রেনেসাঁসের প্রকৃত স্বরূপ।
পঞ্চদশ শতকের ইউরোপের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবন জিজ্ঞাসায়
যে ব্যাপক পরিবতর্নের সূচনা ঘটে, এটাকে সাধারণভাবে ইউরোপের রেনেসাঁস বা নবজাগরণ
বলা হয়ে থাকে। এই বিশাল পরিবর্তন পঞ্চদশ শতকে শুরু হয়েছিল বলে পঞ্চদশ শতককে
নবজাগরণের শতাব্দী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। নবজাগরণ ইতালিতে শুরু হয়েছিল
বলে ইউরোপের অনেক ঐতিহাসিক এটিকে ইতালির রেনেসাঁস হিসেবেও অভিহিত করে
থাকেন। ইতালিতে কিম্বা ইউরোপে হলেও এই রেনেসাঁস সমগ্র মানব সমাজের আধুনিক
সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিল।
রেনেসাঁসের সংজ্ঞা
রেনাইসান্স (জবহধরংংধহপব) শব্দটির অভিধানিক অর্থ হলো পুনর্জন্ম। মানব সভ্যতার ইতিহাস
অতীত থেকে বর্তমান এবং বর্তমান থেকে আগামীর পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজ, সংস্কৃতি,
রাজনীতি আর অর্থনীতি ইতিহাসের কালের পরিসীমায় আবদ্ধ। ইতিহাসে কোনো ঘটনারই
পুনরাবৃত্তি একই ভাবে কিম্বা একই পন্থায় কিম্বা ধারায় ঘটে না। রেনেসাঁস মূলত একটি
দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার
উত্থান ঘটেছে, একই সঙ্গে অবসান ঘটে মধ্যযুগের। সে কারণেই রেনেসাঁসকে এক কথায়
সংজ্ঞায়িত করা যায় না; এর ভিতরগত এবং বাহ্যিক মর্ম অত্যন্ত ব্যাপক।
প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁসের বলতে বুঝায় প্রাচীন যুগের গ্রেকো- রোমান সংস্কৃতির পুনরুত্থান
তথা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ভাস্কর্যকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করে
সত্য সুন্দরকে গ্রহণ করা, এর ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করা। তবে সংজ্ঞাটির প্রধান
সীমাবদ্ধতা হলো শুধুমাত্র প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান অধ্যয়ন এবং প্রয়োগ মানুষের দৃষ্টিভিঙ্গ গঠনে
সহায়ক হলেও সামগ্রিক সমাজ বদলের প্রধান কারণ হতে পারে না।
রেনেসাঁসের প্রচলিত সংজ্ঞার প্রায় বিপরীতে আধুনিক সংজ্ঞাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আধুনিক
ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মধ্যযুগের সামন্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর
স্থবিরতার অবসান ঘটিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক এবং আর্থ-সামাজিক
ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমাজ জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা
ঘটে-এটাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণ। উক্ত নব জীবনের আলোকে ইউরোপের মানুষ তাদের
অতীত ঐতিহ্য তথা গ্রিক ও রোমান যুগের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি পাঠে
মনোনিবেশ করার মাধ্যমে জীবন ও জগতকে যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ
হবে। আর এভাবেই শুরু হয় ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন পর্ব। পর্বটির উত্তরণ ঘটেছিল
সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে। পঞ্চদশ
শতকের ইউরোপের রেনেসাঁসকে প্রকৃত অর্থেই ইউরোপের ইতিহাসে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার
এক অবস্থান থেকে গুণগতভাবে অন্য এক উত্তরণশীল পর্ব হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই
উত্তরণ সমূহ ছিল নি¤œরূপঃ
(ক) মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ
ইউরোপের রেনেসাঁস হলো মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ। এই উত্তরণের মধ্য দিয়ে
একদিকে মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য সমূহের পরিসমাপ্তি ঘটে, অপরদিকে আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্যসমূহ
সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। মধ্যযুগের সামাজিক প্রথা, ধর্মান্ধতা, ক‚পমন্ডুকতা, রক্ষণশীলতা, স্বৈরমানসিকতা ইত্যাদি মধ্যযুগের স্থবির অবস্থা থেকে বিবেক, যুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, উদারতা
তথা এক কথায় গতিশীল ধারায় প্রবাহিত হয়। পুরনো সংস্কার ছিন্ন হয়ে যায়, নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান, চিন্তা-চেতনার আলোকে জীবন হয়ে উঠে গতিময়। কোন প্রকার আবদ্ধতা নয়, প্রাণ
চাঞ্চল্য হয়ে দাঁড়ায় জীবনের ধর্ম। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের এই সামগ্রিক
প্রক্রিয়ার মূলে ছিল রেনেসাঁস।
(খ) গোড়াঁমীপূর্ণ চিন্তা থেকে যুক্তিবাদে উত্তরণ
রেনেসাঁস বা নবজাগরণের মূল মন্ত্রটিই হলো যুক্তিবাদ। মধ্যযুগের মানুষের মন ও চেতনা
আবর্তিত হচ্ছিল বাইবেলকে ঘিরে। বাইবেলে নেই এমন কোনো বিষয় সমাজে গৃহীত হতো
না। অন্ধত্ব আর গোঁড়ামী ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপীয়
রেনেসাঁস মানুষের চিন্তা চেতনাকে প্রচলিত গোঁড়ামীপূর্ণ অবস্থান থেকে যুক্তিবাদে উত্তরণ
ঘটায়। যুক্তিবাদের মূল কথা যেকোনো বিষয়কে প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে গ্রহণ করা এবং বিষয়টি
সম্পর্কে অনুসন্ধান পরিচালনা করা। এই অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদ মানুষের চিন্তা, চেতনা ও
মননলোকে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করার মাধ্যমে আধুনিক, অগ্রসর চিন্তাশীল তৈরিতে
যুগান্তকারী ভ‚মিকা রাখে।
(গ) ইউরোপীয় সাম্রাজ্য থেকে জাতীয় রাষ্ট্রে উত্তরণ
মধ্যযুগে ইউরোপে রাষ্ট্র বলতে ছিল পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য। রাজতন্ত্র এবং পোপতন্ত্র- এই
দুই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতো পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য। মধ্যযুগের হাজার বছর এই
সাম্রাজ্যের প্রতি বা শাসক সমাজের প্রতি মানুষের আস্থা অটুট ছিল বলা যায়। পঞ্চদশ শতকে
ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পটভ‚মিতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। সাম্রাজ্যের
কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজা এবং জমিদারগণ
ক্রামে স্বাধীন হয়ে উঠতে শুরু করে। এইভাবে ইউরোপের ইতিহাসে সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন
এবং জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের জাতীয় রাষ্ট্র আধুনিক রাষ্ট্র চিন্তার ধারণাকে অগ্রসর করে নিতে
ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে। প্রক্রিয়া শুরু হয়।
(ঘ) সামন্তবাদ থেকে বণিজ্যবাদে উত্তরণ
মধ্যযুগে ইউরোপের অর্থনীতি এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি সামন্তবাদী অর্থনীতি
কেন্দ্রিক। এই ব্যবস্থায় সকলের উপরে ছিল রাজার অবস্থান। রাজার অধস্তন ছিল বিভিন্ন
শ্রেণীর জমিদার। এই জমিদার শ্রেণীই ছিল জমির মালিক। তাদের প্রদত্ত করের অর্থে
সাম্রাজ্যের রাজ ও সম্রাটদের পরিবারও সামগ্রিক প্রশাসন পরিচালিত হতো। সমাজের সর্বশেষ
স্তরে ছিল সার্ফ বা ভ‚মিদাস। ভ‚মিদাস শ্রেণী ছিল উৎপাদনকারী। সামন্তবাদী ব্যবস্থায় এরা ছিল
পরাধীন। সুপ্রাচীনকালে ইউরোপের সাথে এশিয়ার বাণিজ্য পরিচালিত হতো আরব সাগর ও
ভ‚মধ্যসাগরের পথে। ইউরোপের পণ্য বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো দক্ষিণ ইউরোপের তথা
ভ‚মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ফ্লোরেন্স, ভেনিস, জেনোয়া প্রভৃতি অঞ্চলের বণিকেরা। চতুর্দশ শতাব্দীতে
ইউরোপে সামন্তবাদ দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলে এই সকল বণিকা অনেকটা স্বাধীনভাবে
বাণিজ্য পরিচালনা করতে থাকে। এর মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ ইতালীকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন
বাণিজ্যিক অর্থনীতির জন্ম নিতে। বাণিজ্যের প্রয়োজনে উন্মেষ ঘটতে থাকে ছোট ছোট
কারখানার। এই পযায়টিকে ইতিহাসে প্রাথমিক পুঁজি-সঞ্চয়নের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এইভাবে রেনেসাঁসের প্রভাবে ইউরোপে সামন্তবাদের স্থলে বাণিজ্যবাদে উদ্ভব ঘটে।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
রচনামূলক প্রশ্ন
১. রেনেসাঁস বলতে কি বুঝায়?
২. ইউরোপ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে কীভাবে উত্তরণ ঘটে?
৩. সামন্তবাদের অবসান ও বাণিজ্যবাদের বিকাশ কিভাবে শুরু হয়?
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত