দ্বিতীয় ক্যাথারিন বা মহামতি ক্যাথারিন ১৭২৯ সালে জার্মানির একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রোটেস্টান্ট
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল সোফিয়া অগাষ্টা ফ্রেডারিখ অর্থাৎ সংক্ষেপে
সোফিয়া। প্রæশিয়ার মহামতি ফ্রেডারিখের উদ্যোগে রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের ভাগ্নে পিটারের
সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এলিজাবেথ নিঃসন্তান ছিলেন বলে তিনি পিটারকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে
ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাশিয়ায় এসেই তিনি ঐ দেশের ভাষা আয়ত্ত¡ করেন, স্থানীয় ধর্ম (এৎববশ
ঙৎঃযড়ফড়ী ঈযঁৎপয) গ্রহণ করেন, স্থানীয়দেরকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন এবং একজন
বুদ্ধিমতি ও দেশপ্রেমিক মহিলা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। নতুন ধর্মমত গ্রহণকালে তিনি
ইক্যাতেরিনা আলেক্সিয়েভনা নামধারণ করেন।
ক্যাথারিনের ক্ষমতালাভ
১৭৬১ সালে সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তৃতীয় পিটার সিংহাসনে বসেন। কিন্তুঅল্প দিনের
মধ্যেই রাশিয়ার জনগণ শাসক হিসেবে তাঁর অযোগ্যতার পরিচয় পায়। বিশেষত গির্জা ও
সেনাবাহিনী প্রæশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত থাকা সত্তে¡ও ক্ষমতায় এসেই পিটার প্রæশিয়ায়
অধিকৃত অঞ্চল এবং ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার পক্ষ ত্যাগ করেন এবং প্রæশিয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। এমন
কি তিনি রাশিয়াকে প্রæশিয়ার একটি আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা করেন।
এভাবে তৃতীয় পিটার যখন তাঁর জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন ক্যাথারিনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
দুজনের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয় এবং এক পর্যায়ে পিটার বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবতে
থাকেন। এদিকে ক্যাথারিন তাঁর জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ
অবস্থায় ১৭৬২ সালের ২৮ জুন তারিখে একটি সামরিক অভ‚্যত্থানের মাধ্যমে পিটার ক্ষমতা থেকে
অপসারিত হন এবং ক্যাথারিন আলেক্সিয়েভনা দ্বিতীয় ক্যাথারিন নাম ধারণ করে রাশিয়ার
সিংহাসনে উপবিষ্ট হন।
দার্শনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ
বিয়ের পর থেকেই ক্যাথারিন ভলতেয়ার, মতেসকিয়োঁ ও বিশ্বকোষ রচনাকারীদের লেখাগুলো
পড়তে থাকেন এবং তাদের চিন্তা-চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। প্রকৃতপক্ষে সম্রাজ্ঞী হওয়ার পর
তিনি ফরাসি দার্শনিকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং তাঁর পরিকল্পিত
সংস্কারগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেন। ভলতেয়ারের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পত্রালাপ
অব্যাহত রেখেছিলেন। ক্যাথারিন তাঁকে মস্কোতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তুতিনি এ
আমন্ত্রণে সাড়া দেন নি। অবশ্য দিদেরো তাঁর আমন্ত্রণে মস্কো এসেছিলেন।
দিদেরোর যখন অর্থাভাব দেখা দেয় তখন তিনি তাকে সাহায্যের লক্ষ্যে তাঁর গ্রন্থাগার ক্রয় করেন।
শর্ত থাকে যে, তিনি যতোদিন জীবিত থাকবেন ততোদিন এর রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং
গ্রন্থাগারিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্যে সম্মানিও পাবেন। বিশ্বকোষ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি
এর অন্যতম রচয়িতা ডি এলেবার্টকে তাঁর নাতি-নাতনীদের গৃহ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের
আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তুতিনি তাঁর এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন নি।
অভ্যন্তরীণ সংস্কার
দ্বিতীয় ক্যাথারিন স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন। কিন্তুতিনি চেয়েছিলেন “জ্ঞানদীপ্ত” (ঊহষরমযঃবহবফ) বা
প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে পরিচিত হতে। এ লক্ষ্যে তিনি কিছুউদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন।
১৭৬৭ সালে তিনি আইন, বিচার ও শাসন ব্যবস্থায় সংস্কার প্রবর্তনের এবং কৃষক সম্প্রদায়ের ভাগ্য
পরিবর্তনের জন্যে ৬৫০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে মতেসকিয়োঁর
ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ খধি গ্রন্থের ভিত্তিতে কতগুলো নির্দেশ (ওহংঃৎঁপঃরড়হং) দেয়া হয় এবং এগুলোকে
জার্মান, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ইউরোপের সর্বত্র পাঠানো হয়। এতে সর্বত্র
প্রগতিবাদীরা বিস্মিত এবং রক্ষণশীল গোষ্ঠী আহত হয়। কিন্তুস্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু
পরিবর্তন ছাড়া এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য
তেমন কোনো সংস্কার প্রবর্তন করা হয় নি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জনগণের অনগ্রসরতা এবং
রাজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে শুধুস্বৈরতন্ত্রী সরকার ব্যবস্থাই রাশিয়ায় কার্যকর হতে পারে।
অতএব প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর আস্থা থাকলেও কার্যত তিনি স্বৈরতন্ত্রী
শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দিদেরো এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন,
“দার্শনিকরা ভাগ্যবান। আপনারা লেখেন প্রাণহীন কাগজে, আর আমাদেরকে লিখতে হয় মানুষের
স্পর্শকাতর চামড়ায়।” অর্থাৎ তত্ত¡গতভাবে যা বলা যায় বাস্তবে সব সময় তা করা যায় না।
কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা
কৃষকরা ছিল দেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৫ ভাগ এবং এদের অর্ধেক ছিল ভ‚মিদাস। অথচ
ক্যাথারিন তাদের মঙ্গলের জন্যে কোনো ব্যবস্থা নেন নি। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর শাসন আমলে
কৃষকদের অবস্থার অবনতি ঘটে। কেননা যেসব ক্ষেত্রে ভ‚মিদাস বেগার খাটুনির পরিবর্তে অর্থের
মাধ্যমে সামন্তপ্রভুদের প্রতি তাদের দায় পরিশোধ করতো সেখানে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়
এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ করা হয়। অপরপক্ষে বেগার খাটুনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভ‚মিদাস প্রথা কৃষিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মহামতি পিটারের শাসন আমল
থেকে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেগুলোর কোনো কোনোটিতে ভ‚মিদাসদেরকে কাজ
করতে হতো। এ অবস্থার কারণে ক্যাথারিনের রাজত্বকালে কয়েকটি কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৭৭৩ সালের কৃষক বিদ্রোহ। ক্যাথারিন নির্মমভাবে এ
বিদ্রোহ দমন করেন। হাজার হাজার কৃষককে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, মহিলা ও শিশুসহ কয়েক হাজার
কৃষককে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ভবিষ্যতে যাতে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত না হয় তার
জন্যে ক্যাথারিন সরকার ও ভ‚স্বামীদের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
শিল্পোন্নয়ন
রাশিয়ার অর্থনীতি মূলত কৃষি ভিত্তিক হলেও এ সময়ে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুকিছূব্যবস্থা গৃহীত
হয়। রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলো ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে এবং এগুলোর কোনো কোনোটিতে
শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় এক হাজারে। এসব ফ্যাক্টরিতে যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক ও নৌ-বাহিনীর সদস্যদের
ব্যবহারের জন্যে জুতা ও বস্ত্র তৈরি করা হতো। ক্যাথারিনের শাসন আমলে দেশের বৈদেশিক
বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হয় এবং আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। আমদানি পণ্যের
মধ্যে ছিল ধনীদের ব্যবহারের পণ্য, উন্নতমানের বস্ত্র, আসবাবপত্র ইত্যাদি। যেসব পণ্য রপ্তানি করা
হতো সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কাঠ, লোহা, ফ্ল্যাক্স, মোম, ভাং ইত্যাদি।
পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকাশ
দ্বিতীয় ক্যাথারিন নিজে পাশ্চাত্য দেশীয় ছিলেন। অতএব পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি স্বভাবতই তাঁর
একটা আকর্ষণ ছিল। তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়ায় পাশ্চাত্য সভ্যতা বিকাশ লাভ করুক। এদিক
বিবেচনা করলে তাঁকে নিঃসন্দেহে মহামতি পিটারের যোগ্য উত্তরসূরী বলা যায়। কিন্তুপাশ্চাত্য
সভ্যতা বলতে তিনি বুঝাতেন ফরাসি সভ্যতা। তাঁর উদ্যোগে রাশিয়ার উচ্চ মহলে ফরাসি ভাষা,
সাহিত্য, পোষাক এবং আচার-ব্যবহারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। অনেক সামন্তপ্রভু
ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্যে ফরাসি দেশীয় শিক্ষক নিয়োগ করেন এবং অনেকে সন্তানদের
উচ্চ শিক্ষার জন্যে ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। এর পাশাপাশি তিনি দেশে সাধারণ শিক্ষা
বিস্তারের জন্যেও কিছুব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন
এবং ১৭৬৪ সালে ঝড়পরবঃু ঋড়ৎ ঃযব ঞৎধরহরহম ড়ভ ঃযব উধঁমযঃবৎং ড়ভ ঃযব ঘড়নরষরঃু প্রতিষ্ঠা
করেন। এছাড়া তিনি অস্ট্রিয়ার অনুকরণে মস্কো ও সেন্ট পিটারসবুর্গে নর্মাল স্কুল (শিক্ষকদের
প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত
হলেও রুশো যে ধরনের জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের কথা ভেবেছিলেন ক্যাথারিনের শাসন আমলে সে
ধরনের কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয় নি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, ক্যাথারিন যখন মৃত্যুবরণ
করেন তখন রাশিয়ায় দুই কোটি ৬০ লক্ষ অধিবাসীর জন্যে স্কুলের সংখ্যা ছিল মাত্র তিনশত।
বৈদেশিক নীতি
বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ক্যাথারিনের অর্জন অনেক বেশি। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল
যতটা সম্ভব রাশিয়ার সীমানা সম্প্রসারিত করা এবং এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি বিরাট সাফল্য লাভ
করেছিলেন। তাঁর শাসন আমলে রাশিয়ার সীমান্ত কাস্পিয়ান, বাল্টিক ও কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত
সম্প্রসারিত হয়। জার ইভানভের পরে আর কোনো শাসকের আমলে রাশিয়ার রাজ্যসীমা এতটা
সম্প্রসারিত হয় নি। অর্থাৎ ‘জ্ঞানদীপ্তম্ব ফ্রেডারিখের ন্যায় ক্যাথারিনও ছিলেন পররাজ্য লোভী এবং
এ লোভ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে তিনি ন্যায়-নীতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা দেখান নি।
পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদে অংশগ্রহণ
দ্বিতীয় ক্যাথারিন প্রথম দৃষ্টি দেন পোল্যান্ডের প্রতি এবং প্রæশিয়ার মহামতি ফ্রেডারিখ ও অস্ট্রিয়ার
সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার সঙ্গে পোল্যান্ডের প্রথম বিভাজনে অংশ নেন। মহামতি ফ্রেডারিখ উল্লেখ
করেছেন যে, পোল্যান্ডের ব্যবচ্ছেদের প্রশ্ন যখন আলোচিত হয় তখন ক্যাথারিনের প্রতি সহানুভ‚তির
নিদর্শন স্বরূপ চোখের পানি ফেলেন। কিন্তুতিনি যতবেশি চোখের পানি ফেলেন পোল্যান্ডের
ততোবেশি অংশ দাবি করেন। পোল্যান্ডের প্রথম ব্যবচ্ছেদ থেকে স্পেন, রাশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল
রাশিয়ার দখলে আসে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, এসব অঞ্চল মধ্যযুগে রাশিয়ার দখলে ছিল
এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল রাশিয়ান। পোল্যান্ডের দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদ ঘটে ১৭৯৩
সালে। এতে অংশ নেন ক্যাথারিন ও প্রæশিয়ার দ্বিতীয় ফ্রেডারিখ উইলিয়াম। এর ফলে ত্রিশ লক্ষ
জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পোল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল (বেলোরাশিয়া ও লিথুয়ানিয়ার অংশ বিশেষ এবং
ইউক্রেন) রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। পোল্যান্ডের তৃতীয় এবং শেষ ব্যবচ্ছেদ ঘটে ১৭৯৫ সালে
রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রæশিয়ার মধ্যে। এর ফলে রাশিয়া কোরল্যান্ড ও লুথিয়ানিয়াব অবশিষ্টাংশ লাভ
করে। এভাবে পোল্যান্ডের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ইতিপূর্বে মহামতি পিটার রাশিয়াকে ‘পাশ্চাত্যকরণম্ব নীতির অংশ হিসেবে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের
অধীনস্থ আজভ শহর দখল করে কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে তাঁর রাজ্যের সংযোগ স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু
১৭১১ সালে পুনরায় আজভ শহর রাশিয়ার হস্তগত হয়েছিল। ক্ষমতায় এসেই দ্বিতীয় ক্যাথারিন
আজভ দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ফলে ১৭৬৮ সালে (অর্থাৎ পোল্যান্ডের প্রথম বিভাজনের
আগেই) রাশিয়া ও তুরষ্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং এ যুদ্ধ ছয় বছরকাল স্থায়ী হয়। যুদ্ধে তুরস্ক
পরাজিত হয় এবং রাশিয়া ক্রমে ক্রমে আজভ, মোলদাভিয়া, ওয়ালেচিয়া ও বুখারেস্ট দখল করে
নেয়। অত:পর ১৭৭৪ সালে কুচুক কাইনা রজীবত স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে এ যুদ্ধের অবসান
ঘটে। এ চুক্তির বলে ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তিম্ব নামে পরিচিত তুরষ্ক ওয়ালেচিয়া ও মলদাভিয়া ফেরৎ
পায়, তবে আজভ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে আবার সরাসরি রাশিয়ার
যোগাযোগ স্থাপিত হয়। রাশিয়ার বাণিজ্য তরীগুলো এবার বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী দিয়ে
ভ‚মধ্যসাগরে প্রবেশ করে এবং পশ্চিমা দেশ সমূহের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে।
দ্বিতীয়ত, অতপর তুরষ্ক সাম্রাজ্যের গ্রিক অর্থডক্স গির্জার অনুসারী প্রজারা রাশিয়াকে তাদের বন্ধু
কিংবা মিত্র হিসেবে দেখতে থাকে। তৃতীয়ত, রাশিয়াকে কনসটান্টিনোপলের কিছুগির্জার রক্ষাকর্তা
হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ফলে রাশিয়া তুর্কি সাম্রাজ্যের সকল খ্রিস্টান প্রজাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে
ঘোষণা দেয়ার এবং এ দাবির ভিত্তিতে তুরষ্কের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অজুহাত পায়।
কিন্তু এতেও দ্বিতীয় ক্যাথারিন সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। কেননা প্রকৃতপক্ষে তার লক্ষ্য ছিল
কনসটান্টিনোপলকে রাজধানী করে এক নতুন বাইজাইনটাইন সাম্রাজ্য স্থাপন করা। এ লক্ষ্যে তিনি
যৌথভাবে তুরষ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। অত:পর
তিনি ক্রিমিয়া দখল করে নেন এবং এভাবে আবার যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ যুদ্ধ পাঁচ বছরকাল স্থায়ী
হয়েছিল। ১৭৯২ সালে জাসিতে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি বলে ক্রিমিয়া এবং ইতিপূর্বে
১৭৭৪ সালের চুক্তিতে রাশিয়া যেসব অঞ্চল অধিকার করেছিল তা রাশিয়ার অধীনে থাকবে বলে
নিশ্চয়তা দেয়া হলো। কিন্তুতুর্কিদেরকে ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ বিতাড়িত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ
হয়।
ফরাসি বিপ্লবের বিরোধিতা
১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হলে প্রথম থেকেই দ্বিতীয় ক্যাথারিন এর বিরোধিতা করেন। কেননা
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এ বিপ্লব তাঁর শাসনের জন্যে বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই তিনি
যেসব ধ্যান-ধারণা বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল সেগুলো যাতে রাশিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে
তার জন্যে সচেষ্ট হন। যেসব নাগরিক বিপ্লবের পক্ষ সমর্থন করেছিল তাদেরকে দেশ থেকে
বিতাড়িত করেন। দ্বিতীয় ক্যাথারিন ১৭৯৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি নিজেকে
যতটা ‘জ্ঞানদীপ্তম্ব’ বা ‘প্রজাহিতৈষীম্ব’ বলে ভাবতেন বাস্তবে তা ছিলেন না। কেননা তিনি অনেক
সংস্কারের পরিকল্পনা করলেও তা বাস্তবায়িত হয় নি। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল
নীতি অবলম্বন করেন। তবে একটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল বিরাটÑ তিনি রাশিয়াকে একটি বৃহৎ
ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, “আমি সাধারণ মেয়ে হিসেবে
রাশিয়ায় এসেছিলাম, রাশিয়া আমাকে অনেক দিয়েছিল। কিন্তুআমি প্রতিদান স্বরূপ রাশিয়াকে
দিয়েছি আজভ, ক্রিমিয়া এবং পোল্যান্ডের বিরাট অংশ।”
সারসংক্ষেপ
১৭৬২ সালে দ্বিতীয় ক্যাথারিন রাশিয়ার সিংহাসনে উপবিষ্ট হন এবং ১৭৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি নিজে ছিলেন প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী শাসক এবং এ ধরনের শাসনের
অন্যতম প্রবক্তা দার্শনিক ভলতেয়ারের সংগে দীর্ঘদিন যোগাযোগ রাখেন। তাঁর রাজত্বকালে
শিল্পোন্নয়ন, শিক্ষা সম্প্রসারণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা বিকাশের জন্যে কতগুলো সংস্কার প্রবর্তিত
হয়। কিন্তু বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ক্যাথারিনের অর্জন ছিল অনেক বেশি। তিনি
পোল্যান্ডের তিনটি ব্যবচ্ছেদে অংশ গ্রহণ করেন এবং তুরষ্কের বিরুদ্ধে সাফল্য জনকভাবে যুদ্ধ
করেন। ফলে তাঁর শাসন আমলে রাশিয়ার সীমারেখা বৃদ্ধি পায়।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
ক. নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। সম্রাজ্ঞী এলিজাবেথ কতো সালে মৃত্যুবরণ করেন?
(ক) ১৭৬০ (খ) ১৭৬১
(গ) ১৭৬২ (ঘ) ১৭৬৩
২। ভলতেয়ারের সংগে ক্যাথারিন কত বছর ধরে পত্রালাপ করেন?
(ক) ২১ (খ) ২০
(গ) ১৮ (ঘ) ১৭
৩। ক্যাথারিনের মৃত্যুকালে রাশিয়ায় স্কুলের সংখ্যা কত ছিল?
(ক) ৫০০ (খ) ৪০০
(গ) ৩০০ (ঘ) ২০০
৪। পোল্যান্ডের দ্বিতীয় ব্যবচ্ছেদে অংশ গ্রহণের ফলে কত লক্ষ জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত অঞ্চল রাশিয়ার
সংগে যুক্ত হয়?
(ক) ত্রিশ লক্ষ (খ) পঁচিশ লক্ষ
(গ) বাইশ লক্ষ (ঘ) বিশ লক্ষ
খ. সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। দ্বিতীয় ক্যাথারিন রাশিয়ায় কি ভাবে ক্ষমতা লাভ করেন?
২। দ্বিতীয় ক্যাথারিনের রাজত্বকালে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে কি কি ব্যবস্থা গৃহীত হয়?
গ. রচনামূলক প্রশ্ন
১। দ্বিতীয় ক্যাথারিনের অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলি আলোচনা করুন।
২। ক্যাথারিনের বৈদেশিক নীতির বর্ণনা দিন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (খ) ২। (ক) ৩। (গ) ৪। (ক)
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত