ইউরোপীয় বাণিজ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল।
খ) নতুন নতুন পণ্য ও শস্যের প্রচলন
মশলা আর সিল্ক আনার প্রয়োজনে ইউরোপ যখন ভারতে আসার পথ খুজঁতে শুরু করে তখন
ভৌগোলিক আবিষ্কারের শুরু। দুর্ঘটনাক্রমে তারা ভারতে না এসে আমেরিকায় পৌঁছে যায়।
কালক্রমে ইউরোপের কাছে আমেরিকার আবিষ্কার এশিয়ায় আসার পথ থেকে অনেক
গুরুত্বপূর্ণ ও সূদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে। আমেরিকায় এমন কিছু কৃষিজপণ্য ছিল যা কোনো দিন
ইউরোপ দেখে নি। যেমন তামাক, ভুট্টা, টমেটো, গোলআলু, বাদাম, রাবার ইত্যাদি।
ইউরোপে গরিব মানুষের খাবার হিসেবে আলু ও ভ‚ট্টা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ইউরোপীয়রা
এক ধরনের খেলার বল দেখলো যা মাটিতে পড়ে লাফিয়ে ওঠে। ইউরোপীয়দের খেলার বল
ছিল কাঠ ও চামড়ার তৈরি। আমেরিকান বলগুলো ছিল রাবারের তৈরি। রাবার ইউরোপীয়দের
নিকট ছিল অজানা। অবশ্য ইউরোপীয়রা এই আবিষ্কারকে কাজে লাগাতে পারল তিনশত
বছর পর। অর্থাৎ উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়াটার প্রæফ কাপড় ও জুতো বানাতে তারা ব্যাপক
হারে রাবার ব্যবহার শুরু করল। ইউরোপীয়রা তাদের দেশ থেকে নিয়ে আমেরিকায় ঘোড়া,
গাধা, শুকর, ভেড়া, হাঁসমুরগী, লেবু, কমলা, কলা, জলপাই ইক্ষু ইত্যাদির প্রচলন করে।
আমেরিকায়এগুলো এক সময় অতিরিক্ত উৎপাদন হয়ে ইউরোপে রফতানি হতে থাকে।
দূরপাচ্য থেকে আনা মশলা ও সিল্ক আগে ইউরোপীয় ধনীরাই ব্যবহার করত। কিন্তু সস্তা
হওয়ায় অনেকে এসব ব্যবহার শুরু করল। ভারত থেকে উন্নত মানের কাপড়ও ইউরোপে
আসতে শুরু করল, আর ইউরোপীয়দের পরিধেয় পোশাক পূর্বের তুলনায় লম্বা ও বিস্তৃত হওয়া
শুরু করলো। পূর্বাঞ্চল থেকে নানা সুগন্ধী ইউরোপে প্রবেশ করলো। এসব সুগন্ধী
ইউরোপীয়রা তাদের কাপড়ে, শরীরে, চুলে মাখত যেন শরীরের দুর্গন্ধ দূর হয়। কেননা
ইউরোপীয় অভিজাতরাও মাসে একবার বা দুবারের বেশি গোসল করত না। বাণিজ্যে বড় বড়
জাহাজ ব্যবহারের প্রচলন শুরু হলে জাহাজে প্রচুর জায়গা প্রায়ই খালি থাকত। প্রচলিত পণ্য-
সামগ্রী ছাড়াও এসব জায়গা পরিপূর্ণ করে তারা অনেক নতুন নতুন জিনিস ইউরোপে নিয়ে
এলো। চীন থেকে চা, পূর্ব আফ্রিকা থেকে কফি ইত্যাদি।
গ) উপনিবেশ স্থাপন
ভৌগোলিক আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের সূচনা করে। ইউরোপীয়
অভিযানের মুখে গোত্রে গোত্রে বিভক্ত আমেরিকার স্থানীয় অধিবাসীরা একত্রিত হতে
পারলোনা। তাদের অস্ত্রশস্ত্র-ও ইউরোপীয়দের তুলনায় ছিল অনুন্নত এবং অতি পুরাতন। ফলে
ইউরোপীরা তাদেরকে পরাভ‚ত করে সহজেই তাদের জায়গা দখল করে নেয়। ইউরোপীয়
আধিপত্যের জন্য আমেরিকার জনগণকে অপরিসীম মূল্য দিতে হয়েছে। যদিও সঠিক হিসাব
পাওয়া কঠিন তবুও হিসপানিওলা দ্বীপে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্থানীয় জনগণের আনুমানিক সংখ্যা
ছিল ২৫০,০০০ জন, তা কয়েকবছর পর ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়ায় মাত্র-৫০০তে। স্পেনীয়
শাসনের একশ বছরে মেক্সিকোর জনসংখ্যা ২০ শতাংশ কমে যায়। অবশ্য ইউরোপীয়দের
কঠোর দমন নীতিই জনসংখ্যা কমে যাবার একমাত্র কারণ নয়। ইউরোপীয়রা অনেক নতুন
রোগ যেমন, গুটিবসন্ত, হাম ইত্যাদির জীবাণু আমেরিকায় নিয়ে আসে যা স্থানীয় লোকদের
পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় নি। মহামারী আকারে এই সব রোগ অসংখ্য মানুষের জীবন
কেড়ে নেয়। কিন্তু অসংখ্য নিরপরাধ লোকের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে দখলদারদের নির্দয়
শোষণের কারণে। শ্রমিকদের এত কঠোর পরিশ্রম করতে তারা বাধ্য করেছে যে অনেকে
ক্লান্তিতে এবং যতেœর অভাবে মারা গেছে। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের ক্যারিবীয়দেরকে স্পেনীয়
উপনিবেশকারীরা এত নৃশংসভাবে শোষণ করে যে পুরো জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এশিয়ায়
উপনিবেশ স্থাপন করতে এসে ভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয় এশিয়ার শাসকরা
শক্তিশালী ছিলেন, তাদের সেনাবাহিনী সুসংগঠিত ও উন্নততর অস্ত্রশস্ত্রে র অধিকারী। তাই
এখানে ইউরোপীয়রা আমেরিকানদের যেভাবে সরাসরি যুদ্ধ করে পরাজিত করেছিল সেভাবে
এশিয়োদের পরাজিত করার আশা করে নি। এশিয়ায় প্রথমে তারা বাণিজ্যের নামে ঘাটি স্থাপন
করে। যখন ক্রমান্বয়ে নিজেদেরকে তারা শক্তিশালী বোধ করতে শুরু করল তখন তারা আস্তে
আস্তে বিভিন্ন এলাকা দখল করলো। কখনো কখনো তারা ককোন স্থানীয় শাসকের সঙ্গে এই
মর্মে চুক্তি করলো যে ইউরোপীয়রা ঐ শাসককে তার শত্রট্টর বিরুদ্ধে সাহায্য করবে, বিনিময়ে
তাদেরকে কিছু জায়গা ছেড়ে দেবে।
উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ পর্তুগাল, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও
ইংল্যান্ড প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। উপনিবেশ নিয়ে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড কয়েক শতাব্দী ধরে
শত্রট্টতা এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
ঘ) দাস ব্যবসা
ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে দাস প্রথা চালু না থাকলেও পর্তুগিজরা এবং স্পেনীয়রা যখন
আফ্রিকায় এবং এশিয়ায় যায় তখন তারা দেখতে পায় ঐ সমস্ত সমাজে দাস প্রথার বেশ
প্রচলন রয়েছে। আমেরিকায় পর্তুগীজ এবং স্পেনীয় উপনিবেশকারীদের সংখ্যা ছিলো কম,
তাছাড়া বিস্তৃর্ণ এলাকায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে বিশাল পাহাড়
ডিঙ্গিয়ে রাস্তাঘাট, ইমারত নির্মাণ, মাটি খুঁড়ে স্বর্ণ রোপ্য উত্তোলন ইত্যাদির জন্য তাদের
আমেরিকার আবহাওয়ায় কাজ করার উপযোগী প্রচুর সস্তা শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। এই ভাবে
ক্রীতদাস প্রথায় তারা জড়িয়ে পড়ে, আর ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, মেক্সিকো, পেরু এবং ব্রাজিলের
জনগণকে ধরে তারা দাস বানিয়ে কঠোর পরিশ্রমে বাধ্য করতে থাকে। এক সময় খ্রিস্টান
মিশনারীদের চাপে এবং মানবতাবাদীদের চেষ্টায় আমেরিকান ইন্ডিয়ানদেরকে দাস বানানোর
প্রচেষ্টা বন্ধ হয়। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত মিশনারি বিশপ ইধৎঃড়ষড়সব ফব ষধং ঈধংধং
অনুরোধে স্পেনের রাজা আফ্রিকা থেকে দাসদেরকে আমেরিকায় আনতে শুরু করেন। তাঁর
যুক্তি ছিল আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের তুলনায় আফ্রিকানরা শ্রমের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত।
পর্তুগিজদের কর্তৃত্বে আফ্রিকান ক্রীতদাসদেরকে আমেরিকায় পাঠানোর পেছনে সস্তায় শ্রম
পাওয়া ছাড়াও তারা এদেরকে খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষা দিতে পারবে এমন একটি কারণও কাজ
করেছিলো। ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের রাজা তার অধীনস্থ নেদারল্যান্ডের একজনকে বছরে
৪,০০০ নিগ্রোকে ওয়েষ্ট ইন্ডিজে প্রেরণ করার একটি অনুমতি পত্র প্রদান করেন। ঐ ব্যক্তি
পরে ঐ অনুমতিপত্র জেনোয়ার এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন। ব্যবসায়ীরা
পর্তুগিজদের থেকে দাস কিনে নিয়ে আমেরিকায় পাঠাতো। এইভাবে পর্তুগিজদের অধীন
আফ্রিকান এলাকা থেকে স্পেনীয় কর্তৃত্বাধীন আমেরিকায় দাস পাঠানোর ব্যবসা নিয়মিত ভাবে
শুরু হয়।
আমেরিকায় বড়ো খামারের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দাস ব্যবসার পরিমানও বাড়তে থাকে।
এক হিসাব মতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বছরে গড়ে ৭৫,০০০ থেকে ৯০,০০০ হাজার দাসকে
আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় নেয়া হয়েছিলো। ব্যবসায়ীরা সাধারণত: কাপড়, ধাতব
দ্রব্য, বন্দুক ইত্যাদির বিনিময়ে দাসদেরকে কিনে নিতো।
ঙ) বাণিজ্যবাদ
ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে ইউরোপের রাষ্ট্রনীতিতে এক অর্থনৈতিক মতবাদের প্রভাব সূচিত
হলো। বাণিক বাদ বা মার্কেন্টালিজম নামের এই মতবাদের মানে হলো সরকার রাষ্ট্রের স্বার্থে
অর্থনীতিকে বিশেষ করে ব্যবসা ও শিক্ষাকে এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে যেন দেশ
স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে। ভৌগোলিক আবিষ্কার ইউরোপীয় দেশগুলোর সামনে
সীমাহীন সম্পদের দ্বার খুলে দিলো, প্রত্যেক রাজা চাইলেন তার দেশ ও জনগণ এ সুযোগ
থেকে কতটা লাভবান হতে পারে। মতবাদটি নতুন কোনো মতবাদ নয়। ষোড়শ শতাব্দীর
পূর্বে নগর সরকার তার নাগরিকদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত¡বধান করত,
ব্যবসায়ীদের গিন্ড এবং কারিগরদের গিল্ডের মাধ্যমেএই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হতো।
কিন্তু ষোড়শ শতকের মার্কেন্টা লিজমের প্রভাবে এর বিস্তৃতি শহর থেকে রাষ্ট্র সরকারের হাতে
চলে যায়, স্থানীয় গিন্ডের পরিবর্তে রাজা এখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।
যেমন পর্তুগালের রাজা দূর প্রাচ্যের ব্যবসার একচ্ছত্র আধিপত্য বা মনোপলি কায়েম করেন
লিসবনের উপকারের জন্য নয়, বরং পুরো পর্তুগিজ জাতির উন্নতি এবং সমৃদ্ধির জন্য। অন্যান্য
রাজাদের একই রকম উদ্দেশ্য ছিল, তারাও চাইছিলেন তাদের নাবিকরা এবং ব্যবসায়ীরা
পর্তুগিজ এবং স্পেনীয়দের মনোপলি ভেঙ্গে দেশের জন্য প্রচুর সম্পদের ব্যবস্থা করুক।
বণিকবাদের কতগুলি বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রথমত: এই মতবাদ মূল্যবান ধাতব পদার্থ জমা রাখার
উপর বিশেষ জোর দিতো। মনে করা হতো একটা দেশের যত বেশি স্বর্ণ ও রৌপ্য থাকবে
দেশটি তত বেশি শক্তিশালী হবে। দ্বিতীয়ত: কোনো দেশ যদি মূল্যবান ধাতব দ্রব্যের
অধিকারী না হয় বাণিজ্যের মাধ্যমে তা তাদেরকে সংগ্রহ করতে হবে। ঐ দেশকে আমদানির
তুলনায় প্রচুর রফতানি করতে হবে যাতে করে বিদেশীরা স্বর্ণ রাজ্যের মাধ্যমে তা পরিশোধ
করে। আমদানি করা হবে শুধু মাত্র এমন দ্রব্য যা দেশে উৎপন্ন হয় না, আমদানির পর ঐ
গুলোকে পণ্যে রুপান্তরিত করে আবার রফতানী করা হবে। তৃতীয়ত: প্রত্যেক দেশ
কাঁচামালের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া উচিত, তা না হলে তাকে উপনিবেশ স্থাপনের দিকে
যাওয়া উচিত যেন প্রতিদ্ব›িদ্ব দেশের তুলনায় ঐ দেশ মূল্যের দিক থেকে সুবিধাজনক ভাবে
অবস্থান করে। উপনিবেশ থাকার আরো একটা লাভ হলো ঐগুলো প্রস্তুত দ্রব্যের অবাধ বাজার
হবে। চতুর্থত: উপনিবেশগুলিকে নিরাপত্তা দিতে হবে, প্রয়োজনে শক্তিশালী নৌবহর গঠন করে
বিদেশীদের যাতে বাজার বা কাঁচামালের উৎস বানাতে না পারে তার জন্য বাঁধা দিতে হবে।
উপনিবেশ গুলোতে এমন উৎপাদনে যাওয়া উচিত হবে না যাতে করে মূলদেশের কারখানা বা
বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মার্কেন্টাইলজিমের প্রভাবে ইংল্যান্ড তার কাঁচা উল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিলো যেন
ইংল্যান্ডের নিজস্ব উল শিল্প বিকশিত হয়। স্পেন ও পর্তুগাল তাদের সাম্রাজ্যে বিদেশী
বণিকদের প্রবেশ বা বাণিজ্য নিষেধ করার চেষ্টা করেছিলো।
ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের প্রসারের ফলে বাণিজ্যিক সহায়তাপ্রদানকারী
প্রতিষ্ঠানের যেমন ব্যাংক, জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানি, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। ব্যাংকের
অস্তিত্ব মধ্যযুগেও থাকলেও গির্জা সুদকে ঘৃণা করায় এ ব্যবসাটা মূলত: ইহুদীদের হাতে ছিল।
কিন্তু মধ্যযুগের শেষের দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার লাভ করায় খ্রিস্টানদের মধ্যে ব্যাংক
ব্যবসা চালু হয়। তবে তাদের মধ্যে প্রথম ব্যাংক গড়ে উঠে পারিবারিক পর্যায়ে। চর্তুদশ ও
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সের মেডিসি পরিবার এবং জার্মানির অগমবার্গের ফাগার পরিবার
উল্লেখযোগ্য ব্যাংকার হিসাবে আর্বিভ‚ত হয়। পরে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে আরো ব্যাংক
প্রতিষ্ঠিত হলো। এখন হল্যান্ডের শহর এ্যামষ্টারডামের একজন ব্যবসায়ী ব্যাংক অব
এ্যামষ্টারডামের টাকা জমা দিয়ে ইরষষ ড়ভ ঊীপযধহমব ইস্যু করিয়ে নিলো। পরে সে ভেনিসের
ব্যবসায়ী থেকে মালামাল ক্রয় করল। ভেনিসের ব্যবসায়ী ইরষষ ড়ভ ঊীপযধহমব নিজস্ব ব্যাংকে
জমা দিয়ে তার প্রাপ্য টাকা উঠিয়ে নিতে পারল। ব্যাংক দুটি পরে নিজেদের মধ্যে
সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের লেনদেন মিটিয়ে নিলো। প্রথমে এই ব্যবস্থা ইতালিতে শুরু হয়
এবং তা ক্রমে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ল।
আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটায় আমেরিকা থেকে আগত মূল্যবান ধাতুর সরবরাহ
ইউরোপে বেড়ে যায়। কিন্তু তারপরও চাহিদা সরবরাহের সঙ্গে তাল মিলাতে পারছিলো না।
ফলে ব্যাংকগুলো চেক (ঈযবয়ঁব) ব্যবস্থার প্রবর্তন করল। ব্যাংকের জমা অর্থের বিপরীতে
একজন ব্যবসায়ী চেক ইস্যু করতে পারতো। অন্য ব্যবসায়ী টাকার মতো মূল্য দিয়ে তা গ্রহণ
করে লেনদেন করত। এ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় নগদ অর্থ লেনদেনের পরিবর্তে চেক ব্যবস্থায়
বাণিজ্য প্রসারিত হলো।
দূরদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্য চালিয়ে যেতে প্রয়োজন পড়ল প্রচুর পুঁজি, যা একজন ব্যবসায়ীর
