গাস্টাভাস এ্যাডোলফাসের পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্য ও সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করুন।
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে সুইডেনের অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো? এই যুদ্ধে গাস্টাভাস এ্যাডোলফাসের ভুমিকা আলোচনা করুন।


গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস সুইডেন তথা আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ
রাজা বলে স্বীকৃত। তিনি ছিলেন দশম চালর্সের পুত্র। তিনি সুইডেনের বিখ্যাত ভ্যাসা পরিবারে
সদস্য ছিলেন। এই পরিবারটি সুইডেনকে কয়েকজন বিখ্যাত শাসক উপহার দিয়েছিলেন
যাদের মধ্যে ছিলেন দ্বাদশ চালর্স এবং গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস।
স্ক্যানডেনেভিয়ার অধিবাসীরা তিনটি রাজ্য গড়ে তুলেছিল। যেমন ডেনমার্ক, নরওয়ে ও
সুইডেন। ক্রমশ তারা উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং স্ক্যানডেনেভিয়ান
উপনিবেশ তৈরি করে। ১৩৯৭ সালে ডেনমার্ক ও সুইডেন যৌথভাবে একত্রীকরণের মাধ্যমে
নাম হয় ‘ইউনিয়ন অব কামর’ (টহরড়হ ড়ভ ঈধষসড়ৎ)। তবে এটি সুইডেনবাসী বেশি দিন
সমর্থন করে নি। বিভিন্ন বিদ্রোহের পর অবশেষে সুইডেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
হয়।
গাস্টাভাস্ ভ্যাস্া সুইডেনের ভ্যাসা রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি আধুনিক সুইডেনের
শক্তি ও মর্যাদার গোড়া পত্তন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে সুইডেনে ডেনমার্কের
আধিপাত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় দেড় শত বছর দক্ষিণ সুইডেন, হল্যান্ড, স্কার্ভিনিয়া ও বে- রিং
নামক স্থানগুলি ডেনমার্ক দখল করে সুইডেনের উত্তর সাগর ঢোকার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
কিন্তু ১৫২৬ খ্রি: গাস্টাভাস্-এর অধীনে সুইডেনের পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং সুইডেন ডেনমার্কের
কাছ থেকে মুক্তি পায়। গাস্টাভাস্ ভ্যাসাই দীর্ঘ দশ বছর তাঁর সামরিক শক্তি, রাজনৈতিক
প্রতিভার প্রয়োগ ঘটিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সুইডেনের ভ্যাসা রাজ বংশের শক্তিশালী
ভিত্তি স্থাপন করেন।
গাস্টাভাসের পৌত্র সিগিসমান্ডের (১৫৯২-১৬০০) আমলে সাময়িকভাবে সুইডেনে রাজনৈতিক
ও ধর্মনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সিগিসমান্ড সুইডেন এবং পোল্যান্ড উভয় স্থানের রাজা
ছিলেন। এই দুই দেশের রাজবংশ একই ভ্যাসা পরিবার থেকে উদ্ভুত। সিগিসমান্ড আমলের
অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন গাস্টাভাসের কণিষ্ঠ পুত্র নবম চার্লস (১৬০৪ - ১৬১১)। তিনি
পুনরায় প্রোটেস্টান্ট ধর্ম এবং রাজনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন। কিন্তু যেহেতু ডেনমার্ক

এবং পোল্যান্ড উভয় দেশেরই উদ্দেশ্য ছিল সুইডেনের রাজসিংহাসন অধিকার করা, তাই এই
সময় সুইডেন এই দুই দেশের সঙ্গে এক পারিবারিক কলহে লিপ্ত হয়। নবম চার্লসের মৃত্যুর
সময়ে সুইডেন পোল্যান্ড এবং ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই দুই দেশের সঙ্গে যুদ্ধে
তাঁর সুযোগ্য পুত্র গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস্ সুইডেনের সিংহাসনে আরোহন করেন।
প্রোটেস্টান্টবাদের চ্যাম্পিয়ান হিসেবে গাস্টাভাস ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বীকৃত
ছিলেন। রোমান ক্যাথলিক দমনে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি এ ক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়োগ
করেন।
ফরাসিরাজ চতুর্থ হেনরির ন্যায় তিনিও বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। নেতৃত্বের উপযোগী
