ক্যালভিনের ধর্ম রাজ্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন।
ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কারের উপর আলোচনা করুন।


মার্টিন লুথারের আন্দোলন জার্মানির বাইরে সামান্য এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।
১৫২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শুধুমাত্র ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং সুইডেনে লুথারের মতবাদকে রাষ্ট্রীয়
ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। স্ক্যানডেনেভিয়ার এই রাষ্ট্রগুলোতে আজও লুথারের
মতবাদ ধর্ম হিসেবে বিরাজমান। ইউরোপের অন্যান্য স্থানে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন প্রভাব
বিস্তার করলেও তা ছিলো লুথারের মতাদর্শের চেয়ে আলাদা। কোথাও মনে করা হয়েছে
লুথারের বক্তব্য খুবই চরমপন্থী, যেমন ইংল্যান্ডে এ্যাঙ্গলিকানিজম নামে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো
তা ছিল প্রোটেস্টান্ট মতবাদ ও ক্যাথলিক মতবাদের সমন্বয়ে মধ্যবর্তী একটি ধর্মমত। কোথাও
আবার যেমন সুইজারল্যান্ডের কতগুলি শহরে লুথারের মতবাদের বাইরে আরো চরমপন্থী
প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্যালভিন
চরমপন্থী প্রোটেস্টান্ট ধর্মীয় মতবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্যালভিনের মতবাদ।
ক্যালভিন ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের পিকার্জি প্রদেশের নয়োন নামক স্থানে এক মধ্যবিত্ত
পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি প্যারিস নগরীতে পড়াশুনা করেন, এই সময় ধর্ম এবং
সাহিত্যে তিনি বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। উনিশ বছর বয়সে বাবার ইচ্ছানুসারে তিনি
যাজক না হয়ে আইনজ্ঞ হওয়ার জন্য কয়েক বছর আইন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। ১৫২৯
খ্রিস্টাব্দে তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। ফ্রান্সে প্রোটেস্টান্ট মতবাদের তেমন প্রসার
না হলেও সেখানে গির্জার অবস্থা নিয়ে অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন। অসংখ্য ফরাসি নাগরিক
চাচ্ছিলেন সঠিক শিক্ষা, খাঁটি নৈতিকতা এবং আন্তরিক প্রচারণা দ্বারা ধর্মের অবস্থান পরিবর্তিত
হোক। কোন পথে ধর্মের পরিবর্তন আসবে অর্থাৎ প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করে, না রোমের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত ছিল না। এমতাবস্থায় ক্যালভিন অন্তরে অনুভব
করলেন যে ঈশ্বর তাঁকে ক্যাথলিক মতবাদ ত্যাগ করে সত্যিকারের খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার জন্য
ডাকছেন। সত্যিকার ভক্তি ও ঈশ্বরানুরাগ লাভের জন্য তিনি এতই উদ্বেলিত হয়ে উঠেন যে
তিনি পড়ালেখা ত্যাগ করে প্রোটেস্টান্ট মতবাদের প্রচারক হয়ে পড়েন। যদিও তিনি সবেমাত্র
রোমের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন এবং তার মতাদর্শ পরিপূর্ণভাবে তখনো বিকশিত করতে

পারেন নি, তবুও দলে দলে লোক ধর্মজ্ঞান লাভ করার জন্য তাঁর নিকট আসতে লাগল। ওই
সময় ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস তাঁর প্রজাদের মধ্যে কোনো রকম ক্যাথলিক মতাদর্শের
বিরোধিতা সমূলে উৎপাটন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। ক্যালভিন ফ্রান্স থেকে পালিয়ে
সুইজারল্যান্ডের শহর বেসেলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ওখানে বসে ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে “দ্যা
ইনস্টিটিউট অব দ্যা খ্রিস্টান রিলিজয়ন’’ (ঞযব ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঃযব ঈযৎরংঃরধহ জবষরমরড়হ) গ্রন্থ
প্রকাশ করেন। মার্টিন লুথার তাঁর ধর্মতত্ত¡গুলো নিয়মাবদ্ধ বা সূত্রাবদ্ধ করেন নি, বরং যখন
সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তখন তার সমাধান দিয়েছেন। কিন্তু ক্যালভিন তাঁর গ্রন্থে
প্রোটেস্টান্ট মতবাদের সকল নিয়মরীতি যৌক্তিক, ধারাবাহিক এবং বোধগম্য করে উপস্থাপন
করেছেন। ক্যালভিনের “ইনস্টিটিউট’’ গ্রন্থটিকে মধ্যযুগের সেন্ট থমাস এ্যাকুইনাসের (১২২৬-
১২৭৪ খ্রি) “সুমা থিউলজিকা’’ (ঝঁসসধ ঞযবড়ষড়মরপধ) ‘ধর্মতত্তে¡র প্রধান প্রধান কথা’
সমপর্যায়ের ধর্মতত্তে¡র গ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়।
ক্যালভিনের ধর্মতত্ত¡
ক্যালভিনের ধর্মীয় মতবাদের মূলে রয়েছে সর্বশক্তিমান এবং সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরের ধারণা।
তাঁর মতে সমস্ত বিশ্ব ঈশ্বরের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু তাঁর গৌরব ও
সৌন্দর্যের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের আদি পাপের জন্য (ঈশ্বর কর্তৃক আদম ও হাওয়াকে
স্বর্গ থেকে বহিষ্কার) প্রত্যেকেই জন্মগতভাবে পাপী, হাত পায়ে বাঁধা এই শৃঙ্খল থেকে কোনো
মানুষ মুক্তি পেতে পারে না। ঈশ্বর তাঁর ইচ্ছাবলে কাউকে মুক্তি দিয়ে স্বর্গে প্রেরণ করেছেন
আর কাউকে নরকে প্রেরণ করে যন্ত্রণায় নিমজ্জিত করেছেন। মানুষ শত চেষ্টা করেও তার
নিয়তিকে খন্ডাতে পারে না। ঈশ্বর কাকে মুক্তি দেবেন সেটা একান্তই তাঁর ব্যাপার। তাহলে
পৃথিবীতে সৎ কাজ করার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? ক্যালভিনের মতে সৃষ্টিকর্তা যাকে মুক্তি
দেবেন সৎ কাজের ইচ্ছা তার অন্তরে প্রোথিত করে রেখেছেন। যে সৎ কাজ করছে তার
কার্যাবলী দেখে সে যে মোক্ষ লাভ করার জন্য ঈশ্বরের কাছে নির্বাচিত হয়েছে অভ্রান্তভাবে না
হলেও মোটামুটিভাবে এ রকম একটা ধারণা করা যায়। তাই জনসম্মুখে বিশ্বাসের ঘোষণা
দেওয়া এবং খ্রিস্টের শেষ নৈশভোজের অনুসারে রুটি ও মদের প্রার্থনার অনুষ্ঠানে যোগদান
অর্থহীন নয়।
ক্যালভিনের মতে খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে ভক্তি ও
নৈতিকতা পরিপূর্ণ-কর্মময় জীবন লাভ করা। তাঁর মতে আদর্শবান খ্রিস্টানদের মনে করা উচিত
যে তারা ঈশ্বরকর্তৃক নির্বাচিত একটা মাধ্যম, এই মাধ্যমে সহায়তায় ঈশ্বর পৃথিবীতে তাঁর
মহান লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চান। পৃথিবীতে মানুষ ঈশ্বরের নির্বাণ লাভ করার চেষ্টা না করে
সৃষ্টিকর্তার মহান উদ্দেশ্যের গৌরব ও মহাত্য প্রচার করবে। মোটকথা ক্যালভিন
খ্রিস্টানদেরকে হাতগুটিয়ে এবং নিশ্চিন্তমনে এই ধারণা নিয়ে বসে থাকার জন্য উৎসাহিত
করেন নি, যে ধারণায় তাদের ভাগ্য তো আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে
দেওয়া হচ্ছে।
ক্যালভিন ও লুথারের ধর্মমতের পার্থক্য
যদিও ক্যালভিন ধর্মতত্তে¡র ব্যাপারে লুথারের কাছে ঋণ স্বীকার করতেন, তবুও দুই ধর্মীয়
নেতার মতাদর্শের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। প্রথমত পৃথিবীতেএকজন খ্রিস্টানের

আচরণ কী হবে এ নিয়ে দু’জন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে ছিলেন। ক্যালভিন খ্রিস্টানদের লুথারের
চেয়ে বেশি কর্মতৎপরতা ও যোদ্ধার মতো জীবন যাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। অর্থাৎ লুথার
যেখানে চাইতেন পৃথিবীতে মানুষ দুঃখ কষ্ট সহ্য করুক সেখানে ক্যালভিনের আকা ক্ষা
মানুষ ঈশ্বরের জন্য প্রচন্ড ও অবিরত পরিশ্রম করে পৃথিবীটাকে কর্তৃত্বের মুঠোয় নিয়ে আসুক।
দ্বিতীয়ত, ক্যালভিনের ধর্মমত ছিল বিধিবিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং লুথারের চেয়ে অনেক
বেশি ওল্ড টেস্টামেন্টের (ঙষফ ঞবংঃধসবহঃ) কাছাকাছি। খ্রিস্টান ধর্মীয় দিন সাবাত (ঝধননধঃয)
সম্পর্কে দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। রোববার সম্পর্কে
লুথারের মতামত আধুনিক খ্রিস্টানদের মধ্যে বিরাজমান ধারণার মতই। লুথার চাইতেন তাঁর
অনুসারীরা রোববার দিন গির্জায় উপস্থিত হবে, কিন্তু এরপর তারা সারাদিন কোনো কাজকর্ম
আনন্দ অনুষ্ঠান করবেনা তা তিনি সমর্থন করতেন না। কিন্তু অপরপক্ষে ক্যালভিন সাবাত
সম্পর্কে ইহুদিদের ধারণা পুনরুজ্জীবিত করেন এবং চাইতেন খ্রিস্টানরা এমন কোনো কাজ না
করুক যার মাধ্যমে পার্থিবতা ফুটে উঠে। গির্জার প্রশাসন এবং শাস্ত্রীয় আচার-অনুষ্ঠান
সম্পর্কেও দু’জনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। যদিও লুথার ক্যাথলিকদের পুরোহিত বা
যাজকদের ক্রমোচ্চ শ্রেণীবিভাগকে অস্বীকার করেছিলেন, তথাপি এর কিছু কিছু তিনি রেখে
দিয়েছিলেন। লুথারের বিভিন্ন ড্রিস্ট্রিক্ট সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের বিশপদের
বিকল্প হিসেবে। রোমান প্রার্থনা ব্যবস্থারও তিনি কিছু কিছু রেখেছিলেন  যেমন প্রার্থনার
পূজোবেদী, যাজকদের এক বিশেষ ধরণের কাপড় ইত্যাদি। কিন্তু ক্যালভিন রোমান ক্যাথলিক
ধর্মের সঙ্গে জড়িত এমন সব কিছুকে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি যাজকদের ক্রমোচ্চ শ্রেণী
বিভাগ ব্যবস্থার বাতিলের পক্ষে যুক্তি পেশ করেন। তাঁর মতে গির্জা ব্যবস্থা পরিচালনা করবে
গির্জার নিয়মিত উপাসকমন্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত যাজকরা। তিনি গির্জার প্রার্থনায় অনাড়ম্বরতা ও
সহজ সরলতার উপর জোর দিয়ে গির্জা থেকে সকল শাস্ত্রীয় আচারানুষ্ঠান, বাদ্যযন্ত্র, মূর্তি এবং
জানালা থেকে রঙিন ও কারুকার্য্য খচিত কাঁচ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। যখন এই আদেশ
নিষেধগুলো-বাস্তবায়ন করা হলো তখন ক্যালভিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিণত হলো চার দেওয়াল
আর ধর্মোপদেশমূলক বক্তৃতায়।
ক্যালভিনের ধর্মরাজ্য
ক্যালভিন শুধু কতগুলো তত্ত¡ই পেশ করেন নি, এগুলোকে বাস্তবায়নের কাজও করেছেন।
ফরাসি ভাষাভাষী জেনেভা শহর তখন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক টালমাটালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল,
ক্যালভিন এই ঘটনা প্রবাহকে কাজে লাগালেন। ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি জেনেভাতে গিয়ে তাঁর
মতামত প্রচার এবং একই সংগে সাংগঠনিক কাজে ত্মনিয়োগ করেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর
কাজের জন্য তিনি জেনেভা থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার জেনেভায় ফিরে
এলেন এবং এসময় তিনি ঐ শহরের সরকার ও ধর্মের নিয়ন্ত্রণ করায়ত্তে¡ নিয়ে আসেন। তাঁর
নিয়ন্ত্রণে জেনেভা শহর একটি ধর্মরাজ্যে পরিণত হয়। নগরীর সর্বোচ্চ ক্ষমতা বারো জন
বিশিষ্ট বয়োবৃদ্ধ নাগরিক এবং পাঁচজন যাজক বিশিষ্ট “কনসিসটরি’’ (ঈড়হংরংঃড়ৎু) নামক
একটি সভার হাতে ন্যস্ত করা হলো। যদিও ক্যালভিন কদাচিৎ এই সভায় পৌরহিত্য করতেন,
তথাপি ১৫৬৪ সালে অর্থাৎ তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি সভাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আইন পাশ
করা ছাড়াও এই সভার দায়িত্ব ছিল মানুষের নৈতিকতা পর্যবেক্ষণ করা। মানুষের অসামাজিক
কার্যকলাপের জন্য শাস্তি বিধানই তাদের দায়িত্ব ছিল না, বরং এই জন্য তারা নিয়মিত
প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে হানা দিত। জেনেভাকে কয়েকটি জেলায় ভাগ করা হয়
এস এস এইচ এল
ইউনিট - ৪ পৃষ্ঠা - ৮৪
এবং “কনসিসটরির’’ একটি কমিটি কোনো পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে মানুষের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ
করত। কারো সামান্যতম অসংযমী আচরণ পর্যন্ত কড়াভাবে নিষিদ্ধ ছিল। নাচ, তাসখেলা,
থিয়েটার দেখা, সাবাত দিনে কাজ বা খেলাধুলা শয়তানের কাজ বলে নিষিদ্ধ করা হয়।
সরাইখানাতে আগত অতিথিদের জন্যও পৃথক খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করার আগে খ্রিস্টীয়
প্রার্থনা উচ্চারণ করা ছিল বাধ্যতামূলক এবং রাত নয়টার পরে সরাইখানা খোলা রাখা ছিল
অপরাধ। এসব আদেশ নিষেধ অমান্য করা হলে শাস্তি যে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হতো তা
বলাই বাহুল্য। খুন ও বিশ্বাসঘাতকতার বাইরে ব্যভিচার, জাদুবিদা, ধর্মদ্রোহিতা ও ঈশ্বর নিন্দা
মৃত্যুদন্ডযোগ্য শাস্তি হিসেবে ধরা হতো। ক্যালভিনের জেনেভা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর
ঐ শহরের মোট ষোল হাজার অধিবাসীর মধ্যে প্রায় ৪৮ জনকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা
হয়েছিলো।
আজকের প্রেক্ষাপটে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এ ভাবে হস্তক্ষেপ করা নিন্দনীয় হতে পারে,
কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর সেই যুগে হাজার হাজার ইউরোপবাসীর নিকট ক্যালভিনের জেনেভা
ছিল প্রোটেস্টান্ট মতবাদের এক আলোকবর্তিকা। ক্যালভিনের শিষ্য জন নক্স স্কটল্যান্ডে
ক্যালভিনের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর একটি মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তৎকালীন
জেনেভার স্থান কি ছিল। তিনি বলেছেন, “ক্যালভিনের অধীন জেনেভা হচ্ছে যিশু খ্রিস্টের
দ্বাদশ শিষ্যের পরে সবচাইতে পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ শিক্ষাগার’’। এই “আদর্শ শিক্ষাগারে’’ আশ্রয়
অথবা দীক্ষা নেওয়ার জন্য বহু বিদেশী জড় হয় এবং তারা ক্যালভিনের মতবাদের প্রচারক
হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। তাছাড়া ক্যালভিনও মনে করতেন জেনেভা হচ্ছে ফ্রান্স ও সারা
পৃথিবীতে ক্যালভিন মতাদর্শ প্রচারের একটি কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে তিনি বৈরী অঞ্চলে দূত
ও প্রচারক পাঠাতে উৎসাহিত করেন। এর ফলে ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে জেনেভা হয়ে উঠে
দূর দূরান্তে প্রাণপণে নতুন বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার কেন্দ্র। শীঘ্রই ক্যালভিনপন্থীরা স্কটল্যান্ডে
প্রেসব্যাটিরিয়ান (চৎবংনুঃবৎরধহং) নামে এবং হল্যান্ডে ডাচ সংশোধিত গির্জা (উঁঃপয
জবভড়ৎসবফ ঈযঁৎপয) নামে সংখ্যাগুরু দল হিসেবে ত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে তারা ফ্রান্সে
হিউগনটস (ঐঁমঁবহড়ঃং) নামে এবং ইংল্যান্ডে পিউরিটানস (চঁৎরঃধহং) নামে লক্ষণীয়
সংখ্যালঘু দল হিসেবে অবস্থান নেয়। ক্যালভিনপন্থীরা যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে
পড়ছিলো তখন কিন্তু ক্যাথলিকরা নিজেদের ঘর গুছাতে এবং প্রোটেস্টান্টরা যাতে আর বড়
ধরনের অগ্রগতি লাভ না করতে পারে সেজন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হচ্ছিলো। ক্যাথলিকরা শীঘ্রই
প্রতিসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের হারানো বেশ কিছু এলাকা ক্যাথলিকবাদের গন্ডির
মধ্যে নিয়ে আসে।
জুইংলিবাদ
ক্যালভিন মতবাদ জন্ম হওয়ার আগে জুইংলি নামের এক ধর্ম সংস্কারকের চেষ্টায় জুইংলিবাদ
সুইজারল্যান্ডে প্রচারিত হয়। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে লুথারের মতো বাইবেল সূক্ষ ভাবে ও
মনোযোগ দিয়ে পড়তে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে প্রচলিত ক্যাথলিক ধর্মতত্ত¡ এবং ধর্মীয়
আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে মূল ধর্মগ্রন্থের যথেষ্ট বিরোধ রয়েছে। অবশ্য যতক্ষণ না লুথার বিদ্রোহ
করলেন জুইংলি ততক্ষণ চুপচাপ রইলেন। ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জুরিখে ক্যাথলিক চার্চের
বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। ক্রমে পুরো জুরিখ ও উত্তর সুইজারল্যান্ডের বিশাল এলাকা জুড়ে
তাঁর নেতৃত্বে জার্মানিতে লুথারের ন্যায় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ইউখারিস্ট নামক ধর্মীয়

অনুষ্ঠান সম্পর্কে জুইলিং এবং লুথারের মধ্যে ব্যাপক তত্ত¡গত মত ভেদ ছিল। লুথার ঐ
অনুষ্ঠানে প্রার্থনার পর রুটি ও মদ যিশুখ্রিস্টের মাংস ও রক্তে পরিণত হয় এটা মানতেন না।
কিন্তু এই বিশ্বাস ক্যাথলিকদের একটি প্রধান সত্য। মার্টিন লুথার এই সত্য না মানলেও ঐ
প্রার্থনা সভায় যে যিশুখ্রিস্ট স্বয়ং আবির্ভূত হন তা বিশ্বাস করতেন। কিন্তু জুইংলি ইউখারিস্টের
প্রার্থনাকে একটি উৎসব মনে করতেন যেখানে যিশু শুধুমাত্র আত্মিক ভাবে উপস্থিত হন। তিনি
মনে করতেন এই ধর্মানুষ্ঠান অতি উচ্চ কোনো মর্যাদা বহন করে না বরং খ্রিস্টানরা স্মৃতি
উৎসব হিসেবে একে পালন করতে পারে। বিরোধটি ক্ষুদ্র হলেও এটি তখন লুথার ও জুইংলির
অনুসারীদেরকে একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী প্রোটেস্টান্ট আন্দোলন হতে দেয় নি। ১৫৩১
খ্রিস্টাব্দে জুইংলি ক্যাথলিকদের সঙ্গে যুদ্ধে জুইংলি নিহত হন, নেতৃত্বের অভাবে এরপর এই
আন্দোলন ক্যালভিন মতবাদের সঙ্গে একীভ‚ত হয়ে যায়।
এ্যানাব্যাপটি মতবাদ
ক্যালভিন মতবাদ উত্থানের অনেক আগে সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানিতে এ্যানাব্যাপটিজম নামে
আরেকটি ধর্মমতের আবির্ভাব হয়। এ্যানাব্যাপটিস্টরা প্রথমে জুরিখে জুইংলির অনুসারী ছিলো।
১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে শিশুদেরকে পবিত্র পানি দ্বারা অভিসিঞ্চন (নধঢ়ঃরংস) নামক এক প্রকার
অনুষ্ঠান এবং সত্যিকার বিশ্বাসীদের স্বতন্ত্র গির্জা থাকতে হবে জুইংলিদের এই দুই ধারণার বিষয়ে
দ্বিমত পোষণের মাধ্যমে তারা জুইংলি মতবাদ থেকে বেরিয়ে আসেন। এ্যানাব্যাপটিস্টদের মতে
ব্যাপটিজম শুধুমাত্র বয়োপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ শিশুরা এর অর্থবোঝার ক্ষমতা রাখে
না। লুথার ও জুইংলি যদিও বিশ্বাস করতেন সকল বিশ্বাসী মানুষই যাজক, তবুও তাঁরা
চাইতেন ধর্মে বিশ্বাস করুক বা নাই করুক প্রত্যেকেরই উচিত প্রার্থনায় যোগ দেওয়া এবং
সরকারি ভাবে গঠিত ধর্মীয় গোষ্ঠির সদস্য হওয়া। কিন্তু এ্যানাব্যাপটিস্টরা বিশ্বাস করত গির্জায়
যোগদানের সঠিক সিদ্ধান্ত আসতে হবে মনের ভিতর থেকে। প্রত্যেকেই তার ভিতরের আলো
দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গির্জার সদস্য হবে, বাকিরা তাদের নিজেদের ইচ্ছামত চলবে। গির্জার
সদস্য হওয়ার ব্যাপারটি প্রত্যেকের ইচ্ছাধীন হওয়ার মতবাদ এমন সময় ত্মপ্রকাশ করে যখন
প্রায় সবার ধারণা ছিল ধর্ম ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং প্রোটেস্টান্ট-ক্যাথলিক
নির্বিশেষে সবাইকে কোনো না কোনো গির্জার কর্তৃত্ব মেনে চলতে হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই
এ্যান্টিব্যাপ্টিজম তৎকালীন ক্ষমতাধর ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট উভয় গোষ্ঠীর জন্য অসহনীয়
হয়ে পড়ে।
এ্যানাব্যাপটিস্টদের জন্য দুর্ভাগ্য স্বরূপ একটি ঘটনা এ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়।
একদল চরমপন্থী এ্যানাব্যাপটিস্ট ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির মানস্টার শহরের কর্তৃত্ব জোর
করে দখল করে নেয়। এ সুযোগে আশপাশের এলাকা থেকে আরো চরমপন্থীরা এসে
মানস্টারে জমা হয় এবং তাদের ধর্মতত্তে¡র বিভিন্ন আইন কানুন প্রয়োগ করতে থাকে।
অবিশ্বাসীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও বহুবিবাহ চালু করা হয়। লেইডেনের জন নামক এক দর্জি
রাজা উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি নিজেকে পয়গম্বর ডেভিডের উত্তরসূরী ঘোষণা করেন এবং
পৃথিবী দখল করে ধর্মহীনতা দূর করার শপথ নেন। এক বছরের কিছু পর ক্যাথলিকরা
মানস্টার পুনর্দখল করে এবং নেতা জনকে নির্যাতন করে মেরে ফেলে। বিভিন্ন স্থানের সরকার
ইতিমধ্যে এ্যানাব্যাপটিস্টদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর মানস্টারের ঘটনা তাদেরকে

আরো কোণঠাসা করে ফেলে। জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে তাদের উপর কঠোর
নির্যাতন চলে। যারা রক্ষা পায় তারা হল্যান্ডের মেনো সাইমনস নামক এক সংস্কারকের
নেতৃত্বে মেনোনাইট খ্রিস্টান নামে এক নতুন উপদল সৃষ্টি করে। এই স¤প্রদায় শান্তিবাদ এবং
হৃদয়ের ধর্ম এ্যানাব্যাপটিজমের এই দুটো মতাদর্শ নিয়ে আজো পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায়
রেখেছে।
এ্যাঙ্গলিকানবাদ
জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে প্রোটেস্টান্টবাদের সূচনা করেছে
ধর্মসংস্কারকরা। কিন্তু ইংল্যান্ডে এর সূচনা করেছেন স্বয়ং দেশের রাজা। অবশ্য রোম থেকে
বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে রাজা ইংল্যান্ডের জনগণের বিপুল সমর্থন লাভ করেছিলেন।
ইংল্যান্ডের জনগণ পোপদের দুর্নীতি এবং দেশের অর্থ রোমে পাচার হওয়া পছন্দ করত না।
দ্বিতীয়ত জন উইক্লিপ (ঔযড়হ ডুপষরভ) নামক মধ্যযুগীয় এক ধর্মসংস্কারকের অনুসারী লোলার্ড
আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন স্থানে ত্মগোপন করে ধর্মীয় অনাচার এবং যাজকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন
অভিযোগ প্রচার করে আসছিলো। তৃতীয়ত, ভ্রমণকারী এবং ছাপাখানার মাধ্যমে লুথারের
ধর্মমত ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। ১৫২০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে লুথারের অনুসারীরা ক্যাম্ব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা করতে থাকে। অবশ্য এই সব কারণে বা ধর্মতত্তে¡র বিরোধের কারণে
টিউডর বংশের রাজা অষ্টম হেনরি রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নি। মূল কারণটি ছিল নিছক
ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক। রাজা অষ্টম হেনরি স্পেনের ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কন্যা
ক্যাথরিনের সঙ্গে আঠারো বছর ব্যাপী বিবাহিত জীবন যাপন করছিলেন। ম্যাফর নামক এক
কন্যা সন্তান তাদের থাকলেও অষ্টম হেনরি তাঁর উত্তরাধিকারের জন্য একটি ছেলে সন্তানের
আশায় ছিলেন। কিন্তু ক্যাথরিন এত বয়স্ক ছিলেন যে তার পক্ষে আর সন্তান ধারণ করা সম্ভব
ছিল না। এ অবস্থায় হেনরি তাঁর প্রেমিকা এ্যান বোলিন নামক এক মহিলাকে নতুন করে বিয়ে
করতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি রোমের দরবারে ক্যাথরিনের সঙ্গে তার বিয়ে বাতিল এবং
এ্যানকে বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। পোপ অষ্টম ক্লিমেন্ট পড়লেন উভয় সংকটে।
তিনি যদি ইংল্যান্ডের রাজার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন তা হলে ক্যাথলিক জগৎ থেকে
ইংল্যান্ড বেরিয়ে যাবে, রাজা অষ্টম হেনরি ছিলেন ক্যাথলিক মতবাদের একজন গোঁড়া সমর্থক।
অপর দিকে রাজার আবেদনে সাড়া দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ক্যাথারিনের ত্মীয় সম্রাট পঞ্চম চার্লসের
সঙ্গে শত্রট্টতায় অবতীর্ণ হওয়া। কারণ, চার্লস তখন ইতালিতে যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত এবং পোপের
রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খর্বের জন্য রীতিমত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পোপ যখন কোনো
সিদ্ধান্ত না দিয়ে কালাতিপাত করছিলেন তখন অষ্টম হেনরির আর তর সইল না। তিনি নিজেই
ব্যাপারটা মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
অষ্টম হেনরি ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে যাজকদের এক সভা ডেকে তাদের থেকে ইংল্যান্ডের গির্জার
প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেন। এর পর ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ডেকে তিনি কতগুলি
আইন পাস করলেন যার দ্বারা রোমে ইংল্যান্ড থেকে অর্থকড়ি পাঠানো নিষিদ্ধ হলো,
ইংল্যান্ডের গির্জাকে স্বাধীন এবং রাজার কর্তৃত্বের অধীন ঘোষণা করলেন। এসব আইন পাসের
সঙ্গে সঙ্গে রোমের সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে হেনরি

পার্লামেন্টের দ্বারা আরো আইন পাস করিয়ে ইংল্যান্ডের সকল মঠের সম্পত্তি দখল করেন এবং
সেসব তার অনুগতদের মাঝে বন্টন করেন।
অষ্টম হেনরি ইংল্যান্ডের সঙ্গে রোমের সম্পর্ক ছেদ করলেও তখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের গির্জা ধর্মীয়
তত্ত¡গত দিক দিয়ে ক্যাথলিক ছিল। বিশপ নিয়ন্ত্রিত গির্জার প্রশাসন, যাজকদের নিকট মৌখিক
পাপ স্বীকার, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে “ম্যাস’’ নামক প্রার্থনা, যাজকদের কৌমার্য্য ইত্যাদি বজায়
রাখা হলো। ক্যাথলিক আচার অনুষ্ঠান ইউখারিস্ট শুধু বজায় রাখাই হলো না এটা যারা
অস্বীকার করবে তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু এরপরও
প্রোটেস্টান্টবাদ ইংল্যান্ডে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। অষ্টম হেনরির ছেলে ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের
সময় বিশিষ্ট রাজন্যবর্গের প্রভাবে ইংল্যান্ডের গির্জার অনেক তত্ত¡ ও আচার অনুষ্ঠানের
পরিবর্তন করা হয়। যাজকদের বিয়ে করা এবং প্রার্থনাগুলো ল্যাটিনের পরিবর্তে ইংরেজি
ভাষায় করার অনুমতি দেয়া হলো, এছাড়া গির্জায় ছবি ও মূর্তি নিষিদ্ধ করা হলো। ব্যাপ্টিজম
বা শিশুজন্মগ্রহণ করার পর পবিত্র পানি সিঞ্চন দ্বারা তাকে পবিত্র করা এবং ক্যামিউনিয়্যান বা
খ্রিস্টের শেষ সান্ধ্যভোজন পর্ব বা তদুপলক্ষে খ্রিস্টানদের অনুষ্ঠান ছাড়া সকল ক্যাথলিক আচার
অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করা হয়। মোটকথা যুক্তি প্রমাণের বদলে শুধুমাত্র বিশ্বাসই যথেষ্ট
লুথারের এই বক্তব্যকে ধর্মীয় জীবনে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের পর
ক্যাথারিনের গর্ভে জন্ম লাভ করা অষ্টম হেনরির কন্যা মেরি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর
মায়ের অপমান এবং তাঁকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি
ঘড়ির কাঁটাকে আবার ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি ক্যাথলিক ধর্ম পুনপ্রবর্তন করলেন
এবং ইংল্যান্ডের গির্জাকে পোপের অধীনে আনলেন। প্রোটেস্টাস্টান্ট ধর্ম নিষিদ্ধও ঘোষণা
করলেন। কিন্তু জনসাধারণের প্রতিরোধের মুখে এসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রোটেষ্টান্ট ধর্মমতকে
আবার যিনি ফিরিয়ে আনেন তিনি হলেন এ্যান বোলিনের কন্যা রাণী এলিজাবেথ (১৫৫৮-
১৬০৩)। তাঁর বাবার বিয়ে এবং বড় হয়ে উঠার পরিবেশের কারণে তিনি ছিলেন প্রোটেস্টান্ট
ধর্মের পক্ষে। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন যদি তিনি
ইংল্যান্ডে চরম প্রোটেস্টান্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন তাহলে ক্যাথলিক অধ্যুষিত ঐ দেশে
ধর্মীয় হানাহানি শুরু হবে। তাই ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্ট মতবাদের সমন্বয়ে একটি
সমঝোতামূলক ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। “এক্ট অব সুপ্রিমেসি’’ (অপঃ ড়ভ ঝঁঢ়ৎবসধপু) বা
প্রাধান্যের আইন দ্বারা তিনি পোপের প্রাধান্য খর্ব করে ইংল্যান্ডের চার্চের ওপর নিজ প্রাধান্য
স্থাপন করেন। তবে এ ক্ষেত্রে অষ্টম হেনরি যেমন নিজেকে “সুপ্রিম হেড’’ ঘোষণা করেছিলেন
সেক্ষেত্রে রাণী এলিজাবেথ নিজেকে “সুপ্রিম গভর্নর’’ বলে ঘোষণা করেন। এডওয়ার্ড গির্জায়
যে সব সংস্কার এনেছিলেন তিনি সেসব বজায় রাখেন। অপর পক্ষে তিনি বিশপদের দ্বারা
পরিচালিত গির্জার প্রশাসন এবং কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস চালু করেন । বিশেষ করে ইউখারিস্টের
অর্থ খুব অস্পষ্ট করে রাখেন যেন ক্যাথলিক এবং প্রোটেস্টান্ট সকলেই তা গ্রহণ করতে পারে।
এলিজাবেথের মৃত্যুর পরও তার ধর্মীয় সংস্কার বজায় থাকে এবং এটা এ্যাঙ্গলিকান মতবাদ
নামে পরিচিত হয়।

সারসংক্ষেপ
মার্টিন লুথারের প্রতিবাদ বা প্রোটেস্টের মাধ্যমে প্রোটেস্টান্টবাদের জন্ম হলেও ক্যাথলিক-বিরোধী
সকল মতবাদ যেমন ক্যালভিনের মতবাদ, জুইংলির মতবাদ, এ্যানাব্যাপটিজম, এ্যাঙ্গলিকান ইত্যাদি
সব ধর্মমত প্রোটেস্টান্টবাদের অন্তর্গত। ধর্মসংস্কারকগণ প্রচলিত ধর্ম ক্যাথলিক মতবাদের ওপর
আস্থা হারিয়ে নিজস্ব বিচার বুদ্ধিকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।
ক্যাথলিকরা ব্যক্তি পোপকে মনে করত অভ্রান্ত, দোষক্রটির উর্ধ্বে এবং বিশ্বাস করত একমাত্র
যাজকদের মাধ্যমেই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। অপর দিকে প্রোটেস্টান্টরা ধর্মগ্রন্থ বাইবেলকে অভ্রান্ত
মনে করতো এবং বিশ্বাস করত ব্যক্তি চেষ্টা করে ত্মার মুক্তি পেতে পারে। এই নিয়ে খ্রিস্টজগত দুই
ভাগে বিভক্ত হয়ে রক্তারক্তি, হানাহানি ও জীবনক্ষয়ের আবেগপ্রবণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
১। ক্যালভিন তাঁর অনুসারীদেরকে
(ক) আনন্দ উৎসব করতে উৎসাহ দিতেন (খ) বেশি করে অর্থ জমা করতে বলতেন।
(গ) আনন্দ ফ‚র্তি না করতে উৎসাহ দিতেন (ঘ) বেশি করে বাইবেল পড়তে বলতেন।
২। “চার দেওয়াল আর ধর্মোপদেশমূলক বক্তৃতা’’ কোন মতবাদের বৈশিষ্ট্য।
(ক) ক্যালভিনবাদের (খ) এ্যাঙ্গলিকানবাদের
(গ) এ্যানব্যাপটিস্টবাদের (ঘ) লুথারবাদের।
৩। মেনোনাইট খ্রিস্টান কোন দল হতে উৎপত্তি লাভ করে।
(ক) ক্যালভিন (খ) জুইংলিবাদ
(গ) লুথারান (ঘ) এ্যানাব্যাপাটিস্ট
৪। কোন মতবাদ ধর্মসংস্কার ধর্মীয় থেকে বেশি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
(ক) ক্যালভিনের মতবাদ (খ) লুথারের মতবাদ
(গ) এ্যাঙ্গলিকানবাদ (ঘ) এ্যানাব্যাপটিস্টবাদ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ক্যালভিনের ধর্ম রাজ্যের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করুন।
২। ইংল্যান্ডের ধর্মসংস্কারের উপর আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (গ), ২। (ক), ৩। (খ), ৪। (গ)।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। লুথারবাদ ও ক্যালভিনের মতবাদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করুন।
২। রাণী এলিজাবেথ যে ধর্মসংস্কার করেন তার উপর আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]