পক্ষে প্রায়ই জোগাড় করা সম্ভব হতো না। এখন আবির্ভূত হলো জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানি। এর
মাধ্যমে অসংখ্য লোকের কাছ থেকে ক্ষুদ্র টাকার শেয়ারের মাধ্যমে বিশাল পুঁজি সংগৃহীত
হওয়া শুরু হলো। যারা কোম্পানির শেয়ার কিনতো তারা কোম্পানির কাজে অংশ গ্রহণ
করতো, অথবা করতো না। কেউ না করলেও সে ব্যবসার যৌথমালিক এবং বিনিয়োগকৃত
শেয়ারের অনুপাতে লভ্যাংশ ভোগ করতো। কোন মালিক তার শেয়ার পণ্য দ্রব্যের মতো
হস্তান্তর করার অধিকারী ছিল।
বীমার ব্যবহারও ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো। সাধারণত: বীমার স্থিতিকাল ছিল
নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। যেমন একটি জাহাজ সাফল্যজনকভাবে গন্তব্যে পৌঁছার সময়কাল
ব্যাপী। জাহাজ ছাড়া মালামাল, জীবন ইত্যাদির উপরও ক্রমেই বীমার প্রচলন শুরু হয়।
সারসংক্ষেপ
ভৌগোলিক আবিষ্কার যে বাণিজ্য বিপ্লব বয়ে আনলো তার ফলাফল বিশ্বের জন্য ছিল সুদুরপ্রসারী।
ইউরোপে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপিত হলে, নতুন বাণিজ্যে শহর বিকশিত হলো, ব্যবসায়ে সহায়তাকারী
কতগুলি প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানি, বীমার আবির্ভাব ঘটলো, বিভিন্ন দেশ থেকে
নতুন পণ্য ইউরোপে প্রবেশ করায় ইউরোপীয়দের প্রচুর লাভ ও জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বেড়ে গেলো।
কিন্তু ভৌগোলিক আবিষ্কার এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার জনগণের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষৎ নিয়ে
এলো। ক্ষমতাধর ইউরোপীয়রা এসব এলাকার অনুন্নত জনগণের শুধু ভ‚মিই ত্মসাৎ করলো না, বরং
তাদেরকে দাস বানিয়ে দেশান্তরীত করে তারা তাদের মুনাফার পরিমান আরো বাড়িয়ে তুলেছিলো।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। বাণিজ্যিক পথ পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হলো -
(ক) ভ‚মধ্যসাগরীয় এলাকাগুলো (খ) আটলান্টিক মহাসাগরীয় এলাকাগুলো
(গ) প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাগুলো (ঘ) ভারত মহাসাগরীয় এলাকাগুলো।
২। রাবার আবিষ্কারের পর ইউরোপীয়রা তা ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করে -
(ক) সপ্তদশ শতাব্দীতে (খ) অষ্টাদশ শতাব্দীতে
(গ) উনবিংশ শতাব্দীতে (ঘ) বিংশ শতাব্দীতে
৩। ইউরোপীয়রা যে দুটি রোগ আমেরিকায় নিয়ে যায় তা হলো -
(ক) গুটিবসন্ত ও হাম (খ) কলেরা ও জল বসন্ত
(গ) টাইফয়েড ও ইনফ্লুয়েঞ্জা (ঘ) আমশা ও উদরাময়।
৪। ইউরোপীয়রা কোন এলাকার জনগণকে সহজে পরাজিত করতে পারে নাই -
(ক) আমেরিকা (খ) আফ্রিকা
(গ) অষ্ট্রেলিয়া (ঘ) এশিয়া।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বণিকবাদ বা মার্কেন্টালিজম সম্পর্কে আলোচনা করুন
২। ভৌগোলিক আবিষ্কার কীভাবে ব্যাঙ্ক, জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানি বিকাশে সহায়তা করেছে তা
আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (ক), ২। (গ), ৩। (ক), ৪। (খ)।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপ কীভাবে লাভবান
হয়েছিলো?
২। ইউরোপীয় আধিপত্যে আমেরিকা ও আফ্রিকার জনগণের উপর কী ধরনের প্রভাব বিস্তার
করে ছিলো?
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত