উত্তরাধিকার যুদ্ধ।
উত্তরাধিকার যুদ্ধের পটভ‚মি
স্যালিক আইন অনুসারে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে কোনো স্ত্রীলোকের আরোহন করার অধিকার
ছিলো না। ষষ্ঠ চার্লস এই আইনগত ত্রট্টটি কাটানোর উদ্দেশ্যে প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন
(চৎধমসধঃরপ ঝধহপঃরড়হ) নামে একটি স্বীকৃতি পত্র মারফত ইউরোপীয় রাজাগণ কর্তৃক স্বাক্ষর
করিয়ে তাঁর কন্যা মারিয়া থেরেসাকে সিংহাসনে উত্তরাধিকার হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার
অধিকার লাভ করেন। অবশ্য মারিয়া থেরেসা পবিত্র রোমান সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত না হয়ে রাণী
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এটিও মোটামুটি স্থির হয়। বেশির ভাগ ইউরোপীয় শক্তি যেমন রাাশিয়া,
ফ্রান্স, সার্বিয়া, স্যাক্সনি, ইতালি, স্পেন, সার্বিয়া এই প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন পত্রে স্বীকৃতি দেন
নি। সম্রাট ষষ্ঠ চালর্সের মৃত্যুর পর ১৭৪০ খ্রি: তাঁর একমাত্র কন্যা মারিয়া থেরেসাকে
প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন অনুযায়ী অস্ট্রিয়ার রানী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় এবং পবিত্র রোমান
সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে তার স্বামী লোরেন ফ্রান্সিস এর নির্বাচন দাবি করা হয়।
সিংহাসনে আরোহনের পর পরই মারিয়া থেরেসা অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
অস্ট্রিয়ার সামরিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগে ইউরোপের একাধিক রাষ্ট্রের
অধিপতিরা তাদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করে মারিয়া থেরেসার দাবির বিরোধিতা করেন।
যে সকল বিদেশী রাজা এই অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল প্রাশিয়ার ফ্রেডারিখ দ্যা গ্রেট তাদের
মধ্যে অন্যতম ছিলেন। উত্তর ওডার এর উর্বর অঞ্চল সাইলেশিয়া দখল করার মাধ্যমে প্রশিয়ার
শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করা হয়। বহুকাল থেকেই পারিবারিক সম্পর্কের অজুহাতে সাইলেশিয়ার উপর
দাবি জানিয়ে ফ্রেডারিখ মারিয়া থেরেসার কাছে একটি চরমপত্র পাঠিয়েছিলেন। জুলিও ও বার্গ
নামক দুটি স্থান না দেয়ায় তিনি প্রথম ফ্রেডারিখ উইলিয়াম স্বাক্ষরিত “প্র্যাগম্যাটিক স্যাংশন”
মেনে নিতে বাধ্য নন এই যুক্তি দেখান। তার প্রেরিত চরমপত্রে জানানো হয় যে, মারিয়া
থেরেসা যদি সাইলেশিয়ার উপর ফ্রেডারিখের অধিকার মেনে নেয়, তবে মারিয়াকে অস্ট্রিয়ার
সাম্রাজ্যের শীর্ষ অবস্থানের ক্ষেত্রে সর্বদাই সাহায্য করবেন। তাঁর এই দাবি অগ্রাহ্য হলে ১৭৪০
সালের ডিসেম্বরে প্রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী সাইলেশিয়ার মাটিতে প্রবেশ করে। ফ্রেডারিখের এই
অভিযান অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের সূচনা করে। এক বছরের মধ্যেই ফ্রেডারিখ সমগ্র
সাইলেশিয়া এবং রাজধানী ব্রেসল দখল করে নেন। সাইলেশিয়া দখল করে মারিয়াকে বলা
হয়১। সাইলেশিয়ার বিনিময়ে তিনি তাঁর স্বামীর পক্ষে সম্রাট হবার ক্ষেত্রে রাজকীয় নির্বাচনে
সমর্থন দেবেন;
২। তাঁকে তাঁর সকল শত্রট্টপক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক সাহায্য দেওয়া হবে;
৩। এছাড়াও তাঁকে তিন মিলিয়ন থেলারস বা গুলডেন মুদ্রা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে
মারিয়া থেরেসা ফ্রেডারিখের এই সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেই দুই পক্ষের মধ্যে
যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। মারিয়া ইউরোপের শাসকদের কাছে এই আগ্রাসী শক্তির
বিরুদ্ধে এবং সাইলেশিয়া থেকে ফ্রেডারিখকে বের করে দিতে সাহায্য চান।
কিন্তু ইউরোপের শক্তিবর্গ মারিয়াকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না, বরং ফ্রেডারিখের
পক্ষ অনুসরণ করে হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্য ধ্বংস করা এবং অস্ট্রিয়াকে নিজেদের মধ্যে
ভাগবাটোয়ারা করে নিতে আগ্রহী ছিলেন।
ব্রিগ নামক স্থানের নিকট মলউইজ এর যুদ্ধে ফ্রেডারিখ মারিয়া থেরেসার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে
পরাজিত করেন। । অষ্ট্রিয়ার পরাজয় অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির জন্য একটি বিপজ্জক সংকেত
হিসেবে কাজ করে। প্রাশিয়ার জয়লাভে প্ররোচিত হয়ে ফ্রান্স, স্পেন, স্যাক্সনি, বাভারিযা,
সার্দিনিয়া উদ্যত হয়ে পড়ে। ফ্রান্স তার ঐতিহ্যগত শত্রট্ট হ্যাপসবার্গকে ধ্বংস করতে দৃঢ়
প্রতিজ্ঞা ছিলো। ১৭৪১ সালে ফ্রান্সের বেলি আইসলে স্পেন ও ব্যাভারিয়ার সঙ্গে একটি
চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্যাক্সনি, সার্দিনিয়া ও প্রাশিয়ার পক্ষে
কোয়ালিশনে যোগ দান করে। এই চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয় -
১। অস্ট্রিয়ার টাইরল এবং বোহেমিয়ার ব্যাভারিয়ার চালর্স আলবার্ট পাবেন
২। স্যাক্সনি পাবে মোরেভিয়া;
৩। সাইলেশিয়ায় প্রাশিয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে;
৪। ফ্রান্স পাবে অস্ট্রিয়া - নেদারল্যান্ড;
৫। স্পেন পাবে ইতালি ও অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ অঞ্চলসম‚হ।
মারিয়া থেরেসার ওপর শুধু হাঙ্গেরির অধিকার স্বীকৃত হবে। এ ছাড়াও এতে সিদ্ধান্ত হয় যে
ফ্রেডারিখ ব্যাভারিয়ার ইলেক্টরকে অস্ট্রিয়ার সম্রাট পদে সাহায্য করবেন এবং রাইন অঞ্চলের
দাবি ত্যাগ করবেন।
তবে মারিয়া থেরেসা সাহসের সঙ্গে শক্তিজোটের এই বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলা
করতে থাকেন। অপরদিকে অস্ট্রিয়ার পক্ষে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড। ফ্রান্স ছিল
ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যগত শত্রট্ট। এছাড়া জার্মানির হ্যানোভার ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক শাসিত
হতো। ফরাসিদের আগ্রাসনে হ্যানোভারে ব্রিটিশদের অধিকারকে হুমকির মধ্যে ফেলবে বলে
ইংল্যান্ড মনে করে। অপরদিকে ১৭৩৭ সালে গ্রেট বৃটেন এবং স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় যা
জেনকিনস যুদ্ধ নামে পরিচিত। গ্রেট বৃটেন মারিয়া থেরেসাকে অর্থবল কতক শক্তি দিয় সাহায্য
করতে এগিয়ে আসে। এভাবে অস্ট্রিয়াকে বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। বৃটেন
স্পেনের সমুদ্রের আধিপত্যকে ধ্বংস করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় এবং নতুন শক্তি হিসেবে ফ্রান্স ও
বৃটেন তাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক দ্ব›দ্ব ক্রমশ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠে।
সুতরাং, অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ একটি ইউরোপীয় যুদ্ধে পরিণত হয়। গ্রেট বৃটেন পরানো
শত্রট্ট ফ্রান্সকে ধ্বংস করার জন্য এবং মহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য
হ্যানোভারের স্বার্থ রক্ষার্থে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে এবং অপরদিকে বৃটেন ডাচ নেদারল্যান্ড বা
হল্যান্ড এরা অস্ট্রিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়।
২। অস্ট্রিয়ার যুদ্ধের পর্যায়সমূহ
মলউইজ এর যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয় ঘটে। এতে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়াকে সাহায্য
করতে না এসে অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যকে ভাগবাটোরায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। ফ্রেডারিখ প্রথমে অস্ট্রিয়া
বিরোধী কোয়ালিশনে অংশগ্রহণে করেন নি। এ ক্ষেত্রে তিনি শর্ত দেন যে অস্ট্রিয়া যদি সমগ্র
সাইলেশিয়া তাকে দিয়ে দেয় তবে তিনি তার বিরুদ্ধে ঐক্যজোটে অংশ নেবেন না। তবে
অস্ট্রিয়ার রানী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে প্রাশিয়া অস্ট্রিয়া-বিরোধী মৈত্রীজোটে অংশ নেয়।
অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্ব প্রথম সাইলেশিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত।
অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে মৈত্রীজোট ফ্রান্স কর্তৃক গঠিত হয়েছিল এবং জোট প্রাশিয়ার সমর্থন লাভ
করে। ফ্রান্স ছিল হ্যাপসবার্গের পুরাতন শত্রট্ট এবং অস্ট্রিয়ার দুর্বল ভ‚-খন্ডের সুযোগ নিয়ে
মহাদেশে তার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ফ্রান্স বোহেমিয়াতে অস্ট্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে পরাভ‚ত
করেছিলো, ব্যাভারিয়া ভিয়েনার শহরতলী পর্যন্ত প্রবেশ করেছিল। এর মধ্যে চার্লস এ্যালবা
পবিত্র রোমান সম্রাট হিসেবে মনোনীত হন। এভাবে কিছু কালের যুদ্ধের পর চর্তুদিকে আক্রান্ত
অস্ট্রিয়া ১৭৪১সালে ক্লিনশ্লিলেনডরফ-এর চুক্তি দ্বারা নি¤œ সাইলেশিয়ার উপর ফ্রেডারিখ এর
অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। তিন সপ্তাহ পরে ফ্রেডারিখ তার জোটের সঙ্গে মোরেভিয়া
আক্রমণ করার পর তিনি তার মৈত্রীজোটকে দ্বিতীয় বারের মতো পরিত্যাগ করেন।
প্রাশিয়া যুদ্ধ ত্যাগ করলো, কিন্তু অপরাপর শক্তির সঙ্গে অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ চলতে থাকে। তবে কিছু
কাল পর অস্ট্রিয়া যুদ্ধ জয়লাভ করতে আরম্ভ করলে ফ্রেডারিখ ভীত হয়ে পড়েন। তিনি আশঙ্কা
করলেন হয়তো অস্ট্রিয়া আবার সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হবে। সেই কারণে ফ্রেডারিখ
পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। জাসল-এর যুদ্ধে অস্ট্রিয়া ফ্রেডারিখের হাতে পরাজিত হয় এবং
১৭৪৩ খ্রি: ব্রেস্ল এর সন্ধি দ্বারা গ- াভস ও সাইলেশিয়ার উপর প্রাশিয়ার অধিকার স্বীকৃতি
লাভ করে। ব্রেসল এর সন্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাইলেশিয়ার প্রথম পর্বের যুদ্ধের অবসান ঘটে।
ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের দ্বারা শত্রট্টবেষ্টিত হয়ে অস্ট্রিয়ার রানী হাঙ্গেরিতে পালিয়ে যান। তিনি
হাঙ্গেরির জনগণের কাছে তাঁকে সাহায্য করার জন্য আকুল আবেদন জানান। তাঁর আবেদনে
হাঙ্গেরিয়ানরা স্বত:স্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে এবং তাঁকে ১ লক্ষ্য সৈন্য দিয়ে সাহায্য দেবার
প্রতিশ্রæতি দেয়। এর প্রতিদান স্বরূপ মারিয়া থেরেসা অস্ট্রো-হাঙ্গেরি দ্বৈত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার
ঘোষণা দেন। ব্রেস্ল-এর সন্ধির ফলে ফ্রেডারিখ যুদ্ধ ত্যাগ করলে অস্ট্রিয়া অন্যান্য শক্তির
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয় এবং যুদ্ধের গতি অস্ট্রিয়ার অনুক‚লে পরিবর্তিত হতে থাকে।
থেরেসা সাইলেশিয়া হারোনোর ক্ষতি হিসেবে ব্যাভারিয়া পেতে দৃঢ় সংকল্প ছিল। ১৭৪৩ সালে
ওয়ামর্সেব চুক্তির মারফত ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়া, সার্দিনিয়া, পিডমন্ট, ফ্রান্স এবং ব্যাভারিয়ার
বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
অপরদিকে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম অস্ট্রেহাঙ্গেরি বা মারিয়া থেরেসার অধীন নেদারল্যান্ড দখল
করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো। ফলে যুদ্ধ অন্যান্য মহাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষত আমেরিকা
এবং ভারতে। দুই শক্তি পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। হাঙ্গেরিরা ফ্রান্সের
সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে দেয় এবং ব্যাভারিয়া ও মিউনিখ থেকে মৈত্রীজোটের বাহিনীকে
উচ্ছেদ করে। চালর্স এ্যালবার্ট ফুসেন অস্ট্রিয়ার রাজসিংহাসনের যে দাবি ছিলো তা পরিত্যাগ
করেন। ইংল্যান্ড সার্দিনিয়া এবং অস্ট্রিয়ার আক্রমণে ফরাসি অঞ্চল এলসাস এবং লরেনও
বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। মূলত প্রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে মৈত্রীজোটের শক্তি বহু পরিমাণে হ্রাস পায়
এবং তাদের ভাগ্যে ভবিষ্যত পরাজয়ই অনিবার্য় হয়ে উঠে।
এদিকে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় জর্জ নিয়ন্ত্রিত প্রাগম্যাটিক সেনাবাহিনী মূলত হ্যানোভার এবং
অস্ট্রিয়ার বাহিনী ১৭৪৪ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ডেটিঞ্জেনের যুদ্ধে ফরাসি
সৈন্য বাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে। এই সময় থেকে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ ইঙ্গ-
ফরাসি দ্ব›দ্ব এবং অস্ট্রিয়া-প্রাশিয়ার দ্ব›দ্ব এই দুই প্রধান দ্ব›েদ্ব পরিণত হয়।
একদিকে অস্ট্রিয়ার সাফল্য এবং অপরদিকে দক্ষিণ সাইলেশিয়া সমর্পন করার ক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার
গড়িমসি এবং ইতস্তত ফ্রেডারিখের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর অস্ট্রিয়ার সঙ্গে
চুক্তি ভঙ্গ করে তিনি বোহেমিয়া আক্রমণ করেন এবং ১৭৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রাগ
দখল করেন। তবে ফ্রেডারিখ বোহেমিয়াতে পর্যুদস্ত হয়ে ১৭৪৫ সালে একটি পৃথক শান্তিচুক্তি
সম্পাদন করেন। ঐ বছরের শুরুতেই ব্যাভারিয়ার সপ্তম চার্লেসের মৃত্যুর পর তার দেশ
অস্ট্রিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হয় এবং ইলেকটররা মারিয়া থেরেসার স্বামী প্রথম ফ্রান্সিসকে পবিত্র
রোমান সম্রাট হিসেবে মনোনীত করেন। এর পরের বছর অস্ট্রিয়ার বাহিনী মৈত্রীজোটের
বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করে এবং ইতালি ও ফ্রান্স স্পেনের বিরুদ্ধে একটার পর একটা যুদ্ধে জয়
লাভ করতে থাকে। তবে এর বিপরীতে ফরাসি সেনা বাহিনী হল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ডাচদের
বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল।
অস্ট্রিয়া স্যাক্সনি, পোল্যান্ড এবং রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি স্থাপন করে এবং প্রাশিয়াকে দুই দিক
থেকে আক্রমণ করে। সুতরাং ফ্রেডারিখ অস্ট্রিয়ার মোকাবিলা ও সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারে
আবার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। তবে যুদ্ধে ফ্রেডারিখের পুনরায় আগমনে মৈত্রীজোট তথা
ফ্রান্সের যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনা উজ্জল হয়। সাইলেশিয়া পুনর্দখলের জন্য অস্ট্রিয়ার সৈন্যরা
অগ্রসর হলে হোহেনফ্রিডবার্গের যুদ্ধে পরাজিত হয়। অস্ট্রিয়ার সৈন্যেদের ধাওয়া করে
বোহেমিয়ার নিকট সোহর যুদ্ধে পুনরায় তাদেরকে পরাজিত করে। দুটো যুদ্ধে পরাজয়ের পর
অস্ট্রিয়া ফ্রেডারিখকে সমগ্র সাইলেশিয়া দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৭৪৫ সালে ড্রেসডনের যুদ্ধে
সাইলেশিয়া এবং গ- াৎসো প্রাশিয়ার কাছে সমর্পন করা হয়। এরই মধ্যে থেরেসার স্বামী প্রথম
ফ্রান্সিস রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফ্রেডারিখ এই নির্বাচন মেনে
নেন। তবে এর পরও যুদ্ধ চলতে থাকে, ১৭৪৮ সালের মধ্যে দুই পক্ষই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে
শান্তির প্রত্যাশা করে। এর ফলে ১৭৪৮ সালে আইয়ে-লা-স্যাপেলের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এই
সন্ধি আট বছরের দ্ব›দ্ব সংঘাত বন্ধ করার মাধ্যমে ইউরোপে শান্তির পরিবেশ নিয়ে আসে।
৩। আইয়ে-লা-স্যাপেলের সদ্ধি, ১৭৪৮
অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে ১৭৪৮ সালে দুই পক্ষের মধ্যে আইয়েলা-সাপেলের বিখ্যাত চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই সন্ধির মূল ধারাসমূহ হলো :
১। এই চুক্তির মাধ্যমে মারয়িা থেরেসাকে অস্ট্রিয়ার শাসক এবং তাঁর স্বামী ফ্রান্সিস লোরেনকে
পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়,
২। সাইলেশিয়া ও গ- ্যৎস এর উপর প্রাশিয়ার অধিকার স্বীকৃত হয়,
৩। দ্বিতীয় জর্জকে ইংল্যান্ডের রাজা বলে ঘোষণা দেয়া হয়,
৪। উইটেলসব্যাক (ডরঃঃবষংনধপশ) পরিবার ব্যাভারিয়া এবং প্যালাটিনেটে তাদের ক্ষমতা
পুন:প্রতিষ্ঠা করে,
৫। সার্দিনিয়ার চালর্স ইমানুয়েল লোম্বার্ডি, স্যাভয় এবং নিৎস লাভ করেন, কিন্তু ফিনেইল
স্থানটি ত্যাগ করতে ব্যর্থ হন;
৬। ফ্রান্স অবিরত যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও এই চুক্তি থেকে কিছুই পায়নি। ডানকার্ক বন্দরের
রক্ষাপ্রাচীর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ইউট্রেক্ট সন্ধি দ্বারা যে সকল দুর্গ স্থাপিত হয়েছিলো তা
ফ্রান্সকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়;
৭। এই যুদ্ধের পর ফ্রান্সও গ্রেট বৃটেনের মধ্যে ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক যুদ্ধের সূচনা হয়।
প্রথমত : এই চুক্তির মাধ্যমে মারিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা
করতে সক্ষম হন;
দ্বিতীয়ত : এই চুক্তি মারফত প্রাশিয়া ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত
হয়,
তৃতীয়ত : ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে বাণিজ্যিক, ঔপনিবেশিক এবং সামাজিক প্রাধান্যের যে
দ্ব›দ্ব ছিলো, আইয়ে-লা-স্যাপেলের সন্ধি এই দ্ব›েদ্বর সন্তোষজনক কোনো সমাধান
দিতে সক্ষম হয় নি,
চতুর্থত : ফ্রান্স এই যুদ্ধে কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ এবং অপমানিত হয়েছিলো এমন নয়, বরং এই
চুক্তির মাধ্যমে তাকে কয়েকটি স্থান ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়,
পঞ্চমত : রাশিয়া অস্ট্রিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সাইলেশিয়া যুদ্ধে যোগাদান করে এবং এই চুক্তিতে
অংশ গ্রহণের ফলে ভবিষ্যতে ইউরোপের রাজনীতিতে রুশ শক্তির প্রভাব বৃদ্ধির
ইঙ্গিত দেয়,
ষষ্ঠত : আইয়ে-লা-স্যাপেলের সন্ধি রাজনৈতিক মীমাংসা করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। এই
চুক্তি কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারে নাই। ফলে ইউরোপ পুনরায় যুদ্ধের জন্য
প্রস্তুত হতে লাগলো। ফলে কিছু দিন পরেই সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সূচনা হয়।
৪। ইউরোপীয় রাজনীতিতে উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রভাব
অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের ফলাফল যে সব বিচেনায় সুদূর প্রসারী ছিলো তা নি¤œরূপ।
প্রথমত : এটি ছিলো অষ্ট্রিয়া এবং প্রাশিয়ার দ্ব›েদ্বর যুদ্ধ। মারিয়া থেরেসা কখনই সাইলেশিয়া
হারানোর দু:খ মেনে নিতে পারেন নাই। মারিয়া সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারে
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেও এতে তার সম্মান দারুনভাবে ক্ষুন্ন হয়। এটি তার সামরিক
শক্তির দুর্বলতাকেই প্রমাণ করে।
দ্বিতীয়ত : এই যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানি তথা প্রাশিয়া ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ
শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। প্রাশিয়ার আন্তর্জাতিক মর্যাদা যেমনি বৃদ্ধি পেয়েছিল
তেমনি এই যুদ্ধে এর রাজ্যসীমাও বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এরপর প্রাশিয়া
ইউরোপের অন্যতম নেতৃত্বকারী দেশ হিসেবে পরিচিত হয়।
তৃতীয়ত : যুদ্ধে কিছু না পাওয়ায় ফ্রান্স এই চুক্তি মেনে নিতে পারে নি। এই-লা-স্যাপেলের
চুক্তিটি ফ্রান্সের কাছে ‘চবধপব রিঃযড়ঁঃ ঠরপঃড়ৎু’ নামে পরিচিত হয়। ভবিষ্যতে ফ্রান্স
আবার ইউরোপে নিজের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ খুঁজতে থাকে।
চতুর্থত : এই যুদ্ধ সমাপ্তির পর পরই ইউরোপীয় রাজনীতিতে নতুন মিত্র প্রাপ্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি
হয়। ইউরোপের শক্তিবর্গ নিজ স্বার্থের অনুকূলে তাদের বহুদিনের মিত্র ত্যাগ করে
নতুন মিত্র সন্ধানে মৈত্রীজোট গঠন করে। ইতিহাসে এটিই ‘কুটনৈতিক বিপ্লব’
নামে পরিচিত।
সুতরাং দেখা যায় যে, ১৭৪৮ সালে স্বাক্ষরিত আইয়ে-লা-স্যাপেল চুক্তি সাময়িকভাবে
উত্তরাধিকার যুদ্ধ ঠেকালেও এটি স্থায়ী সমস্যার সমাধানে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।
৫। ক‚টনৈতিক বিপ্লব
১৭৫৬ সালে ইরোপীয় রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ১৭৪৮ সাল থেকে ১৭৫৬ সাল
পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিবর্গ তাদের নিজস্ব ক‚টনীতি পরিচালিত করার নিমিত্তে
নতুন নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। প্রত্যেকেই নিজস্ব উন্নতির কথা বিবেচনায় এনে যে যার শত্রট্টর
হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে১৭৫৬ সালে নতুনমৈত্রী
জোট গঠিত হয়েছিল।
ক) অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্স তাদের দু‘দশকের বিবাদ ভুলে গিয়ে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
খ) অপরদিকে প্রাশিয়া এবং ইংল্যান্ড মৈত্রীজোটে আবদ্ধ হয়ে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়ার
বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এই বিপরীতধর্মী জোটই ‘ক‚টনৈতিক বিপ্লব’ নামে পরিচিত।
‘ক‚টনৈতিক বিপ্লব’ এর পূর্ব ইউরোপীয় শক্তিবর্গ প্রধানত দুইটি শিবিরে বা পক্ষে বিভক্ত
ছিলো। ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও পর্তুগাল সাধারণত এক পক্ষে থাকতো এবং ফ্রান্স,
প্রাশিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, তুরস্ক ও সুইডেন থাকতো অন্যপক্ষে। তবে অস্ট্রিয়ার
সামুদ্রিক শক্তি ইংল্যান্ডের সঙ্গে অনুসৃত মৈত্রী রক্ষার নীতি ত্যাগ করে ইংল্যান্ড থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অপর দিকে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্যিক প্রাধান্য বাজায়
রাখার জন্য প্রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি পুর্নদ্যমে চালিয়ে যেতে
থাকে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক‚টচালের এই বিরাট
পরিবর্তনকে ‘ক‚টনৈতিক বিপ্লব’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
ক‚টনৈতিক বিপ্লবের মূল কারণগুলো হচ্ছে
১। ১৭৪৮ সালের আইয়ে-লা-স্যাপেলের সন্ধি কোনো পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
প্রাশিয়া সাইলেশিয়া দখল করলেও এর নিরাপত্তার সমস্যা তখনও ফ্রেডারিখকে চিন্তিত
রেখেছিল। অস্ট্রিয়া ইংল্যান্ডের জোরজবরদস্তিতে সাইলেশিয়া ফ্রেডারিখকে দিতে রাজি
হলেও রানী মারিয়া দু:খ ভুলতে পারেন নি। সর্বোপরি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে বাণিজ্যিক
ও ঔপনিবেশিক প্রাধান্যের কোনো দ্ব›েদ্বর মীমাংসা এই সন্ধি করতে পারেন নি। ক‚টনৈতিক
যুদ্ধই যেকোন মুহূর্তে সশস্ত্র যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২। প্রাশিয়ার উত্থান এবং শক্তি সঞ্চয় ইউরোপীয় রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন
এনেছিলো। প্রাশিয়ার উত্থান ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। কারণ এতে
মহাদেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয় বলে সবাই আশংকা করতে থাকে।
৩। কূটনৈতিক বিপ্লবের প্রত্যক্ষ কারণ ছিলো মারিয়া থেরেসার সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারের
সংকল্প। মারিয়া থেরেসা অস্ট্রিয়ার ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্পর্কে চিন্তা
ভাবনা শুরু করেন।
৬। ক‚টনৈতিক বিপ্লবের মূল ঘটনাসমুহ
মারিয়া থেরেসা সাইলেশিয়া হারানোর ক্ষতিপূরণ লাভের লক্ষ্যে তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
তাঁর দেশের সম্মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি ফ্রেডারিখের বিরুদ্ধে মৈত্রীজোট গঠন শুরু করেন। তিনি
স্যাক্সনি এবং রাশিয়াকে তাঁর মিত্র হিসেবে রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন, গ্রেট বৃটেন এবং হল্যান্ডের
সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন থেকে বেরিয়ে আসেন।
ক) ক‚টনৈতিক বিপ্লবের প্রধান রুপকার ছিলেন মারিয়া থেরেসার মন্ত্রী কৌনিজ। অস্ট্রিয়ার
মন্ত্রীরা পুরাতন মিত্র শক্তি তথা ইংল্যান্ড এর সঙ্গে অস্ট্রিয়ার মৈত্রী রক্ষা করে চলাকেই যুক্তিযুক্ত
বলে জানান। কিন্তু তাঁর মন্ত্রী কৌনিজ একটি নতুন নীতি উদ্ভাবন করেন। তিনি ফরাসিদের
নিয়ে মৈত্রীজোট গঠনে তৎপর হন। তিনি যুক্তি দেখালেন যে অস্ট্রিয়ার প্রধান শত্রট্ট হলো
প্রাশিয়া। প্রাশিয়ার উত্থানে ইউরোপের রাজনীতিতে এক বিরাট পরবির্তন ঘটেছে। সুতরাং
কৌনিজ যুক্তি দেখালেন দূরবর্তী শক্তি ইংল্যান্ডের মিত্রতাকে গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।
এ ছাড়া তিনি আরো যুক্তি দেখালেন যে, সাইলেশিয়া সাহায্য কল্পে ইংল্যান্ড সাইলেশিয়াকে
সাহায্য করতে প্রস্তুত হবে না। এ ছাড়াও প্রাশিয়ার ফ্রেডারিখ ইংল্যান্ডের যথেষ্ট জনপ্রিয়
কৌনিজ এই যুক্তিও দেখালেন। মারিয়া থেরেসার কাছে কৌনিজের পরামর্শ অত্যন্ত মনোগ্রাহী
হয়ে উঠে। কারণ তিনি সাইলেশিয়া পুনরুদ্ধারে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন এবং যেকোন উপায়ে তা
পুনরূদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।
অপরদিকে ফ্রান্সেও আইয়ে-লা-স্যাপেলা চুক্তি খুবই অজনপ্রিয় ছিলো। ফ্রান্স এই চুক্তি
সহজভাবে মেনে নেয় নি। ফ্রান্স এবং প্রাশিয়ার মধ্যে প্রকাশ্য দ্ব›দ্ব না থাকলেও সাইলেশিয়ার
যুদ্ধে ফ্রেডারিখ একাধিকবার ফ্রান্সকে না জানিয়ে যুদ্ধ ত্যাগ করায় এবং মৈত্রীজোট থেকে
বিদায় নেয়ায় ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সদ্ভাব ছিল না।
খ) ইংল্যান্ড ফ্রেডারিখকে সমর্থন করেছিলো। কারণ ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যে ঔপনিবেশিক
এবং মহাদেশে প্রাধান্যগত দ্ব›দ্ব ছিল তাতে ফ্রান্সকে দমন করা জরুরি ছিলো। এ ছাড়াও
জার্মানির হ্যানোভার নামক দেশটি ছিলো ইংল্যন্ডের হ্যানোভার বংশীয় রাজাগণের মাতৃভ‚মি।
গ্রেট বৃটেন হ্যানোভারের নিরাপত্তা বিধানের জন্যও একটি মৈত্রী জোট খুঁজে বের করতে সচেষ্ট
হয়। তবে নিউক্যাসেলের ইংরেজ ডিউক এটি অবিষ্কার করেন যে অস্ট্রিয়া বৃটেনের সঙ্গে
পুনরায় সম্পর্ক ঝালাই করতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিট নিউক্যাসেল
হ্যানোভারের নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার কাছে আবেদন করে। এই দুই শক্তি ‘সাবসিডাই চুক্তি’
সম্পাদন করে। এর ফলশ্রæতিতে ওয়েস্টমিনিস্টার কনভেনশন চুক্তি (১৭৫৫) স্বাক্ষরিত হয়,
যার ফলে ইংল্যান্ড এবং প্রাশিয়া একে অপরের অঞ্চল রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
গ) যদিও প্রাশিয়া মনে করেছিলো যে ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী ফ্রান্সের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে
কোনোরূপ বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কারণ দুই দেশই অস্ট্রিয়া ও স্পেনের হ্যাপসবার্গের
বিরুদ্ধে ছিলো। কিন্তু ওয়েস্ট মিনিস্টার চুক্তির খবর শোনামাত্র ফ্রান্স কৌনিজের মধ্যস্থতায়
আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সঙ্গে আরো একটি চুক্তি সম্পাদানে এগিয়ে আসে। অপরদিকে রাশিয়া তার
সঙ্গে ইংল্যান্ডের চুক্তি বাতিল হলে অস্ট্রো-ফ্রাঙ্ক জোটে যোগদান করে। এভাবে ১৭৫৬ সালে
পূর্বেকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার বিষয়টিই
ইউরোপের ইতিহাসে ‘কূটনৈতিক বিপ্লব’ নামে পরিচিত হয়। এতে নতুন রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব শুরু
হয়।
৭। ক‚টনৈতিক বিপ্লবের তাৎপর্য
১) ক‚টনৈতিক বিপ্লবের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইংল্যান্ড প্রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী
বন্ধনে আবন্ধ হয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রাশিয়াকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করে
আমেরিকা ও ভারতে সাহায্য প্রেরণের পথ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়। দুর্বল অষ্ট্রিয়া থেকে
উদীয়মান শক্তি প্রাশিয়ার মৈত্রী ইংরেজদের জন্য বিশেষত ইংরেজ অধিকারভুক্ত হ্যানোভার
রাজ্য রক্ষার জন্য অধিকতর সহায়ক হয়েছিল।
২) প্রাশিয়ার দিক থেকে ইংরেজদের বন্ধুত্ব লাভজনক ছিলো। কারণ অস্ট্রিয়ার আক্রমণ থেকে
সাইলেশিয়া রক্ষার জন্য এবং ফরাসি আক্রমণ থেকে রাইন অঞ্চল রক্ষার জন্য ইংল্যান্ডের
সাহায্য প্রয়োজন ছিলো।
৩) ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার মৈত্রী স্থাপনের পশ্চাতে উদ্দেশ্য ছিলো সাইলেশিয়া উদ্ধার করা।
সুতরাং ইংল্যান্ডের পরিবর্তে ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত নিকটবর্তী দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে মৈত্রী
স্থাপন অস্ট্রিয়ার পক্ষে কূটনৈতিক বিচক্ষণতার কাজ ছিলো।
৪) কূটনৈতিক বিপ্লবের রাজনীতিতে বুরবোঁ ফ্রান্সই সবচাইতে বেশি নির্বুদ্ধিতা বা প্রাজ্ঞহীনতার
পরিচয় দিয়েছিলো। ফ্যান্সের পক্ষে দুই শতাব্দীর পুরনো হ্যাপসবার্গ দ্ব›দ্ব ভুলে গিয়ে অস্ট্রিয়ার
সাহায্যে এগিয়ে আসা মোটেও বুদ্ধির পরিচায়ক ছিলো না। অস্ট্রিয়া ছিলো দুর্বল দেশ।
প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে আতœরক্ষা করবার সামরিক শক্তি অস্ট্রিয়ার ছিলো না। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ফ্রান্সের
মৈত্রী ইউরোপীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে রাইন অঞ্চলে
ফরাসি প্রাধান্য অক্ষুন্ন থাকে।
৫। সর্বোপরি অস্ট্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো সাইলেশিয়া উদ্ধার করা। সেজন্য ইউরোপ মহাদেশে
অস্ট্রিয়ার জন্য আরো একটি যুদ্ধ জরুরি ছিলো। আমেরিকা এবং ভারতবর্ষে সৈন্য এবং অর্থ
সাহায্য প্রেরণ করা ছিলো ফ্রান্সের আতœরক্ষার একমাত্র উপায়। কিন্তু ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রী
স্থাপন করে নিজেকে সাইলেশিয়া অধিকারের দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে ফেলে। নিরপেক্ষ বিচারে ফ্রান্স
অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে স্বীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করে।
সারসংক্ষেপ
অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ এবং কূটনৈতিক বিপ্লব ইউরোপের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে মারিয়া থেরেসার অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইউরোপীয় দ্ব›েদ্বর পরিপ্রেক্ষিতে
উত্তরাধিকার যুদ্ধের সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার রানী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিক‚ল পরিস্থিতি
মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। সাইলেশিয়া হারালেও অস্ট্রিয়ার রানী হিসেবে তাঁর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন
এবং এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পক্ষে এবং বিপক্ষে ইউরোপীয় শক্তিসমূহকে বিভক্ত করার মাধ্যমে নিজের
স্বার্থ রক্ষা করতে সক্ষম হন। অপরদিকে এই যুদ্ধের পরপরই ইউরোপে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন
ঘটে। ইউরোপীয় রাজারা তাদের পুরাতন মিত্র ত্যাগ করে নতুন মিত্রের সন্ধান করেন এবং মৈত্রীজোট
গড়ে তোলেন। ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের এই পূর্বতন অবস্থার পরিবর্তন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন
ইউরোপীয় ব্যবস্থাই ‘কূটনৈতিক বিপ্লব’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। তবে এই পরিবর্তিত অবস্থাও
ইউরোপকে যুদ্ধের ডামাডোল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় নি এবং ইউরোপ দ্রæতই আরো একটি যুদ্ধে
জড়িয়ে পড়েছিলো।
পাঠত্তোর মূল্যায়ন
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পার্শ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। কোন আইন অনুসারে অস্ট্রিয়ার সিংহাসনে স্ত্রীলোকের কোনো অধিকার ছিলো না?
ক) রোমান আইন খ) স্যালিক আইন
গ) প্রোগ্রেসিভ আইন ঘ) জুডিস আইন
২। উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রথম পর্বে কোন যুদ্ধে ফ্রেডারিখের বাহিনী অস্ট্রিয়ার বাহিনীকে
সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে?
ক) মলউইজের যুদ্ধ খ) সেডানের যুদ্ধ
গ) জুরিখের যুদ্ধ ঘ) বোহেমিয়ার যুদ্ধ
৩। উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রথম পর্ব কি নামে পরিচিত ছিলো ?
ক) দ্বিতীয় সাইলেশিয়ার যুদ্ধ খ) প্রথম রাইন যুদ্ধ
গ) দ্বিতীয় রাইন যুদ্ধ ঘ) প্রথম সাইলেশিয়ার যুদ্ধ
৪। উত্তরাধিকার যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বে কোন যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী ফরাসি বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে
পরাজিত করেছিল?
ক) মিউনিখের যুদ্ধ খ) লোরেনের যুদ্ধ
গ) ডেন্টিজেনের যুদ্ধ ঘ) প্রাগের যুদ্ধ
৫। এই-লা-স্যাপেলের সন্ধি কত সালে সম্পাদিত হয়?
ক) ১৭৪২ সালে খ) ১৭৪৪ সালে
গ) ১৭৪৬ সালে ঘ) ১৭৪৮ সালে
৬। ক‚টনৈতিক যুদ্ধের মূল রূপকার কে ছিলেন?
ক) রিচার্ডসন খ) জর্জরাফটেল
গ) এমিলি ঘ) কৌনিজ
৭। ইংল্যান্ড এবং রাশিয়া কোন চুক্তিবলে মৈত্রীজোটে আবদ্ধ হয়?
ক) ওয়েস্ট মিনিস্টার চুক্তি খ) প্যারিসের চুক্তি
গ) লন্ডন চুক্তি ঘ) গ্রিনফিল্ডের চুক্তি
৮। ক‚টনৈতিক বিপ্লবের সবচাইতে বেশি নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয় কোন দেশ?
ক) ইংল্যান্ড খ) ফ্রান্স
গ) প্রাশিয়া ঘ) অস্ট্রিয়া
উত্তর : ১। (খ), ২। (ক), ৩। (খ), ৪। (গ), ৫। (খ), ৬। (খ), ৭। (ক), ৮। (খ)।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। উত্তরাধিকার যুদ্ধের পটভ‚মি সম্পর্কে লিখুন।
২। ক‚টনৈতিক বিপ্লব বলতে কি বুঝায়? এর কারণসমূহ চিহ্নিত করুন।
৩। ইউরোপীয় রাজনীতিতে উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রভাব বর্ণনা করুন?
রচনামূলক প্রশ্ন
১। উত্তরাধিকার যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করুন।
২। আইয়ে-লা-স্যাপেলার চুক্তি কখন সম্পাদিত হয়? এই চুক্তির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করুন?
৩। ক‚টনৈতিক বিপ্লবের মূল ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করুন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত