আঠারো শতকের ফ্রান্সে একদল দার্শনিক ও চিন্তানায়কের আবির্ভাব ঘটে। এরা তাদের লেখনীর
মাধ্যমে প্রচলিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রæটি-বিচ্যুতি মানুষের কাছে তুলে
ধরেন। এসব লেখকের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ভলতেয়ার, মঁতেসকিয়ো এবং রুশো।
মহামতি ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮ খ্রি.)
ভলতেয়ার ছিলেন পূর্ববর্তী যুগের তথা ইউরোপের জ্ঞানদীপ্তি বা যুক্তির যুগের (অমব ড়ভ
ঊহষরমযঃবহসবহঃ বা অমব ড়ভ জবধংড়হ) শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ফ্রাঁসোয়া ম্যারি
এ্যারাউয়্যে। তিনি ১৬৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৭৮ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি নাটক, কাব্য, ইতিহাস, প্রবন্ধ ইত্যাদি নানা প্রকার রচনায়
পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাতœক রচনায় তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তাঁর লেখাগুলোর মধ্যে
সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ঙবফরঢ়ব, খবঃঃবৎং চযরষড়ংড়ঢ়যরয়ঁবং, ঊষবসবহঃং ড়ভ ঊংংধুং ড়হ টহরাবৎংধষ
ঐরংঃড়ৎু, এবং তড়ফরম ইত্যাদি. এসব লেখায় তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায়
ত্রæটি-বিচ্যুতি অতি সহজ এবং অনেকক্ষেত্রে ব্যঙ্গাতœক ভাষায় তুলে ধরেন। তিনি তাঁর লেখনীর
জন্যে দু’বার কারাবরণ করেন এবং একবার ইংল্যান্ডে ও আর একবার প্রæশিয়ায় পালিয়ে যান। কিন্তু
পূর্বতন আমলের সমাজ ও রাজনৈতিক অবস্থার সমালোচনা করলেও এগুলো সংশোধনের জন্যে
বিপ্লবের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করতেন না। তাঁর ধারণা ছিল জ্ঞানদীপ্ত অথচ স্বৈরাচারী
শাসনের মাধ্যমে এসব দোষ-ত্রæটির সংশোধন সম্ভব। অর্থাৎ তিনি ছিলেন জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী
শাসনের প্রবক্তা।
গির্জা ও যাজকদের সমালোচনা
অবশ্য গির্জা ও যাজকদের সমালোচনায় তিনি প্রকৃতই বিপ্লবী ছিলেন। তিনি শত উপায়ে রোমান
ক্যাথলিক গির্জা এবং যাজকদের স্বার্থপরতা, অসহিঞ্চুতা এবং দুর্নীতির কথা উল্লেখ করেন এবং
এভাবে তাদের প্রতি মানুষের আস্থার ভিতকে দুর্বল করতে সাহায্য করেন। বিপ্লবের পথ সুগম
করার ক্ষেত্রে এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কেননা ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থার অভাবের অর্থ
ছিল এই যে, প্রচলিত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পেছনে ধর্মের অনুমোদন বা সমর্থন রয়েছে
এবং এর পরিবর্তন কামনা করা ধর্ম-বিরোধী কাজ হবে- এ ধারণার অবসান। এভাবে বিচার করলে
বলা যায় যে, তিনি বিপ্লবী না হলেও ফরাসি বিপ্লবের জন্যে অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ
অবদান রেখেছিলেন। বিপ্লবের শুরুতে জাতীয়সংবিধান সভা যেসব সংস্কার প্রবর্তন করে তাতে
ভলতেয়ারের ধ্যান-ধারণার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
শার্লস মঁতেসকিয়ো (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)
বিপ্লব পূর্ববর্তী যুগের অপর এক বিখ্যাত লেখক ছিলেন মঁতেসকিয়ো। তিনি ১৬৮৯ সালের ফ্রান্সের
এক সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৫৫ সালে মারা যান। তিনি প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে
অবস্থান করেন এবং সে দেশের সরকার পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর প্রথম লেখা ঞযব চবৎংরধহ
খবঃঃবৎং. এ পুস্তকে তিনি উজবেক ও রিকা নামক দুইজন পারস্যদেশীয় ভ্রমণকারীর ছদ্মনামে
ফরাসি সমাজের দোষ-ত্রæটির কথা উল্লেখ করেন। তাঁর দ্বিতীয় অবদান ছিল ছোট একটি পুস্তকÑ
ঞযব এৎবধঃহবংং ধহফ উবপধফবহপব ড়ভ ঃযব জড়সধহং মঁতেসকিয়োর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান
হচ্ছে ঞযব ঝঢ়রৎরঃ ড়ভ খধ.ি
মঁতেসকিয়োর বিশ বছরের পরিশ্রমের ফসল এ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৭৪৮ সালে। মাত্র আঠারো
মাসে পুস্তকটির ২২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এতে পুস্তকটি কত যে জনপ্রিয় হয়েছিল তার প্রমাণ
পাওয়া যায়। এ পুস্তকে তিনি দুটো প্রধান মতবাদ ব্যক্ত করেন। প্রথমত, কোনো দেশে কি ধরনের
আইন বা সংগঠন (ওহংঃরঃঁঃরড়হ) প্রচলিত থাকবে তা নির্ভর করে সে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও
ঐতিহ্যের ওপর। দ্বিতীয়ত, জনগণ যাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে সেজন্যে সবকারের
তিনটি বিভাগ (কার্য-নির্বাহী, আইন প্রণয়ণ এবং বিচার) পরাধীন থেকে স্বাধীন হওয়া অপরিহার্য।
অর্থাৎ একটি বিভাগ অপর বিভাগের ওপর কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা বাঞ্ছনীয় নয়। এর
অন্যথা হলে জনগণ গনতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এ ধারণা ক্ষমতার বিভাজন তত্ত¡
(উড়পঃৎরহব ড়ভ ঃযব ঝবঢ়ধৎধঃরড়হ ড়ভ চড়বিৎং) নামে পরিচিত। এভাবে মঁতেসকিয়ো ফ্রান্সে প্রচলিত
স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র এবং উরারহব জরমযঃ গড়হধৎপযু-এর ভিত্তিমূলে আঘাত করেন। মঁতেসকিয়োর
দ্বিতীয় মতবাদটি দেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভলতেয়ার যেমন রোমান ক্যাথলিক গির্জা ও এর
কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন মঁতেসকিয়ো তেমনি স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্রের ত্রæটি-বিচ্যুতির
প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘যদি একই ব্যক্তির হাতে সরকারের আইন, বিচার
ও কার্যনির্বাহী বিভাগ ন্যস্ত থাকে তবে রাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অবসান হবে।’
জ্যাঁ জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.)
জ্যাঁ-জাক রুশো ১৭১২ সালে জেনেভায় এক ঘড়ি প্রস্তুতকারকের ঘরে জন্মগহণ করেন। বাল্যকালে
তিনি তাঁর মাতাকে হারান। তাঁর পিতাও তাকে পরিত্যাগ করে চলে যান অন্যত্র। এভাবে ¯েœহমমতার বন্ধন থেকে বিছিন্ন হয়ে তিনি কয়েক বছর ধরে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় ভবঘুরে
হিসেবে জীবন যাপন করেন এবং এ সুযোগে সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংস্পর্শে আসেন। এ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং দেশের ছোট ছোট গ্রামে মানুষের সহজ সরল জীবন তাঁর চিন্তায় বিরাট
প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তী কালে তিনি প্যারিসে চলে যান। এখানে ১৭৪৯ সালে তিনি
সভ্যতার অগ্রগতির ফলে মানুষের চরিত্র অধ:পতিত হয়েছে কিনা এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। এভাবে লেখক হিসেবে রুশোর
আবির্ভাব ঘটে। এরপর তিনি অনেক বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখার মধ্যে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘবি ঐবষড়রংরব, ঊসরষব, ঈড়হভবংংরড়হ (তাঁর আতœজীবনী) এবং ঝড়পরধষ
ঈড়হঃৎধপঃ বা সামাজিক চুক্তি গ্রন্থ।
রোমান্টিক আন্দোলনের প্রবর্তন
রুশোর মূল বক্তব্য ছিল প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যাওয়ার আহ্বান। সভ্যতার শুরুতে মানুষ যখন
প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করতো তখন তাঁর জীবনে ছিল সুখ, শান্তি, প্রাচুর্য এবং সে ভোগ করতো
সমান অধিকার। কিন্তু পরবর্তীকালে সভ্যতার অগ্রগতির সংগে মানুষ তার স্বাধীনতা ও সমান
অধিকার হারায়। তাই তিনি ‘সমাজিক চুক্তি’ গ্রন্থের শুরুতেই উল্লেখ করেন ‘স্বাধীনতা মানুষের
জন্মগত অধিকার, কিন্তুতবুমানুষ সর্বত্রই শৃঙ্খলিত’। প্রকৃতির রাজ্যে যে সুখ-শান্তির কথা তিনি
উল্লেখ করেন ঐতিহাসিকভাবে তা সত্য নয়। তাছাড়া আক্ষরিক অর্থে তিনি আদিম সভ্যতার যুগে
ফিরে যাওয়ার কথাও বলেন নি। কিন্তুপ্রকৃতির রাজ্যে ‘দুধ ও মধুর বন্যা' বয়ে যাওয়া সম্পর্কে তাঁর
উচ্ছাস এবং সেই কল্পিত স্বর্গরাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্যে মানুষের ভাবাবেগ ও অনুভূতির প্রতি
আবেদন চিন্তার জগতে এক নতুন প্রবণতার সৃষ্টি করে। সে প্রবণতা রোমান্টিক আন্দোলন
(জড়সধহঃরপ গড়াবসবহঃ) নামে পরিচিত। এখানেই ভলতেয়ারের সংগে রুশোর পার্থক্য।
ভলতেয়ার ছিলেন যুক্তির পূজারী, আর রুশো ছিলেন ভাবপ্রবণ, আদর্শবাদী, আবেগ উচ্ছ¦াসের
পূজারী ও কল্পনাবিলাসী। তাই বলা হয়েছে যে, রুশো শৃ´খলমুক্ত করেছেন অগণিত ভাবপ্রবণ
ব্যাঘ্র, অন্যদিকে ভলতেয়ার ‘সজ্জিত করেছেন যুক্তিপ্রবণ অশ্ব’।
সমষ্টিগত ইচ্ছা
ফরাসি বিপ্লবের পথ সুগম করার ক্ষেত্রে রুশোর অবদান সবচেয়ে বেশি। এ বিপ্লবের মূলমন্ত্র সাম্য,
স্বাধীনতা ও মৈত্রী তাঁর চিন্তাধারা থেকে নেয়া। তাঁর মতে রাষ্ট্রের জন্ম হয় একটি সামাজিক চুক্তির
মাধ্যমে। এ চুক্তি মোতাবেক প্রকৃতির রাজ্যে বসবাসকারী মানুষ ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’-এর (এবহবৎধষ
ডরষষ) কাছে নিজের অধিকার ছেড়ে দেয়। রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন হয় এজন্যে যে ক্রমে প্রকৃতির
রাজ্যে ব্যক্তিগত মালিকানার ধারণা জন্ম নেয় এবং তাদের মধ্যেসৃষ্টি হয় বৈষম্য। আর এর ফলে
প্রতারণা ও অতৃপ্ত বাসনা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে প্রাধান্য বিস্তার করে। ‘সমষ্টিগত ইচ্ছার’
কাছে নিজের অধিকার সমর্পণ করে মানুষ লাভবান হলো, কেননা সে এতে করে অন্যকে তার উপর
যতটুকুও যে ধরনের কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা ছিল, সে নিজেও ঠিক অন্যের ওপর ততটুকুএবংএকই
জাতীয় কর্তৃত্ব করার অধিকার পায়। ফলে সে নিজের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে সমষ্টির বৃহত্তর
শক্তির সহায়তা পায়। এভাবে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয় তা প্রতিনিধিত্বমূলক ছিল না। সিদ্ধান্ত হয় যে
আইন-বিধি প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারাই প্রণীত হবে; সরকার হবে রাষ্ট্রের কার্য-নির্বাহী সংগঠন
মাত্র। সরকারের দায়িত্ব হবে ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’ বাস্তবায়িত করা, এ ইচ্ছা বিধিবদ্ধ করা নয়। এছাড়া
জনগণ ইচ্ছামত সরকার গঠন করতে বা এর পতন ঘটাতে পারবে। অতএব জনগণ সার্বভৌম
ক্ষমতার উৎস। মানুষ যেহেতুব্যক্তি-স্বাধীনতা হারিয়ে শাসক শ্রেণীর হাতে শৃঙ্খলিত হয়েছে সেহেতু
সেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর অধিকার মানুষের রয়েছে। রাষ্ট্র গঠন ও ‘সমষ্টিগত ইচ্ছা’
সম্পর্কে রুশোর বক্তব্যে স্ববিরোধিতা ছিল। ঐতিহাসিকভাবেও এসব বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে
মতভেদ থাকার অবকাশ আছে। কিন্তুরুশো এমন ভাষায় তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন যে তা
সহজেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
ভলতেয়ার, মঁতেসকিয়ো এবং রুশো ছিলেন সে যুগের সর্বাধিক খ্যাতিমান দার্শনিক। কিন্তুএ সময়ে
আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে
অনুপ্রাণিত, কেউ কেউ ছিলেন অর্থনীতিবিদ এবং অন্য কয়েকজন বিশ্বকোষ রচনার কাজে হাত
দিয়েছিলেন।
বিশ্বকোষ সংকলকগণ
বিশ্বাকোষ সংকলকদের দলে ছিলেন অংকশাস্ত্রবিদ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও
দার্শনিক। এরা নিজ নিজ বিশেষ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের চিন্তা-চেতনা সন্নিবেশ করার জন্যে একটি
বিশ্বকোষ রচনার কাজে হাত দেন এবং ১৭৫১ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে ২৮ খন্ড সংকলন
করেন। একাজের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন দেনিশ দিদেরো, দ্যালেমবার, দোলবাস ও
এলভেতিয়াস। নতুন বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত এসব গ্রন্থ জ্ঞান বিকাশের
ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পাশাপাশি প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক
জীবনের ত্রæটি-বিচ্যুতি গুলো মানুষের কাছে তুলে ধরে।
ফিজিওক্র্যাট্স
আঠারো শতকের মাঝামাঝি ‘ফিজিওক্র্যাট' নামে একদল অর্থনীতিবিদের অভ্যুদয় ঘটে। এদের
মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন ফ্রাঁসোয়া কেসনে, মিরাবো, তুর্গো এবং নেমুর। এসব অর্থনীতিবিদ
দৃঢ়মত পোষণ করেন যে, মানুষের স্বভাবসিদ্ধ প্রবৃদ্ধি অনুসারে তাকে উদ্ভাবন, উৎপাদন এবং
ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়া উচিত। অর্থাৎ বণিকবাদের প্রভাবে তৎকালে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের
ওপর সরকারের যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অবসান করতে হবে। গুরনে এ ধারণাকে
বলেছেন ‘লেসেফের’ (খধবরংংবু-ভধরৎব) বা অবাধ নীতি অর্থাৎ মানুষ নিজে যেটাকে উত্তম মনে
করে সেটাই তাকে করতে দেয়া। এর পাশাপাশি ফিজিওক্র্যাটগণ নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব,
যাজক-পুরোহিতদের তান্ত্রিক শাসন-শোষণের অবসান, পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিলোপ প্রভৃতি
দাবিও পেশ করেন।
সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদগণ
বিপ্লব-পূর্ববর্তী ফরাসি সমাজ্যের ত্রæটি-বিচ্যুতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছুলেখক ও চিন্তাবিদ ব্যক্তি-
মালিকানা, বিশেষ করে সম্পত্তির মালিকানাকে এর জন্যে দায়ী করেন। অর্থাৎ সামগ্রিক সমস্যাটাকে
এরা বিচার করেন অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এর সমাধানে সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের
বিভিন্ন পরিকল্পনার উল্লেখ করেন। এ মতবাদের অগ্রনায়ক ছিলেন জ্যা মেসলিয়ে নামক একজন
যাজক। তিনি বলেন ‘‘অসমতা প্রাকৃতিক বিধানের পরিপন্থী। প্রকৃতি সবাইকে সমানভাবে সৃষ্টি
করেছে। সবার বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে, অধিকার রয়েছে সমানভাবে স্বাধীনতা উপভোগ
করার।” অন্যান্য সমাজতন্ত্রী লেখকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ছিলেন মরেলি, আবে মাবলি ও
মিমোঁ ল্যাংগে।
বুদ্ধিজীবীদের অবদান
ফরাসি বিপ্লবের পথ সুগম করার ক্ষেত্রে দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীদের অবদান সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের
মধ্যে মতভেদ আছে। সেতোব্রিয়াঁ, টেইন, রুস্তান প্রমুখ ঐতিহাসিকদের ধারণা বুদ্ধিজীবীরা
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। অপরপক্ষে, মার্কসবাদী ঐতিহাসিক যথা লেফেভর, মাতিয়ে,
মর্সস্টিফেন্স সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একথা সত্য
যে দার্শনিকদের কেউ প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন নি। প্রকৃতপক্ষে ভলতেয়ার, মঁতেসকিয়ো
এবং রুশো বিপ্লবের অনেক আগেই মারা যান। এরা সবাই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের
পক্ষেও মত দেন নি। একথাও সত্য যে দেশের সাধারণ মানুষ বুদ্ধিজীবীদের লেখা পড়ে নি।
তাঁদের মতবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষেরও ধারণা ছিল। বুদ্ধিজীবীদের রচনার মর্ম জনসাধারণের
মধ্যে প্রচার পুস্তিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখের প্রয়োজন
বুদ্ধিজীবীদের মতবাদ শুধুধ্বংসাÍক ছিল না, এর একটি গঠনমূলক বা ইতিবাচক দিকও ছিল। অর্থাৎ
তাদের লেখনি একদিকে যেমন মানুষকে প্রচলিত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি
আস্থাহীন করে তোলে, অপর দিকে তেমনি এর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা দেয়। এভাবে
দার্শনিকগণ মানুষের বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের চিন্তাজগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন
আনেন। ১৭৮৯ সালের বিপ্লব মানসজগতে এ পরিবর্তনেরই ফসল। তাছাড়া দার্শনিকদের অবদান
ছিল বলেই এ বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে।
সারসংক্ষেপ
আঠার শতকে ফ্রান্সে একদল লেখকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে প্রচলিত
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবস্থার, ক্রটি-বিচ্যুতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেন। এসব লেখকের মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভলতেয়ার, মতেসকিও ও রুশো।
এ ছাড়া একদল লেখক ফিজিওক্র্যাটস নামে পরিচিত, একদল অর্থনীতিবিদ ও কয়েকজন,
সামাজতন্ত্রী চিন্তাবিদেরও আবির্ভাব ঘটে। এরা সবাই বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তুতাঁদের
লেখনী বিপ্লবের পথ সুগম করতে অবদান রাখে।
ক. নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন
সঠিক উত্তরের পাশ্বে টিক () চিহ্ন দিন।
১। ভলতেয়ার কত সালে জন্ম গ্রহণ করেন?
(ক) ১৬৯০ সালে (খ) ১৬৯২ সালে
(গ) ১৬৯৪ সালে (ঘ) ১৬৯৫ সালে
২। রুশো কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
(ক) প্যারিস (খ) জেনেভা
(গ) বার্লিন (ঘ) ব্রাসেলস
৩। ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বকোষের কত খন্ড প্রকাশিত হয়?
(ক) ২৮ (খ) ২৬
(গ) ২৫ (ঘ) ২০
৪। মঁতেসকিয়ো কত দিন ইংল্যান্ডে অবস্থান করেন?
(ক) প্রায় তিন বছর (খ) প্রায় আড়াই বছর
(গ) প্রায় দুই বছর (ঘ) প্রায় দেড় বছর
খ. রচনামূলখ প্রশ্ন
১। ভলতেয়ার, রুশো, ও মঁতেসকিয়োর মতামত আলোচনা করুন।
২। ফিজিওক্র্যাটস ও সমাজতন্ত্রী লেখকদের বক্তব্য কি ছিল?
গ. সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। মঁতেসকিয়োর ক্ষমতার বিভাজন তত্ত¡ ব্যাখ্যা করুন।
২। রুশোর প্রাথমিক জীবন আলোচনা করুন।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর
১। গ ২। খ ৩। ক ৪। ঘ
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত