শিল্প বিপ্লব


শিল্প বিপ্লব
আঠারো শতকের শেষার্ধে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়
সাধারণভাবে তাই শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ফরাসি
সমাজতান্ত্রিক লেখক জেরোমি বøাংকি, তবে এটি সবিশেষ পরিচিতি লাভ করে ১৮৮১ সালে ইংরেজ
ঐতিহাসিক আর নল্ড জে. টয়েনবি কর্তৃক অক্সফোর্ডে প্রদত্ত Lectures on the Industrial Revolutions of the 18th Century in England k শীর্ষক বক্তৃতা মালার মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব
ইংল্যান্ড তথা পাশ্চাত্য জগতের ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর ফলে ইংল্যান্ড
বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশটির সমৃদ্ধির ভিত্তি রচিত
হয়। সংগে সংগে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও শিল্প বিপ্লব সুদূরপ্রসারী
প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে ইউরোপ ও পশ্চিমা জগতের অনেকগুলো রাষ্ট্রও শিল্পোন্নত হয়,
যদিও এ অগ্রগতি বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে নি। শিল্প বিপ্লবের বিষয়টি খুব বিতর্কিত ও বটে।
কেননা শিল্প বিপ্লবের সংজ্ঞা, এ বিপ্লব কখন শুরু হয়, কখন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে, বিপ্লব
শব্দটি যথার্থই প্রযোজ্য কি না, এর ফলে ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণীর ভাগ্যে কি ঘটেছিল, ফ্রান্সের
পরিবর্তে ইংল্যান্ডে শিল্প-বিপ্লবের সূত্রপাত হয় কেন প্রভৃতি প্রশ্নে ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ ও
সমাজতত্ত¡বিদদের মধ্যে বিরাট মত পার্থক্য রয়েছে। <
পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনা থেকে দেখা যাবে যে, শিল্প বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে কখন শুরু হয়েছিল সে
বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তুসাধারণভাবে যে ধারণাটি প্রচলিত তা হলো
এই যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত হয় আঠার শতকের মধ্যভাগে। অতত্রব, এ সময়ে
ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা কেমন ছিল তা আমাদের জানার প্রয়োজন
রয়েছে। কেননা এতে প্রমাণিত হবে যে একটি স্থবির বা অনগ্রসর সমাজে শিল্প বিপ্লব হঠাৎ করে
শুরু হয় নি, দীর্ঘকাল আগে থেকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রস্তুতি চলছিল।
রাজনৈতিক পটভ‚মি ঃ
১৪৮৫ সালে টিউডর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সপ্তম হেনরি ইংল্যান্ডের সিংহাসনে উপবিষ্ট হন।
এভাবে টিউডর রাজবংশের যে শাসন শুরু হয় তা স্থায়ী হয়েছিল ১৬০৩ সাল পর্যন্ত। টিউটর
রাজবংশের শাসনকাল থেকে আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছে এ জন্যে যে এখান থেকে ইংল্যান্ডে
আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।
টিউডর শাসনকালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, এ সময়ে দেশে শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত
হয়। টিউডর রাজাগণ অত্যাচারী সামন্ত প্রভুকে দমন, নতুন নতুন কার্যকরী সংগঠন ও বিশেষ
ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারালয় প্রতিষ্ঠা, শাসন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অনুগত এবং বিশ্বস্তলোক নিয়োগ,
স্থানীয় শাসন ব্যাপারে অধিকতর কর্তৃত্ব আরোপ এবং সর্বোপরি পার্লামেন্টের সংগে
সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের শক্তিশালী শাসন প্রজাপীড়ন বা জনমতের বিরুদ্ধাচারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয় নি,
শক্তিশালী শাসন গড়ে উঠেছিল সমগ্র জাতির সমর্থনের উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ টিউডরদের
শক্তিশালী শাসনের পেছনে জনসমর্থন ছিল।
শক্তিশালী রাজতন্ত্র
টিউডর রাজত্বকালে শুধুঅভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি, ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক
ও ধর্মীয় জীবনে রোমের পোপের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়। অষ্টম হেনরির শাসনকাল থেকে পরবর্তী
রাজাদেরকে ইংল্যান্ডের গির্জা ও রাষ্ট্র উভয়ের প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এভাবে ইংল্যান্ড
বৈদেশিক প্রভাব থেকে মুক্ত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তুএর ফলে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে
অনেক সমস্যা দেখা দেয়; কেননা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে যে এ্যাংলিকান চার্চ
(অহমষরপধহ ঈযঁৎপয) প্রতিষ্ঠিত হয় তা একদিকে চরমপন্থী প্রোটেস্টান্ট বা পিউরিটান ও

অপরদিকে ক্যাথলিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয় নি। অর্থাৎ এ্যাংলিকান চার্চের প্রধান রাজাকে
ক্যাথলিক ও পিউরিটানদের বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হয়।
সার্বভৌম রাষ্ট্র
টিউডর যুগের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের (জবহধরংংধহপব)
সূত্রপাত। ফলে এ যুগে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে। বিশেষত এলিজাবেথের
রাজত্বকাল সাহিত্যের ক্ষেত্রে চরম উৎকর্ষের যুগ ছিল। এ যুগে ইংরেজি সাহিত্যের অভ‚তপূর্ব
অগ্রগতি সাধিত হয়। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শেক্সপিয়ের এ যুগেই তাঁর অমর লেখনী
চালনা করেন। এ যুগে দর্শন চর্চারও প্রসার ঘটে। বেকন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক।
রাণী এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১৬০৩ সালে প্রথম জেম্সের সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে
ইংল্যান্ডে স্টুয়ার্ট রাজবংশের শাসন শুরু হয়। রাজা এবং পার্লামেন্টের মধ্যে বিরোধ এবং শেষ
পর্যন্ত জাতীয় জীবনে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা এ যুগের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্টুয়ার্ট
শাসনকগণ বিশ্বাস করতেন যে, তাঁরা বিধিদত্ত ক্ষমতার (উরারহব জরমযঃ) বলে রাজা। সুতরাং
তাঁদের কার্যাবলির জন্যে তাঁরা জনগণের কাছে নয় একমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছে দায়ী। পার্লামেন্ট
রাজার এরূপ সীমাহীন ক্ষমতার দাবি মানতে সম্মত ছিল না। পার্লামেন্ট মনে করতো যে রাজক্ষমতা
ব্যক্তিগত বা দৈব অধিকার ক্ষমতার ভিত্তি বা মূল উৎস সম্পর্কে রাজা ও পার্লামেন্টের দৃষ্টিভংগী ছিল
সম্পূর্ণ বিপরীত। অতএব স্টুয়ার্ট শাসন আমলের শুরু থেকেই রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে
বিরোধের সূত্রপাত হয় ।
ঈশ্বর প্রদত্ত রাজাধিকার মতবাদে বিশ্বাসী
এ বিরোধের অনেক ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৬২৯-৪০ সাল পর্যন্ত প্রথম
চার্লসের ব্যক্তিগত শাসন (অর্থাৎ পার্লামেন্টের অধিবেশ আহবান না করে শাসনকার্য পরিচালনা),
দীর্ঘ পার্লামেন্টের অধিবেশন, সাত বছর (১৬৪২-৪৯) স্থায়ী গৃহযুদ্ধ, প্রথম চার্লসের মৃত্যুদন্ড,
রাজতন্ত্র ও লর্ড সভার উচ্ছেদ এবং ওলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা
এবং ১৬৬০ সালে দ্বিতীয় চার্লসের সিংহাসন আরোহণের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পুন:প্রতিষ্ঠা।
পুনপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের সংগে শীঘ্র আবার বিরোধ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৬৮৮ সালে
গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে এ বিরোধের অবসান হয়। পার্লামেন্ট শর্তাধীনে উইলিয়াম এবং মেরিকে
সিংহাসন দান করে। ফলে স্টুয়ার্ট ১৬৮৮ সালে গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যম্যে রাজবংশের অবসান
এবং জাতীয় জীবনে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বিপ্লব পরবর্তী বিল অব রাইটস, মিউটিনি
এ্যাক্ট, ট্রিনিয়াল এ্যাক্ট প্রভৃতি আইন পার্লামেন্টের সার্বভৌম ক্ষমতাকে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে
এবং ইংল্যান্ডে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। অনুরূপভাবে টলারেশন এ্যাক্টের মাধ্যমে
ধর্মীয় সহনশীলতা নীতি স্বীকৃতি পায়।
আরও একটি কারণে রাজনৈতিক দিক থেকে স্টুয়াট যুগ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। ইতোপূর্বে
১৫৩৬ সালে ওয়েলস ইংল্যান্ডের সংগে যুক্ত হয়েছিল। অতপর এলিজাবেথের রাজত্বকালের
শেষদিকে আয়ারল্যান্ডের বিজয় সমাপ্ত হয়। এবার ১৬০৩ সালে স্কটল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস
ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহন করার ফলে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড একই রাজার শাসনাধীনে আসে।
শেষ পর্যন্ত ১৭০৭ সালে এ্যাক্ট অব ইউনিয়নের মাধ্যমে দুটো দেশকে একই পার্লামেন্টের শাসনাধীন
বলে ঘোষণা করা হয়। এ আইনে আরও স্থির হয় যে এখন থেকে দেশ দুটো গ্রেট ব্রিটেন নামে
পরিচিত হবে। স্টুয়ার্ট যুগে ইংল্যান্ডে রেনেসাঁসের দ্বিতীয় পর্বের সূত্রপাত হয়। বিজ্ঞান চর্চা এ যুগের

একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ যুগের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে নিউটন, হার্ভি ও নেপিয়ারের
নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালে বিখ্যাত রয়াল সোসাইটি নামক বিজ্ঞান
সভা স্থাপিত হয় (১৬৬২)। স্টুয়ার্ট যুগের সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন জন লক। টিউডর যুগে
সাহিত্যে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল ষ্টুয়ার্ট শাসন আমলে তা অব্যাহত থাকে। মিলটন, ড্রাইডেন,
জন বানিয়ান এবং পোপ ছিলেন এ যুগের উল্লেখযোগ্য কবি। এ যুগে গদ্য সাহিত্যেরও বিপুল
প্রসার ঘটে। স্টুয়ার্ট শাসন আমলের অপর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাময়িকী সাহিত্যের
উদ্ভব।
অর্থনৈতিক পটভ‚মি
শিল্প বিপ্লবের আর্থ-সামাজিক পটভূমি স্বভাবতই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসংগে যেসব বিষয়
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে উপনিবেশ স্থাপন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, শিল্প-কৃষিপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি, বণিক পুঁজির বিকাশ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি।
স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলে উপনিবেশ স্থাপন এবং তৎসংগে বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ শুরু হয়।
প্রথম জেমসের শাসন আমলে ইংল্যান্ডের প্রথম উপনিবেশ স্থাপিত হয় বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
জেমস টাউনে বা ভার্জিনিয়ায়। পরবর্তীকালে উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া
অব্যাহত থাকে এবং ১৭৩৩ সালের মধ্যে ১৩ টি উপনিবেশ গড়ে উঠে। ইংল্যান্ড ত্যাগ করে যারা
উত্তর আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে তাদের অধিকাংশই ছিল পিউরিটান। একই সংগে ওয়েস্ট
ইন্ডিজের বার্বোডাস, বার্মুডা এবং জ্যামাইকা দ্বীপে ইংল্যান্ডের উপনিবেশ গড়ে উঠে। অপর দিকে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপিত হয়
এবং কোলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে কোম্পানির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। উপনিবেশ ও
বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কাজটি স্বভাবতই খুব সহজ ছিল না, কেননা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশও
একই লক্ষ্য স্থির করেছিল। এক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ¡ী ছিল ফ্রান্স। কিন্তু
সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে উত্তর আমেরিকায় ফরাসি প্রতিদ্বন্দি¡তার অবসান ঘটে।
ইতোমধ্যে পলাশী যুদ্ধে বাংলার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে ভারত উপমহাদেশে
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
এভাবে পনেরো, ষোল ও সতেরো শতকে ইউরোপে যে বাণিজ্য-বিপ্লব (ঈড়সসবৎপরধষ
জবাড়ষঁঃরড়হ) সংঘটিত হয় তার ফলে সব চেয়ে বেশি লাভবান হয় ইংল্যান্ড। প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য
যে, ১৬০০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের রপ্তানি দ্বিগুণের বেশি এবং ১৭০০ থেকে ১৭৫০
সালের মধ্যে তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়, কিন্ত
আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল সব সময়ই বেশি।
ইংল্যান্ডের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের এ ধরনের সম্প্রসারণের প্রভাব হয়েছিল
সুদূর প্রসারী। কেননা এর ফলে কয়লা, ইস্পাত, বাসন-পত্র তৈরি, জাহাজ নির্মাণ এবং বিশেষভাবে
বয়ন-শিল্পে অগ্রগতি সাধিত হয়, আবাদি জমি বৃদ্ধি পায়, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়, বণিক পুঁজি
বিকাশ লাভ করে, সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থান শক্তিশালী হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। একই সংগে আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠে
এবং ১৬৯৪ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়, বড় বড় ব্যবসায়ী
প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, ১৬৯৮ সালে লন্ডন স্টক এক্সেঞ্জের কার্যক্রম শুরু হয় এবং কয়েকটি বীমা
কোম্পানি গঠিত হয়। বয়ন শিল্পে তিনটি পরিবর্তনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত,
চঁঃঃরহম-ড়ঁঃ প্রথার উদ্ভব হয়। মধ্যযুগে বস্ত্র উৎপাদিত হতো তাঁতীদের ঘরে। তাঁতী কাঁচামাল

সংগ্রহ করে বস্ত্র উৎপাদন করতো এবং সরাসরি তা বাজারজাত করতো। কিন্তুআধুনিক যুগের
শুরুতে ব্যবসায়ীগণ তাঁতীদের কাছে কাঁচামাল সরবরাহ করে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার
দায়িত্ব গ্রহণ করে। এভাবে তাঁতী তার স্বাধীনতা হারায় এবং বণিক পুঁজি শিল্প পুজিতে রূপান্তরিত
হয়। দ্বিতীয়ত, কোন কোন ক্ষেত্রে পুঁজিপতিগণ তাঁতীদেরকে নিজ বাড়িতে উৎপাদন করতে না দিয়ে
তাদেরকে এক জায়গায় জড়ো করে উৎপাদন কাজে নিয়োগ করে। তাঁতীদের প্রত্যেকের বাড়িতে
গিয়ে উৎপাদন কাজ তদারকি করার ক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা দেখা গিয়েছিল প্রধানত তা দূর করার
জন্যেই এ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এ ব্যবস্থা ছিল শিল্প বিপ্লবের সৃষ্ট কারখানা বা ফ্যাক্টরির
পূর্বসূরী।
তৃতীয়ত প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল
ফ্লাইয়িং শাটল (ঋষুরহম ঝযঁঃঃষব) নামক এক ধরনের বৈজ্ঞানিক মাকুর প্রবর্তন। এটি ১৭৩৩ সালে
জন কে সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন। এটি যান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হতো। অন্যান্য ক্ষেত্রেও
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। এ প্রসংগে উল্লেখ্য যে, ১৬৬০ থেকে ১৭২৯ সালের
মধ্যে মোট ২৭০ টি উৎপাদন কৌশল সরকারি অফিসে নিবন্ধন্ধীকৃত হয়েছিল।
প্রসংগক্রমে অপর একটি বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যায়। ইংল্যান্ডের সরকার সে যুগে প্রচলিত
বণিকবাদ নীতি অনুসরণ করে উপনিবেশ স্থাপন, বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, উপনিবেশগুলোর
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য অনেক উপায়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার
ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করেছিল। এক্ষেত্রে নেভিগেশন এ্যাক্টের কথা
বিশেষভাবে উল্লেখের প্রয়োজন। প্রথম নেভিগেশন এ্যাক্ট প্রবর্তিত হয় ১৬৫১ সালে, ওলিভার
ক্রমওয়েলের শাসনকালে। এ আইনে বলা হয় যে, উত্তর আমেরিকায় ও অন্যান্য এলাকার
উপনিবেশ এবং ভারত থেকে যেসব পণ্য ইংল্যান্ডে আমদানি করা হবে তা শুধুব্রিটিশ বাণিজ্য
তরীতে বহন করতে হবে। দ্বিতীয় আইনটি প্রবর্তিত হয় ১৬৬০ সালে। এ আইনে বলা হয় যে
উপনিবেশ সমূহ কত সংখ্যক পণ্য শুধু ইংল্যান্ডে রপ্তানি করতে পারবে। একই সংগে উত্তর
আমেরিকায় কতগুলো শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন এবং ভারত থেকে কয়েক প্রকার সুতীবস্ত্রের
আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ইংল্যান্ডের শিল্পোৎপাদনকে উৎসাহিত করার
লক্ষ্যেই শেষোক্ত ব্যবস্থা দুটো গ্রহণ করা হয়েছিল।
এভাবে ১৪৮৫ সালের পরে তিনশত বছরের কম সময়ে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক,
চিন্তা-চেতনা এবং বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। এর পরের পাঠে আমরা
উল্লেখ করব যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল এজন্যে যে প্রায় একই সময় দেশে শিল্পক্ষেত্রে
বিরাট পরিবর্তনের জন্যে সহায়ক উপাদানের সমম্বয় ঘটেছিল। আর এসব সহায়ক উপাদানের
ক্রমশ বিকাশ ঘটেছিল আঠার শতকের মধ্যভাগের পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে। এজন্যে আঠার
শতকের মধ্যভাগের পূর্ববর্তী কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসকে শিল্প বিপ্লবের প্রস্ততিকাল হিসেবে চিহ্নিত

সারাংশ
শিল্প বিপ্লব কোনো আকষ্মিক ঘটনা ছিল না। দীর্ঘদিন আগে থেকেই শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রস্ততি চলছিল। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক, সামাজিক, মানুষের চিন্তা-
চেতনা এবং বিশেষত অর্থনৈতিক ও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হচ্ছিল।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ অগ্রগতির প্রধান দিকগুলো ছিল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের
সম্প্রসারণ, কৃষি ও শিল্পখাতে উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি, বণিক পুঁজির বিকাশ, বিজ্ঞান-চর্চায় উন্নতি
ও উৎপাদনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ব্যাংক, বীমা এবং স্টক

পাঠোত্তর মূল্যায়ন
ক. নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। স্টুয়ার্ট রাজত্বকাল কতো সালে শুরু হয়?
(ক) ১৬০১ (খ) ১৬০২
(গ) ১৬০৩ (ঘ) ১৬০৭
২। ষ্টুয়ার্ট শাসন আমলের সবচেয়ে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কে ছিলেন?
(ক) হার্ভি (খ) নিউটন
(গ) নেপিযার (ঘ) এদের কেউ নন
৩। উত্তর আমেরিকায় ইংল্যান্ডের প্রথম উপনিবেশ কোথায় স্থাপিত হয়?
(ক) জেমস টাউন (খ) মেরিল্যান্ড
(গ) পেনসেলভিনিয়া (ঘ) নিউইয়র্ক
৪। ১৬০০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের বৈদেশিক বাণিজ্য কতগুণের বেশি বৃদ্ধি পায়?
(ক) দুইগুণ (খ) তিন গুণ
(গ) চারগুণ (ঘ) পাঁচগুণ
৫। ১৬৯৮ সাল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত কেন?
(ক) কয়েকটি বীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়(খ) ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়
(গ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠিত হয় (ঘ) লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম শুরু হয়।
খ. রচনামূলক প্রশ্ন
১। গৌরবময় বিপ্লবের কারণও গুরুত্ব আলোচনা করুন।
২। সতেরো ও আঠারো শতকের প্রথমভাগে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের অগ্রগতির বিবরণ দিন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। (গ) ২। (খ) ৩। (ক) ৪। (ক) ৫। (ঘ)
গ. সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ঃ
১। সতেরো ও আঠার শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ড কোথায় কোথায় উপনিবেশ স্থাপন করে?
২। বণিকদের যুগে ইংল্যান্ডের সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কীরূপ নীতি অনুসরণ করে?

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]