প্রতিভা, উদ্ভাবনী শক্তি, সামরিক ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁকে সমসমায়িক রাজাগণের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ স্থান করে দিয়েছিল। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশও জনগণের
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি অনেক কিছু করেছিলেন। জার্মান
প্রোটেস্টান্টদের রক্ষা করার জন্য তিনি অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ শক্তির বিরোধিতা করেছিলেন।
চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের গুণে এ্যাডোলফাস সুইডেন তথা ইউরোপের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ রাজাগণের
অন্যতম বিধায় তাকে ‘উত্তরের সিংহ’ নামে অভিহিত করা হয়।
গাস্তাভাসের আগ থেকেই পোল্যান্ড এবং ডেনমার্কের সঙ্গে সুইডেনের দ্ব›দ্ব ছিল। সুতরাং পিতার
মৃত্যুর পর থেকেই তিনি পোল্যান্ড ও ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ষোড়শ
শতাব্দীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে সুইডিশগণ প্রতিবাদী বা প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ
করে। সুইডেন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উসকে দেয়। তিনি হ্যানস্যাটিক লীগ থেকে
সুইডেনকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সামরিক শক্তিতে সুইডেনকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতৃত্বদানকারী
বালটিক শক্তিতে পরিণত করেন। এছাড়াও তার সময়ে লুথারবাদ সমগ্র সুইডেনে ছড়িয়ে
পড়ে। তাঁর অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ছিলো ঃ
১। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন ;
২। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সুইডেনকে উত্তর ইউরোপের একটি শ্রেষ্ঠ শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করা। এ
এক্ষেত্রে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল :
ক) বাল্টিক সাগরকে সুইডিস হ্রদে পরিণত করা ;
খ) জার্মানিতে প্রোটেস্টান্টদের ধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে সাহায্য করা এবং সেই সূত্রে
ইউরোপে হ্যাপসবার্গ সম্রাটের আধিপত্যকে খর্ব করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ত্রিশ
বছরব্যাপী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
২। গাস্টাভাসের অভ্যন্তরীণ সংস্কারসমূহ
গাস্টাভাস প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হন। এর পূর্বে
কোনো রাজাই এ বিষয়ে মনোযোগ দেন নি। শ্রমিকদের জন্য তিনি কাঁচ, চিনি, শ্বেতসার,
তামা ও লোহা ইত্যাদি নানা প্রকারের শিল্প গড়ে তোলেন। ১৬২৯ খ্রি: একটি নৌ-শিল্প
প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ ও বাণিজ্য জাহাজ
তৈরি করা। তাঁর আমলে উসেলিংক নামে জনৈক ব্যবসায়ী ‘সাউথ সি কোম্পানি’ নামে একটি
প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এটি একটি কোম্পানি যা আফ্রিকা প্রæশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার

সঙ্গে বাণিজ্য করতো। এভাবে কর্মদক্ষতা এবং বিচক্ষণতায় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গাস্টাভাস
আশানুরূপ ফল লাভে সমর্থ হয়েছিলেন।
৩। গাস্টাভাসের পররাষ্ট্রনীতি
দ্বিতীয় গাস্টাভাস্ এডোলফাস ছিলেন সুইডেনের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। গাস্টাভাস্
ইউরোপের প্রোটেস্টান্টদের রক্ষাকল্পে একজন চ্যাম্পিয়ান হিসেবে আবিভর্‚ত হন। তিনি
সুইডেনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি যখন সিংহাসনে আরোহন
করেন তখন এটি ছিল একটি বিভক্ত অন্ধকারে পতিত সমস্যা সঙ্কুল দেশ। তাঁর সমগ্র শাসন
ছিল দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিপূর্ণ। যেমন, ডেনমার্কের সঙ্গে (১৬১১-১৬১৩), রাশিয়ার সঙ্গে
(১৬১৪-১৬১৭) এবং পোল্যান্ডের সঙ্গে(১৬১৭-১৬১৯) যুদ্ধ।
পররাষ্ট্রনীতির উন্নতির লক্ষ্যে গাস্টাভাস আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও রণসাজে সজ্জিত একটি সেনা
বাহিনী গড়ে তোলেন। এই আধুনিক সৈন্য বাহিনীর কারণেই তিনি একটি শক্তিশালী বৈদেশিক
নীতি গ্রহণ করতে সক্ষম হন এবং তাঁর দেশের সীমানা ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি যুদ্ধ
ক্ষেত্রে সৈন্য বাহিনীকে যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ইউনিটে বা এককে বিভক্ত
করেন। পদাতিক গোলন্দাজ এবং অশ্বারোহী বাহিনীকে শক্তিশালী আলাদা আলাদা ইউনিট
হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
সুইডেনের রাজা হিসেবে গাস্টাভাস বাল্টিকের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর বৈদেশিক
নীতির একটি বিশেষ অংশ পরিচালিত হয় ডেনমার্কের বিরুদ্ধে। ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে
ডেনমার্কের রাজা চতুর্থ খ্রিস্টান ক্যাথলিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের সৈনাধ্যক্ষ ওয়েলেনস্টিনের
হাতে পরাজিত হলে তার সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই সময়ে তিনি
গাস্টাভাসের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে বাধ্য হন। ক্যাথলিক আক্রমণ থেকে ডেনমার্কের স্বার্থ
রক্ষার্থে তিনি ১৬২৮ খ্রি: ‘সাউথ সি’ জলভাগে সুইডেনের জাহাজ বিনাশুল্কে চলাচলের
অধিকার স্বীকার করে নেন। গাস্টাভাস বাল্টিক সাগরে আটখানা যুদ্ধ জাহাজ সবর্দা মোতায়েন
রেখে ক্যাথলিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ডেনমার্কের নিরাপত্তার ভার গ্রহণ করেন। এভাবে সুইডেন
এবং ডেনমার্কের মধ্যে সাময়িক সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মিখাইল (মাইকেল) রোমানভ রাশিয়ার রাজা তথা জার পদ লাভ
করেন। তিনি বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করলে গাস্টাভাস
এ্যাডোলফাসের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। স্তোলরোভও-এর সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে।
রাশিয়া ইংগ্রিয়া ও ক্যারোলিনা নামক বাল্টিক সাগর উপক‚লস্থ বন্দর দুটি সুইডেনের নিকট
ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং এসোনিয়া ও লিভোনিয়া প্রভৃতি বন্দরের উপর আক্রমণ করবে না
এই প্রতিশ্রæতি দেয়। এভাবে রাশিয়া বাল্টিক উপক‚ল থেকে বিতাড়িত হয়, তবে ১৬১৭ সালের
চুক্তি বলে রাশিয়া ইনগ্রিয়া দখল করে।
পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে গাস্টাভাসের যুদ্ধ দীর্ঘ নয় বছর ধরে চলতে থাকে। অপ্রতিহত গতিতে এই
দ্ব›দ্ব চলতে থাকে। পোল্যান্ড সিগিসমান্ড গাস্তাভাসকে সুইডেনের রাজা বলে স্বীকার করেনি।
দুই পরিবারের দ্ব›দ্ব কিছুকাল স্থগিত থাকলেও ১৬২৫ সালে পুনরায় দুইদেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু

হয়। গাস্টাভাস প্রাশিয়া আক্রমণ করেন। অল্পকালের মধ্যেই ব্রানসবার্গ সুইডেনের দখলে চলে
যায়। পোল্যান্ডের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে রিশল্যুর মধ্যস্থতায় ছয় বছরের জন্য (১৬২৯)
আল্টমার্ক নামক এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে সিগিসমান্ড গাস্টাভাসকে
সুইডেনের রাজা বলে পোল্যান্ড স্বীকার করে নেয়। ইলরিং, পিলো ও মেমেল নামক বন্দরসহ
লিভেনিয়া সুইডেনের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এছাড়াও সুইডেন এস্তোনিয়া, বোরল্যান্ড ও
ভিসুটলা হস্তাগত করে, বিখ্যাত শিল্প ও বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলি পায়। ডানজিগ বন্দরের শুল্ক
থেকে যাবতীয় আয় সুইডেন পাবে এটিও স্বীকৃত হয়।
এভাবে নতুন ভ‚মি দখল করে গাস্টাভাস বাল্টিক উপক‚লে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠেন
এবং বাল্টিক বাণিজ্য সম্পূর্ণ নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এর ফলে উত্তর জার্মানিতে
সুইডেনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বাল্টিকই উত্তর-সাগরকে সুইডিশ হ্রদে পরিণত করার
পরিকল্পনা অনেকটা এগিয়ে যায়।
৪। ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে গাস্টাভাসের ভ‚মিকা
গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস ছিলেন সুইডেনের শ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি ছিলেন রাজনীতি এবং একজন
সেরা সমর কুশলী, সুইডেনের শ্রেষ্ঠত্ব, শৌর্য ও শক্তির প্রতীক। ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে তাঁর
অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ইউরোপের প্রোটেস্ট্যান্টবাদকে রক্ষা করার সঙ্গে দেশের ভাগ্য
সুপ্রসন্ন করা।
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধ বহুকাল ধরেই জার্মানিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছিল। ১৬৬০ সালে
প্রোটেস্টান্টদের রক্ষাকল্পে গাস্টাভাস এই যুদ্ধে অংশ নিলেও নতুন ভ‚মি হস্তগত করার মাধ্যমে
তাঁর দেশকে ‘উত্তরের শক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর প্রধান ইচ্ছা।
এই প্রচেষ্টায় গাস্তাভাস কার্ডিনাল রিশ্যলু কর্তৃক সাহায্য প্রাপ্ত হয়। রিশ্যলুর মূল উদ্দেশ্য ছিল
হ্যাপসবার্গকে দুর্বল করা। মূলত এই যুদ্ধে ফ্রান্সের বুরবোঁ এবং স্পেন ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ
দ্ব›েদ্ব রূপান্তরিত হয়। ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য রিশ্যলু গাস্টাভাসের সঙ্গে
চুক্তিসম্পাদন করেন। ক্যাথলিক হয়েও রিশ্যলু গাস্টাভাসের মিত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে ছাব্বিশ
হাজার সৈন্য এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধের তৃতীয় পর্বে গাস্টাভাস সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়
ফার্দিনান্ড যখন যুদ্ধে পরাজিত হন তখন গাস্টাভাস প্রোটেস্টন্টদের চ্যাম্পিয়ান হিসেবে
বোহেমিয়ার প্রোটেস্টান্টদের রক্ষার্থে জার্মানিতে আগমন করেন। সুইডেনের সৈন্যবাহিনী
১৫৩০ সালে জুলাই মাসে জার্মানিতে প্রবেশ করেছিল। এটি ইউরোপের আধুনিক ও অন্যতম
শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল। এর গোলন্দাজ বাহিনী ছিলো দ্রæত গতিসম্পন্ন। এছাড়াও এটি
ছিলো একটি জাতীয় সেনা বাহিনী-যার মূলে ছিলো জাতীয় চেতনা এবং একই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট
ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় চিন্তা। সর্বোপরি এটি ছিলো ইউরোপের সবচাইতে সুশৃঙ্খল ও সামরিক শিক্ষায়
সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী।

গাস্টাভাস প্রথম দিকে তেরো হাজার সৈন্য সমেত করতে এগিয়ে গেলেও দ্রæত তা চল্লিশ
হাজারে উন্নীত হয়। গাস্টাভাসের জার্মানি আক্রমণের প্রাক্কালে প্রোটেস্টান্ট রাজন্যবর্গ-বিশেষত
ব্রানডেনবার্গ এবং স্যাক্সনির ইলেকটর জার্মানিতে সুইডেনের প্রভাবের আশংকায় নিরপেক্ষতা
বজায় রাখে। তবে প্রথম থেকে গাস্টাভাস প্রতিটি যুদ্ধে বিজয়ী হন। পোমারানিয়ার পতন
ঘটলে ব্রানডেনবার্গের ডিউক জর্জ উইলিয়াম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গগুলিসহ গাস্টাভাসের বাহিনীর কাছে
ত্মসমর্পণ করেন। এরপর হ্যাপসবার্গ বাহিনীর প্রধান কাউন্ট টিলি এবং কাউন্ট পাপেন হাইম
ম্যাগডেবার্গ শহর ধ্বংস করতে উদ্যত হন। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে সমগ্র শহরটি ধ্বংসস্তুপে
পরিণত হয়। ম্যাগডেবার্গের ধ্বংসযজ্ঞ এবং স্যাক্সনির আক্রমণের পরপরই প্রোটেস্ট্যান্ট
রাজন্যবর্গ নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে গাস্টাভাসের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
উত্তরের সিংহ গাস্টাভাস এরপর আক্রমণাÍক নীতি গ্রহণ করে ব্রাইটেনফিল্ডের দিকে এগিয়ে
যান। সেখানে তিনি টিলির নেতৃত্বধীন রাজকীয় সৈন্যবাহিনীকে মোকাবিলা করেন ৭ সেপ্টেম্বর
১৬৩১ সালে। লিপজিগের অদূরে টিলির সৈন্যবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। এই যুদ্ধে
সুইডিশ সৈন্য বাহিনী তাদের যোগ্যতা প্রমাণের মধ্য দিয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত
হয়। এরপর চৌদ্দমাস গাস্টাভাস একের পর এক বিজয় অজর্ন করতে থাকেন। রাইন পর্যন্ত
এগিয়ে গিয়ে তিনি উত্তর জার্মানি দখল করেন। এভাবে গাস্টাভাসের সৈন্যরা ভিয়েনা পর্যন্ত
বিজয় অভিযান চালিয়ে যায়। পবিত্র রোমান সম্রাট ফার্ডিনান্ড কোনো উপায় না দেখে সেনাপতি
ডিউক অব ব্রাইটল্যান্ডকে ওয়েলেনস্টিন ডেকে পাঠান। এর ফলে রাজকীয় বাহিনী আবার
প্রাণশক্তি ফিরে পায়। ব্যাভারিয়া অভিযানে লিচফিল্ডের যুদ্ধে টিলি পরাজিত ও নিহত হন।
এরপর সুইডেনের রাজা জার্মানিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন এবং রাজকীয় বাহিনী
ওয়েলেনস্টিইনের উপর নির্ভর হয়ে পড়ে।
বিজয়ী গাস্টাভাসের বাহিনী অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গের বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।
এই দুই বাহিনী ১৬৩২ সালে লুজনে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। ভয়াবহ যুদ্ধের পর
ওয়েলেনস্টিন তার সৈন্য বাহিনী তুলে নিতে বাধ্য হন। যুদ্ধে সুইডেন জয়লাভ করে। তবে
সুইডেনের এই বিজয় হয়েছিল সর্বোাচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে। কারণ এই যুদ্ধে গাস্টাভাস মারা
যান। সুইডেন গাস্টাভাসের নীতি ত্যাগ করে নি বরং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। তবে ৬ মাস
পরে নরজিঙ্গজে সুইডিশ বাহিনী পরাজিত হলে প্রাগে শান্তিচুক্তি হয়। এই চুক্তির পর সুইডেন
ইউরোপে তার মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
৫। শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক
নেতৃত্বের প্রতিভা, উদ্ভাবনী শক্তি, সামরিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় গাস্টাভাস ইউরোপের
রাজা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতির স্বাক্ষর ছাড়াও
শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিও তার অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিলো। তিনি ইউরোপের তিনটি ভাষা
জানতেন। হুগো গ্রসিয়াস ছিল তাঁর প্রিয় লেখক। কবিতা এবং সঙ্গীতের প্রতি তিনি ছিলেন
প্রবল অনুরাগী। শিক্ষা, বিচারবুদ্ধি, দূরদৃষ্টি প্রভৃতি গুণ তাকে সমসাময়িক রাজগণের উর্ধ্বে
স্থাপন করে দেয় ।

সারসংক্ষেপ
সপ্তদশ শতাব্দীতে উত্তর-ইউরোপে সুইডেনের প্রাধান্য স্থাপনের পথ প্রদর্শক ছিলেন গাস্টাভাস
এ্যাডোলফাস। কেবলমাত্র বীর যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুশিক্ষিত, জনকল্যাণকামী দেশ
প্রেমিক হিসেবে গাস্টাভাস সুইডেন তথা ইউরোপের ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছেন। সুইডেনের
জাতীয় এক সঙ্কটময় মুহূর্তে সিংহাসন লাভ করে তিনি সুইডেনের স্বার্থ রক্ষা করেন। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যের দ্বারা তিনি জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি করেন। ব্যবসায়, বাণিজ্য বৃদ্ধি, শক্তিশালী
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী গঠন সবদিকেই এর ফলে সুইডেনের পুনরুজ্জীবন ঘটে। জার্মানিতে নতুন স্থান
হস্তগত হওয়ায় সুইডেন জার্মানির ব্যবস্থাপক সভায় ভোটের অধিকার প্রাপ্ত হয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে
তাঁর পথ ও আদর্শ অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে সুইডেন বাল্টিক সাগরে একক প্রাধান্য স্থাপন করতে
সমর্থ হয়েছিল। আবার জার্মানির উত্তরভাগে হ্যাপসবার্গ সম্রাটের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তৃত হলে
সুইডেনের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এই উপলব্ধি থেকে ত্রিশবছরব্রাপী যুদ্ধে সম্রাটের বাহিনীকে প্রতিহত করতে
তিনি এগিয়ে আসেন। ইউরোপ তথা জার্মানির প্রোটেস্টান্টদের রক্ষা করাও ছিল তাঁর অন্যতম
উদ্দেশ্য। ব্রাইটেনফিল্ড ও লুজনের যুদ্ধে গাস্টাভাসের অসাধারণ সামরিক প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিনি সামরিক পদ্ধতিতে নতুন কৌশল আনয়ন করে অবিস্মরণীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বলা যায়
ইউরোপীয় রাজনীতিতে এবং ব্যক্তিত্বের গুণে এ্যাডোলফাস সুইডেন তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
রাজা বলে বিবেচিত হয়ে থাকবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে গাস্টাভাসের সময় সুইডেন
ইউরোপের প্রথম সারির দেশ হিসেবে অবিভর্‚ত হয় এবং সুইডেনের জন্য অসামান্য গৌরব বয়ে আনেন
তিনি।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পার্শ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। সুইডেনের ভাসা রাজাবংশের প্রতিষ্ঠতা কে ছিলেন?
ক) দশম চালর্স খ) গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস
গ) গাস্টাভাস ভাসা ঘ) দ্বাদশ চার্লস
২। গাস্টাভাস এ্যাডোলফাসকে কোনো নামে ভ‚ষিত করা হয় ?
ক) উত্তরের সিংহ খ) বাল্টিকের সম্রাট
গ) স্ক্যানডেনেভিয়ার মহারাজ ঘ) সুইডেনের অক্লান্ত যোদ্ধা
৩। কোনো যুদ্ধকে প্রথম আধুনিক রণসাজে সজ্জিত যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ?
ক) গোলাপের যুদ্ধ খ) ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধ
গ) সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ ঘ) আফিমের যুদ্ধ
৪। সুইডেনের সঙ্গে পোল্যান্ডে দীর্ঘ কত বছর ব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল ?
ক) ৫ বছর খ) ৭ বছর
গ) ৩ বছর ঘ) ৯ বছর
৫। কোনো শহর পতনের পর প্রোটেস্ট্যান্ট রাজন্যবর্গ গাস্টাভাসের প্রতি তাদের নিরপেক্ষতা
ভঙ্গ করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ?
ক) ম্যাগডেবার্গ খ) পোমারনিয়া
গ) লুটার ঘ) বাভারিয়া
৬। কোনো যুদ্ধে গাস্টাভাস টিলিকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন ?
ক) লুটারের যুদ্ধে খ) ব্রাইটেনফিল্ডের যুদ্ধে
গ) লর্ড নরজিঙ্গজের যুদ্ধে ঘ) হোয়াইটহিলের যুদ্ধে
৭। লুজনের যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন কোনো সেনা শাসক ?
ক) ফার্ডিনান্ড খ) কাউন্ট টিলি
গ) গাস্টাভাস এ্যাডোলফাস ঘ) ওয়েলেনস্টাইন
৮। গাস্টাভাসের প্রিয় লেখক ছিলেন -
ক) এ্যারাসমাস খ) হুগো গ্রসিয়াস
গ) জি. ব্রæনো ঘ) ডেকার্টে
উত্তর : ১। (গ), ২। (ক), ৩। (খ), ৪। (ঘ), ৫। (ক), ৬। (খ), ৭। (গ), ৮। (খ)।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। গাস্টাভাস এ্যাডোলফাসের উত্থান সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখুন।
২। গাস্টাভাসের অভ্যন্তরীণ সংস্কারসমূহের বর্ণনা দিন।
৩। শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গাস্টাভাসের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। গাস্টাভাস এ্যাডোলফাসের পররাষ্ট্র নীতির মূল উদ্দেশ্য ও সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা
করুন।
২। ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে সুইডেনের অংশগ্রহণের মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো? এই যুদ্ধে গাস্টাভাস
এ্যাডোলফাসের ভুমিকা আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]