সূচনা : ইউরোপের ইতিহাসে ব্যান্ডেনবার্গ প্রাশিয়ার উত্থান এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা। ব্রান্ডেনবার্গ
হলো একটি উত্তর জার্মান রাষ্ট্র যা ওডার নদীর পাশ ঘিরে অবস্থিত ছিলো। এটি মূলত একটি
সীমান্তবর্তী রাজ্য যা ‘মার্ক’ নামে পরিচিত ছিল। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো মূলত সামরিক ঘাঁটি
হিসেবে- বিশেষত úাভদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। কাঙ্কিশ শাসক শার্লামেনের সময়ে এটি মার্ক
বা ব্রান্ডেনবার্গ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে।
প্রাশিয়ার হোহেনজোলার্ন পরিবার পবিত্র রোমান সম্রাটের অধীনে দক্ষিণ জার্মানির অতি ক্ষুদ্র
স্থানীয় শাসক পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার
দায়িত্ব হোহেনজোলার্ন পরিবারকে দেয়া হয়। দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে হোহেনজোর্লান
ছোট ভ‚-স্বামী হিসেবে জোলান নামক দুর্গ অধিকার করে। দ্বাদশ শতাব্দীতে রোমান শাসক
ন্যুরনবার্গের মতো ধনী শহরের বার্গেজ বা শাসক নিযুক্ত হন। ১৪১৭ সালের ১৫ এপ্রিল সম্রাট
সিগিসমান্ড হোহেনজোলার্ন তুর্কিদের বিরুদ্ধে সাহায্যের মাধ্যমে ব্রান্ডেনবার্গ মার্ক বা সীমান্তবর্তী
প্রদেশের ফেডারিখকে শাসকের মর্যাদা দেন। এটি ভিন্ন হোহেনজোলার্ন পরিবারকে ইলেকটর
পদে নিযুক্ত করা হয়। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যারা অংশ গ্রহণ
করার অধিকার লাভ করতো তাদের ইলেক্টর বলা হতো।
পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে হোহেনজোলার্ন বংশ নিজেদের ক্ষমতা ও রাজ্য বৃদ্ধি করে চলে।
ব্রান্ডেনবার্গ প্রাশিয়ার উত্থান মূলত তিনটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো।
প্রথমত : পূর্ব প্রাশিয়া ছিলো বাল্টিক সাগর উপক‚লস্থ একটি ছোট ডাচি বা অঞ্চল যা পোল্যান্ড
রাজ্য দ্বারা বেষ্টিত এবং এখানকার জনগণ পোল্যান্ডের রাজার প্রতি অনুগতশীল ছিল।
জাতিগত ভাবে এরা ছিলো úাভ এবং ধর্মবিশ্বাসে লুথারপন্থী।
দ্বিতীয়ত : ব্রান্ডেনবার্গ ডাচি ১৪১৭ সালে ফ্রেডারিখ হোহেনজোলার্ন কর্তৃক হস্তগত হয়।
তৃতীয়ত : রাইনের পার্শ্ব ঘিরে ক্লিভস ডাচি গড়ে উঠেছিলো। জার্মানিতে ধর্মসংস্কার
আন্দোলনের সময় টিউটানিক নাইট প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে সমস্ত চার্চের জমি দখল
করে এবং একটি জাতিগত পরিচয় গ্রহণ করে। এটির নেতা হন এ্যালবার্ট হোহেনজোলার্ন।
তিনি পূর্ব প্রাশিয়াকে ব্রান্ডেনবার্গ-হোহেনজোলার্ন শাখার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। অতএব ১৬১১
সালের পর থেকে ব্রান্ডেনবার্গ হোহেনজোলার্ন শাসকেরা পূর্ব প্রাশিয়া শাসন করতে সমগ্র
বান্ডেনবার্গের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। তবে প্রাশিয়া তখনো পোল্যান্ডের অধীন
ছিলো। পোল্যান্ডের হস্তক্ষেপে ব্রান্ডেনবার্গ এবং প্রাশিয়া বিচ্ছিন্ন ছিলো। তবে পূর্ব প্রাশিয়া
এবং ব্রান্ডেনবার্গের মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে হোহেনজোলার্নরা ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে
জিইয়ে রাখে। ১৬১৮ সালে নি¤œ রাইন অঞ্চলের ক্লিভস ডাচি (উঁঃপযু) ব্রান্ডেনবার্গের হস্তগত
হয় দুই শাসকের বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে। এভাবে ব্রান্ডেনবার্গ প্রাশিয়ার
একত্রীকরণ হোহেনজোলার্ন পারিবারের ভাগ্যে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।
ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে প্রাশিয়া অর্থাৎ ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া প্রোটেস্টান্টদের দেশ হিসেবে
ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে ব্র্যান্ডেনবার্গ প্রথমে নিরপেক্ষ ছিলো। তবে
পরে গাস্টাভাসের চাপে তারা এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। এই সময় প্রাশিয়ার ইলেকটর
ছিলেন জর্জ ইউলিয়াম। ১৬৪০ সালে তিনি গ্রেট ইলেকটর হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন।
গ্রেট ইলেকটরের ক্ষমতালাভের সঙ্গে সঙ্গে ব্রান্ডেনবার্গ-প্রশিয়ার পুনরুজ্জীবন ও উত্থানের
ইতিহাস শুরু হয়। এর ফলে সপ্তদশ শতাব্দীতে হোহেনজোলার্ন ইউরোপের অন্যতম প্রধান
রাজকীয় পরিবার হিসেবে আবিভর্‚ত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মধ্য ইউরোপে একটি অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি এবং উনিশশতকে প্রাশিয়া সমগ্র জার্মানিকে শাসন করতে সমর্থ হয়।
মূলত তিনটি পর্বে এর উত্থানকে ভাগ করা যায় :
প্রথম পর্বে : হোহেনজোলার্ন সীমান্ত অঞ্চলে শক্তিশালী এলাকা হিসেবে গড়ে উঠে।
দ্বিতীয় পর্বে : ১৬৪০ থেকে ১৬৭০ খ্রি: ব্রান্ডেনবার্গ প্রাশিয়া উত্তর-ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়। এই পর্বে গ্রেট ইলেকটর তৃতীয ফেডারিখ এবং প্রথম ফ্রেডারিখ
উইলিয়াম ছিলেন।
তৃতীয় পর্বে : ফ্রেডারিখ দ্যা গ্রেটের সময়ে সমগ্র ইউরোপে একটি শক্তিশালী ইউরোপীয় শক্তি
হিসেবে এটি উত্থিত হয়।
গ্রেট ইলেকটরের অভ্যন্তরীণ নীতি
গ্রেট ইলেকটর-এর ক্ষমতা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাশিয়ার উত্থান ও পুনরুজ্জীবনের ইতিহাস
শুরু হয়। সিংহাসনে আরোহনের পর ফ্রেডারিখ উইলিয়াম যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন তা
হলো :
১। ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধে প্রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত বা ধ্বংস হয়।
২। ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া রাজ্যের বিভিন্ন অংশ ছিলো অসংহত, ইতস্তত এবং বিক্ষিপ্ত। প্রত্যেক
অংশেই একটি স্থানীয় সভা (উরবঃ) ছিলো এবং স্থানীয় কর্মচারীবৃন্দ নিয়ে পৃথক শাসনব্যবস্থা
চালু ছিলো।
৩। তিন অংশের জনসাধারণই সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিলো অনুন্নত যা একটি জাতির প্রগতি
এবং উন্নতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি যে নীতি
গ্রহণ করেছিলেন তা হলো- (১) প্রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন এবং বিক্ষিপ্ত রাজ্যগুলিকে একত্রিত করা- ২)
প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন; ৩) শক্তিশালী সেনাবাহিনীও সুদক্ষ আমলা শ্রেণীর সাহায্যে নিজ
ক্ষমতাকে সর্বাত্মক করা। ৪) সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো কেন্দ্রীয়
সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীনে স্থাপন করা।
ফ্রেডারিখ উইলিয়াম চতুর্দশ লুইয়ের আদর্শ অনুযায়ী রাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী
ছিলেন। তিনি তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অংশকে একত্রিত করেন। ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া
তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত হয়েছিলো, যথা ক্লিভস, ব্রান্ডেনবার্গ এবং পূর্ব প্রাশিয়া। এই
তিনটি রাজ্যই ছিলো স্বাধীন। প্রত্যেকের নিজস্ব সংবিধান, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী ও
ব্যবস্থাপক সভা ছিলো। গ্রেট ইলেকটর তিনটি রাজ্যকে একত্রিত করে কেন্দ্রীভ‚ত শাসন বা
সরকার প্রতিষ্ঠা করে। তিনি সকল প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাকে দমন করে এদেরকে বার্লিনের
সরাসরি অধীনে নিয়ে আসেন। এভাবে তিন রাষ্ট্র একত্রিত হয় এবং নিজেকে তিনি একচ্ছত্র
অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
খ) প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুন : র্গঠন
প্রশাসনিক সংস্কারে গ্রেট ইলেকটর তৈরিতে তিনি সমসাময়িক চতুর্দশ লুইয়ের নীতি গ্রহণ
করেন। প্রাশিয়াকে ইউরোপের একটি শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করাই ছিল তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতির
মুল উদ্দেশ্য। তিনি কাউন্সিল অব স্টেট বা রাষ্ট্র সভা নামে একটি কেন্দ্রীয় সভা স্থাপন করেন।
এটি ছিলো সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল উৎস। রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মসূচি ও রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় তিনি
কেন্দ্রীয় সরকার বা কাউন্সিল অব স্টেট এর অধীনে স্থাপন করেন। প্রত্যেকটি প্রদেশ একজন
স্টেটপলজারের বা প্রদেশ প্রধানের অধীনে নিয়ে আসেন। এ ছাড়াও প্রশাসনিক কাউন্সিলার বা
কর বা খাজনা আদায়ের বিষয়টি পরিচালিত হতো ‘ল্যান্ডোরেথ’-এর অধীন। সরকারের এই
পরিবর্তন ছিলো বার্লিন কর্তৃক সকল প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ বা কেন্দ্রীভূত করার। এটি গ্রেট
ইলেক্টর নাম এবং শক্তিশালী রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত রাখে।
গ) শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং সুদক্ষ আমলা বাহিনী গঠন
ফ্রেডারিখ গ্রেট ইলেকটর প্রশানের উন্নতিকরণের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং
আমলা বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। এই বাহিনী গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের বিচ্ছিন্ন
এবং বিভক্ত জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
গ্রেট ইলেকটর সামরিক বাহিনীতে পুরানো আমলের ভাড়া করা সৈন্যবাহিনী গঠনের যে নীতি
ছিলো তা বাতিল করে নতুন তালিকাভ‚ক্ত সৈন্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সৈন্যবাহিনী
গঠন। সেনাবাহিনীকে সুনিপুণভাবে গঠন করার লক্ষে তিনি ১৬৮১ সালে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা
প্রবর্তন করেন। এ ছাড়াও সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ইউনিট যেমন গোলন্দাজ, পদাতিক এবং
ইঞ্জিনিয়ারিং কোর গঠন করা হয়।
উচ্চাকাংক্ষী এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ফ্রেডারিখ প্রাশিয়ার কর
ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। ১৬৬৭ সালে ট্যাক্স আইন পরিবর্তন করে যে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়
তা হচ্ছেঃ
১। ব্যবহার্য জিনিসের উপর কর; ২। চাকুরি বা পেশা সংক্রান্ত কর, এবং ৩। ভ‚মি কর ধার্য
করা।
এ ছাড়াও গ্রেট ইলেকটর দেশের আমলা বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে।
ঘ) অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন
ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধে যে ব্যাপক আর্থনৈতিক অবনতি ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিলো তা দূরীকরণের
লক্ষ্যে ফ্রেডারিখ ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সমসাময়িক অর্থনৈতিক নীতি
মার্কেন্টাইলবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রপ্তানিকে উৎসাহিত করেন এবং অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের
প্রসারে ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দেশীয় শিল্পের বিকাশে তিনি বিদেশী পণ্যের উপর কর
বসিয়ে দেশীয় পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে থাকেন। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের উন্নতির
জন্য তিনি রাস্তাঘাট নির্মার্ণ এবং ডাকযোগ ও যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন। মূলধন এবং
দেশে অপচয় রোধ, সেনাবহিনী এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে তিনি নতুন কর
আরোপ করেন। তিনি অভিজাত শ্রেণীকে কর দিতে বাধ্য করেন। তার সময়ে হলবার স্টেট
এবং ম্যাগডেবার্গে লৌহ এবং ইস্পাত কারখানা স্থাপিত হয়। তিনি আফ্রিকা উপক‚লের
দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
গ্রেট ইলেকটর দেশে কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি ওলন্দাজ
খামার পদ্ধতির সূচনা করেন। যে সব কৃষক নতুন আবাদি জমিকে বসবাস ও কৃষির উপযোগী
খামার হিসেবে গড়ে তুলবে তাদের ৬ বছরের খাজনা মওকুফের ব্যবস্থা করেন। তিনি
ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে উন্নত বীজ সংগ্রহ করেন। এ ছাড়াও কৃষি কাজের উন্নতির
জন্য বিভিন্ন জায়গায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করা হয়। এর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য
ছিলো ‘ফ্রেডারিখ উইলিয়াম’ খাল। এই খাল ওডার এবং এলবা নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন
করেছিল। এছাড়াও কৃষি কাজের উন্নতির জন্য তিনি জলাভ‚মি ও বিল পরিষ্কার করা এবং
পতিত জমি কৃষিযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষে তিনি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বার্লিন এবং অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ ডাচিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় যেখানে বিজ্ঞান, রসায়ন ও প্রাণীবিদ্যা পড়ানো
হতো। বার্লিন শহরকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি।
গ্রেট ইলেকটর ক্যালভিনপন্থী ছিলেন। তবে অন্য ধর্মের প্রতিও তাঁর সহিষ্ণুতা ছিলো। চতুদর্শ
লুই এডিক্ট অব নানটিস বাতিল করলে ফ্রেডারিখ নিজ দেশে হিউগিনটদের আশ্রয়ের জন্য
আবেদন জানান। প্রায় দশ থেকে বিশ হাজার হিউগিনেট প্রাশিয়ার আশ্রয় নিয়েছিলো। এ
ছাড়াও তার আমলে ইংল্যান্ড ও পোল্যান্ড থেকে মানুষজন এসে জড়ো হতে শুরু করে।
৩। গ্রেট ইলেকটর এর বৈদেশিক নীতি :
পররাষ্ট্র বিষয়ে গ্রেট ইলেকটর যুদ্ধ বিগ্রহের পক্ষপাতি ছিলেন না। ক‚টনীতি এবং চালাকির দ্বারা
স্বার্থসিদ্ধি করাই ছিলো তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। তবে প্রয়োজনবোধে তিনি যুদ্ধ করতেও কুন্ঠিত
ছিলেন না।
ত্রিশ বছর ব্যাপী যুদ্ধের পর গ্রেট এলেকটর তাঁর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে একটি কাঠামোতে দাঁড়
করানোর চেষ্টা করেন। যেহেতু প্রাশিয়া ছিলো একটি শত বিচ্ছিন্ন এবং বিভক্ত দেশ- তাই এই
যুদ্ধে ব্রান্ডেনবার্গ- প্রাশিয়ায় তার নিজ অবস্থা এবং সুবিধা অনুযায়ী তিনি পক্ষ পরিবর্তন করে।
তিনি অবস্থা বুঝে কারো পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতেন। আবার অনেক সময নিরপেক্ষ
থাকতেন। ১৬৪৮ সালে সম্পাদিত ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির মারফত তিনি কূটনৈতিক ক্ষমতা
বলে হলবারস্টেট, কেমিন, মিনডেন, ম্যাগডেবার্গ এবং পূর্ব পোমারনিয়া লাভ করতে সক্ষম
হন। এই সকল স্থান প্রাপ্তির ফলে প্রাশিয়ার রাজ্য সীমা যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। এভাবে গ্রেট
ইলেকটর তাঁর বিচ্ছিন্ন অঞ্চলকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে যান।
২। ত্রিশবছরব্যাপী যুদ্ধ এবং ১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির পর ফ্রেডারিখ উইলিয়াম
একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে থাকেন। যেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একপক্ষ থেকে
অন্যপক্ষ পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করতেন না, এর ফলে ইউরোপীয় কোনো শক্তিই তাকে
বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলো না এবং তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো
শান্তিচুক্তিতে কেউ আসেনি।
গ্রেট ইলেকটরের বৈদেশিক নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো সুইডেন এবং পোল্যান্ডের যুদ্ধে
অংশ গ্রহণের মাধ্যমে নিজ দেশের জন্য সুবিধা আদায় করা। এই যুদ্ধে ব্রান্ডেনবার্গের তিনটি
বিকল্প পথ ছিল১। এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকা;
২। নিজেকে সুইডেনের মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা;
৩। অথবা বিপরীতে পোল্যান্ডের মিত্র হিসেবে সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়া।
এই যুদ্ধেই প্রথম হোহেনজোলার্ন বংশ তাদের অন্তভর্‚ক্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই একটি একক
সেনাবাহিনী গঠন করে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৬৫৫ সালে পোল্যান্ড ও সুইডেনের মধ্যে যখন যুদ্ধ
শুরু হয় তখন গ্রেট ইলেকটর তার দেশের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।
সুইডেনের দশম চালর্স যখন ১৬৫৫ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তখন ফ্রেডারিখ উইলিয়াম
সুইডেনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন এবং দশম চালর্সের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৬৫৬ সালে ওয়ারশতে
পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। এই সাফল্য রাশিয়া এবং পোল্যান্ডের
সঙ্গে দ্ব›েদ্বর জন্ম দেয়। এভাবে তিনি প্রথমে পোল্যান্ডকে দুর্বল করে সুইডেনের পক্ষে কিছুকাল
থেকে আবার তাঁর একদা শত্রট্ট পোল্যান্ডের পক্ষে যোগ দেন। পোল্যান্ডের পক্ষ অবলম্বন
করেছিলেন এই শর্তে যে পোল্যান্ড পূর্ব প্রাশিয়ায় হোহেনজোলার্নদের একচ্ছত্র অধিকার ত্যাগ
করে সারা জীবনের জন্য গ্রেট ইলেকটরের কাছে সমর্পণ করে। এটি ছিলো নি:সন্দেহে
ফ্রেডারিখ এর জন্য এক বিশাল বিজয়।
ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধেও গ্রেট ইলেকটর তার নিজ দেশের জন্য
সম্মান ও প্রতিপত্তি নিয়ে আসেন। ডাচদের ক্রমউত্থিত শক্তি ফরাসিদের ভীতির কারণ হয়ে
দাঁড়ালে ফরাসি রাজা লুই তাদের শাস্তি দিতে প্রস্তুত হন। ১৭৫৬ সালে ওলোন্দাজরা
ফরাসিদের আক্রমণের মুখে পড়ে। তাদের দুঃখ দুর্দশার সময় বার্ন্ডেনবার্গ-প্রাশিয়া ফ্রান্সকে
ত্যাগ করে এবং ওলোন্দাজদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ফরাসিরাজা চতুর্দশ লুই যখন
ওলোন্দাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন তখন সুইডেন ফ্রান্সের মিত্রশক্তি হিসেবে প্রাশিয়া
আক্রমণ করে। সুইডেনের রাজা একাদশ চালর্স পোমারনিয়া আক্রমণ করলে ফারবেলিন-এর
যুদ্ধে (১৬৭৫) একাদশ চালর্স গ্রেট ইলেকটরের হাতে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন। এই যুদ্ধে
উত্তর ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তি সুইডেনকে পরাজিত করে গ্রেট ইলেকটর ইউরোপের রাজনীতির
ক্ষেত্রে এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। তখন থেকে প্রাশিয়ার শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যদিও ভবিষ্যতে সেন্ট জার্মিন চুক্তি মারফত সুইডেন তার মর্যাদা আবার ফিরে পেতে
চেয়েছিলো, এবং ১৬৭৯ সালে নিমত্তয়েগের সন্ধি দ্বারা প্রাশিয়া ফ্রান্সের সকল দখলকৃত অংশ
ফিরিয়ে দিয়েছিলে, তথাপি এই যুদ্ধ ক্ষেত্রেই ব্র্যানডেনবার্গ-প্রাশিয়া একটি শক্তিশালী জার্মান
রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় এবং সুইডেন ও অস্ট্রিয়ার যোগ্যতম
প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে আবিভর্‚ত হয়।
৪। তৃতীয় ফ্রেডারিখ : (১৬৮৮ - ১৭১৩)
গ্রেট ইলেকটর-এর মৃত্যুর পর তারপুত্র তৃতীয় ফ্রেডারিখ ইলেকটর পদ লাভ করেন।
হোহেনজোলার্ন পরিবারের শাসনভার বহন করার বিচক্ষণতা তার চরিত্রে ছিলো না। তিনি
ছিলেন মূলত একজন দুর্বল শাসক। তবে গ্রেট ইলেকটর-এর সকল কার্য তিনি সমুন্নত
রেখেছিলেন। তিনি বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁর সময় বিজ্ঞান একাডেমী নামে
একটি পরিষদ স্থাপিত হয়।
তৃতীয় ফ্রেডারিখ-এর সময় প্রাশিয়া রাজকীয় উপাধি বা খেতাব অর্জন করে। ব্রানডেনবার্গ-
প্রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য, এবং রাজতন্ত্র এতে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর শাসককে কখনই
রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। প্রায় সাত বছর যাবত এই রাজকীয় উপাধি পেতে চেষ্টা
করলেও পবিত্র রোমান বা হ্যাপসবার্গ সম্রাট তাকে তা প্রদান করেননি। তবে স্পেনের
উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হলে অস্ট্রিয়ার রাজা প্রথম লিওপোল্ড তৃতীয় ফ্রেডারিখের সাহায্য কামনা
করেন। ফ্রেডারিখ অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ডকে রাজপদবির দশ হাজার সৈন্য দিতে রাজি
হলেন। যেহেতু অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ সম্রাট আর কোনোদিক থেকে সাহায্যের আশ্বাস
পাচ্ছিলেন না, তাই হ্যাপসবার্গ সম্রাট ফ্রেডারিখের এই শর্ত তিনি মেনে নেন। ১৭০১ সালে
তৃতীয় ফ্রেডারিখ অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ কর্তৃক রাজা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তবে এই
রাজপদবি শুধু পূর্ব পোমারনিয়া ডাচির উপর বর্তায়। পশ্চিম প্রাশিয়া পোল্যান্ডের অধীনে থাকায়
তার উপর পদবিটি বর্তায় নি। আনন্দ, উদ্দীপনা এবং উৎসবের আমেজে ১৭০১ সালের ১৮
ফেব্রæয়ারি তৃতীয় ফেডারিখ রাজা ফ্রেডারিখ হিসেবে অভিষিক্ত হন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে স্পেনের
বিরুদ্ধে তার সমর্থন পাবার পর ১৭১৩ সালে ইউট্রেক্ট-এর চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য ইউরোপীয়
স¤প্রদায়ও এই পদবি মেনে নেয়। অতএব হোহেনজোর্লানের জন্য প্রাশিয়ার রাজার পদবি
এবং ইউট্রেক্ট চুক্তি মাধ্যমে ভবিষ্যতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রাশিয়ার একটি
বড় ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়।
৫। প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম : (১৭১৩ - ১৭৪০)
প্রথম ফ্রেডারিখের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম ফ্রেডারিখ উইলিয়াম প্রাশিয়ার রাজা হন। তিনি
ছিলেন একজন কঠোর শাসক। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ব্রান্ডেনবার্গ এবং প্রাশিয়ার (যা
হোহেনজোর্লানদের একত্রিত দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে) জন্য তিনি একটি শক্তিশালী
সমাজ কাঠামো গড়ে তোলেন। প্রথম ফ্রেডারিখ পিতৃসুলভ শুভেচছা নিয়ে প্রাশিয়াবাসীদের
সর্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টা করেন। তিনি সমগ্র রাজ্যটিকে একটি পাঠশালা বা স্কুল বলে মনে
করতেন এবং উৎসাহী শিক্ষকের ন্যায় অলস ও অকমর্ন্য প্রজাদিগকে নির্দয়ভাবে বেত্রাঘাত
করতে দ্বিধা করতেন না। সামরিক দিক দিয়ে তিনি প্রাশিয়াকে ইউরোপের এক অপরাজেয়
শক্তিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। একজন নিবেদিত প্রাণ ক্যালভিনিস্ট হওয়ার কারণে
তিনি কঠোর পরিশ্রম পছন্দ করতেন। সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন ও সঙ্গীতের প্রতি তার
কোনো পছন্দ ছিলো না। তার মূল দর্শন ছিলো রাজাই সকল ক্ষমতার উৎস। সকল কিছু রাজা
নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সবকিছু তার নখদর্পনে থাকতে হবে।
৬। ফ্রেডারিখ উইলিয়ামের অভ্যন্তরীণ নীতি
অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে ফ্রেডারিখের তিনটি মূল উদ্দেশ্য ছিলো :
ক) ব্যাপক অর্থ সঞ্চয় করা;
খ) প্রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা;
গ) রাজ শক্তিকে সর্বময় হিসেবে গড়ে তোলা।
ফ্রেডারিখ তাঁর শাসন ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভ‚ত এবং শাসন সংক্রান্ত সকল বিষযেই একক
আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ গুলিকে একত্রিত করার লক্ষ্যে একটি একক
প্রশাসন ব্যবস্থা গঠন এবং ভৌগোলিকভাবে তাদের একত্রিত করেন। এ লক্ষ্যে তিনি জেনারেল
ডাইরেক্টরি নামে একটি কেন্দ্রীয় সভা গঠন করেন। আইন এবং ধর্ম মন্ত্রণালয় ছাড়া এটি প্রায়
সর্ববিষয়ই দেখতো। এই সভা রাজার নির্দেশে রাজস্ব বিভাগ পরিচালনা এবং রাজ কর্মচারীদের
কার্য পরিচালনা করতো।
ফ্রেডারিখ উইলিয়াম একটি শক্তিশালী আমলা শ্রেণী গড়ে তোলেন। ফ্রান্সের মডেল অনুসারে
তিনি একটি সুদক্ষ সরকারি কর্মচারী গড়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ফলে প্রাশিয়ার
আমলা শ্রেণীও কেন্দ্রীভ‚ত হয়ে পড়ে এবং শহর থেকে গ্রাম সরকারও রাজার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে
চলে আসে। তবে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ফ্রেডারিখের মিতব্যয়িতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এছাড়াও তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। প্রশাসনের জন্য যে ডাইরেক্টরি তিনি গঠন করেছিলেন
তাতে রাজা সরাসারি যোগ দিতেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ডাইরেক্টরির অধিবেশন চলতো,
অধিবেশন চলাকালে কেউ উঠে যেতে পারত না।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ফ্রেডারিখ উইলিয়াম ফরাসি অর্থনীতিবিদ কোর্লবাট-এর নীতি অনুসরণ
করেন। ‘মার্কেন্টাইল নীতি’ অনুসরণ করে তিনি আমদানির উপর শুল্ক স্থাপন এবং রপ্তানি
বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেন। দেশের অবস্থার উন্নতিকল্পে তিনি কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের
উৎসাহ প্রদান করেন। তিনি দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেন এবং উচ্চকর
আরোপের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি দিয়ে সম্পদশালী শিল্প গড়ে তোলেন।
ফ্রেডারিখ অতিরিক্ত ব্যয় পছন্দ করতেন না। বিভিন্ন উৎসবে রাজকীয় সভাসদ-এর খরচ
কমিয়ে এবং সেনাবাহিনীর বেতন কমিয়ে তিনি বাজেটে ভারসাম্য আনেন। এছাড়াও তিনি পূর্ব
প্রাশিয়ার কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতির চেষ্টা করেছিলেন। কৃষিবীজ, পণ্য এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির
প্রচলন করেন। উচ্চ শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ থাকলে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং
অর্থনৈতিক বিদ্যা শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।
শক্তিশালী সেনাবাহিনী স্থাপন করা ছিলো ফ্রেডারিখ উইলিয়াম-এর অন্যতম কৃতিত্ব। তিনি
বুঝতে পেরেছিলেন যে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে তিনি তার অবস্থানকে
শক্তভাবে দাঁড় করাতে পারেন। ফ্রেডারিখ উইলিয়াম মিতব্যয়ী হলেও সেনাবাহিনীতে খরচের
ব্যাপারে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। প্রাশিয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে এই জাতীয়
সৈন্যবাহিনী গঠিত হয়েছিলো। ক্ষুদ্র প্রাশিয়া রাজ্যের সৈন্য সংখ্যা ৩৮ হাজার থেকে ৮৪
হাজারে উন্নীত করা হয়। তিনি ভাড়াটে সৈন্যের বদলে একটি স্থায়ী সৈন্য বাহিনী গঠন করেন।
তিনি পদাতিক সৈন্যবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেন। এ ছাড়াও সৈন্যরা বহু সুযোগসুবিধা ভোগ করতো যা সাধারণ মানুষ পেতো না। তা ছাড়া পোস্টডাম গার্ড নামে ছয় ফুট
উচ্চতা বিশিষ্ট সৈন্যবাহিনী নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তার মৃত্যুর সময় ১৭৪০
সালে মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ছিলো সৈন্য বাহিনীর সদস্য। তৎকালীন ইউরোপে
প্রাশিয়ার অবস্থান সামরিক শক্তির ছিলো চতুর্থ। এই নতুন ব্যবস্থার পর দেশকে সামরিক
ক্যান্টনমেন্টে বিভক্ত করা হয়েছিলো- যার এক একটি রেজিমেন্ট ছিলো।
তবে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠিত হলেও তিনি এদেরকে কোথাও যুদ্ধে জড়ান নি। তিনি যুদ্ধ
ক্ষেত্রে নিস্ক্রিয় বা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে তার পুত্র
বহু যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে পরবর্তী কালে ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ
সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে পেরেছিলেন।
৫। ফ্রেডারিখ উইলিয়ামের বৈদেশিক নীতি
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ফ্রেডারিখ উইলিয়াম আগ্রাসী নীতি বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের
পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর সময়ে প্রতিক্রিয়ার পক্ষে কোনো নতুন অঞ্চল যুক্ত করা হয়নি।
সুইডেনের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের যে মৈত্রীজোট গঠিত হয়েছিলো ফ্রেডারিখ মূলত
রাশিয়ার নেতৃত্বে সেই মৈত্রীজোটে প্রথমে অংশ নেননি। সুইডেনের রাজা তখন ছিলেন দশম
চার্লস। তবে ১৭০৯ সালে পোল্টাভার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সুইডেন দুর্বল হয়ে পড়লে
ফ্রেডারিখ উইলিয়াম ইউরোপের শক্তিবর্গের সঙ্গে মৈত্রীজোটে যোগদান করে। সুইডেনের
বিরুদ্ধে ফ্রেডারিখ অংশ নেন, এবং সুইডেনের নউলিংজনের যুদ্ধে পরাজিত হন। ১৭১৮ সালে
সুইডেনের রাজার মৃত্যুর পর ইউরোপের যে কয়েকটি শক্তি সুইডেনের অঞ্চলসমূহ
ভাগবাটোয়ারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার মধ্যে প্রাশিয়া সবচাইতে বেশি লাভবান হয়। এই যুদ্ধে
জয়লাভ করে তিনি ওডার নদীর মোহনা পোমারনিয়া, ডানজিগ ও স্ট্যাটিন লাভ করেন।
নিস্টাডাটের সন্ধির মাধ্যমে এ সকল স্থানের উপর অধিকার স্বীকৃত হয়। স্টেটিন দখল করায়
তিনি বার্লিনের জন্য একটি বাণিজ্যিক নির্গমন পথ পান। এভাবে প্রাশিয়া ইউরোপের উত্তরের
সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি সুইডেনের আসন লাভের মাধ্যমে একটি নতুন বাল্টিক শক্তি হিসেব তার
বাণিজ্যিক সুবিধাসমূহ অর্জন করেছিল।
যদিও প্রথম ফ্রেডারিখ উইলিয়াম একটি আগ্রাসী বৈদেশিক নীতি গ্রহণে নিজেকে গুটিয়ে
নিয়োছিলেন তথাপিও তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং প্রাশিয়ার স্বার্থে তিনি বিভিন্ন
সময় তাঁর অবস্থান বা পক্ষ পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। উদাহরণ স্বরূপ প্রাশিয়া ১৭২৫ সালে
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষ হয়ে হ্যানোভার লীগে যোগ দেন। তবে ১৭২৬ সালে অস্ট্রিয়ার সম্রাট
ষষ্ঠ চার্লকে জুলিখ ও বার্গ নামক দুটি স্থান দান করার প্রতিশ্রæতি দিয়ে এই লীগ ত্যাগ করতে
রাজি করান। তিনি ‘প্রাগম্যান্টিক স্যাংশন’ নামক স্বীকৃতি পত্রে স্বাক্ষর করেন। এভাবে
ফ্রেডারিখ উইলিয়াম প্র্যাগম্যান্টিক স্যাংশনে’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যার মাধ্যমে ষষ্ঠ চার্লসের
মৃত্যুর পর মারিয়া থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার রানীর মর্যাদা দেয়া হয়। তবে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হলেও
ষষ্ঠ চার্লস পরবর্তীকালে ফ্রেডারিখ উইলিয়ামের সঙ্গে তাঁর দেয়া প্রতিশ্রæতি রক্ষা করেননি।
ফলে এই প্রতিশ্রæতি পূরণ না করায় প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে তিক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিলো।
সারসংক্ষেপ
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থানে ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার উত্থান একটি
ঐতিহাসিক ঘটনা। ইউরোপে প্রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে ফ্রেডারিখ উইলিয়াম সর্বোাচ্চ ভ‚মিকা
পালন করেন। গ্রেট ইলেকটর ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার তিনটি বিচ্ছিন্ন অংশকে একত্রিত করে অভ্যন্তরীণ
ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রাশিয়ার স্বার্থকে সমুন্নত করেন। ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার ইতিহাসকে
পুনরুজ্জীবিত করে। তৃতীয় ফ্রেডারিখ নিজের বংশ এবং দেশের জন্য রাজকীয় উপাধি আনায়নের
মাধ্যমে দেশের সম্মান এবং মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। প্রথম ফ্রেডারিখ উইলিয়াম একটি
বিশাল শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গ্রেট ইলেকটর এর নীতি সমুন্নত রেখে
প্রাশিয়ার অবস্থানকে সুসংহত করেন। তার গঠিত শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপর ভিত্তি করেই প্রাশিয়ার
সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ফ্রেডারিখ দ্যা গ্রেট পরবর্তীকালে ইউরোপের ইতিহাসে প্রাশিয়াকে সর্বোচ্চ অবস্থানে
নিয়ে যায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, পূর্ববর্তীকালের প্রাশিয়া ইউরোপের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রে
পরিণত হয়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরে টিক () চিহ্ন দিন
১। মার্ক নামটি কোন বিষয়কে চিহ্নিত করে?
ক) একটি রাজধানী শহর খ) একটি সীমান্তবর্তী প্রদেশ
গ) একটি কৃষি প্রধান এলাকা ঘ) সামন্ত প্রভুর এলাকা
২। কোন্ সম্রাট হোহেনজোলার্ন পরিবারকে ফ্রেডারিখ হিসেবে ভ‚ষিত করেন?
ক) সম্রাট সিগিসম্যান্ড খ) সম্রাট দশম চার্লস
গ) সম্রাট লিওপোল্টল্ড ঘ) সম্রাট হাইজেনবার্গ
৩। প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নতির জন্য গ্রেট ইলেকটর যে কেন্দ্রীয় সভা স্থাপন করেছিলেন তার
নাম ছিলো -
ক) রাষ্ট্র সংঘ খ) কেন্দ্রীয় কাউন্সিল
গ) কেন্দ্রীয় ইলেকটরেট ঘ) রাষ্ট্র সভা
৪। গ্রেট ইলেকটরেট কোন মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন ?
ক) পুঁজিবাদী নীতি খ) সামন্তবাদ
গ) মার্কেন্টাইলবাদ ঘ) সাম্যবাদী নীতি
৫। গ্রেট ইলেকটরের সময় কোন যুদ্ধে প্রাশিয়া সুইডেনকে চ‚ড়ান্তভাবে পরাজিত করতে সক্ষম
হয়?
ক) ফারবেলিনের যুদ্ধ খ) পোলটভার যুদ্ধ
গ) নউলিংজনের যুদ্ধ ঘ) সেডানের যুদ্ধ।
৬। ফ্রেডারিখের সবচাইতে কৃতিত্বপূর্ণ কাজ কি?
ক) অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া
খ) হোহেনজোলার্ন পারিবারকে ইলেকটর পদে অধিষ্ঠিত করা
গ) হোহেনজোলার্ন রাজ বংশের জন্য রাজকীয় উপাধি অর্জন করা
ঘ) রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করা।
৭। প্রাশিয়ার কোন রাজা শিক্ষকসুলভ মনোভাবে দেশ শাসন করতেন?
ক) গ্রেট ইলেকটর খ) প্রথম ফ্রেডারিখ উইলিয়াম
গ) তৃতীয় ফ্রেডারিক ঘ) ফ্রেডারিখ দ্যা গ্রেট
৮।ফ্রেডারিখ উইলিয়াম ষষ্ঠ চার্লসের সঙ্গে কোন স্যাংশনে প্রাশিয়ার পক্ষে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন?
ক) প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন খ) বিল অব রাইটস
গ) বিল অব ম্যাগনাকাটা ঘ) হিউম্যানিস্ট স্যাংশনে
উত্তর : ১. খ, ২. ক, ৩. ঘ, ৪. গ, ৫. ক, ৬. গ, ৭. খ, ৮. ক।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। ব্রান্ডেনবার্গ-প্রাশিয়ার উদ্ভব সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখুন
২। তৃতীয় ফ্রেডারিখ এর শাসনকালের প্রধান গৌরব কি ছিলো?
রচনামূরক প্রশ্ন
১। গ্রেট ইলেকটর অভ্যন্তরীণ নীতির মূল উদ্দেশ্য কি ছিলো? তার অভ্যন্তরীণ নীতি সংক্ষেপে
বিশ্লেষণ করুন।
২। গ্রেট ইলেকটর এর পররাষ্ট্রনীতি বর্ণনা করুন।
৩। ফ্রেডারিখ উইলিয়ামের রাজনৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করুন। সংস্কারের ক্ষেত্রে তিনি কি কি
নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত