চরিত্রবান পোপেরা কীভাবে চার্চের অনাচার এবং দুর্নীতি দূর করে ক্যাথলিক ধর্মকে পুরুজ্জীবিত করেন?
ইনকুজিশন আন্দোলন
ট্রেন্টের ধর্মসভার মূলসিদ্ধান্ত
সোসাইটি অব জেসুইট-এর কর্ম পদ্ধতি


প্রতিসংস্কার আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য
ষোড়শ শতাব্দীর সংস্কার আন্দোলনের পর রোমান ক্যাথলিক চার্চের মধ্য থেকেই আরো একটি
আন্দোলন গড়ে। সংস্কারের মাধ্যমে ক্যাথলিক ধর্মমতের পুনরুজ্জীবনই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
ধর্মসংস্কার আন্দোলন মূলত রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিলো। ক্যাথলিক
ধর্মের সকল প্রকার অনাচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত আন্দোলনে রুপান্তরিত
হয়ে এই আন্দোলন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত গড়ে তোলে। তবে
প্রোটেস্টান্ট ধর্ম মতের দ্রæত প্রসারের বিরুদ্ধে রোমান ক্যাথলিক চার্চ নিজেরাই তাদের মধ্যকার
নানা অসংগতি এবং গাফিলতি দুরীকরণের লক্ষ্যে আর একটি নতুন আন্দোলন শুরু করে। এই
আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের প্রভাব যতদুর সম্ভব নিয়ন্ত্রনে রেখে
ক্যাথলিক চার্চকে সংস্কারের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও শক্তিশালী করা। এক কথায় প্রোটেস্টান্ট
ধর্মমতের প্রভাব ও বিস্তার প্রতিহত করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে পরিচালিত এই সংস্কার
আন্দোলন প্রতিসংস্কার আন্দোলন নামে পরিচিত।
চার্চের সংস্কারের উদ্দেশ্য গুলি হলো
ক) ক্যাথলিক চার্চের সকল অন্যায় অত্যাচার এবং অনৈতিকতা দুরীকরণের মাধ্যমে চার্চের
বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগগুলি ছিল তা বের করা;
খ) ক্যাথলিক ধর্মমতের মধ্যে সত্যিকার অর্থে আধ্যাতিœক, অপার্থিব এবং পবিত্রভাব জাগিয়ে
তোলা;

গ) যে সমস্ত অঞ্চল প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল তাদেরকে পুনরায় ক্যাথলিক
মতবাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
ক্যাথলিক ধর্মের সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে সব কৌশল ব্যবহৃত হয়েছিল তার মধ্যে ছিল
অবিশ্বাসীদের শাস্তিদান, সংস্কারমূলক কর্মকান্ড, ধর্মান্তরিতকরণ এবং সমাজ সেবামূলক নীতির
মাধ্যমে নিজেদের জনগণের সেবায় উৎসর্গ করা। ইনকিউজিশন ক্যাথলিক ধর্মচ্যুতদের
শাস্তিদানের জন্য কাউন্সিল অব স্টেট সংস্কার মূলক কর্মকান্ড, সোসাইটি অব জেসুইট গঠন
করে।
আন্দোলনের পর প্রতিসংস্কার আন্দোলন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে
ক্যাথলিক ধর্মমত জার্মানি, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্পেন, ইতালি প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত
থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ক্যাথলিক ধর্মমতে ফিরে আসে।
২। প্রতি সংস্কার আন্দোলন বিকাশের প্রধান কারণসমূহ
প্রোটেস্টান্ট মতবাদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দ্রæত ছড়িয়ে পড়লেও প্রোটেস্টান্টদের বিভিন্ন দল
এবং উপদলের মধ্যে দলাদলি, অন্ত:কলহ, গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের সুযোগে ক্যাথলিকরা
নিজেদের পুনরুজ্জিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ধর্ম বিপ্লবের সময়কার অসন্তোষ, হাঙ্গামা,
অনৈক্য, বিশৃংখলা কমে আসতে থাকলে জনগণ এটি বুঝতে সম্মত হয় যে রোমের সঙ্গে
সম্পর্ক ছিন্নকারী ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসীরাও সত্যিকার অর্থে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে
সক্ষম হয়নি। প্রোটেস্টান্ট ধর্মমতও একটি আদি অকৃত্রিম খ্রিস্ট ধর্মীয় বিশ্বাস রা অনুভ‚তিকে
জাগিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক উভয়েই কোনো না কোনোভাবে
ইউরোপীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ক্যাথলিক রাজারা ক্রমশ ক্যাথলিক ধর্মের পুনরুদ্ধারে
সর্বশক্তি নিয়োগ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। এছাড়াও মধ্যযুগের শক্তিশালী ঈশ্বর প্রেম বা
অনুভুতি এবং চার্চের ঐতিহ্যের লক্ষ্যে অতীন্দ্রিয়বাদ বা মিষ্টিকবাদের প্রসার দ্রæত বাড়তে
থাকে। এই সময়ের খ্রিস্টান মানবতাবাদী প্রাচীন গ্রিক রোমানদের মতো সংস্কারে এবং শিক্ষায়
বিশ্বাসী। প্রোটেস্টান্টদের চাইতে ক্যাথলিক ধর্ম মতের প্রতি অনুগতশীল ছিলেন।
৩। চরিত্রবান পোপের আবির্ভাব
ষোড়শ শতাব্দীতে কতিপয় ধর্মপরায়ন এবং চরিত্রবান পোপের আবির্ভাব ঘটে। তাদের বলিষ্ঠ
নেতৃত্ব প্রদান প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা সকল
প্রকার অনাচার দুর্নীতি থেকে মুক্ত ছিলেন এবং খ্রিস্টের আদর্শের অনুকরণে নৈতিক মান
উন্নয়নে আতœনিয়োগ করেন। তাদের আন্তরিকতা, ন্যায় পরায়নতা ক্যাথলিক ধর্মের পুনরুজ্জীবনে
সাহায্য করে। প্রতিসংস্কার আন্দোলনের পোপদের মধ্যে যেমন তৃতীয় পল, চতুর্থ এবং পঞ্চম
পায়াস ষোড়শ সিক্সটাস ছিলেন উজ্জল চরিত্রের অধিকারী। এরা ক্যাথলিক ধর্মমতের প্রচারের
লক্ষ্যে ক্রুসেডের প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে আসেন। এভাবে চরিত্রবান পোপদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়
ক্যাথলিকদের মধ্যে প্রেরণা এবং আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষ রোমের চার্চের প্রতি শ্রদ্ধা
হারালেও ঈশ্বরের প্রতি একেবারে আস্থা হারিয়ে ফেলেনি। তাই ক্যাথলিক চার্চ যখন আতœশুদ্ধির
জন্য সংশোধনের পথে এগিয়ে আসে তখন সকলেই তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে।
ইউরোপের কতিপয় রাজাও ক্যাথলিক উত্থানকে নৈতিকভাবে এবং অর্থ সাহায্য দিয়ে

জোরদার করে তুলতে পোপদের সাহায্য করেন। এদের মধ্যে স্পেনের দ্বিতীয় ফিলিপের নাম
বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৪। ইনকুইজিশন
ইনকুইজিশন ছিল ক্যাথলিকদের জন্য নির্ধারিত বিচারালয় যা প্রতিসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম
প্রধান, এজেন্সি, বা বাহক হিসেবে কাজ করে। ধর্ম ক্ষেত্রে মানুষের চরিত্রকে সংশোধনের জন্য
এই ইনকুইজিশন গঠন করা হয়। ক্যাথলিক ধর্মমতে অবিশ্বাসী ব্যক্তিগণকে খুঁজে শাস্তি দেয়াই
ছিল আদালতের একমাত্র কাজ। এই ধরনের আদালত প্রাচীন রোমান যুগে থাকলেও এর
প্রভাব ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায় নি। প্রতিসংস্কার আন্দোলন শুরু হবার পর ক্যাথলিকরা এর
পুর্ণসুযোগ গ্রহণ করে এবং অন্যধর্মাবলম্বীদের প্রতি নির্মম ও অমানবিক নির্যাতন আরম্ভ করেন।
১৫৪২ সালে পোপ তৃতীয় পল ঝঁঢ়ৎবসব ঞৎরনঁহধষ ড়ভ ওহয়ঁরংরঃরড়হ গঠন করে। স্পেনের
ইনকুইজিশনের পর ১৫৪২ সালের সমগ্র চার্চকে নিয়ন্ত্রনের জন্য কেন্দ্রীয় ইনকুইজিশন তৈরি
করা হয়। এর মাধ্যমে ক্যাথলিক ধর্মবিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে যেকোন লোককে বিশেষত
প্রোটেস্টান্টদের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে শাস্তি দেয়া হতো। আসামীকে আতœপক্ষ সমর্থনের কোনো
সুযোগ দেয়া হতো না।
ইনকুজিশেনের শাস্তিদানের প্রক্রিয়া ছিলো নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং বর্বর। এই সব নিষ্ঠুরতা ও
নির্মমতা মানুষকে বিদ্রোহী এবং অসহিঞ্চু করে তোলে। ফলে দ্রæত স্পেনে এটি জনপ্রিয়তা
হারায় এবং অন্যান্য স্থানে এর প্রভাব ও জনপ্রিয়তা দ্রæত কমতে থাকে। তবে ক্যাথলিক
ধর্মবিশ্বাসকে পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য এবং প্রোটেস্টান্ট ধর্মমতকে রুখে দেবার জন্য ইনকুইজিশন
যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছিল।
ঙ) ট্রেন্টের ধর্ম সভা
প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে কাউন্সিল অব ট্রেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের ত্রট্টটি দূরীকরণ এবং লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের
জন্য বাস্তব কর্মপন্থা এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গৃহীত হয়। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর যাবতীয়
খ্রিস্টানদের প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাথলিক ধর্মের মূলনীতিসমূহ নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। পোপ
তৃতীয় পল পোপতন্ত্রের বিভিন্ন সংস্কার আনয়নের ক্ষেত্রে ১৫৪২ খ্রি. কাউন্সিল আহবান করে।
এ সভাগুলি চলে ১৫৪২ সালে ১৫৪৫ - ৪৯, ১৫৫১ - ৫২ এবং ১৫৬২-৬৩ সালের মধ্যে।
ইতালির আল্পস্ পর্বতমালা এবং অস্ট্রিয়ার তিরল এর নিকটবর্তী ট্রেন্ট নামক রাজকীয় শহরে
এই সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ১৮ বছর ধরে এই সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল অব
ট্রেন্টের সভাগুলি আহবানের মূল উদ্দেশ্য ছিল :
ক) ধর্মীয় হানাহানি, মতবিরোধ পরিহার করে ক্যাথলিক ধর্মদর্শনকে একটি সঠিক এবং
সুনির্দিষ্ট পথে নিয়ে আসা;
খ) বিভিন্ন বিশপ এবং চার্চ-এর নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিহার করে নিয়মনীতি মেনে চলা;
গ) ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের সকল মতবাদের পুন:প্রতিষ্ঠা করা;
ঘ) খ্রিস্টান জগতের আইন কানুন এবং নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা করা;

ট্রেন্টের এই সিদ্ধান্তসমূহ যেমন তত্ত¡ীয় তেমনি প্রায়োগিক করার চেষ্টা করা হয়। কাউন্সিলে এই
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে প্রোটেস্টান্টদের সঙ্গে কোনো আপোষ রক্ষা করা হবে না। কাউন্সিল অব
ট্রেন্টে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা হল :
ক) পোপকে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ প্রভুত্ব বা প্রামিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়
এবং একমাত্র গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনিই হবেন খ্রিস্টান
ধর্মতত্তে¡র প্রধান ব্যাখ্যাকারী। বিশপ এবং যাজকদের উপর পোপের নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করা হয়;
খ) একমাত্র গ্রহণযোগ্য কর্তৃপক্ষ হিসেবে চার্চের ধর্মমতকে একটি স্পষ্ট সহজ এবং লিখিত
আকারে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটিই হবে খ্রিস্ট্রান ধর্মতত্তে¡র প্রধান ব্যাখ্যাকারী কর্তৃপক্ষ।
গ) চার্চের দুর্নীতি এবং অন্যান্য আচরণ দূরীকরণের লক্ষ্যে কিছু নিয়মানুবর্তিতা বা আদেশ.
নির্দেশ. নিয়ম শৃঙ্খলা বলবৎ করার প্রচেষ্টা চালানো হয় । সাইমনি বা গির্জার কোনো
পদের জন্যে ঘুষ দেয়া বা নেয়া, মুক্তিপণ বিক্রয় করা। খ্রিস্ট্রের ভোজ উৎসব, অর্থ সংগ্রহ
প্রভৃতি বিধি বহিভর্‚ত কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, ভালো কাজের জন্যে পুরস্কারের
কথা বলা হয়। খ্রিস্টান ধর্মের ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান যেমন ধর্মীয় ভোজ,
ট্র্যানসাবস্ট্র্যানশিয়েনতত্ত¡ (ঞযবড়ৎু ড়ভ ঞৎধহংঁনংঃধহঃরধঃরড়হ) যাজক স¤প্রদায়ের
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বা মনোনয়নের নিয়মনীতি, সাধু সন্নাসীদের প্রার্থনার আহবানসমূহ,
চারিত্রিক শুদ্ধতা রক্ষার রীতিনীতি অত্যাবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হয়। যাজক এবং
বিশপদের অজ্ঞতা দূর করতে নিয়মিত ধর্ম বিষয়ক সেমিনার এবং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা
হয়। যাজক শ্রেণীকে চরিত্রবান এবং লোভ লালসার উর্ধ্বে থাকার এবং তাদের নৈতিক
উন্নতি সাধনের সর্বাতœক প্রচেষ্টা চালানো হয়।
৪। ট্রেন্টের ধর্মসভার নিষিদ্ধ বইয়ের তালিকা (ঈড়হমৎবমধঃরড়হ ড়ভ ওহফবী) প্রকাশিত হয় যা
খ্রিস্টানদের জন্য পঠন-পাঠন এবং ব্যবহারের জন্যে নিষিদ্ধ করা হয়।
৫। অপরাধীদের শাস্তিদানের জন্য ইনকুইজিশন আবার পুন:প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল
এ ভাবে ট্রেন্টোর কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমত, এটি ক্যাথলিক ধর্মমতের
বিভিন্ন মতবাদ বা বিতর্কিত বক্তব্যকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রামাণ্য, ধর্মতত্ত¡ এবং বিশ্বাসেেযাগ্য
হিসেবে বিধিবদ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, কাউন্সিল ক্যাথলিক ধর্মমত সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থাকে
শক্তিশালী করে এবং ক্যাথলিক চার্চের অধীনে চার্চগুলি যাতে পরিচালিত হয় সেভাবে কেন্দ্রীভ‚ত
করে। এর ফলে ক্যাথলিকরা তাদের শত্রট্টপক্ষ বা বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে
দাঁড়াতে পারে। তৃতীয়ত, এটি বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মকান্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সকল
ধরনের অনৈতিক, অনাচার থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করলে প্রোটেস্টান্ট ধর্মমত দুর্বল হয়ে
পড়ে। এভাবে রোমান চার্চকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে প্রোটেস্টান্ট বিশ্বাসী লোকেরা আবার
রোমান চার্চ-এর অধীনে ফিরে আসতে থাকে।
৬। সোসাইটি অব জেসুইট

প্রতিসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিল সোসাইটি অব
জেসুইট নামক একটি সংস্থা। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইগনাটিয়াস লয়লা (১৪৯১-১৫৫৬)।
১৪৯১ সালে লুই পুকুজাতে তাঁর জন্ম হয়। ১৫২১ সালে তিনি পম্পলেদা যুদ্ধে আহত হন।
অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে তিনি খ্রিস্টের জীবনী নামক বিভিন্ন সাধু সন্নাসীদের জীবনী, প্রাচীন
ক্যাথলিকস এবং ধর্মের বই পড়তে থাকেন। এর ফলস্বরূপ চার্চ এবং বিশপদের অনুপ্রেরণায়
যুদ্ধের সৈনিক হওয়ায় চেয়ে তিনি ঈশ্বরের সৈনিক হওয়াকে শ্রেয় মনে করেন। প্রথমে মেনসেরা
(গধহংবৎধ) এবং মনসিরাতে (গধহংরৎৎধঃ) এ তীর্থ যাত্রার পর জেরুজালেমে যাওয়ার জন্য
মনস্থির করলেও পরে প্লেগের কারণে মনসেরা থেকে ফিরে এসে তার বিখ্যাত দ্যা স্পিরিচুয়াল
এক্সারসাইজ (ঞযব ঝঢ়রৎরঃঁধষ ঊীবৎপরংব) বইটি লিখেন। বইটি চারটি পর্বে বিভক্ত ছিল। প্রথম
পর্বে অন্তহীন পাপের বিরুদ্ধে সচেতনভাবে গড়ে তোলা, দ্বিতীয় পর্বে যিশুর জীবনী, তৃতীয়
পর্বে ছিল বিভিন্ন আবেগপূর্ণ ঘটনা এবং চতুর্থ পর্বের শেষ দিকে পুনরুদ্ধার এবং বিচারকার্য
সম্মন্ধে লিখেন। জেসুইটরা একে খ্রিস্ট ধর্মের হ্যান্ডবুক বলে মনে করেন। এই বইটি লয়লার
চিন্তাচেতনার মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
লয়লা কর্তৃক গঠিত সোসাইটি অব জেসুইট বা এই সংঘের সদস্যরা তিনটি ধর্মনীতি মেনে
চলতো -
ক) চারিত্রিক পবিত্রতা খ) স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ গ) আজ্ঞানুবর্তিতা। ১৫৪০ সালে পোপ তৃতীয়
পল সরকারিভাবে রোমান ক্যাথলিক চার্চের এই সংস্কারকে স্বীকৃতি দিলে এটি একটি শক্তিশালী
প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সোসাইটি অব জেসুইট সদস্যদের বলা হতো জেসুইট।
ইগনাটিয়াস লয়লা ১৫৪১ সালে এই সংগঠনের জেনারেল নিযুক্ত হন। এর সদস্য সংখ্যা ছিল
১০ জন। এ ছাড়াও সোসাইটি ভাগ্যপীড়িত, দরিদ্র এবং শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার
করতে থাকে। প্রকৃত পক্ষে ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হলেও জেসুইট সংঘ ছিল একটি
সামরিক প্রতিষ্ঠান। বিনা প্রশ্নে বা সন্দেহাতীতভাবে জুনিয়র সদস্যদের আদেশ শুনতে এবং
পালন করতে বাধ্য ছিল।
সোসাইটির তিন মূল লক্ষ্য হচ্ছে
ক) তরুণদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা (খ) বিভিন্ন অনুশীলনী ও চর্চার মাধ্যমে খ্রিস্টান
সমাজে ধর্মীয় আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে, গ) ক্যাথলিক ধর্মমতে বিশ্বাসী অঞ্চলসমূহকে
প্রোটেস্টান্ট মতে ফিরিয়ে আনা।
তবে জেসুইটরা সবচাইতে বেশি সাফল্য লাভ করেছিল শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী
তাদের কমক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দেয়। জেসুইটদের মূল úোাগানই ছিল, ‘আপনাদের শিশুকে স্কুলে
পাঠান।’ ধর্ম ছাড়াও তারা বিভিন্ন বিষয়ে-যেমন বিজ্ঞান, ভ‚গোল, ইতিহাস, আধুনিক
ভাষাবিজ্ঞান, শারীরিক চর্চা এবং নৈতিক উৎকর্ষে জ্ঞানলাভ করতো। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তর
প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইতালি,
পর্তুগাল, স্পেন. ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ড এবং ক্যাথলিক জার্মানির সকল স্কুল ও কলেজ
জেসুইটরা নিয়ন্ত্রন করতো।

ইউরোপের বাইরে ভারত, চীন, ব্রাজিল, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে তিন
হাজার স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্ম ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে ভাষা, যেমন - বিজ্ঞান, সঙ্গীত,
শিল্প ল্যাটিনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন খেলাধুলায় দক্ষতা অর্জন করতে থাকে। এভাবে শিক্ষা
প্রসারে জেসুইটরা বিশ্বের সর্বত্র সাফল্য লাভ করে। জেসুইট শাসকরা ক্যাথলিক ধর্মমতের
বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে এবং প্রোটেস্টান্টদের কাছ থেকে হারানো রাজ্য আবার ফিরিয়ে নিয়ে
আসতে সচেষ্ট হয়। ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মকে টিকিয়ে রেখে তারা এশিয়া ও আমেরিকায় আদর্শ
মুক্তিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এভাবে জেসুইটরা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মূল বাহক হিসেবে কাজ করে। প্রথমত, তাদের
কর্মকান্ডে, দক্ষ ও ট্রেনিং প্রাপ্ত উৎসাহী মিশনারি স¤প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে যারা প্রোটেস্টান্ট
ধর্মমতের পূর্ববর্তী ক্যাথলিক ধর্মমতকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, এরা
উচ্চমধ্যবিত্ত এবং ভ‚-স্বামী অভিজাত স¤প্রদায়ের মধ্যে ক্যাথলিক ধর্মমত তথা খ্রিস্ট ধর্মমত
প্রচারে সফল হয়। তৃতীয়ত, এরা শিক্ষার্থীদের ক্রমশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে।
এরা ধর্মবিষয়ক যেকোনো বিতর্ক এড়িয়ে চলতো এবং এভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিক্ষাক্ষেত্রে
ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
সারসংক্ষেপ
প্রোটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের পর ক্যাথলিক ধর্মমতের পুনরুজ্জীবন ঘটে। বেশ কিছু অনিশ্চয়তার
হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ক্যাথলিকরা নিজেদের সংশোধনের জন্য আরেকটি আন্দোলনে এগিয়ে
এসেছিল। ইউরোপে এটি প্রতিসংস্কার আন্দোলনে নামে পরিচিত হয়ে উঠে। চার্চের নৈতিকতা এবং
সকল দূুর্নীতি দূরীকরণের লক্ষ্যে পোপদের তৎপরতা এবং ইনকুইজশনের মাধ্যমে শাস্তিদান প্রক্রিয়া
ক্যাথলিক ধর্মমতকে সুসংগঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাউন্সিল অব ট্রেন্ট এর সভাগুলিতে
ক্যাথলিক ধর্মমতকে স্পষ্ট লিখিত বিধিবদ্ধ আকারে প্রকাশ করা হয় এবং পোপের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
সুসংহত করা হয়। শেষত জেসুইট সংঘ ক্যাথলিক ধর্মের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে সবচাইতে গঠনমূলক
কার্য সম্পন্ন করে। শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে তারা ক্যাথলিক ধর্মমতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে
সক্ষম হয়। কারিগরী শিক্ষক এবং ধর্মের প্রতি আনুগতের মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব বিস্তার
হয়। এভাবে ক্যাথলিক ধর্ম অন্যতম বিশ্বধর্মে পরিণত হয়।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পার্শ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। প্রতি সংস্কার আন্দোলনের মূলউদ্দেশ্য ছিল --
ক) প্রোটেস্টান্টদের সঙ্গে সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ করা;
খ) নিজেদের সকল অসংগতি ও দুর্নীতি দূরীকরণের মাধ্যমে ক্যাথলিক ধর্মমতে পুনরুজ্জীবিত
করা;
গ) গতানুগতিক পথেই ক্যাথলিক ধর্মমতকে চালিত করা;
ঘ) বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট নীতিসমূহকে গ্রহণ করা।
৩। ইনকুইজেসন বিচারালয়ের কাজ কি ছিল?
ক) প্রোটেস্ট্যান্টদের শাস্তি দেয়া
খ) ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকদের পুরষ্কৃত করা
গ) ক্যাথলিক ধর্মমতে অবিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে খুজে বের করে শাস্তি দেয়া
ঘ) ধর্মবিরোধী বই নিষিদ্ধ করা।
৪। ইনকুইজিশন বিচারালয় সর্বপ্রথম কোন সভ্যতায় চালু ছিল ?
ক) রোমান সভ্যতায় খ) মেসোপটোমীয় সভ্যতায়
গ) মিশরীয় সভ্যতায় ঘ) গ্রিক সভ্যতায়
৫। কোন ভাষায় রচিত বাইবেলকে খ্রিস্ট জগতের বা ক্যাথলিক ধর্মমতের প্রমাণিত গ্রন্থ হিসেবে
স্বীকৃতি দেয়া হয়?
ক) হিব্রæ খ) এ্যাংলো স্যাক্সন
গ) ল্যাটিন ঘ) গথিক
৬। সোসাইটি অব জেসুইট-এর প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
ক) ইগনাটিয়াস লয়লা খ) ফ্রান্সিসকো সুবেজ
গ) ফ্রান্সিস জেভিয়ার ঘ) পিয়ারি লেফেবরি
৭। জেসুইটরা কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন?
ক) দূর শিক্ষণ খ) ব্যবহারিক শিক্ষা ব্যবস্থা
গ) কারিগরী শিক্ষা ব্যবস্থা ঘ) ছাত্র-শিক্ষক সমমন্বয়ে প্রত্যক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা
উত্তর : ১। (খ), ২। (গ), ৩। (ক), ৪। (ঘ), ৫। (ক), ৬। (খ)।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। প্রতিসংস্কার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল ?
২। ইগনাসিয়াস লয়লার জীবনী সংক্ষেপে লিখুন।

রচনামূলক প্রশ্ন
১। চরিত্রবান পোপেরা কীভাবে চার্চের অনাচার এবং দুর্নীতি দূর করে ক্যাথলিক ধর্মকে পুরুজ্জীবিত
করেন?
২। ইনকুজিশন আন্দোলনের কার্যাবলী মূল্যায়ন করুন।
৩। ট্রেন্টের ধর্মসভার মূলসিদ্ধান্ত গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করুন।
৪। সোসাইটি অব জেসুইট-এর কর্ম পদ্ধতি সংক্ষেপে আলোচনা করুন।
প্রতিসংস্কার আন্দোলনের প্রভাব ও তাৎপর্য

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]