পিটারের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো? আধুনিক রাশিয়া গঠনে তার অভ্যন্তরীণ সংস্কার সম্পর্কে সংক্ষেপে মূল্যায়ন করুন।

মহামতি পিটার (১৬৭২ - ১৭২৫) এবং তৎকালীন রাশিয়া
প্রথম পিটারের উত্থানের সময় রাশিয়া ছিল ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎপদ দেশ। আর্টিক থেকে কাস্পিয়ান সাগর এবং জাপান
উপসাগর থেকে কিয়েভ পর্যন্ত বিশাল ভ‚খন্ড নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। শ্বেত সাগরের
তীরে অবস্থিত আঁেচঞ্চল বন্দর বছরে নয় মাস বরফে আচ্ছাদিত থাকতো। অপর কোনো পথে
রাশিয়ার সমুদ্র অভিমুখে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। পোলিশ এবং সুইডিসরা কৃঞ্চ সাগরে
রাশিয়ার প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়। এভাবে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে রাশিয়ার
সভ্যতা ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি পিছিয়ে পড়েছিল। সমগ্র মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগে
রাশিয়া ছিল পশ্চাৎবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন দেশ। রেনেসাঁস এবং ধর্মসংস্কার আন্দোলন-এ দুটি
ঘটনার প্রভাব বলয়ের বাইরে রয়ে যায় রাশিয়া। রাশিয়া ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রাচ্যদেশীয়
সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত।
রাশিয়ার শাসনব্যবস্থা ছিল স্বৈরাচারী, ‘ডুমা‘ নামে অভিজাত সভা জারের পরামর্শদাতা স্বরূপ
ছিল। রুশ সমাজ অভিজাত এবং ভ‚মিদাস এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। মধ্যবিত্ত নামে
কোনো স¤প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। ধর্মের ব্যাপারে এটি বাইজানটাইন কনস্টানটিনোপলের
চার্চকে অনুসরণ করতো।
তবে অনেক পশ্চাৎপদতার পরও রাশিয়ার জনগণ তাদের রাজ্য বাড়াতে থাকে। মধ্যযুগে
মোঙ্গলদের আক্রমণ দেশটিকে পদানত করলেও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চলতে থাকে। নবম
এবং দশম শতাব্দীতে কিয়েভ, রিয়াজান ও শ্লোভেন নামক তিনটি রাজ্য বেশি পরিচিত হয়ে
উঠে। ১২৫০ থেকে তাতারগণ দেশটিকে পদানত করলে মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউক স্বাধীনতা
ঘোষণা করেন। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের উত্থান
ঘটে। প্রথম আইভান মস্কোকেন্দ্রিক শক্তিশালী ক্ষমতা গড়ে তোলেন। তার মৃত্যুরপর তৃতীয়
আইভান বিদেশী হস্তক্ষেপ দমন করে তাতারদের খাজনা পাঠানো বন্ধ করে একছত্র অধিপতি
হিসেবে আবিভর্‚ত হন। তিনি ‘রাশিয়ার জার‘ এই উপাধি ধারণ করেছিলেন। তৃতীয়
আইভানের মৃত্যুর পর পুত্র ভ্যাসিল এবং নাতি চতুর্থ আইভান (১৫৩৩- ১৫৮৪) তৃতীয়
আইভানের শাসননীতি অব্যাহত রাখেন। ১৫৭৭ সালে লিভোনিয়া যুদ্ধে রাশিয়া বালটিক

অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শ্বেতসাগরের তীরে আঁচঞ্চল নামে একটি বন্দর স্থাপন
হয় এবং রাশিয়ার দক্ষিণ সীমান্ত ক্যাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত রাশিয়া বিস্তার লাভ করে।
চতুর্থ আইভেনের মৃত্যুর পর রাশিয়ায় প্রায় ত্রিশ বছর অরাজকতা চলতে থাকে এবং ঐ সময়টি
অরাজকতার যুগ (ঞরসব ড়ভ ঞৎধঁনষবং) নামে পরিচিত ছিল।
বৈদেশিক আক্রমণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, ‘কৃষক বিদ্রোহ’-অভিজাত শ্রেণীর
বিদ্রোহ এই যুগের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগে বিদেশী শক্তি যেমন পোল্যান্ড কর্তৃক
ক্রেমলিন দখল (বালটিকের পূর্বাঞ্চল) সুইডেন অধিকৃত অঞ্চলের সীমানা বৃদ্ধি, দক্ষিণে
অটোম্যান সাম্রাজ্য কর্তৃক কসেক দখল করে ক্রিমিয়াতে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার
পরিস্থিতি মারাতœক আকার ধারন করে। ফলে এই পরিস্থিতিতে অপমাণিত হয় রুশজাতি। এই
অবস্থা অবসানের লক্ষে রাশিয়ার সকল শ্রেণীর প্রতিনিধি সভা জেমসকি সবোর আহবান করা
হয়। প্রায় ৫০টি শহরের প্রতিনিধিগণ মস্কোতে জড়ো হয়ে প্রাচীন বোয়ার পরিবারের মাইকেল
রোভানভ নামে এক ব্যক্তিকে জার পদে অধিষ্ঠিত করে। রোমানভ সিংহাসন লাভের পর
থেকেই আধুনিক রাশিয়ার বিবর্তন শুরু হয়। দেশটিতে দ্রæত শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং
জারের সম্মান বৃদ্ধির ফলে সকল জনগোষ্ঠী মিলেমিশে রাশিয়া একটি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত
হয়। রাশিয়ার উত্থানে রোমানোভদের নীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রথমত, ভৌগোলিক সীমানা
বিস্তারের মাধ্যমে রাশিয়ার মর্যাদা বা শক্তি বৃদ্ধি করা এবং দ্বিতীয়ত, সকল ক্ষেত্রে রাশিয়াকে
পশ্চিমাকরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
২। মহামতি পিটারের বাল্যজীবন, শিক্ষা এবং পশ্চিমাদেশ ভ্রমণের প্রভাব
রাশিয়ার ইতিহাসে সবচাইতে বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন পিটার দ্য গ্রেট। মাইকেল রোমানভ
বংশের উত্তরাধিকারী পিটার দ্য গ্রেট শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ রাশিয়া গঠনে খুবই বলিষ্ঠ
ভূমিকা পালন করেন। প্রথম পিটার-এর আমলে রাশিয়া কার্যত মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে
আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। ১৫৮২ খ্রি: পিটার এবং তার ভাই আলেক্সিস-এর পুত্র দ্বিতীয়
থিওডোরকে যুক্তভাবে রাশিয়ার শাসক নিযুক্ত করা হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র দশ
বছর। তাদের বোন সোফিয়া ছিলেন রাজ প্রতিনিধি। এভাবে সাত বছর পর্যন্ত পিটার তার ভগ্নি
সোফিয়ার কর্তৃতাধীনে ছিলেন। সতেরো বছর বয়সে ভগ্নি সোফিয়াকে সরিয়ে এবং অসুস্থ
ভাইকে ত্যাগ করে ১৬৯৬ সালে রাশিয়ার একছত্র অধিপতি হিসেবে পিটার প্রতিষ্ঠা লাভ
করেন। দীর্ঘ ৩৫ বছর তার রাজত্বকালে রাশিয়ার জারের ক্ষমতার সংহতিকরণ, কেন্দ্রীভ‚ত
সরকার ব্যবস্থা, রাজ্যের সীমাবৃদ্ধি, চার্চের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, পশ্চাৎপদ রাশিয়ার বিভিন্ন
প্রকার সংস্কার কর্মসূচিকে অগ্রসর করা এবং পশ্চিমা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথ
প্রদর্শক।
শিশুকাল থেকেই পিটার ছিলেন শক্তিশালী এবং বিশাল আকৃতির মানুষ। লম্বায় ৭ ফুট, উৎসুক
দৃষ্টি সম্পন্ন, সংকল্পবদ্ধ, বদমেজাজী এবং শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী। বদমেজাজী এবং
নিষ্ঠুর হলেও তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ এবং কর্মঠ। প্রাচ্য দেশীয় সংস্কৃতির বদলে পশ্চিমা
আধুনিক সংস্কৃতির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল সবচাইতে বেশি। পিটারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম
ছিল। শুদ্ধ ব্যকরণ, বানান চর্চা, অঙ্ক শাস্ত্র ইত্যাদির বদলে তার মূল উৎসাহ ছিলো সামরিক

এবং নৌবিদ্যার প্রতি। তার ডাচ শিক্ষক টিম্যারম্যান তাকে অঙ্ক শাস্ত্র, ক্ষেপনাস্ত্র সম্পর্কীয়
বিদ্যা এবং দুর্গ নির্মাণ কৌশলাদি শিক্ষা দেন।
পিটার যখন রাশিয়ার সিংহাসনে আরোহন করেন তখন রাশিয়া ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
সামাজিক অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কোনো ক্ষেত্রেই রাশিয়ার ইউরোপীয় জাতিসমূহের সঙ্গে
তুলনা চলে না। পিটার এই অবস্থা পরিবর্তনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে তার
নীতিসমূহ হলো:
প্রথমত, তিনি ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে রাশিয়াকে ইউরোপীয়
রাজনীতিতে এক মর্যাদাশীল এবং শক্তিশালী দেশে পরিণত করা, এবং দ্বিতীয়ত, রাশিয়াকে
দ্রæত পশ্চিমাকরণ প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
১৬৯৬ সালে পিটার রাশিয়ার জাতশত্রট্ট তুর্কিদের কাছ থেকে অ্যাজভ দখল করেন, তুর্কিদের
বিরুদ্ধে তিনি মিত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। ২৭০ জন সদস্য নিয়ে পিটার মিখালাভখো-এর
নেতৃত্বে ইউরোপ ভ্রমণের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিলো
তুর্কিদের বিরুদ্ধে সর্বতোভাবে একটি তুকিবিরোধী মহাজোট গড়ে তোলা। তিনি তার এই
ভ্রমণে ইউরোপের সবচাইতে আধুনিক এবং অগ্রগতি সম্পন্ন এলাকা যেমন, হল্যান্ড, সুইডেন,
বাল্টিক, হ্যানোভার ঘুরে আসেন। ছদ্মবেশে এই সকল এলাকার শিক্ষা, শিল্প, কারিগরী,
বাণিজ্য, যুদ্ধ জাহাজ তৈরির কারখানা, নৌবিদ্যা, স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল দেখার তার
সুযোগ হয়েছিল। ফ্রান্সের ভার্সাই-এর সভ্য আচরণে তিনি যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি
ইংল্যান্ডের লর্ডসভার বিতর্ক তাকে চমৎকৃত করেছিলো। এই ভ্রমণে পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতা
এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে বিশেষত পশ্চিমের সরকার কাঠামো, ক‚টনীতি তিনি
বুঝতে পারেন। এই ভ্রমণে তিনি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় রাশিয়া কতটা পশ্চাৎপদ
এবং রাশিয়ার জনমসাজ কতদূর পিছিয়ে ছিলো তাও সম্যকভাবে উপলদ্ধি করতে পারেন।
জার্মানি, প্রæশিয়া, ইংল্যান্ড ঘুরে পিটার অবশেসে ভিয়েনায় আসেন। তবে ১৬৯৮ সালে জুলাই
মাসে স্ট্রেলজি সৈন্যবাহিনী বিদ্রোহ করে তাকে সরিয়ে সোফিয়াকে বসানোর ষড়যন্ত্র করে।
তিনি তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফিরে এসে স্ট্রেলজির বিদ্রোহী বাহিনীকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন।
রাশিয়াতে জারের একচ্ছ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক‚টনৈতিকভাবে ইউরোপে এই মিশনটি ব্যর্থ হলেও অর্থাৎ তুরস্কের বিরুদ্ধে কেউ যুদ্ধে এগিয়ে
না আসলেও এই ভ্রমণের ফলস্বরূপ রাশিয়ার সমাজকে আধুনিকীকরণের তিনি ধারণা ও
অভিজ্ঞতা লাভ করেন।
৩। পিটার এবং তার সংস্কার কর্মসূচি
অভ্যন্তরীণ সংস্কার :
রাশিয়াকে আধিকীকরণের লক্ষ্যে পিটার ৪টি নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
ক) রাশিয়াকে ইউরোপীয় ভাবধারায় গড়ে তোলা, খ) পশ্চিমের জানালা খুলে দেয়া-এই
উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বাল্টিক ও কৃঞ্চসাগর এবং সম্ভব হলে উভয় সাগরেই
প্রবেশাধিকার লাভ করা।

গ) জারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা।
ঘ) বিভিন্নমুখী সংস্কার আনয়ন করা। এই নীতিসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিটার কঠোর নীতি
গ্রহণ করে।
পিটার পিছিয়ে পড়া রাশিয়ার অবস্থা পরিবর্তনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। চতুর্দশ লুই-এরা দ্বারা
প্রভাবিত শাসন ব্যবস্থাই তিনি রাশিয়ার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেন। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের
মাধ্যমে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা স্থাপন, অভিজাত শ্রেণীর ক্ষমতা হ্রাস, চার্চের ক্ষমতা হ্রাস, ডুমার
প্রাধান্য লোপ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পের প্রসার, সেনাবাহিনী ইত্যাদি রাশিয়ার জাতীয় জীবনে
তিনি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধনে সচেষ্ট হন। এ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জারের ক্ষমতাকে
সর্বোাচ্চ স্তরে স্থাপন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি রাশিয়া এবং
পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে রুশদের একটি মর্যাদাশীল জাতিতে পরিণত
করতে চেয়েছিলেন।
শুধুস্ট্রেলজি বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা নয় বরং শক্তিশালী রাজতন্ত্র সৃষ্টির লক্ষ্যে
পিটার সর্বতোভাবে ব্যবস্থা নিতে থাকেন। তিনি বোয়েরদের জারের উপর যে নিয়ন্ত্রণ ছিল তা
অপসারণই করেন নাই বরং একটি সুনির্দিষ্ট এবং নিয়ন্ত্রিত জারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
এই লক্ষ্যে পিটারের সংস্কারের অন্যতম পদক্ষেপ ছিলো রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে পুর্নগঠিত
করার মাধ্যমে রাজশক্তি বৃদ্ধি এবং ইউরোপীয় দেশেগুলির সৈন্যদের সম্মুখীন হবার মতো
উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য পিটার-এর স্থায়ী অনুগত বেতনভোগী সেনাবহিনী গঠন করতে
সচেষ্ট হন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে পিটার রাশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী তুর্কি, পোল্যান্ড প্রভৃতি
দেশের কাছে তার সামরিক শক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেন। ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের আধুনিক
সৈন্যবাহিনী সম্পূর্ণ ধারণা গ্রহণ করে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা
করতে থাকেন। এ্যাজোভ দখলের সময়েই তিনি স্থায়ী ও নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠনের
প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। রাশিয়ার হাজার মাইলের সীমান্ত এলাকা তুর্কি, পোল্যান্ড,
সুইডেন এবং অন্যান্য দেশের জন্যে উন্মুক্ত ছিল।
পিটারের সেনা বাহিনীর অফিসার বা সৈন্যদের সমাজের সকল স্তর থেকে সংগ্রহ করা হতো।
প্রত্যেক দেশের জন্য নির্দিষ্ট কোটা বা সংখ্যা নির্ধারিত ছিল। সৈন্যবাহিনীর লোকদের জন্য
তাদের ভরণ পোষণের ব্যয়ও তারা নির্বাহ করতো। প্রত্যেক ২০টি কৃষকের ঘর থেকে একজন
সৈন্য অন্তভর্‚ক্ত করা হতো। এ ছাড়াও পিটার অভিজাত শ্রেণীর আলস্য ত্যাগ করে
সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য করেন। এর ফলে নুতন অভিজাত বা মধ্যবিত্ত স¤প্রদায়ের
উদ্ভব হয় যারা জমির মালিক, সৈন্যবাহিনী এবং জারের প্রতি অনুগত ছিলেন।
রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীকে পশ্চিমা ভাবধারায় নিয়ে আসার লক্ষে পিটার একটি
অশ্বারোহী সৈন্যদল, একটি গোলন্দাজ বাহিনী এবং একটি পৃথক সরবরাহ বিভাগ গঠন
করেন। পোল্যান্ডের যুদ্ধে আলেক্সিস-এর সময় দশ হাজার সদস্যের সৈন্যবাহিনী ছিলো।
পিটারের সংস্কারের ফলে ১৭০৯ সালে রাশিয়ায় দুই লক্ষ সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়াও
পিটার সামরিক এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ছোট একটি নৌবাহিনীও গড়ে তোলেন (১৭০৩

সালে) যারা তুরস্ক এবং সুইডেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এটিতে ৬টি ফ্রিগ্রেট, ৪৮টি বৃহৎ যুদ্ধ
জাহাজ, ৮০০টি গ্যালিস বা মাঝারি জাহাজ এবং ত্রিশ জাহার নাবিক ছিল।
এভাবেই পিটার দেশের ভিতরে ও বাইরে বিদ্রোহ এবং আক্রমণ দমন করেন। রাশিয়ার
সাধারণ জনগণকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় তিনি নিয়ে আসেন। জারের শক্তিকে সর্বাÍক করে
তুলবার উদ্দেশ্যে পিটার শাসনতন্ত্রের সংস্কার সাধন করে। এ ক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা নীতি গ্রহণ
করেন যেখানে রাষ্ট্রের সর্বোাচ্চ নির্বাহী বা প্রশাসক হিসেবে ছিলেন জার বা সম্রাট যিনি নিরঙ্কুশ
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। পিটারের শাসনের আগে বোয়েরদের ডুমা নামক যে অভিজাত সভা
বা জেমসকি সবোর (তবসড়ংশর ঝবনড়ৎ) নামক সাধারণ সভা ছিল তা বাতিল করা হয়। এ
গুলির পরিবর্তে তিনি নিজ মনোনীত নয়জন সদস্য নিয়ে ‘সিনেট’ নামের এক রাজকীয় সভা
গঠন করেন।
এ ছাড়াও পিটার প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থাকে পুর্নগঠন করেন যেটি ঐ সময় একেবারে বিশৃঙ্খল
অবস্থায় ছিল। পূর্বের গঠন প্রণালী ভেঙ্গে শাসন ব্যবস্থাকে বিভক্ত করেন। এই গুইবারনিস
একজন গভর্নর এবং ক্ষুদ্র সহায়ক সভা (ল্যান্ডব্যাথ) দ্বারা পরিচালিত হতো, সদস্যরা অভিজাত
শ্রেণী কর্তৃক মনোনীত হতো। এ ছাড়া দশটি সরকারি মন্ত্রণালয় গঠন করা হয় যা যুদ্ধ,
অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, কৃষি ইত্যাদি কাজের দেখভাল করতো। শহর এলাকায় একটি করে
পৌরসভা স্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রের সবচাইতে ক্ষুদ্রতম একক এর নাম ছিল ‘মির’। এভাবে গ্রাম
থেকে কেন্দ্রীয় শাসন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই জারের কর্তৃত্ব সুসংহত করা হয। অভিজাত শ্রেণী
যারা সরকারি পদে আসীন ছিলেন তাদের কোনো সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা ছিল না। এরা
জারের অনুগত ভৃত্যে পরিণত হয়।
তিনি অভিজাত স¤প্রদায়ের পুত্রদের বিদেশে পড়াশুনার নির্দেশ দেন। তাদের পিতাদের মতো
আজীবন সেনাবাহিনী, সরকারি এবং শিল্প কারখানায় কাজ করার ব্যবস্থা করেন। এভাবে তিনি
চাকুরি ভিত্তিক অভিজাত শ্রেণী (ঝবৎারপব ঘড়নরষরঃু) সৃষ্টি করেন যা পরবর্তীসময়ে অভিজাত
স¤প্রদায় বা মধ্যবিত্ত স¤প্রদায় নামে এক নতুন শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। মূলত পিটারকে সর্বাÍক
সাহায্য দানের জন্যই একটি চাকুরী ভিত্তিক অভিজাত স¤প্রদায়ের সৃষ্টি করা হয়।
রাশিয়া ধর্মীয় ব্যাপারে কনস্টানটিনোপল বা বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেহেতু
যাজক স¤প্রদায় পিটারের সংস্কারের সবচাইতে বড় শত্রট্ট ছিলো তাই পিটার ধর্মান্ধ চার্চের
ক্ষমতাকে দুর্বল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। রাশিয়ার চার্চের সর্বোচ্চ শাসককে প্যাটিয়ার্ক বলা
হতো। পিটার রাশিয়ার চার্চের কর্তা প্যার্টিয়াক-এর পদ বিলোপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৭০০ সালে বিশপ এ্যাড্রিয়ান মারা যান, এরপর প্রায় একুশ বছর পিটার কোনো উত্তরাধিকার
মনোনীত করেন নাই। ১৭২১ সালে তিনি প্যাট্রির্য়াক-এর ক্ষমতা একটি কমিশনের উপর ন্যস্ত
করেন যা ‘পবিত্র সভা’ নামে পরিচিত হয়। এভাবে পিটার ধর্মীয় সংস্থা চার্চকে রাষ্ট্রীয় সংস্থায়
এবং যাজক স¤প্রদায়কে রাষ্ট্রের কর্মচারীতে পরিণত করেন। যেহেতু ‘পবিত্র সভা’ জারের
অধীনে ছিল এবং অফিস বা ধর্মীয় সংস্থার নিয়োগ এই সভার অনুমতি ছাড়া করা যেতোনা,
তাই চার্চ এবং রাষ্ট্র উভয়ের উপরই পিটারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধর্ম সংক্রান্ত
কোনো বইও এই সভার অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা যেতো না। তবে এর মাধ্যমে পিটার এর

ইচ্ছা অনুযায়ী রাশিয়ার চার্চ জারের সবচাইতে বড় সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবিভর্‚ত
হয়।
পিটার সমসাময়িক ইউরোপের মার্কেন্টাইলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তিনি
সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে রাশিয়াকে
তার নিজস্ব পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে হবে এবং কাঁচামাল নয় বরং তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি
করতে হবে এই নীতি প্রবর্তন করেন। এছাড়া তিনি রাশিয়ায় শিল্পকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত
করেছিলেন। নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল এবং এসব কল কারখানায় মূলত অস্ত্র,
যুদ্ধের সরঞ্জামাদি নির্মাণ এবং বস্ত্র সামগ্রী তৈরি করা হয়। তিনি জার্মানির মত রাশিয়ায় গিল্ড
ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেন। এ ছাড়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে রসদ সংগ্রহের জন্য তিনি রাশিয়ার বিভিন্ন
জায়গায় অনাবিষ্কৃত খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন।
এ ছাড়াও পিটার রাশিয়ার কৃষিক্ষেত্রে উন্নতির চেষ্টা করেন। কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর উন্নত বীজ,
সার ও আধুনিক যন্ত্রাদির ব্যবহার শুরু করেন। ১৬৯৮ থেকে ১৭২৫ সালের মধ্যে তিনি নানা
ভাবে খাজনা উত্তোলনের ব্যবস্থা করেন। গৃহস্থালি এবং ব্যক্তিগত উভয় বিষয়ের উপর
করারোপ করা হয়। এ ছাড়াও সিগারেট, তামাক, কবরস্থান সবকিছুর উপর কর আরোপ করা
হয়। এভাবে পূর্বের ১ লক্ষ ২০ হাজার রুবলের পরিবর্তে ২ লক্ষ ৫০ হাজার খাজনা আদায়
হয়।
পিটার প্রথম থেকে রাশিয়ার জনগণকে পাশ্চাত্য ভাবধারায় নিয়ে আসতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি
জনগণের আচার-আচরণ এবং পোশাক-পরিচ্ছেদে পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট হন। রুশ
জাতিকে পশ্চিম ইউরোপীয় আচার ব্যবহার, সভ্যতা ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে তিনি
রাশিয়ায় ইউরোপীয় পোশাক পরিচ্ছেদ, নৃত্যগীত ইত্যাদি প্রবর্তন করেন। ইউরোপ থেকে
দেশে ফিরে এসে তিনি কিছু নয়া নির্দেশ জারি করেন। লম্বা দাঁড়ি ছিল রাশিয়ার পুরনো
ঐতিহ্যের প্রতীক এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত, এছাড়া লম্বা ঢিলেঢালা পোশাক যা টোগা
নামে পরিচিত ছিল। এসব তিনি নিষিদ্ধ করেন । ফ্রান্স এবং জার্মানির কাপড় ব্যবহারে
উৎসাহিত করেন। পশ্চিমা মেয়েদের মুক্ত জীবনের প্রতি মিল রেখে পিটার উচ্চ শ্রেণীর
মেয়েদের পর্দা খুলে দেবার নির্দেশ দেন। এছাড়া স্বামী-স্ত্রীর একত্রে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাবার
অনুমতি দেয়া হয়। জার নিজে পশ্চিমা নৃত্য শিখেছিলেন, তিনি অভিজাত শ্রেণীকেও এই
শিক্ষা দেন এবং আশা করেন যে, আধুনিক কলা হিসেবে এটি রাশিয়াতে দ্রæত প্রসার লাভ
করবে। এ ছাড়াও পিটার ধুমপানের অনুমতি দেন যা তার বাবা নিষিদ্ধ করেছিলেন- ১৬৪৯
সালে। এ ছাড়াও পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে সাধারণ চিকিৎসক এবং দন্তচিকিৎসকের কাছে
যাবার রীতি শুরু হয়। এছাড়াও প্রাচ্য দেশীয় নিয়মানুযায়ী সম্রাটের সম্মুখে মাথা ঠুকিয়ে কুর্নিশ
করার যে রীতি তা বাতিল করা হয়।
পিটার শিক্ষার ব্যাপারে জোর দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে শিক্ষা বাধ্যতামুলক করা হয় এবং
বিভিন্ন জায়গায় প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষার স্কুল খোলা হয়। মস্কো এবং সেন্টপিটার্সবার্গে
তিনি যে সব স্কুর খোলেন তা ছিল সামরিক ও বৃত্তিমূলক। তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলসমূহে
ইঞ্জিনিয়ারিং, নৌবিদ্যা, হিসাববিদ্যার উপর ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়াও তিনি

একটি বিজ্ঞান পরিষদ গঠন করেন। তার সময়ে রাশিয়ার বর্ণমালা সংস্কার করা হয়। পূর্বের
আটটি বর্ণ প্রত্যাহার করা হয় এবং আরো কিছু অক্ষর সহজীকরণের ব্যবস্থা করা হয়। এ
ছাড়াও পিটার রাশিয়াতে যিশু খ্রিস্টের জন্মসাল অনুসরণ করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন
করেন। এই নতুন পঞ্জিকা অনুসারে সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে নতুন বছর শুরু জানুয়ারিতে হয়।
১৭০৩ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার নতুন রাজাধানী স্থাপিত হয়। নেভা নদীর পার্শ্বে
একদিকে দ্বীপ এবং অন্যদিকে জলাভ‚মি বেষ্টিত সেন্ট পিটার্সবার্গ গড়ে উঠে। সেন্ট
পিটার্সবার্গকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দশ থেকে বিশ হাজার সৈনা বাহিনী,
চাষী এবং কৃষককে কাজে নিযুক্ত করা হয়। এখানে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং মন্ত্রীদের
স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। সেন্ট পিটার্সবার্গকে অপূর্বসুন্দর নির্মাণশৈলীতে সাজিয়ে
তৈরি করা হয়েছিলো। এর মধ্যে ছিল শীতকালীন প্রাসাদ, বারুশ শিল্পরীতি ভিত্তিক বিভিন্ন
রাজকীয় ও সুনিপুণ কারুশার্যময় প্রাসাদ, বাগান ইত্যাতি। একশত বছরে এটি প্যারিস, রোম
এবং আমস্টার্ডামের মত শহরে পরিণত হয়। এই শহর আধুনিক রাশিয়াকে উপস্থাপন করে,
পশ্চিম-এর সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গড়ে উঠে।
রাজত্বের শেষের দিকে পিটার সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে
আসেন। ভার্সাই যেমন চতুর্দশ লুইয়ের শাসনকে চিহ্নিত করে, সেন্টপিটার্সবার্গ ও তেমনি
পিটারের শাসন ব্যবস্থার শক্তি এবং একনায়কতন্ত্রের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে।
৪। পিটাররের পররাষ্ট্রনীতি
পিটারের পররাষ্ট্রনীতির মূলে ছিল রাশিয়াকে ইউরোপীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি অবস্থানে
নিয়ে আসা। তার পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল১) বাল্টিক অথবা কৃষ্ণসাগরে সম্ভব হলে উভয় সাগরেই রাশিয়ার প্রবেশ পথ নিশ্চিত করা।
২) এই দুই সাগরের পথ ধরে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ
স্থাপন করার প্রচেষ্টা চালানো।
এই পররাষ্ট্রনীতিসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রতিক‚ল পরিবেশ বা ভৌগোলিক অবস্থা
তার লক্ষ বা উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য প্রয়োজন ছিল
বালটিক অথবা কৃষ্ণসাগরের প্রবেশ পথে একটি রবফহীন বন্দর লাভ করা। কারণ, শ্বেতসাগর
বছরে নয় মাস বরফে আবৃত থাকায় ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য বিস্তারে রাশিয়ার নৌশক্তি
পিছিয়ে পড়েছিল। তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি পশ্চিম দিকে জানালা খুলতে চান অর্থাৎ তিনি
পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হন। বাল্টিক এবং কৃষ্ণসাগরের পানি বারো
মাসই তরল থাকে অর্থাৎ বরফ পানির অঞ্চল থেকে উষ্ণ পানিতে প্রবেশ করার এই যে
বৈদেশিক নীতি তা ‘উষ্ণজলনীতি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এভাবে উত্তর বাল্টিক সাগর থেকে দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের অন্তর্গত ভ‚মধ্যসাগরে ঢোকার তিনি
চেষ্টা করেন। এভাবে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে পিটার পশ্চিমের জানালা খুলে দেবার চেষ্টা
করেন।

পিটারের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য সফল করতে বা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন
করতে সুইডেন ও তুরস্কের সঙ্গে সংঘাত এবং যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। কারণ এই সময় বাল্টিক
সাগরের তীরবর্তী স্থানসমূহ ছিল সুইডেনের অধীন এবং কৃঞ্চসাগর ছিল তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত।
এই দুই সাগরের দিকে বা এই পথে অগ্রসর হবার অর্থই ছিল সুইডেন বা তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে
অবতীর্ণ হওয়া। গুস্তাভাস এডোলফাস-এর সময় থেকে সুইডেন ‘উত্তরের শক্তি’ হিসেবে
আবির্ভূত হয়। ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া লিভোনিয়া, ইনগ্রিয়া, পশ্চিম পোমারনিয়া-এর অধীনে
ছিল। এছাড়া কৃষ্ণসাগরে তুরস্কের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তাই সুইডেন এবং তুরস্কের সঙ্গে
যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধেই পিটার অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি এ্যাজভ
বন্দর দখল করতে সৈন্যবাহিনী পাঠান। কিন্তু বসবরাস এবং দার্দনেলিস প্রণালীদ্বয়ের উপর
কোনো অধিকার না থাকায় কেবলমাত্র এ্যাজভ বন্দর দখল করে এই পথে ভ‚মধ্যসাগরে
পৌঁছানো রুশদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইউরোপের সকল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে ব্যর্থ হলে
পিটার সুইডেনের পোতাশ্রায়গুলি দখর করতে আগ্রহী হয়ে উঠে। এ ছাড়াও ডেনমার্ক,
পোল্যান্ড, ব্রানডেনবার্গে সুইডেনের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙ্গে দিতে তিনি সোচ্চার
হয়েছিলেন। সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষে এই সময় পিটারের সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ
চলে আসে। তা হলো সুইডেনের সিংহাসনে পঞ্চদশবর্ষীয় অনভিজ্ঞ রাজা দ্বাদশ চার্লসের
ক্ষমতায় আসীন হন। দশম চার্লস যখন রাজা হন তখন রাশিয়া এবং এর আশপাশের রাজারা
মনে করেছিলেন যে তরুণ রাজার অপরিপক্কতা ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুইডেনকে তারা
ভাগ করতে সক্ষম হবেন। ১৬৯৯ সালে গঠিত রাষ্ট্রজোটের খবর পাওয়া মাত্র তাদের একত্রিত
হবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে দ্বাদশ চালর্স অর্তকিতে ডেনমার্ক আক্রমণ করেন। ডেনিসরা
সলর্সডহগ আক্রমণ করে। এরপর অগাস্টাস স্যাক্সন লিভোনিয়া আক্রমণ করলে দ্রæত গতিতে
দ্বাদশ চালর্স স্যাক্সন থেকে ১৭০০ সালের মে মাসে ১৫০০০ সৈন্যসহ ডেনমার্ক আক্রমণ
করেন এবং কোপেনহেগেন পর্যন্ত তার সেনা বাহিনী এগিয়ে যায়। ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ
ফ্রেডারিখকে অত্যন্ত অপমানজনক চুক্তি সম্পাদনে (১৭০০) বাধ্য করা হয়।
এভাবে ডেনিসদের পরাজিত করে চালর্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। ১৭০০
সালের নভেম্বর মাসে নাভা নদীতে উভয় পক্ষ মিলিত হয়। মাত্র আট হাজার সৈন্যসহ রাশিয়ার
চল্লিশ হাজার সৈন্যবাহিনীকে তিনি সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেন। তবে চালর্স এই যুদ্ধ আর না
চালিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের চ‚ড়ান্ত নিস্পত্তির আগেই তিনি তার তৃতীয় শত্রট্টু পোল্যন্ডের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হন। দীর্ঘ সাত আট বছর তিনি পোল্যান্ডের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ
চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৭০৬ সালে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ এবং ক্রাকো তিনি জয়
করেন এবং পোল্যান্ডের পার্লামেন্টকে রাজা আগস্টাসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাধ্য করেন তার
মনোনীত ব্যক্তি স্টেনিগলস জেলেস্কিকে পোল্যান্ডের রাজা হিসেবে বসানো হয়।
১৭০৮ সালে দ্বাদশ চালর্স প্রায় তেত্রিশ হাজার সৈন্যসহ রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং মস্কোর
দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই যুদ্ধে রাশিয়া রক্ষণাÍক ভূমিকা পালন করে। এই অভিযানের
মূল লক্ষই ছিল মস্কো দখল করা। রাশিয়ার স্মরণকালের তীব্র শীতে সুইডিসবাহিনী মস্কো
থেকে তখনও বহু দূরে ছিল। খাদ্য এবং অন্যান্য সরবরাহ ফুরিয়ে আসতে থাকে, ফলে বিভিন্ন
রোগে বহুলোক মারা যায়। রাশিয়ার বাহিনীর ক্রমাগসরতার কারণে সুইডিশ বাহিনী দক্ষিণ

দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এখানে কসেক উপজাতির সঙ্গে এক মৈত্রী চুক্তিতেও আবদ্ধ
হয়। ১৭০৯ সালে উভয়বাহিনী পোলটোভায় মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে পিটার চার্লসকে
পদানত করতে সক্ষম হন, বহু সুইডিস সৈন্য বন্দি হন। রাজাও যুদ্ধে গিয়েছিলেন।
তুির্কসাম্রাজ্যে তিনি আশ্রয় গ্রহণ করেন। পোলটোভায় রাশিয়ার বিজয় ইতিহাসে চ ড়ান্ত
নিস্পত্তিকারী বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৭২১ সালে সুইডেন এবং রাশিয়ার মধ্যে ন্যাসডেট চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী
রাশিয়া লিভোনিয়া, এস্তোনিয়া, ইনগ্রিয়া পায়। এভাবে সুইডেন বাল্টিক উপক‚লে তার
একচেটিয়া অধিকার হারায়। রাশিয়া ফিনল্যান্ড বা পশ্চিমদিকে তার জানালা খুলে দিতে সক্ষম
হয়। পিটার তার এই স্বপ্ন বাস্তাবয়নের লক্ষে সেন্ট পিটার্সবার্গে নুতন রাজধানী স্থাপন করেন
বাল্টিকের জানালা হিসেবে। বলা যায় এই চুক্তি বালটিক তথা উত্তর ইউরোপে সুইডিশ
আধিপত্য ভেঙ্গে দেয় এবং তার জায়গা রাশিয়া দখল করে নেয়। যদিও রাশিয়ার বন্দরসমূহ
বছরের অর্ধেক সময় বরফে আচ্ছাদিত থাকতো। কিন্তু তারপরও তিনিই রাশিয়াকে ইউরোপে
একটি সম্মানজনক আসন প্রদান করেছিলেন। পিটারের যোগ্যতা এবং সুইডেনের পতনে
রাশিয়া ইউরোপীয় সাম্রাজ্যভুক্ত শক্তিশালী দেশ হবার প্রথম পথ অতিক্রম করেন। যদিও
কৃষ্ণসাগরের দিকে তিনি তেমন সাফল্যমন্ডিত হন নাই। এটি পিটারের কৃতিত্ব যে তিনি
রাশিয়াকে একত্রিত করেন এবং এর সঙ্গে রাশিয়ার সীমানা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। এভাবে
ইউরোপীয় রাজনীতিতে রাশিয়া ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হতে থাকে।
সারসংক্ষেপ
মহামতি পিটার একটি জাতির সৃষ্টিতে সহায়তা করেন এবং সেই দেশটির জন্য উন্নতির বার্তা বয়ে
নিয়ে আসেন। একটি স্বৈরাচারী এবং দারিদ্র্য পীড়িত সমাজ ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে
সমাজের সকল অন্যায় অবিচার বন্ধ করে তিনি আধুনিক রাশিয়া গড়ে তোলেন। তিনি শক্তিশালী
রাজতন্ত্রের প্রতিভ‚ ছিলেন। রাশিয়ার পশ্চিমাকরণের নীতির ক্ষেত্রে তিনি অসমঝোতামূলক নীতি গ্রহণ
করেন। বোয়ের নামক পুরানো অভিজাত স¤প্রদায় বিলুপ্ত করেন এবং নতুন ভদ্রলোক স¤প্রদায় শ্রেণী
গঠন করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে কারখানা, ছাপাখানা, বিভিন্ন হাসপাতাল ও রাস্তাঘাট নির্মাণে
অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তবে পিটারের বৈদেশিক নীতি অভ্যন্তরীণ
নীতির চেয়ে সাফল্যমন্ডিত হয়ে ছিল। তিনি রাশিয়াকে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে রূপান্তরিত
করেছিলেন। বাল্টিক উপক‚লে রশিয়ার প্রবেশধিকার ছিল। তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে তিনি
বিরমাহীনভাবে সুইডেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি তৎকালীন সুইডেনের স্থলে রাশিয়াকে ‘উত্তরের
শ্রেষ্ঠ শক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ক‚টনৈতিক পাঠিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা
করেন।এভাবে কঠোর পরিশ্রম এবং চেষ্টায় সর্বাত্মক দিক দিয়ে রাশিয়াকে ইউরোপীয় শক্তির মর্যাদায়
ভ‚ষিত করেন। তার শাসনামলে আধুনিক সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী, শক্তিশালী আমলা শ্রেণীর গঠন,
প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নতুন রাজধানী যা আধুনিক এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ধারণ করতো, সর্বোপরি
একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করার ফলশ্রæতিতে রাশিয়াকে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে
পরিণত করেন পিটার।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পার্শ্বে টিক () চিহ্ন দিন
১। পিটারের পূর্বে রাশিয়ায় জারের সাধারণ সভার নাম কি ছিল?
ক) নেসটেড খ) ডুমা
গ) ডায়েট ঘ) পার্লামেন্ট
২। কার মৃত্যুর পর রাশিয়ায় প্রায় ত্রিশ বছরব্যাপী অরাজক অবস্থা চলতে থাকে?
ক) তৃতীয আইভান খ) চতুর্থ আইভান
গ) দ্বিতীয় আইভান ঘ) পঞ্চম আইভান
৩। কত সালে রাশিয়া তুর্কিদের কাছ থেকে এ্যাজভ বন্দর দখল করেন?
ক) ১৬৯০ খ) ১৬৯৩
গ) ১৬৯৬ ঘ) ১৬৯৯
৪। রাশিয়ার চার্চের সর্বোচ্চ শাসককে কি বলা হতো?
ক) প্যাটিয়ার্ক খ) পোপ
গ) ডিসিগথ ঘ) লর্ড
৫। রাশিয়া তৎকালীন সুইডেনের কোন রাজার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন?
ক) গুস্তাভাগ ভাসা খ) দশম চালর্স
গ) দ্বাদশ চালর্স ঘ) গুস্তাভাস এডোলভাস
৬। ন্যাসটেডের চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া কোনস্বপ্ন বাস্তবায়নে সক্ষম হয়?
ক) পূর্বের জানালা খুলে দেয়া খ) ডেনমার্ক দখল করা
গ) প্যাশ্রিæয়া দখল করা ঘ) পশ্চিমের জানালা খুলে দেয়া
উত্তরমালা : ১। (খ) ২। (ক) ৩। (গ) ৪। (ক) ৫। (গ) ৬। (ঘ)
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। রোমানভ বংশের উত্থানের সময় তৎকালীন রাশিয়ার অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখুন।
২। ছদ্মবেশে পিটারের ইউরোপ ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল? পশ্চিমা দেশসমূহে এই ভ্রমণ
রাশিয়ার আধুনিকীকরণের কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। পিটারের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো? আধুনিক রাশিয়া গঠনে তার
অভ্যন্তরীণ সংস্কার সম্পর্কে সংক্ষেপে মূল্যায়ন করুন।
২। বৈদেশিক ক্ষেত্রে মহামতি পিটার কোন উদ্দেশ্য পূরণে সর্বশক্তি ব্যয়িত করেন? পিটারের বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]